পাহাড়ে মেঘের ছায়া পর্ব – ৩

0
859

উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া
পর্ব – ৩
(নূর নাফিসা)
.
.
৪.
প্রথম দেখাতেই নাফিসাকে ভালো লেগেছিলো। এক্সিডেন্টের পর চোখের সামনে বারবার দেখতে দেখতে পাহাড়ি কন্যার প্রেমে পড়ে গেছে মেঘ! বারবার এটা সেটা জিজ্ঞেস করে কথা বলার সুযোগ খোঁজে মেঘ। কিন্তু পাহাড়ি কন্যার মন যে পাথরের মত শক্ত। প্রয়োজন ছাড়া সহজে কথা ফুটে না মেয়েটির মুখে। আন্টি সবসময় হাসিমুখে কথা বলে কিন্তু নাফিসা একদম চুপচাপ স্বভাবের। ঘরের ভেতরে একা একা সারাদিন কাটে মেঘের। এতোদিন এখানে থেকে লক্ষ্য করলো, নাফিসা আর তার মা ছাড়া কেউ এ বাড়িতে থাকে না! নাফিসার কি কোন ভাইবোন নেই! তার বাবাও কি নেই! খাটে বসে ভাবতে ভাবতে চোখ পড়লো বুকশেলফে রাখা কয়েকটি উপন্যাসের বইয়ের উপর। মেঘ শেলফের কাছে এগিয়ে গেলো। হাজার বছর ধরে, লালসালু, বড়দিদি, ছোটদিদি, পথের পাচালী এই পাচটি উপন্যাসের বই রাখা আছে একসাথে। তার পাশে আছে দুটি কবিতার বই মেঘনাদ বধ কাব্য ও স্বাধীনতা। “পাহাড়ি কন্যা, তুমি তো দেখছি সাহিত্যে মগ্ন!” ভাবতেই মেঘের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। মেঘ পথের পাচালী উপন্যাসের বইটি হাতে নিয়ে আবার খাটের দিকে এগিয়ে এলো। এ বইয়ের একটা অংশ পড়েছিলো, বাকিটা পড়া হয়নি। আধশোয়া অবস্থায় বসে বইটি পড়তে লাগলো। কিছুক্ষণ পর দুপুরের খাবার নিয়ে আন্টি রুমে প্রবেশ করলো।
– বই পড়ছো?
– হুম।
– খাবারটা আগে খেয়ে নাও। ওষুধ খেতে হবে।
– আন্টি কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করি?
– হুম, করো।
– আপনার পরিবারে আর কোন সদস্য নেই?
– না। আমি আর আমার মেয়েই আমার পরিবার। আর কেউ নেই।
– আন্টি আপনাদের দেখেই বুঝা যায় এ অঞ্চলের না। আপনাদের স্থানীয় বাসা কোথায়?
– এটাই আমাদের স্থানীয় বাসা। খাবারটা খেয়ে ওষুধ খেয়ে নাও।
কথাটা বলে আন্টি সেখানে আর অপেক্ষা করলো না। আন্টি বেরিয়ে গেলে মেঘ বুঝতে পারলো উনি এ নিয়ে আর কোন কথা বলতে চাচ্ছে না। এটা তাদের স্থানীয় বাসা না, তা মেঘ খুব ভালো করেই বুঝে গেছে। এর পিছনে কোন না কোন রহস্য আছে যার জন্য তিনি এরিয়ে চলে গেছেন! যাক, অন্যের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে তার ঘাটাঘাটি না করলেও চলবে। বিপদে আশ্রয় দিয়ে এমনিতেই অনেক সাহায্য করেছে, যার জন্য মেঘ তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। মেঘ হাত ধুয়ে খাবার খেয়ে ওষুধ নিয়েছে। ওয়ালেট হাতে নিয়ে দেখলো পর্যাপ্ত টাকা নেই। থাকবেই কিভাবে! ওষুধে কি আর কম টাকা খরচ হয়েছে! হবিগঞ্জে, শ্রীমঙ্গলে ঘুরেই তো টাকা কমে গিয়েছিলো! ভেবেছিলো, মাধবপুর যাওয়ার পর ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিবে,তা আর হলো কোথায়! তারউপর, ফ্রীতে এখানে থাকছে, খাবার পাচ্ছে! আবার প্রথমদিকে নাফিসাও ওষুধের খরচ দিয়েছে। ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নাফিসাকে তার টাকাটা ফেরত দিতে হবে। এই ভেবে নিলো মেঘ।
একটু পর নাফিসা বাসায় এসেই “আম্মি আম্মি” বলে বাইরে থেকে জোরে ডাকতে শুরু করলো। হয়তো আম্মির রুমে আম্মিকে পায়নি তাই গলা ছেড়ে ডাকতে লাগলো। কোন সাড়া না পেয়ে মেঘ যে রুমে আছে সে রুমে এলো। দেখলো মেঘ একা বসে আছে। মেঘ দেখলো ক্লান্ত নাফিসার মুখে অস্পষ্ট হাসির ঝিলিক। অন্যকেউ হয়তো এ হাসিটা বুঝতে পারতো না কিন্তু মেঘ বুঝতে পেরেছে। মেঘ কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই নাফিসা জিজ্ঞেস করলো,
– আম্মি কোথায়?
– এতো খুশি কেন?
– কোথায়!
– তোমার চেহারায় খুশি দেখছি আমি।
– আম্মিকে দেখেছেন?
– একটু আগে এসেছিলো। এখন কোথায়, তা জানা নেই।
নাফিসা আবার বেরিয়ে যাচ্ছিলো, টুলের উপর চোখ পড়তেই দরজার কাছ থেকে ফিরে এসে মেঘকে কিছুক্ষণ আগে খাবার দিয়ে যাওয়া থালাবাটি হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
অন্যদিন পাশে থেকেও নাফিসার গলার আওয়াজ শোনা যায় না। অথচ আজ জোর গলায় আম্মিকে ডাকছে, হুট করেই ঘরে এসে মেঘের সাথে কথা বলেছে! এর পিছনে কারণ তো নিশ্চয়ই আছে! কিন্তু সেটা কি!
একটু পর নাফিসার আম্মি এলে উনার কাছে জানতে পারলো নাফিসা এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। আজ এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশ হয়েছে! নাফিসা তাহলে বৃষ্টির সমবয়সী! তাহলে তো বৃষ্টির ও রেজাল্ট দিয়েছে। কি হয়েছে রেজাল্ট, কে জানে! মেঘ ফোন হাতে নিয়ে বাবার নম্বরে ডায়াল করলো। বাবার সাথে কথা বলে জানতে পারলো, বৃষ্টি গোল্ডেন এ+ পেয়েছে। বৃষ্টির সাথেও কথা বলতে চেয়েছে। কিন্তু বৃষ্টি রেগে আছে তাই মেঘের সাথে কথা বলবে না। মেঘ টিশার্ট চেঞ্জ করে অফ হোয়াইট শার্টটি পড়ে বিকেলে বের হলো বাসা থেকে। আন্টি না করেছিলেন কিন্তু মেঘ বললো বেশি দূর যাবে না। আশেপাশের মানুষের কাছে জিজ্ঞাসা করে ব্যাংকের ঠিকানা নিলো এবং ব্যাংকে গিয়ে টাকা তুলে নিলো। বাজার থেকে পাচ কেজি মিষ্টি ও এক কেজি সন্দেশ নিয়ে বাসায় ফিরলো মেঘ। হাতে মিষ্টি দেখে আন্টি জিজ্ঞেস করলো,
– এসব কি!
– কেন, মিষ্টি।
– তা তো দেখছি ই। কিন্তু এতো মিষ্টি কেন?
– আমাদের ওদিকে তো পরীক্ষায় পাস করলে মিষ্টি খাওয়ানো হয়। এদিকে কি হয় না?
– হ্যাঁ। কিন্তু এতো মিষ্টি নিয়ে এলে কেন?
– নাফিসা জিপিএ-৫ পেয়েছে না, তাই।
মেঘের ও মায়ের কথা শুনে নাফিসা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো,
– আপনাকে কে বলেছে আমার জন্য মিষ্টি আনতে?
– তোমার জন্য না তো, পাড়াপ্রতিবেশির জন্য।
– উদ্দেশ্যটা তো আমিই না?
– হ্যাঁ।
– সেটাই বলছি, আপনি এনেছেন কেন?
– আন্টি ধরুন তো। মিষ্টির সাথে সন্দেশ আছে। ওটা শুধু আপনাদের জন্য। আমার ছোট বোন গোল্ডেন পেয়েছে তাই সন্দেশ টা আমার বোনের উদ্দেশ্যে।
– তাই নাকি! আলহামদুলিল্লাহ, ভালোই তো।
মেঘ নাফিসার কথার কোন উত্তর না দিয়ে ঘরে চলে এলো। বইটা নিয়ে আবার পড়ছিলো, এমন সময় নাফিসা এলো রুমে। মেঘ একবার নাফিসার দিকে তাকিয়ে আবার বই পড়ায় মনযোগ দিলো। নাফিসা জিজ্ঞেস করলো,
– মিষ্টি আনতে কত টাকা খরচ হয়েছে?
নাফিসার কথা শুনে ব্রু কুচকে তাকালো মেঘ। তারপর বললো,
– কেন?
– উল্টো প্রশ্ন করছেন কেন! জানতে চেয়েছি উত্তর দিবেন।
– কারণ না বললে উত্তর দিবো না।
– আমি আপনার টাকা ফেরত দিবো। এবার বলুন!
– এসব কি বারাবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না, নাফিসা? সামান্য মিষ্টি এনেছি, তা নিয়ে কি শুরু করেছো!
– মিষ্টি আমিও কিনতে পারি। সুতরাং, আপনার কেনার কোন প্রয়োজন ছিলো না। বলুন কত টাকা খরচ হয়েছে?
– পাহাড়ের নিচ থেকে উদ্ধার করে আমার সেবাযত্ন সহ ডাক্তারী ওষুধ করাতে কত খরচ হয়েছে, বলো।
– কেন?
– কেন, আবার? আমি তোমার টাকা ফেরত দিবো তাই!
– আমি কাউকে দেয়া কিছু ফেরত নেই না। নিজেকে গুছিয়ে চলতে শিখে গেছি অনেক আগেই।
– তুমি কাউকে দেয়া কিছু ফেরত নেও না, তাহলে এটা ভাবলে কিভাবে যে আমি মিষ্টি আনার টাকা ফেরত নিবো! যাই হোক, তুমি যা চাইছো তা ই হবে। তুমি আমার টাকা ফেরত দিবে আমিও তোমার টাকা ফেরত দিবো। বলো বলো কত খরচ করেছো! আমার এতোদিনের থাকা, খাওয়ার হিসেব সহ বলবে। বলো…
নাফিসা আর একমুহূর্তও দাড়ালো না। রেগেমেগে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। কিছুক্ষণ পর নাফিসা প্লেটে করে ৪টা মিষ্টি নিয়ে আবার মেঘের কাছে এলো। কিছু না বলে প্লেট টুলের উপর রেখে চলে যাচ্ছিলো এমন সময় মেঘ বললো,
– এসব কি! এখানে রেখে যাচ্ছো কেন?
নাফিসা দরজার কাছ থেকে ফিরে এসে প্লেট টা হাতে নিয়ে মেঘের সামনে ধরে বললো,
– আমি পরীক্ষায় পাস করেছি, সে জন্য মিষ্টি এনেছি। নিন ধরুন।
– তুমি খেয়েছো?
– না, আমি খাবো না। আপনিই খান। বেশি করে খান।
মেঘ নাফিসাকে কিছু না বলে আন্টিকে জোরে জোরে ডাকতে লাগলো। নাফিসা তার কর্মকাণ্ড দেখে অবাক! আন্টি ডাক শুনে রুমে প্রবেশ করলে মেঘ বললো,
– আন্টি নাফিসা মিষ্টি খেয়েছে?
– না। বলেছি খেতে। কিন্তু খাবে না।
– তাহলে একটা মিষ্টিও কাউকে দিবেন না।
– তাহলে কি করবো এগুলো?
– যেখানে আছে, সেখানেই থাকুক।
– সে কি! ঘরে রেখে দিলে পচে যাবে তো!
– পচুক। তা ও দিবেন না। যার উদ্দেশ্যে মিষ্টি আনা, সে ই যদি না খায় তাহলে আর অন্যের খাওয়ার প্রয়োজন কি?
মেঘের কথা শুনে নাফিসা অবাক! এতোগুলো মিষ্টি এনে এখন বলছে কাউকে না দিয়ে ঘরে রেখে পচাতে! সে তার মা কে উদ্দেশ্য করে বললো,
– আম্মি, আমি মিষ্টি খাবো। যাও তুমি কাকে দিবে, দিয়ে এসো।
মেঘ নাফিসাকে জিজ্ঞেস করলো,
– খাবে তুমি?
– হ্যাঁ বলেছি তো! এবার ধরুন।
মেঘ নাফিসার হাত থেকে প্লেট নিয়ে তার সামনে ধরে বললো,
– নাও, তাহলে খাও।
– বলেছি তো খাবো। বিশ্বাস হয় না!
– না হয় না। এখন খাও, আমার সামনে, আন্টির সামনে।
নাফিসা একটা মিষ্টি থেকে একটু ভেঙে নিয়ে মুখে দিলো। নাফিসার মা মৃদু হাসলো মেঘ তার জিদ্দি মেয়েকে মানাতে পারায়। অল্প নেওয়াতে মেঘ বললো,
– মাত্র এতোটুকু!
এবার নাফিসা রেগে তার মা কে বললো,
– আম্মি, তুমি কিছু বলবা!
– মেঘ, নাফিসা মিষ্টি খেতে পছন্দ করে না। এতোটুকুই অনেক তার জন্য।
মেঘ বিড়বিড় করে বললো,
– এজন্যই তো কারো সাথে মিষ্টি করে কথাও বলতে পারে না!
– কিছু বলেছো?
– না, নিন আপনিও ধরুন।
– তুমি খাও। আমি খেয়ে নিবো।
– না, আমার সামনে নিন।
আন্টি একটা মিষ্টি তুলে নিলে মেঘও একটা তুলে মুখে দিলো। তারপর প্লেট আন্টির কাছে দিয়ে দিলো।
– সে কি! আর খাবে না?
– না আন্টি। একটাই যথেষ্ট।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here