বাদামি সংসার পর্ব-৪৭

0
1832

পর্ব ৪৭

অম্লানের মুখ হাসিহাসি। নীলাক্ষী শব্দহীনভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। অম্লানের চিরপরিচিত চাহনী ওকে ক্রমশ আন্দোলিত করছে। বুকের ভেতর উথলে উঠছে আগন্তুকের ন্যায় ঢেউ। মুখ ফিরিয়ে নিলো নীলু। তবুও মনকে শান্ত করার অভিপ্রায় নিজের মাঝে জাগলো না।
অম্লান সহজ গলায় জিজ্ঞেস করল, “বাড়ির ডিজাইনটা চমৎকার হয়েছে না?”
নীলাক্ষী উত্তর দিলো না। চাপা রাগ ফুঁসে বেরিয়ে আসছে। অম্লান পিঠে বালিশ চাপা দিয়ে অর্ধশোয়া অবস্থায় বসলো। গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি। নতুন এই গেঞ্জিতে ওকে একদম নতুন বর বর লাগছে। নীলাক্ষীর মোটেও ওর দিকে তাকাতে ইচ্ছে করছে না। ক্ষণিক আগেও যেখানে অবচেতন মনে নীলাক্ষী চেয়েছিল অম্লান আসুক। সেখানে এইমুহুর্তে অম্লানকে ভীষণ অসহ্যবোধ হওয়ার কারণ বুঝতে পারছে না। মানব মন বড়ই বিচিত্র কি না।
অম্লান নীলাক্ষীকে বলল, “একটা বই দাও তো পড়ি। বসে বসে থাকতে ভালো লাগছে না।”
নীলাক্ষী নড়াচড়াও করলো না। ওর গা জ্বলে যাচ্ছে রাগের মিশ্রণে।
অম্লান দ্বিতীয়বার বই চাইতেই নীলাক্ষী ফোঁস করে উঠলো। মুখে রাগের অভিব্যক্তি ফুটিয়ে বইয়ের তাক হতে একটা বই নামিয়ে অম্লানের দিকে এগিয়ে দিলো। অম্লান বইটা গ্রহণ করার সময় ইচ্ছেকৃত ভাবেই নীলাক্ষীর হাত স্পর্শ করলে নীলাক্ষী বই রেখে দ্রুতপদে বেরিয়ে গেল ঘর হতে। অম্লান বই বুকে জড়িয়ে স্তব্ধ মনে ভাবতে লাগল, এই রাগ খুব সহজে ভাংবে বলে মনে হয় না।

বাদামী সংসার
লেখা- মিশু মনি

নীলাক্ষীর গেস্ট রুমের দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ বসে রইলো। অন্ধকার ঘরে নিজেকে একজন বন্দি ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না। এভাবে আর কিছুক্ষণ থাকলে মা বাবা সবচেয়ে বেশী দুঃখ পাবেন। নিজের ভেতরের দুঃখগুলোকে বাইরে প্রকাশ করে বেড়ানোর অভ্যাস নেই নীলার। সে স্থির করলো, একই ঘরে অম্লানের পাশেই থাকবে সে। কিন্তু বাদামের মতোই। অম্লান ওকে দেখতে পারবে, ছুঁতে পারবে, হাস্য রসিকতা কিংবা কিছু চাইবা মাত্রই সেটা পেয়ে যাবে। কিন্তু একটা জিনিস পাবে না, সেটা হচ্ছে “ভালোবাসা।”
নীলা দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। হাতমুখ ধুয়ে সোজা চলে এলো নিজের ঘরে। অম্লান বিছানায় শুয়ে বই পড়ছিল। নীলাক্ষীকে দেখে বই বন্ধ করে ওর দিকে তাকালো অম্লান। নীলাক্ষী বেশ সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গীতে মোবাইল হাতে নিয়ে বিছানার অন্য পাশে শুয়ে পড়ল। ইউটিউবে ভিডিও দেখতে দেখতে হা হা করে হেসে উঠছিল থেকে থেকে। অম্লান উঁকি মেরে বলল, “আমাকেও দেখতে দাও। কী দেখছো একা একা?”
নীলাক্ষী কথা না বলে মোবাইলটা অম্লানের দিকে এগিয়ে দিলো। অম্লান নীলাক্ষীর পাশেই মাথা রেখে ফোনের স্ক্রিনে তাকায়। তবে আঁড়চোখে সে তাকায় নীলাক্ষীর গলার দিকে। গলা, চিবুকে ছড়িয়ে থাকা দু একটা চুল দেখেও অম্লানের বুকে প্রেমের নেশা জাগে। সবই তার ভীষণ চেনা।
নীলাক্ষী ফোনটা অম্লানকে দিয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়লো। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল অম্লান। একটা বই নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল নীলাক্ষী।

রাতে পাশাপাশি শুয়ে আছে ওরা। কেউই ঘুমাতে পারছে না। নীলাক্ষী পাশ ফিরে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর বৃথা চেষ্টা করছে। অপরপাশে অম্লান বারবার উশখুশ করছে একবার নীলাক্ষীকে জড়িয়ে ধরার জন্য। সবকিছু মিটিয়ে নেয়াটাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।
অম্লান ধীরেধীরে একটু একটু করে নীলাক্ষীর দিকে সরে আসতে লাগল। নীলাক্ষী কোনো শব্দ করল না, যেন সে ঘুমাচ্ছে। অম্লান সুযোগ বুঝে নীলাক্ষীকে নিজের বুকে টেনে নেয়ার চেষ্টা করল। তাতেও কাজ হল না। ঘুমন্ত নীলাক্ষীকে টেনে আনা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। অম্লান নিজেই নীলাক্ষীর কাছে সরে এসে ওকে বুকে চেপে ধরল। অনেক্ষণ কোনো নড়াচড়া করল না নীলাক্ষী। চোখ বন্ধ করে নীলাক্ষীকে অনুভব করছে অম্লান। সেই প্রিয় চুলের ঘ্রাণ নাকে এসে লাগছে। বহু পরিচিত নিশ্বাসের শব্দ। বুকে জড়িয়ে ধরলেই এক ধরনের শান্তি শান্তি লাগে। অথচ একটু আগেও বুকটা ভীষণ ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল।
নীলাক্ষীর হৃদস্পন্দন দ্রুত বেড়ে যায়। চোখে জল চলে আসে ওর। একইসাথে অভিমানের সুক্ষ্ম বেড়াজাল ওকে ক্রমশই ছিন্নভিন্ন করে তোলে। ‘ ঘুমাতে দাও’ বলে নিজেকে অম্লানের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে নীলাক্ষী। অম্লানের বুক থেকে যেন কলিজাটাকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। ছটফট করতে করতে কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে রইল অম্লান। তারপর উঠে গিয়ে একটা সিগারেট ধরালো।
নীলাক্ষী সবকিছু টের পায়। অম্লানের উঠে যাওয়া ওর ভেতরের অভিমানগুলোকে আরেকবার নাড়া দিয়ে যায়। ঘুমানোর ভান করে চোখ বন্ধ করে রাখাটাও এক ধরনের যন্ত্রণা। ছটফট করতে করতেই একসময় ঘুমে ডুবে গেল নীলাক্ষী।

অম্লান ঘুম থেকে উঠে দেখলো নীলাক্ষী অফিসে চলে গেছে। একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ বালিশ ধরে শুয়ে রইল সে। সারাদিন নীলাক্ষীর সাথে দেখা কিংবা কথা হওয়ার সুযোগ নেই। এই কয়েক ঘন্টা কাটাবে কীভাবে সে!
নাস্তা খেয়ে অম্লান নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। প্রতিটা মানুষের জীবনে অনুশোচনার মুহুর্ত আসে। কিন্তু যখন অনুশোচনা আসে, তখন সাথে করে দলবেঁধে মানসিক যন্ত্রণাকেও নিয়ে আসে। এই অনুশোচনা হওয়ার মুহুর্তের যন্ত্রণা আর আগের যন্ত্রণা দুটোই দু রকম। অম্লানের ভেতর বিষণ্ণতা ভর করেছে। এভাবে নীলাক্ষীর সামনে নির্লজ্জের মতো কথা বলাটাও অনুচিত। সবকিছুর আগে ওর কাছে ক্ষমা চাওয়া দরকার।

অম্লান বাসায় এসে মাকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘আমার একটা উপকার করবে আম্মু?’
‘এভাবে বলছিস কেন? তুই আমার ছেলে। কী করতে হবে বল?’
‘মা, নীলুকে আমি কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। ওর কাছে কীভাবে সরি বলবো বুঝতে পারছি না। প্লিজ তুমি ওকে আমার হয়ে কিছু একটা বলো।’
‘পাগল ছেলে আমার। আমি বললে কী নীলাক্ষী সব ভুলে যাবে? বরং ও আরও বেশী অভিমান করবে যে তুই নিজে কেন সরি বলছিস না। সবচেয়ে ভালো হয় তুই নিজেই ওর কাছে মুখ ফুটে ক্ষমা চেয়ে নে।’
‘মা, আমি পারছি না।’
‘মানুষ আসলে ক্ষমা চাইতে পছন্দ করে না রে, আমি জানি। যাই হোক, আমি কথা বলে দেখি ওর সাথে।’

অম্লান দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখে বসে রইল। নীলাক্ষীর জন্য ওর মনে নতুন করে আবেদন সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু কীভাবে ওকে ‘সরি’ বলা যায় সেটাই বুঝতে পারছে না। গম্ভীর মুখে বসে থাকতে থাকতে আচমকা হেসে উঠলো অম্লান।

নীলাক্ষী অফিসের সব কাজ গুছিয়ে নিচ্ছে। একটু পরেই ছুটি হয়ে যাবে। ঠিক সেই সময়ে ফোন বেজে উঠলো। শাশুড়ী মা কল দিয়েছেন। নীলাক্ষী সালাম জানিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘ভালো আছেন মা?’
‘মেয়ে যদি মাকে দেখতে না আসে, মা কিভাবে ভালো থাকে?’
‘আমি কাজের জন্য যেতে পারছি না মা।’
‘কাজ টাজ অতকিছু বুঝি না। আজকে অফিস শেষ করে এখানে আসো। অনেকদিন দেখি না তোমাকে।’
‘কিন্তু মা, আমার আজকে একটা কাজ আছে।’
‘কাজ কী রাতেও আছে? রাতে আসো।’
নীলাক্ষী সরাসরি ‘না’ বলতে পারছিল না বলেই মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, ‘ হ্যাঁ মা, রাতেও আছে।’
কথাটা বলেই লজ্জায় পড়ে গেল নীলাক্ষী। মা নিশ্চয় এবার জানতে চাইবেন কী কাজ? দ্রুত নীলাক্ষী উত্তর দিলো, ‘আচ্ছা আমি সন্ধ্যার পরে চলে আসবো।’
‘এইতো আমার লক্ষী মেয়ে। আসার সময় আমার জন্য একটা মাথা ঠাণ্ডা করা তেল নিয়ে এসো তো।’
নীলাক্ষীর ইচ্ছে ছিল না ওই বাড়িতে যাওয়ার। মা’য়ের জন্য তাকে আসতে হল। অম্লান সেখানে থাকবে এটা নিশ্চিত হয়েই নীলাক্ষী এসেছে। বাসায় ঢুকে মায়ের সাথেই প্রথম দেখা করল। ছেলের অবহেলার শিকার এই পুত্রবধূর প্রতি ভেতর থেকে এক ধরনের মমতা বোধ করলেন অম্লানের মা। উনি নীলাক্ষীকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, স্নেহের সাথে হাত বুলিয়ে দিলেন নীলাক্ষীর গায়ে। এই ভালবাসায় সামান্য খাদ নেই, নীলাক্ষী সেটা অনুভব করছে।

অম্লানের সাথে নীলাক্ষীর বসার ঘরে মুখোমুখি সাক্ষাৎ হলো। অম্লান এমন মায়াভরা চোখে চেয়ে আছে যেন ওই চোখ দিয়েই নীলাক্ষীকে বুকের গভীরে ঢুকিয়ে ফেলবে। নীলাক্ষী দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো।
দরজা খুলতেই একটা মিষ্টি সুঘ্রাণ এসে নাকে লাগে। এই ঘরে বহুদিন প্রবেশ করা হয় না। বোটকা গন্ধের পরিবর্তে সুঘ্রাণ কিসের ভেবে পেলো না নীলা। দরজা খুলে ঘরের দিকে তাকাতেই ওর চোখ বিস্ফারিত হলো।
পুরো ঘর ফুলে ফুলে সজ্জিত, বিছানায় মখমলের চাদর, মেঝেতে হাজারও গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো। এমন যত্ন নিয়ে কে সাজিয়েছে এই ঘর! চমকে স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো নীলাক্ষী।
বিছানার ওপর একটা বাদামী রঙের কাগজ মুড়িয়ে রাখা। সাথে ফিতা দিয়ে বেঁধে রাখা গোলাপ ফুল। নীলাক্ষী ত্রস্তপদে এগিয়ে গেল। ফুল হাতে নিয়ে কাগজটা খুলে দেখলো তাতে খুব সুন্দর করে লেখা, ‘sorry.’
মুহুর্তেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো নীলাক্ষীর। মনে হচ্ছে এই ‘সরি’ শব্দের সাথেই ওর সমস্ত রাগ, অভিমান স্রোতে মিশে যাবে। কিন্তু ক্ষণিক পরেই কী যেন ভেবে নীলাক্ষী কাগজটা আগের মতোই মুড়িয়ে যথাস্থানে রেখে দিলো। কোনো কিছুতেই হাত ছোঁয়ালো না, এমনকি টেবিলের ওপর রাখা গিফট বাক্সটাও খুলে দেখলো না। ভয়ংকরভাবে আঘাত করার পর এভাবে মান ভাঙানোর চেষ্টা করাটা সিনেম্যাটিক হতে পারে কিন্তু তাতে সব মেয়ে গদগদ হয়ে স্বামীর বুকে লুটিয়ে পড়বে সেটা ভাবা ভুল।
ভ্যানিটি ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে নীলাক্ষী বেরিয়ে এলো। মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘রাত বেশী হচ্ছে। আমি খুব ক্লান্ত। আজকে আসি, আমার একটা কাজ আছে।’
শাশুড়ী মা কোনোকিছু না জানার ভান করে বিস্ময়ের সুরে জানতে চাইলেন, ‘মানে! কোথায় যাবে তুমি? এখানে থাকবে না?’
‘না। কারণটা আপনার ছেলেকে জিজ্ঞেস করে নেবেন। আমি কিছু বলতে পারবো না।’
মাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ওনাকে হতভম্ব করে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয় নীলাক্ষী। অম্লান বসার ঘরে দাদীর সাথে দুষ্টুমি করছিল। নীলাক্ষীকে চলে যেতে দেখে ওর বুকে ব্যথার প্রবল আঘাত ঝাপিয়ে পড়ে। ব্যস্ত ভঙ্গীতে নীলাক্ষীকে আটকানোর জন্য ওর পিছু নিলো অম্লান।

চলবে..

গত পর্বের লিংক https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=784170558874627&id=310794352878919

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here