বাদামী সংসার
পর্ব ৪২
নীলাক্ষী ঘরে প্রবেশ করে দেখলো অম্লান আলো জ্বালিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে। ওকে দেখেও মনে হওয়ার কারণ নেই কিছুক্ষণ আগে এখানে কী ঘটে গেছে। খোলা জানালা বয়ে আসছে গা শিরশির করা হাওয়া। নীলাক্ষী জানালা বন্ধ করে দিয়ে বললো, ‘এই বাসাটা কী দারুণ তাই না বলো?’
‘হুম।’
‘তোমাকে বলতে ভুলে গেছি। আমাদের পাশের বাড়িতে এক ভাবী থাকে। বাচ্চা আছে একটা। কিন্তু ভাবী অনেক ইয়াং। মনেহয় আমার থেকেও বয়স কম। আমাকে ডেকেছিলো। যাইনি। কালকে যাবো।’
‘ও। যেও।’
অম্লান মন দিয়ে কিছু ঘাটাঘাটি করছে বলে নীলাক্ষী আর ওকে বিরক্ত করলো না। ছাদ থেকে তুলে আনা কাপড়চোপড় গুলো এলোমেলো জমা আছে চেয়ারের ওপর। ওগুলো একটা একটা করে গোছাতে লাগলো।
অম্লান বললো, ‘তোমার নেক্সট প্লান কি বলোতো?’
‘কিসের প্লান?’
‘এভাবে রান্নাবান্না আর ঘর পরিষ্কার করার জন্য নিশ্চয় জন্মাও নি?’
নীলাক্ষী একবার অম্লানের চোখের দিকে তাকিয়ে দ্রুত নামিয়ে ফেললো। একগাল হেসে বললো, ‘সে কিছু একটা করবো। কয়েকদিন যাক। এ জায়গায় মনটা বসুক।’
অম্লান ল্যাপটপ বন্ধ করে রেখে বললো, ‘তোমার মন এখনও বসেনি বলছো? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে বেশ পছন্দ হয়েছে জায়গাটা। অবশ্য মেয়েদেরকে দেখলে অবাকই হই বুঝছো। কত দ্রুত এ জায়গায় নিজেকে মানিয়ে নিলে অথচ আমি এতদিনেও পারলাম না। বাবা মাকে ছেড়ে অন্য জনের ঘরে এসে সব অপরিচিত মানুষকে আপন করে নিতে হয়। কত যুদ্ধ তোমাদের!’
নীলাক্ষী হাসতে হাসতে বললো, ‘ এটা আর এমন কী! মনের সাথেই যখন যুদ্ধ করতে হয়!’
একটা চাপা নিশ্বাস ফেলে আবারও কাজে মন দেয় নীলাক্ষী। যত্ন করে কাপড় গোছাতে থাকে। অম্লান বললো, ‘তোমাকে শ্বশুরবাড়ির সবাইকে কল দিয়ে খোঁজ খবর নিতে হয়, সবার সাথে আলাদা কথা। অথচ আমি শ্বশুর শাশুড়ীকে বোধহয় মাসেও একবার কল দেই না। স্বামী আর স্ত্রী’র মধ্যে কত পার্থক্য তাইনা? সংসারটা স্ত্রী’র জন্যই সংসার।’
নীলাক্ষী বললো, ‘সংসার আর হলো কই! সবাইকে আপন করে নিয়ে যখন চেষ্টা করছিলাম ভালো বউ হয়ে উঠতে, তখনই তো আলাদা হয়ে গেলাম। এখানে একা একা আর কী সংসার করবো বলো?’
অম্লান চুপ করে রইলো। একটা সিগারেট ধরালো খানিক পর। নীলাক্ষী কাজ শেষ করে বিছানার পাশে এসে দাঁড়ালো। অম্লানের সিগারেটের ধোঁয়া ঘরময় কুয়াশার মতো আবরণ তৈরি করেছে।
নীলাক্ষী বললো, ‘আমাকে আর ভালোবাসো না তাইনা?’
চমকে উঠলো অম্লান। হাতের সিগারেটও বোধহয় খানিকটা চমকে গেছে। হঠাৎ ছাইগুলো জ্বলে উঠে মেঝেতে ঝড়ে পড়লো। নীলাক্ষী বিরতিহীন ভাবে বললো, ‘আগে তো আমার সামনে সিগারেটও ধরাতে না। বারান্দায় গিয়ে খেয়ে আসতে। পুরনো হয়ে গেলে বুঝি সবকিছু অভ্যাস হয়ে যায়?’
অম্লান নিরুত্তর ভঙ্গীতে চেয়ে রইলো। বিছানা থেকে উঠে বেলকনির দরজায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকতে লাগলো। নীলাক্ষী এসে দাঁড়ালো দরজার অপর পাশে।
অম্লান বললো, ‘তুমি ঢাকায় থাকলেই ভালো করতে। সবাই মিলে আনন্দে সময় কেটে যেতো। সংসারের সাধও পূর্ণ হতো।’
‘যে সংসারে তুমি নাই তার আবার সাধ? আনন্দ আছে? ভালোই চিন্তা করছো আজকাল।’
‘আমাকে ভুল বুঝো না।’
‘ওহ আচ্ছা? কী বুঝবো তাহলে?’
অম্লান নীলাক্ষীর চোখে কিঞ্চিৎ রাগের বহিঃপ্রকাশ দেখতে পায়। দপ করে জ্বলে ওঠা হারিকেনের আলোর মতো। মুহুর্তেই নিভে যায় আবার। অম্লান কিছু বলতে পারে না। নীলাক্ষী বিছানায় গিয়ে বুকে বালিশ জড়িয়ে শুয়ে পড়লো।
অম্লান খানিক্ষন দাঁড়িয়ে রইলো। এমন সময় ফোন বেজে উঠে নীলাক্ষীর। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে নিথর ভঙ্গীতে শুয়েই রইলো নীলাক্ষী। অম্লান নীলাক্ষীর ফোন হাতে নিতে নিতেই কল কেটে গেলো। একটা মেসেজ এলো টুং করে, ‘মিসেস নীলা আপনি কল ধরছেন না। এদিকে স্যারের কাছে কথা শুনতে শুনতে আমার জান বেরিয়ে যাচ্ছে। ভালো মন কিছু একটা তো জানাবেন। গতকাল আপনার বাড়িতে গিয়ে দেখি তালা দেয়া। এলাকাবাসীরা জানালো আপনি তো শ্বশুরবাড়িতে। শ্বশুরবাড়ির ঠিকানাও আমি জানি না। আমাকে এমন বিপদে ফেললেন কেন বলুন তো?’
মেসেজ দেখে অম্লান আগের মেসেজগুলোও দেখে নিলো। আলগোছে বিছানায় এসে বসলো। নরম সুরে বলার চেষ্টা করলো, ‘নীলু তুমি অফিসে কিছু জানাও নি কেন?’
‘আমি নিজেই কী জানি নাকি? কী জানাবো?’
‘এখানে থেকে যেতে চাইলে চাকরি আর করবে না জানাও। অযথা মানুষকে হয়রানি করছো কেন?’
‘এখানে কিসের জন্য থাকবো? কে আছে আমার? যার কাছে এসেছি সে তো আমাকে রাখতে চাইছেই না। নিতান্তই বেহায়া না হলে কেউ এভাবে পড়ে থাকে।’
অম্লান নিশ্চুপ। এখন কিছু বললেই ঝগড়া লেগে যাবে, সেটা নিশ্চয় ভালো হবে না। নীলাক্ষী কান্নাভেজা স্বরে বললো, ‘যে মানুষটা আমাকে না জানিয়ে ট্রান্সফার নিতে চেয়েছে ঢাকার বাইরে। যাতে তাকে ফ্যামিলি থেকে দূরে থাকতে হয়। আমি আগে ভেবেছিলাম হয়তো আমাকে নিয়ে যাবে, সারপ্রাইজ দেবে। কিন্তু এমন সারপ্রাইজ পাবো জীবনেও ভাবি নাই। তার কাছে কিসের আশায় পড়ে থাকবো আমি!’
কাঁদছে নীলাক্ষী। অম্লান নিথর ভঙ্গীতে বসে রইলো। কিইবা বলার আছে তার। নীলাক্ষীর প্রত্যেকটা কথা শুনে নিজেকে বড্ড খারাপ লোক বলে মনে হচ্ছে। ঘৃণা জাগছে নিজের ওপর।
মৃদু স্বরে অম্লান বললো, ‘আমি ঢাকার বাইরে ট্রান্সফার নিয়েছি এটা তোমাকে কে বলেছে?’
‘যাকে বলেছিলে তোমার নাকি ঢাকার কাছাকাছি থাকার ইচ্ছা নাই।’
‘সব যখন জেনেই গেছো..’
‘কী জেনে গেছি? তুমি দিনের পর দিন শুধু অভিনয় করে যাচ্ছো আমার সাথে। আমি নিজেকে ভাবতাম জগতের সবচেয়ে সুখী স্ত্রী। সেই তোমার মাঝে কী চলছে কী করে বুঝবো আমি?’
অম্লান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, ‘নীলাক্ষী আমি একটা পাষাণ। আমাকে মাফ করে দাও তুমি। আসলে কী জানো? তুমি কষ্ট পাবে বলে আমি তোমাকে কিছু জানাই নি।’
‘কী জানাও নি?’
বিছানায় উঠে বসলো নীলাক্ষী। তাকালো অম্লানের মুখের দিকে। ওর চোখেমুখে উদ্বিগ্নতা ভর করেছে ভীষণভাবে। অম্লান বললো, ‘আমি শুরু থেকে তোমাকে ভালোবেসেছি, তোমাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টাও করেছি। কিন্তু যত দিন যাচ্ছিলো আমার শুধু মনে হচ্ছিলো আমি পারছি না। তোমাকে জোর করে ভালোবাসতে পারছিলাম না। কখনো মনে হচ্ছিলো ভালোবাসি আবার কখনো মনে হচ্ছিলো আমি তোমার সাথে শুধুমাত্র সম্পর্কে আছি, এখানে ভালোবাসা বলে কিছু নাই। জানি তুমি অনেক কষ্ট পাচ্ছো। কিন্তু আমি না সত্যিই বুঝতে পারছিলাম না কী করবো। সেজন্য ভেবেছিলাম দূরে এসে থাকি। ফোনে কথা হবে, মাঝেমাঝে বাসায় যাবো। সম্পর্কটাও থাকলো আর সবকিছু…’
নীলাক্ষী কান্নাভেজা কণ্ঠে বললো, ‘আমি হুট করে এসে সবকিছু গন্ডগোল পাকিয়ে দিলাম তাই না? একটা গন্ডগোল যে আছে সেটা আমারও মনে হয়েছিলো। সে কারণেই এসেছি। যাইহোক, সবকিছু যখন খুলেই বলেছো তখন আর কিছু বলার থাকে না। কী চাও তুমি? আমি চলে যাই?’
অম্লান মাথা নিচু করে ফেললো। চলে যাওয়ার প্রশ্নটা নীলাক্ষীর মুখে শুনে ওর বুকে কেমন যেন অনুভূত হয়। জানতে চাইলো, ‘চলে যাওয়া মানে!’
‘তুমি কী চাইছো? আমরা আলাদা হয়ে যাবো?’
অম্লান মৃদুস্বরে বললো, ‘জানি না। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে পারবো না। তোমার পরিবারকেও না। তুমি যা বলবে তাই হবে। থেকে যাও এখানে, কিন্তু আমি যেমন আছি আমাকে এভাবে সহ্য করে যাও। আমি মানুষ হিসেবে খারাপ না। কিন্তু কনফিউজড। কখনো খারাপ আচরণ করবো না। মাঝেমাঝে ভালোবাসবো আর মাঝেমাঝে বাসবো না। এইটুকুই..’
নীলাক্ষী বাঁকা ঠোঁটে হেসে বললো, ‘এটাও তো কনফিউশান নিয়েই বললা। আমি তোমার সাথে থাকতে চাই অম্লান। কিন্তু এরকমভাবে না। আমি যেটা চাই সেটা তুমি পারবেই না। বাদ দাও। তারচেয়ে ভালো হয় আমি চলে যাই।’
নীলাক্ষী বিছানা থেকে নেমে পড়লো। অম্লান ব্যস্ত হয়ে বললো, ‘কই যাচ্ছো?’
‘আরে এখন যাচ্ছি না। গেলেও কালকে যাবো।’
‘সরি নীলাক্ষী।’
‘সরি কেন? জোর করে তো আর কিছু হয় না। তারপরও চেষ্টা করেছো। আমি সৌভাগ্যবান যে শুরু থেকেই স্বামীর খারাপ আচরণ পেতে হয়নি।’
অম্লান ঠায় বসে রইলো। নীলাক্ষী বাথরুমে গেলো। হাতমুখ ধুয়ে ফিরে এসে চুল আঁচড়াতে লাগলো। অম্লানের বুক ধুকপুক করছে। কোনো এক অজানা কারণে বুকের ভেতর শূন্যতার মতো অনুভূত হচ্ছে।
নীলাক্ষী বললো, ‘তুমি আমাকে ডিভোর্স দিতে চাও?’
‘না। তুমি চাও?’
‘আমি কেন চাইবো? আব্বু সারাজীবনের জমানো টাকা দিয়ে আমার বিয়ে দিয়েছেন। আত্মীয় স্বজন সবাই আমাকে অসম্ভব আদর করে। সবাইকে কষ্ট দিতে আমি বলবো যে আমি এক বছরও সংসার করতে পারিনি?’
অম্লান ভীষণ ব্যথিত হলো। কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থেকে বললো, ‘আচ্ছা নীলু। ওসব বাদ দাও। আমরা তো ভালোই আছি। তাইনা? এভাবে থাকি না একসাথে।’
‘হ্যাঁ আমিও সেটাই বলছি। টি টুয়েন্টি ম্যাচ খেলছি আমরা। চলুক না, সমস্যা কী? আমি আবার দুঃখ কষ্টকে ভালোই হজম করে রাখতে পারি।’
অম্লান বিছানা থেকে উঠে আরেকটা সিগারেট ধরালো। নীলাক্ষী বললো, ‘তোমাকে উঠতে দেখে ভেবেছিলাম আমাকে জড়িয়ে ধরবে। আমার প্রতি একটুও ভালোবাসা নাই না?’
‘আচ্ছা সরি সরি।’
অম্লান নীলাক্ষীর দিকে এগিয়ে আসার চেষ্টা করলে নীলাক্ষী রাগত স্বরে বললো, ‘ছাড়ো আমাকে। আর ধরা লাগবে না। আমি চাকরি ছাড়বো না। কালকেই চলে যাবো ঢাকায়।’
‘বসের ঝাড়ি খাবা না?’
‘বলবো আমার স্বামীর অসুখ হয়েছিলো। শখের অসুখ।’
‘বললে ছেড়ে দেবে?’
‘দু চারটা ঝাড়ি দিলে দিক না। আমি তো মানুষ না, হজম করে নেবো না নাহয়।’
নীলাক্ষী রান্নাঘরে চলে গেলো। মাথায় এখন প্রচন্ড রাগ উঠেছে। এই রাগকে ঝাড়া দিয়ে বিদায় করার মতো অবকাশ নেই। যতই চেষ্টা করছে, ততই রাগ বেড়ে যাচ্ছে আগুনের ফুলকির মতো। বাধ্য হয়েই মোবাইল নিয়ে স্কুলের এক বান্ধবীকে কল দিলো নীলাক্ষী। কথায় কথায় বান্ধবীকে একগাদা বকুনি দেয়ার পর মাথা ঠান্ডা করে এসে বসলো।
অম্লান বললো, ‘আমার রাগ আরেকজনকে ঝাড়ছো কেন?’
‘চুপ থাকো। একটা কথা বলবা না।’
অম্লান ঠোঁটের ওপর আঙুল রেখে চুপ হয়ে গেলো। রাতের খাবার খেয়ে কারোরই আজ ঘুমোবার নাম নেই। নীলাক্ষী অফিসের কলিগকে ফোন করে জানালো সে একটা ঝামেলায় পড়েছিলো, দ্রুত অফিসে চলে আসবে। ফোন রাখার পর উভয়ে বিছানায় শুয়ে মোবাইল টিপতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কেউ কারও সাথে কথা বলছে না।
নীলাক্ষী একে একে সব বন্ধুদেরকে ভিডিও কল দিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করলো। রাত যখন আড়াইটা, তখন তো ঘুমাতেই হয়। অম্লান নীলাক্ষীকে বুকে টেনে নিয়ে বললো, ‘ঘুমাও।’
‘আমাকে ধরছো কেন?’
‘না ধরলে তুমি ঘুমাতেই পারবা না।’
‘সেজন্য দয়া দেখাবা?’
‘উফফ চুপ করে ঘুমাও তো।’
নীলাক্ষী চুপ করে গেলো। মনটা শান্ত হলো এতক্ষণে। কী যে এলোমেলো লাগছিলো এতক্ষণ ধরে। এক্ষুনি মনে হচ্ছে সবকিছু ঠিকঠাক আছে, আবার মুহুর্তেই মনে হচ্ছে কিছুই ঠিক নেই। জগতের সব স্বামী স্ত্রী’র সংসার কী এমন করেই কাটে?
চলবে..
গত পর্বের লিংক https://www.facebook.com/310794352878919/posts/735637500394600/