পাহাড়ে মেঘের ছায়া পর্ব – ৭

0
863

উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া
পর্ব – ৭
(নূর নাফিসা)
.
.
৯.
নতুন পরিবেশে রাতটা খুব আনন্দের সাথে কাটিয়ে দিলো। সকালে ঘুম থেকে উঠে তাবুর বাইরে এসে দেখলো সূর্য উদয় হয়েছে হয়তো কয়েক মিনিট আগে। দুহাত মেলে আড়মোড়া ভাঙল বৃষ্টি। জংগলে এই প্রথম রাত কাটালো সে। গাছপালায় আচ্ছন্ন একটা জায়গায় তিনটা তাবু টানানো, নির্জন জংগল, পাখিদের কিচিরমিচির কলোরব, পাতার ফাকে ফাকে নতুন লাল সূর্যের আলো এসে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে! এর চেয়ে সুন্দর পরিবেশ আর কি হতে পারে! না, বৃষ্টির মতে এর চেয়ে সুন্দর পরিবেশ আর নেই! এতোক্ষণ মনে হচ্ছিলো সবার আগে বুঝি তারই ঘুম ভেঙেছে! এখন দেখছে তার আগেও সেই আকাশ নামের ছেলেটার ঘুম ভেঙেছে! কিন্তু ছেলেটা গাছের ডালে ঝুলছে কেন! বৃষ্টি আর একবার হাত মেলে আড়মোড়া ভেঙে সামনে এগিয়ে গেলো। আকাশ তাকে দেখেছে ঠিকই কিন্তু কিছু বললো না। তাই বৃষ্টিই জিজ্ঞেস করলো,
– এই যে মিস্টার, সকাল সকাল আপনি গাছের ডালে ঝুলছেন কেন?
আকাশ কোনো জবাব দিলো না। তাই বৃষ্টি আবার বললো,
– ডাল ভাঙার চেষ্টা করছেন নাকি! শুধু শুধু বৃথা চেষ্টা করে লাভ নেই! এই ডালটা যথেষ্ট মোটা। আর কাচা ডাল এমনিতেই সহজে ভাঙে না। নেমে পড়ুন, নেমে পড়ুন…
আকাশ ঝুলন্ত অবস্থায় থেকেই জবাব দিলো,
– অন্যের কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করার জন্যই কি মেয়ে জাতের সৃষ্টি হয়েছে?
– মানে!
ডাল ছেড়ে দিয়ে আকাশ নিচে নেমে পড়লো।
– ধ্যাত! কোন একটা কাজে শান্তি নেই। কেউ না কেউ এসে বাধা দিবেই! মানে টা বুঝো না! কোন কাজ করতে দেখলেই তোমরা এটা সেটা বলে কাজে বাধা দাও!
– আমি আবার আপনার কোন কাজে বাধা দিলাম! আমি তো যেটা সত্য সেটাই বলছিলাম!
– কে বললো তোমাকে, আমি ডাল ভাঙার চেষ্টা করছি? কাচা ডাল ভেঙে আমি কি করবো?
– তাহলে ঝুলছিলেন কেন?
– ব্যায়াম করছিলাম, ব্যায়াম বুঝো? ইয়োগা!
– হয়েছে হয়েছে, বাংলা বলাতেই বুঝতে পেরেছি। ইংরেজি বলার প্রয়োজন নেই। কিন্তু এটা আবার কোন ধরনের ব্যায়াম! আগে তো কখনো দেখিনি!
– রিং ধরে ব্যায়াম করতে দেখেছো কখনো? এটা আর ওটা সেইম কাজ!
– তাই নাকি! ওটা তো লম্বা হতে কাজে লাগে! আপনি তো এমনিতেই অনেক লম্বা! এই দেখুন, আমার চেয়েও কতো লম্বা!
কথা বলতে বলতে বৃষ্টি একেবারে আকাশের গা ঘেঁষে দাড়ালো উচ্চতা মাপার জন্য। আকাশ তা দেখে হাসতে লাগলো! বৃষ্টি মুগ্ধ হয়ে আকাশের হাসি দেখছে! ছেলেদের হাসলে এতো সুন্দর লাগে, আগে জানা ছিলো না তার! আকাশ হাসতে হাসতে বললো,
– তুমি কি লম্বা নাকি! তোমার সাথে আমার উচ্চতা মাপতে এসেছো যে!
– আমি লম্বা না!
– উচ্চতা কতো তোমার? ছয় ফিট? নাকি সাত ফিট?
– হুহ্! মেয়েরা এতো লম্বা হয় নাকি! আমি পাচ ফিট তিন ইঞ্চি !
– মেয়েরা এতো লম্বা হয় না, সেটা মাথায় আছে। আর আমি যে ছেলে, সেটা মাথায় নেই!
– ওফ্ফ! সরি!
– তবে এটা ঠিক বলেছো, আমি এমনিতেই লম্বা। আমার এই ব্যায়ামের প্রয়োজন নেই। কিন্তু তোমার প্রয়োজন আছে! সুতরাং তুমি ঝুলতে থাকো, পরে আমার সাথে উচ্চতা মাপতে এসো।
আকাশ কথাটা বলে তাবুর দিকে পা বাড়ালো। বৃষ্টি বিড়বিড় করতে করতে বললো,
– আহ! লম্বা হয়েছে বলে কি ভাব! যেন আর মানুষ লম্বা হতে পারে না! আমিও লম্বা হয়ে দেখিয়ে দিবো আপনাকে। প্রয়োজনে আজ সারাদিন ঝুলে থাকবো এই গাছের ডালে!
বৃষ্টি আর সময় নষ্ট না করে গাছ বাইতে লাগলো। ডালটা বেশি উচুতে না। আর একটু আধটু গাছ বাইতে জানে বৃষ্টি। আকাশ তাবুর কাছাকাছি গিয়ে আবার পেছনে তাকালো একবার। বৃষ্টিকে গাছে উঠতে দেখে অবাক হয়ে আছে! এতো বড় মেয়ে গাছ বাইছে! পাগল নাকি! আকাশ তারাতাড়ি গাছের কাছে গেলো। বৃষ্টি এতোক্ষণে ডাল পর্যন্ত উঠে গেছে! আকাশ নিচ থেকে বলতে লাগলো,
– এই মেয়ে! পাগল হয়ে গেছো নাকি! গাছে উঠেছো কেন! নামো!
– এতোক্ষণ তো মেয়ে জাতের দোষ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এখন কি ছেলে জাতের দোষ দেখতে পাচ্ছেন না! আপনিও তো আমার কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছেন!
– আমি কোন ব্যাঘাত সৃষ্টি করছি না। গাছে উঠেছো কেন? গাছে তোমার কি কাজ?
– লম্বা হওয়ার জন্য ব্যায়াম করবো আমি।
– আরে পড়ে গেলে হাড়গোড় ভেঙ্গে যাবে। নামো বলছি!
– না, নামবো না।
– তুমি এমনিতেই লম্বা। আর লম্বা হতে হবে না। নেমে আসো।
– না, আজ ব্যায়াম করেই নামবো। এরপর আর লম্বা হওয়া নিয়ে খোটা দিতে পারবে না।
আকাশ আর কোন কথা বললো না। চুপচাপ দাড়িয়ে আছে বৃষ্টির কান্ড দেখার জন্য! খুব বড় গলায় তো কথাগুলো বলেছে বৃষ্টি। জেদ করে গাছের ডাল পর্যন্তও উঠে এসেছে! কিন্তু এবার ঝুলবে কিভাবে! সেই সাহস যে আর হচ্ছে না! হাত একটু একটু এগিয়ে নিতে নিতে হঠাৎ মচকে পড়েই গেলো। ভয় পেয়ে এতো জোরে চিৎকার দিলো, পুরো জংগলে প্রতিধ্বনি সৃষ্টি হলো আর তাবুতে থাকা সবার ঘুম ভেঙে গেলো। তারা তারাহুরো করে দৌড়ে বেরিয়ে এলো। সবার চোখ গুলোর আকৃতি দ্বিগুণ বড় হয়ে গেছে, আর মুখটা হা হয়ে আছে! বৃষ্টি তো গাছ থেকে পড়ে গেছে! কিন্তু ব্যাথা পায়নি কেন! চোখ খুলে বৃষ্টি নিজেকে আকাশের কোলে আবিষ্কার করলো! রিজভী এগিয়ে এসে বললো,
– কি দেখছি রে আমি! সবসময় দেখেছি, বৃষ্টি আকাশ থেকে মাটিতে পড়ে! কিন্তু আজ দেখি বৃষ্টি আকাশ থেকে আকাশেরই কোলে পড়ে!
আকাশ আর বৃষ্টি ছাড়া সবাই হো হো করে হেসে উঠলো! আকাশ বৃষ্টিকে কোল থেকে নামিয়ে দাড় করালো। অভ্র পেছন থেকে রিজভীর মাথায় ঠুসি দিয়ে বললো,
– চোখ তোর অন্ধ বাছা! এ নহে বৃষ্টিপাত! এ-তো প্রেমের আলোকপাত! এ যে প্রেম বর্ষন!
সবাই অভ্রের কবিতা শুনে আবার হেসে উঠলো। বৃষ্টিও খিলখিল করে হাসতে হাসতে বললো,
– ও রে বাবা! কবি নাকি! খুব সুন্দর কবিতা বানান দেখছি! নামটা কি কবি মহাশয়ের, বলেন তো শুনি ?
অভ্রের কাধে হাত রেখে রিজভী বললো,
– এ যে মোদের অভ্র কবি! হা হা হা!
বৃষ্টিও খিলখিল করে হাসতে লাগলো। আকাশ বৃষ্টির কান্ড আর বন্ধুদের মস্করা দেখে রেগে চলে গেলো তাবুতে। ঝুমুর নামের মেয়েটা বৃষ্টির কাছে এগিয়ে এসে বললো,
– সকাল সকাল এ কোন মহাপ্রলয় ঘটলো! বলবেন কি?
– মানে?
– মানে তুমি আকাশের কোলে উঠতে গেলে কেন? আর এতো জোরে চিৎকার করে জংগল কাপালেই বা কেন?
– ছি ছি! কি বলো আপু! আমি আকাশের কোলে উঠি নি! ও ই আমাকে কোলে নিয়েছে!
সবাই অবাক বৃষ্টির কথা শুনে! সিমি এগিয়ে এসে বললো,
– তাই নাকি! কেন হটাৎ আকাশ তোমাকে কোলে নিতে গেলো!
– আমি গাছে উঠেছিলাম ব্যায়াম করার জন্য। সেখান থেকে পড়ে যেতেই আকাশ ধরে ফেললো!
রিজভী হাসতে হাসতে বললো,
– তুমি গাছে উঠতে পারো? আবার উঠে দেখাও তো আমাদের!
– এবার পড়ে গেলে ধরবে কে?
– কেন! আমি আছি, রওনক আছে! না সরি, রওনক না! আমি আছি, আমাদের কবি মহাশয় আছে! আমরা ধরবো!
– না থাক, আপনারা না ধরতে পারলে আমি শেষ! এতো রিস্ক নিতে যাবো না!
সকলে হাসতে হাসতে তাবুতে চলে গেলো।
১০.
বৃষ্টি সিমির সাথে বাইরেই হাটতে লাগলো আর নিম গাছের কচি ডাল দিয়ে ব্রাশ করতে লাগলো।
– আপু একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
– হুম, করো।
– রওনক ভাইয়া কি তোমার কোন কিছু হয়? ফ্রেন্ড ছাড়া।
– আমার হাসব্যান্ড।
– সত্যিইইইইই!
– হাসব্যান্ড মিথ্যা হয়!
– জানো, আমিতো প্রথমেই সন্দেহ করেছিলাম!
– সন্দেহ করার কি আছে! সবার কাছেই ক্লিয়ার!
– না, মানে আমি তো আর জানতাম না! যখন শুনলাম ওই ভাইয়ার নাম রওনক, তখন মনে হয়েছে তুমি বলেছো তোমার নাম, সিমি রওনক! তখনই বুঝতে পেরেছি নিশ্চই তোমাদের কানেকশন আছে! তা লাভ ম্যারেজ নাকি এরেঞ্জ ম্যারেজ?
– সমবয়সী হলে আবার এরেঞ্জ ম্যারেজ হয়!
– ফ্যামিলি এতো সহজে মেনে নিলো?
– মেনে নেয় নি। মানিয়ে নিয়েছি।
– ওহ! কাল তুমি আমাদের তাবুতে থাকোনি কেন? ভাইয়ার সাথে ঘুমিয়েছো?
এবার সিমি এক হাত কোমড়ে রেখে বৃষ্টির দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালো। বৃষ্টি দাতে দাত চেপে বললো,
– সরি, সরি! আর জিজ্ঞেস করবো না!
– এতো কথা বলতে পারো তুমি! ভাবতেও পারিনি!
– আচ্ছা, অন্য একটা বিষয় জানবো। আর কিছু জিজ্ঞেস করবো না।
– না, আর একটা কথাও না।
– প্লিজ আপু, একটা।
– একটাও না। যাও আমার কাছ থেকে।
– প্লিজ আপু, আজ তো চলেই যাবো। আর তো দেখাও হবে না! প্লিজ এটাই লাস্ট।
– ওকে।
– কাল তুমি আমাকে এটা বলেছিলে কেন, আকাশের প্রেমে পড়লে সফল হতে পারবো না!
– এই তুমি প্রেমে পড়ে গেছো?
– দূর আমি কি জানতে চাইছি আর তুমি কি বলছো!
– হা হা হা! আকাশ একটু অন্যরকম ছেলে। গোমড়ামুখো! হাসতেও জানে না, কাদতেও জানে না! শুধু রাগটাই দেখাতে জানে। তাকে দেখে কতো মেয়ে প্রেমে পড়েছে হিসেব নেই। কমবেশি সবাই চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছে। কোন মেয়ে তার বাড়ি পর্যন্ত চলে গেছে, কোন মেয়ে তার জন্য তার সামনে হাত কেটে ফেলেছে। কিন্তু আকাশের মন গলাতে পারেনি! পাষাণ একটা! আমাদের সাথে খাটো মেয়েটা আছে না, অথৈ! সেও প্রেমে পড়েছিলো, তার পাগলামি দেখে আকাশ তাকে শেষ পর্যন্ত ফ্রেন্ড বানিয়ে ছেড়েছে! আল্লাহ জানে এর কপালে কোন মেয়ে জুটবে! যেই মেয়ে ওর ঘরে বউ হয়ে আসবে, তিনদিনও টিকবে না! গ্যারান্টি!
– এমন কেন, লোকটা?
– কি জানি! মেয়েদের তেমন একটা পাত্তা দেয় না। শুধু আমরা যারা ফ্রেন্ড আছি, তাদের সাথে প্রয়োজন ভেদে টুকটাক কথা বলে।
সিমির ব্রাশ করা হয়ে এলে তাবুর দিকে চলে গেলো। বৃষ্টি এখানেই দাড়িয়ে আছে। আর নিজের সাথে নিজেই বিড়বিড় করে কথা বলে যাচ্ছে,
– তোমার বলা কথাগুলো মিললো না গো আপু! আকাশ হাসতে জানে! আমি আজ দেখেছি তাকে হাসতে। সেই হাসিতে আমি প্রেমে পড়ে গেছি লোকটার! সে কথাও বলতে জানে, আমার সাথে সে কিছুক্ষণ আগে চাপা ছেড়েছে! আজ তো বলেছে আমাকে দিয়ে আসবে! না আমি যাবো না! আমি এখানেই থাকবো, আকাশের কাছাকাছি! তার উপর এমন একটা পরিবেশ, ইচ্ছে করছে সারাজীবন কাটিয়ে দেই এখানে! ওফ্ফ! অসম্ভব ভালোলাগা! কিন্তু এরা কি আমাকে সাথে রাখবে! কি করা যায়!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here