উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া
পর্ব – ১১
(নূর নাফিসা)
.
.
১৩.
প্রায় বিকেলের প্রথম ভাগে সেই বৃষ্টি থামলো। আজ ছুটির দিন হওয়ায় বাচ্চাদের পড়াও নেই, চা পাতা তোলার কাজও নেই। তবুও নাফিসাকে বিকেলে পাহাড়ে আসতে হলো মেঘের ফোন আর ওয়ালেট ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। অনেক্ক্ষণ যাবত এখানে বসে আছে কিন্তু মেঘ আজ আসছে না! আসছে না কেন আজ পাহাড়ে! সে কি আগে থেকেই জানতো নাকি যে আজ বাচ্চাদের পড়া নেই! না এলে ফোন আর ওয়ালেট ফিরিয়ে দিবে কিভাবে! ইকো রিসোর্টে যেতে হবে নাকি তাকে! আর একটু অপেক্ষা করবে নাফিসা, তাই ঘাষের উপর বসে রইলো। আর পশ্চিমে হেলে পড়া সূর্যের দিকে তাকিয়ে রইলো। সেই ভোর বেলায় সূর্যের দেখা পেয়েছিলো আর এখন অস্ত যাওয়ার সময় আবার দেখা পেল। একটু পর মনে হলো পাশে এসে কেউ বসলো। নাফিসা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই মেঘকে দেখতে পেল।
– আপনার জন্যই তো অপেক্ষা করছিলাম! আজ এতো দেড়ি করে এলেন যে!
– ইদানিং আমাকে খুব বেশি মিস করো মনে হচ্ছে! ক’দিন পর তো দেখা না পেলে পাগলই হয়ে যাবে!
– সবসময় দু চার লাইন বেশি বুঝেন কেন! আপনার দেখা পাওয়ার জন্য না, ফোন আর ওয়ালেট ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আমি অপেক্ষা করছিলাম।
নাফিসা ফোন আর ওয়ালেট মেঘের সামনে ধরলে মেঘ তা হাতে নিলো। ফোনটা তাদের থেকে কিছুটা সামনে ঘাসের উপর রাখলো আর ওয়ালেট পকেটে রাখতে রাখতে বললো,
– এখন যা ই বলো না কেন, একদিন আমার কথাও সত্য বলে প্রমাণিত হবে মেডাম। তাছাড়া আমি এখানে ঠিক সময়েই এসেছি। এতোক্ষণ লুকিয়ে ছিলাম তোমাকে একটু অপেক্ষা করানোর জন্য।
– মানুষ কতোটা নির্বোধ, ভাবা যায়! শুধু শুধু অপেক্ষা করালেন কেন আমাকে! আমার যে আরো কাজ থাকতে পারে সেটা সম্পর্কে একটু ভেবেছেন!
– শুধু শুধু অপেক্ষা করাই নি।
– তাহলে কেন করিয়েছেন?
– তোমার সাথে সূর্যাস্ত দেখার জন্য অপেক্ষা করিয়েছি।
– এসব ফালতু কাজে অযথা সময় নষ্ট করতে আমি পারবো না।
নাফিসা চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাড়ালো। মেঘও দ্রুত উঠে নাফিসার হাত ধরে টেনে এক ঝটকায় তার কাছে এনে পূর্ব দিকে ঘুরিয়ে পেছন থেকে দু’হাতে সম্পূর্ণ বন্দী করে ফেললো। নাফিসা ভাবতেও পারেনি মেঘ তার সাথে এমনটা করবে! তার কাছ থেকে ছুটা তো দূরের কথা, একটা হাতও মুক্ত করতে পারছে না! খুব বিরক্ত লাগছে সাথে ভয়ও হচ্ছে। মেঘ কি সেইসব বাজে ছেলে! মেঘ কি এখন তার সাথে উল্টাপাল্টা কিছু করবে! এমনটা তো ভাবেনি কখনো মেঘকে নিয়ে! ভয়ার্ত ও কান্না জড়িত কণ্ঠে নাফিসা বললো,
– কি করছেন এসব! ছাড়ুন বলছি। ছাড়ুন আমাকে!
– আমার ইচ্ছে পূরণ না করা পর্যন্ত ছাড়বো না মিস মেঘা। সবসময় এতো কাজ আর কাজ নিয়ে পড়ে থাকো কেন! মনে কি একটু আবেগ, ইচ্ছে, ভালোলাগা আর ভালোবাসা নেই! এতো সুন্দর মুহুর্তগুলোকে উপেক্ষা করো কেন!
– না নেই। ছাড়ুন, না হলে আমি চিৎকার করবো।
– ওফ্ফ! সময় তো তুমিই নষ্ট করছো! পূর্বাকাশে তাকাও একটু।
– কেন তাকা…
পূর্বাকাশে তাকিয়ে সম্পূর্ণ কথা শেষ করার আগেই নাফিসার দৃষ্টি আটকে গেল এক মনোরম দৃশ্যে! খুব সুন্দর রংধনু ভেসে আছে নীল পূর্বাকাশে! নাফিসার চোখ দুটো ছলছল করছে। মুখে যতই বলুক এসব আলতু ফালতু কাজ! সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, রংধনু, বৃষ্টি এসব কার না ভালো লাগে! নাফিসা ছোটাছুটির চেষ্টা বাদ দিয়ে খুব শান্ত হয়ে পলকহীন রংধনুর দিকে তাকিয়ে আছে। অচেনা, অজানা এই মানুষটা বিনা স্বার্থে তাকে এতো সারপ্রাইজ দিয়ে যায় কেন! একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য! নাফিসাকে শান্ত থাকতে দেখে মেঘ তার মাথাটা একটু নিচু করে নাফিসার কাধে থুতনি রেখে সেও পলকহীন রংধনুর দিকে তাকিয়ে আছে। নাফিসা একটু কেপে উঠলো! তাও রংধনু থেকে চোখ সরায়নি। মেঘকে এখন একটুও বিরক্ত লাগছে না তার কাছে। বরং খুব ভালো লাগছে। কারো বাহুডোরে বন্দী হয়ে রংধনু দেখাতে যে এতো আনন্দ, এতো ভালোলাগা মিশে আছে তা জানা ছিলো না। এই প্রথম এমন অনুভূতির সৃষ্টি হলো তার মাঝে! সকালে বৃষ্টিতে ভেজার সময়ও মেঘ তাকে এক ভিন্ন জগৎ থেকে ঘুরিয়ে এনেছে। আবার এখনও আরেকটা জগতে রংধনুর সৌন্দর্য উপভোগ করাচ্ছে।
রংধনুর রঙ আস্তে আস্তে আবছা হয়ে বিলীন হয়ে গেছে। কতোক্ষন তারা এভাবে ছিলো কারোরই জানা নেই। শুধু এটা জানে পুরোটা সময় তারা একে অপরের সাথে মিশে এভাবেই দাড়িয়ে ছিলো। রংধনু আর খুঁজে না পাওয়া গেলে এভাবে দাঁড়ানো অবস্থায় থেকেই মেঘ তার মাথা সোজা করে মেঘাকে সাথে নিয়ে পশ্চিম দিকে ঘুরে দাড়ালো। নাফিসা পশ্চিমাকাশে তাকালে মেঘ আবার কাধে থুতনি রাখলো। এতোক্ষণে সূর্য এক চতুর্থাংশ ডুবে গেছে।বাকিটাও নিরবে দাড়িয়ে দেখতে লাগলো দুজনেই। মেঘ নাফিসার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলতে লাগলো,
– মনে ভালোবাসার অনুভূতি কখন সৃষ্টি হয়েছিলো জানিনা। তবে প্রিয় মানুষকে সাথে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজবো, এভাবে সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, রংধনু দেখবো, সেই স্বপ্ন অনেক আগে থেকেই বুনে রেখেছি আমি। আজ তুমি পূর্ণ করে দিলে আমার স্বপ্ন, মেঘা। এখন শুধু সূর্যোদয় দেখাটা বাকি। ইনশাআল্লাহ, সেটাও সুযোগ বুঝে পূরণ করে নিবো তোমায় নিয়ে।
কথাগুলো শেষ করে মেঘ কেমন যেন হয়ে উঠেছে! মেঘ সেভাবে দাড়িয়েই নাফিসার কান থেকে ঘাড়ে নাকমুখ ঘষছে আর একের পর এক ঠোঁটের ছোয়া দিয়ে যাচ্ছে! নাফিসা এ কোন জগতে ভাসছে তার নিজেরও জানা নেই! মেঘের প্রত্যেকটা স্পর্শ কাপিয়ে তুলছে তাকে। স্পর্শগুলো যেন মেঘের ভালোবাসার জানান দিয়ে যাচ্ছে! একের পর এক নতুন অনুভূতির জন্ম দিয়ে যাচ্ছে মেঘ! নতুন স্বপ্ন দিয়ে সাজাচ্ছে তাকে! এতোকিছুর সূচনা কিভাবে করতে পারে সে! সকালে বৃষ্টিতে ভিজিয়েছে, এখন রংধনু আবার সূর্যাস্ত! একদিনেই পরপর তিনটা জগতে ঘুরে বেড়িয়েছে! একি সত্যি নাকি স্বপ্ন! সূর্য সম্পূর্ণ ডুবে গেছে। নাফিসার কেমন যেন লাগছে। মেঘের উপর রাগও দেখাতে পারছে না, মেঘকে ঠেলে দূরেও সরাতে পারছে না। স্থীর হয়ে গেছে সে। অনেক চেষ্টা পর মুখ থেকে কিছু শব্দ বের হয়ে এলো নাফিসার,
– এ..এসব ঠিক না, মেঘ। এসব পাপ!
এতোক্ষণে মেঘের খেয়াল হলো সে কি করছিলো! সে তো তার স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে কোনো অধিকার ছাড়া আস্তে আস্তে কাছে চলে যাচ্ছিলো!
মেঘ নাফিসাকে ছেড়ে দিয়ে একটু দূরে সরে দাড়ালো। নাফিসা চোখের পাতা বন্ধ করে ঘন ঘন নিশ্বাস নিতে ও ছাড়াতে লাগলো। চারিদিকে অন্ধকার নেমে আসছে। ঘাসের উপর থেকে ফোনটা নিয়ে পকেটে রাখলো মেঘ। স্বাভাবিক হয়ে নাফিসাকে বললো,
– বাসায় যাবে না? চলো…
নাফিসা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিলো। আবছা অন্ধকারে হাত ধরে উঁচুনিচু পথ বেয়ে পাহাড় থেকে নেমে এলো দুজন। রাস্তার দিকে এগিয়ে আসতেই চার পাচ জন লোক পড়লো সামনে। নাফিসা একটু ঘাবড়ে গেলো কিন্তু মেঘ কোন প্রতিক্রিয়া করলো না। লোকগুলো তাদের দেখে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো কিন্তু কিছু বললো না। নাফিসা তারাতাড়ি রাস্তায় হাটতে শুরু করলো। মেঘও তার সাথে তাল মিলিয়ে হাটছে।
– আরে আস্তে হাটো। এতো তাড়া কিসের!
– বাসায় যেতে হবে।
– বাসায় তো যাবেই।
মেঘ হুট করেই নাফিসার একটা হাত ধরে তাকে থামিয়ে দিলো। নাফিসা তার দিকে তাকাতেই মেঘ বললো,
– এক কাপ চা খাবে আমার সাথে? এই টংয়ের দোকানে মাটির কাপে এক কাপ চা খাবো। দোকান এখন ফাকা আছে। আমরা ভেতরে যাবো না। বাইরে বেঞ্চিতে বসে খাবো। মাত্র এক কাপ!
মেঘ উত্তরের আশায় দৃষ্টিতে আকুল আবেদন নিয়ে তাকিয়ে আছে। এ কেমন আবদার! যতই দূরে যেতে চেষ্টা করছে ততই কাছে টেনে নিচ্ছে! সারাদিন যে একের পর এক ভিন্ন জগৎ দেখিয়েছে তার একটা আবদার তো রাখাই যায়! নাফিসা পেছনে তাকিয়ে দেখলো লোকগুলোকে দেখা যাচ্ছে না। তাই মেঘকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– চলুন।
মেঘ তার উত্তরে খুব খুশি হলো। তাই উৎফুল্ল হয়ে বললো,
– তুমি বেঞ্চিতে বসো আমি চা নিয়ে আসছি।
মেঘ দোকানে এসে দুকাপ চা অর্ডার করলো। নাফিসা এসে বেঞ্চিতে বসলো। চা খাওয়া শেষ হলে আর এক মুহূর্তও দেড়ি করবে না কোন কারণে। সোজা বাসায় যাবে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, আম্মি নিশ্চয়ই চিন্তা করছে। মেঘ দুকাপ চা এনে নাফিসার পাশে বসলো। নাফিসার হাতে এক কাপ দিয়ে অন্যটায় খুব গভীর অনুভূতি নিয়ে এক চুমুক দিলো। এমনিতেই অভ্যাসে পরিণত হয়েছে আর আজ তো প্রিয় জনের সাথে বসায় এই চায়ের প্রেমেই পড়ে গেছে!
নাফিসা চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে আর আড়চোখে মেঘের দিকে তাকিয়ে মেঘের চা খাওয়ার নমুনা দেখছে। ভালোই লাগছে মেঘের সাথে বসে চা খেতে।
চা শেষ করে টাকা দিয়ে আবার নাফিসার সাথে হাটতে লাগলো।
– আপনি এদিকে আসছেন কেন? রিসোর্টের রাস্তা ওদিকে।
– জানি আমি। তোমাকে বাসার পাশে পৌছে দিয়ে রিসোর্টে যাবো।
অন্ধকারে সরু পাকা রাস্তায় প্রিয় মানুষের সাথে পথ চলাটাও প্রেমের এক মুগ্ধকর অনুভুতির সারা দেয়। মুহুর্তটা শিহরিত করে তুলছে মেঘকে। বাসার প্রায় কাছাকাছি এসে পড়লে মেঘ আচমকা নাফিসাকে টেনে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। খুব শক্ত করে বাহুডোরে বন্দী করে ফেলে। ইচ্ছে করছে সারাজীবন এভাবে রেখে দিতে।
– তোমায় দেখার পর থেকে প্রত্যেকটা মুহুর্ত তোমাকে মিস করি মেঘা। ইচ্ছে করে সারাজীবন এভাবে আগলে রাখতে।
এতোক্ষণ ভালো লাগলেও এখন নাফিসার কাছে খুব বিরক্ত লাগছে। মাঝে মাঝে এসব কি কাণ্ড ঘটায় মেঘ! এসব একদমই ভালো লাগে না তার কাছে। এমনভাবে চেপে ধরেছে, তার শক্তির কাছে পেরে উঠছে না নাফিসা। তার চোখে পানি এসে ভীড় জমিয়েছে। একমিনিট পর মেঘই তাকে ছেড়ে দিয়ে কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে বললো,
– যাও, বাসায় যাও।
নাফিসা হঠাৎ বড় বড় চোখ করে তাকালো। এ দৃষ্টি তো মেঘের দিকে নয়! মেঘ নাফিসার দৃষ্টিকে অনুসরণ করে পেছনে তাকিয়ে দেখলো ওই লোকগুলো! যাদের পাহাড় থেকে নামার সময় দেখেছিলো! লোকগুলো হঠাৎ করেই মেঘ আর নাফিসাকে ধরে নিয়ে নাফিসার বাসার দিকে অগ্রসর হলো। মেঘ কিছু না বুঝতে পেরে বারবার বলছিলো তাদেরকে এভাবে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন কেন! কিন্তু তারা কোন জবাব দিলো না!