উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া
পর্ব – ৩৭
(নূর নাফিসা)
.
.
৩৫.
সকালে বৃষ্টি কোচিং-এর জন্য বেরিয়ে গেলো। মেঘ অনেক দিন হলো ব্যবসা থেকে দূরে আছে, তাই বাবার সাথে আজ সেখানে গেলো। বাসায় মোহিনী আর নাফিসা আছে। টুকটাক গল্প করলো মোহিনী নাফিসার সাথে। মেঘ অফিসে থেকে মায়ের ফোনে কল করে নাফিসার সাথে একটু কথা বললো। কোচিং শেষে বৃষ্টি আকাশকে কল করলো। আজ প্রথমবারেই রিসিভ করে ফেলেছে আকাশ।
– আসসালামু আলাইকুম।
– ওয়ালাইকুম আসসালাম। কি বলবে, বলো?
বৃষ্টি প্রথমে ক্ষেপে গিয়ে বললো,
– ফোন রিসিভ করেই “কি বলবে বলো!” কেমন আছি সেটাও তো জিজ্ঞেস করতে পারতে!
প্রতুত্তরে আকাশ কিছু বললো না। বৃষ্টি ফোনে তাকিয়ে দেখলো কল কাটেনি সে, এখনো লাইনে আছে! সেও কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে নিজেকে ঠান্ডা করে কিছু বলতে যাবে এমন সময় আকাশ বললো,
– কেমন আছো?
– এভাবে কথা বলো কেন তুমি? একটা কলও করো না! আমি প্রতিদিন কল দেই একবার রিসিভও করো না! এতোটাই ব্যস্ত থাকো তুমি, একটু আধটু কথা বলার সময় হয়না তোমার?
– এটা কি “কেমন আছো” এর উত্তর?
বৃষ্টি হেসে বললো,
– না। আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি আমি। তুমি কেমন আছো?
– আলহামদুলিল্লাহ।
– দেখা করবে একবার?
– কি প্রয়োজন?
– দেখবো তোমাকে।
– দেখে কি করবে?
– দেখে ডান্স করবো!
– ডান্স বাদ দিয়ে পড়াশোনায় মনযোগী হও। বেশিদিন নেই এডমিশন টেস্টের!
বৃষ্টির রাগ আরও বেড়ে গেলো! বিরক্ত হয়ে সে কল কেটে দিলো! রিকশা ডেকে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। মনে মনে আকাশকে হাজারটা বকা দিয়ে যাচ্ছে! ভালোবাসে খুব, তাই প্রকাশ্যে বকা দিতে পারে না! এজন্য মনে মনেই বকে যায়! পথেই দেখা হলো মারিশার সাথে! রিকশা থামিয়ে বললো,
– আরে, মারিশা আপু! কেমন আছো?
– এইতো, আলহামদুলিল্লাহ! তুমি কেমন আছো?
– আলহামদুলিল্লাহ। কোথায় যাচ্ছো?
– তোমাদের বাসায়ই যাচ্ছিলাম!
– তাহলে উঠে এসো। আমি তো বাসাতেই যাচ্ছি।
মারিশা উঠে পড়লো রিকশায়! দুজনেই গল্প করতে করতে বাসায় ফিরলো। মোহিনী মারিশাকে দেখে খুশি হয়ে বললো,
– আরে মারিশা যে! কেমন আছো?
– এইতো আলহামদুলিল্লাহ। কেমন আছো আন্টি?
– আলহামদুলিল্লাহ। কাল তোমার বাবার সাথে এলে না কেন প্রোগ্রামে?
– এমনি আন্টি। এক জায়গায় বেড়াতে গিয়েছিলাম।
মোহিনীও জানে, মেঘকে ভালোবাসে তাই তদের প্রোগ্রামে আসেনি মারিশা! নিজেই কথা ঘুরিয়ে বললো,
– ওহ আচ্ছা। বসো।
– নতুন বউ কোথায়? দেখতে এলাম বউকে।
– রুমে আছে। বৃষ্টি, নাফিসাকে আসতে বল।
– ওকে।
মারিশা বললো,
– আন্টি আমিই যাই, দেখা করে আসি।
– ওকে, যাও। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি। একসাথে লাঞ্চ করবো আজ।
– ওকে।
মারিশা আর বৃষ্টি মেঘের রুমে এলো। নাফিসা জানালার পাশে দাড়িয়ে ছিলো। রুমে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে তাকিয়ে দেখলো বৃষ্টি আর সাথে একটি মেয়ে। বৃষ্টি বললো,
– ভাবি, এ হচ্ছে মারিশা আপু। বাবার বন্ধুর মেয়ে।
নাফিসার সাথে সাথেই মনে পড়লো সেদিনের কথা! মা কল করে মেঘকে বলেছিলো মারিশার সাথে বিয়ে ঠিক করছে! তাহলে এ ই সেই মেয়ে! দেখতে সুন্দরী, বেশেও অনেক স্মার্ট দেখা যাচ্ছে! নাফিসা সালাম দিলো মারিশাও সালামের জবাব দিলো। নাফিসার দিকে কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে! পা থেকে মাথা পর্যন্ত খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে। যা নাফিসার মোটেও ভালো লাগছে না! বৃষ্টি হেসে বললো,
– আপু, কি দেখছো এমন করে?
– দেখছি, মেঘ কি জন্য পাগল হলো তোমার ভাবির প্রতি!
– সেটা তো মেঘ ভাইয়াই ভালো জানে।
– হুম, তাও ঠিক! কি ব্যাপার, মেহমান এসেছি বসতেও বলবে না?
নাফিসা বললো,
– জ্বি বসুন।
মারিশা খাটে বসে পড়লো। বৃষ্টি আর তার রুমে যায়নি। এ রুমের বাথরুমে গিয়েই হাতমুখ ধুয়ে নিচ্ছে। মারিশা নাফিসাকে জিজ্ঞেস করলো,
– মেঘ কি অফিসে গেছে?
– হ্যাঁ।
– নাম কি তোমার?
– নূর নাফিসা।
– বাসা কোথায়?
– সিলেটের শ্রীমঙ্গলে।
– পাহাড়ি মেয়ে! আসতে তো হলো ঢাকাতেই! কে জানে, মেঘ কি পেলো সেই পাহাড়ি অঞ্চলে! নাকি আবার কেউ বশ করে তাকে পাহাড়ি অঞ্চলেই বেধে রেখেছে সেটাই বা কে জানে!
মারিশার কথাবার্তা নাফিসার একটুও ভালো লাগছে না! না চাইতেও বাধ্য হয়ে উত্তর দিয়ে যাচ্ছে! মারিশা আবার জিজ্ঞেস করলো,
– পড়ালেখা জানো তো?
– এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি।
– বয়স কত?
– উনিশ চলছে।
– এখনই সংসারে নেমে গেছো! বিয়ের এতো তাড়া! নাকি মেঘকে দেখে আর মন মানাতে পারোনি?
নাফিসার ইচ্ছে করছে অনেক কিছুই কিন্তু আত্মসম্মানবোধের কারণে কিছুই বলছে না! বৃষ্টি বাথরুম থেকে বেরিয়ে লাস্ট কথাটা শুনেছে। তাই সে জবাব দিলো,
– এসব কি বলছো আপু! জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে তো আল্লাহর হাতে। যার যখন যেখানে হুকুম পড়বে সেখানেই সে স্থির হবে।
– তোমার যেমন জ্ঞান আছে, সেটাই যাচাই করছিলাম তোমার ভাবির আছে কিনা! জ্ঞানের স্বল্পতা আছে তোমার ভাবির মাঝে! জ্ঞানহীন মানুষ পশুর সমান। তবে, বৃষ্টি এটা জানো তো? অন্যের খাবার ছিনিয়ে নেওয়ার মজাই আলাদা! কিছু কিছু মানুষের স্বভাব এমনই! না চাইতেও অন্যের জিনিসে লোভ ধরে যায়! আন্টি বোধহয় খাবার রেডি করে রেখেছে, চলো।
বৃষ্টি কিছু বলতে যাচ্ছিলো তার আগেই মারিশা উঠে বেরিয়ে যেতে লাগলো। তাই বৃষ্টি থেমে গেলো। নাফিসা চুপচাপ দাড়িয়েই আছে। বৃষ্টি তার কাছে এসে বললো,
– ভাবি, মন খারাপ করেছো? আসলে মারিশা আপু ভাইয়াকে পছন্দ করতো। এজন্যই তোমার সাথে একটু এরকম ব্যাবহার করেছে। ভাইয়া কিন্তু মোটেও ওকে তেমন পছন্দ করে না। শুধুমাত্র বন্ধুসুলভ আচরণ করে। ভাইয়ার চেয়ে তিন বছরের ছোট, তবুও বাবার বন্ধুত্বের খাতিরে দু পরিবারের আসা যাওয়া বিধায় ছোট থেকেই তারা বন্ধু! চলো, লাঞ্চ করবে।
– হুম, যাও আমি আসছি।
– না, এখন আসো আমার সাথে।
নাফিসা বাথরুমে গিয়ে মুখে পানি ছিটিয়ে অত:পর বৃষ্টির সাথে ডাইনিং টেবিলে এলো।
মোহিনী ডেকে নিজের পাশে বসালো নাফিসাকে। কাটা বেছে দিতে নিলে নাফিসা বললো,
– মা, আমি এখন মাছ খাবো না।
– কেন?
– এমনি, ইচ্ছে করছে না খেতে।
– উহুম, খেতে হবে। আমি কাটা বেছে দিচ্ছি।
মারিশা বললো,
– বাহ! আন্টি, এতো বড় মেয়ে সামান্য মাছের কাটা বেছে খেতে পারে না! এ তো দেখছি শাশুড়িকে সেবা করার বদলে উল্টো শাশুড়িকে দিয়ে নিজের সেবা করাচ্ছে!
নাফিসা চোখ বন্ধ করে কঠিন নিশ্বাস ছাড়লো! সে জানতোই মারিশা কাটা বেছে দিতে দেখলে কিছু না কিছু বলবেই! এজন্যই বলেছিলো মাছ খাবে না! শ্বশুর বাড়ির সম্মানের কথা ভেবে শুধু চুপচাপ সহ্য করে যাচ্ছে মারিশাকে! মোহিনী হেসে বললো,
– এটা মা মেয়ের আদর মারিশা! যখন তুমি আমার অবস্থানে আসবে, তখন বুঝবে!
নাফিসা যথাসম্ভব দ্রুতই খাবার শেষ করলো। কিছুক্ষণ পূর্বের ব্যাবহারে মারিশার সামনে থাকতে তার মোটেও সস্তি বোধ হচ্ছে না! সবার খাওয়া শেষ হলে মাকে নিষেধ করে সে নিজেই থালাবাটি গুছাতে লাগলো। তবে মোহিনী বসে থাকেনি। সেও এগিয়ে দিচ্ছে।
মারিশা আরও কিছুক্ষণ থেকে মোহিনী ও বৃষ্টির সাথে গল্প করে চলে গেলো। নাফিসা একা তার রুমে বসেছিলো। কষ্ট তার ভেতর চাপা পড়ে আছে।
সন্ধ্যায় নাফিসা মায়ের সাথে কিচেনে ছিলো। সে কেটেকুটে দিয়েছিলো এখন মোহিনীই রান্না করছে আর নাফিসা পাশে বসে আছে। মেঘের গলার আওয়াজ শুনে কিচেন থেকে বেরিয়ে এলো। মেঘ আর বৃষ্টি ফোন সম্পর্কে কিছু বলছে। রায়হান চৌধুরী বিকেলে ফিরলেও মেঘ সন্ধ্যায় বাসায় ফিরলো। আজ রোদ উঠেছিলো কড়াভাবে! মেঘকে দেখেও ক্লান্ত মনে হচ্ছে, তাছাড়া ঘেমে একাকার। মেঘের হাত থেকে প্যাকেট নিয়ে বৃষ্টি তার রুমে চলে গেলো। মেঘ নিজের রুমে গেলে নাফিসাও পিছু পিছু গেলো। মেঘ তাকে রুমে ঢুকতে দেখে দরজাটা চাপিয়ে ক্লান্ত মুখে হাসি ফুটিয়ে নাফিসাকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে ঠোঁটের গভীর ছোয়া দিলো। নাফিসা চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। আজ এই স্পর্শ মনে কোনো সাড়া জাগাতে পারলো না! মেঘ ছেড়ে দিলে সে ওয়ারড্রব থেকে মেঘের জামাকাপড় বের করে বাথরুমে রেখে এলো। মেঘ শার্ট খুলে গোসল করতে চলে গেলো। বৃষ্টি এসে নাফিসার কাছে একটা ফোন দিয়ে গেলো।
– ভাবি নাও। সিম মেমোরি সব লাগিয়ে দিয়েছি। ফেসবুক একাউন্ট খুললে আমাকে এড দিও।
– আমি কি করবো এটা দিয়ে?
– ফোন দিয়ে তো কতো কিছুই করে! ফোন ছাড়া এখন কারো সময় কাটে নাকি! তাছাড়া ভাইয়া আজ এনেছে এটা তোমার জন্য।
– কে বলেছে ফোন ছাড়া সময় কাটে না! আমি তো ইউজ করি না, তাহলে আমার সময় কাটছে না?
– আচ্ছা, তাহলে ভাইয়ার কাছে জেনে নিও কেন আনলো এটা! আমি যাই! পড়তে বসবো।
বৃষ্টি ফোন রেখে চলে গেলো। মেঘ গোসল করে বেরিয়ে এসে দেখলো নাফিসা জানালার পাশে দাড়িয়ে আছে আর খাটে ফোন রাখা। মাথা মুছতে মুছতে বললো,
– মেঘা, ফোনটা পছন্দ হয়েছে?
নাফিসা কোনো উত্তর দিলো না! মেঘ বাসায় ফেরার পর থেকেই লক্ষ্য করছে নাফিসা কেমন মনমরা হয়ে আছে! দরজা লাগিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,
– বেগমের মনটা কি আজ খুব বেশি খারাপ?
– বিয়ে কেন করেছেন আমাকে?
– এটা কেমন প্রশ্ন!
মেঘ তাকে ছেড়ে দিয়ে দাড়ালে নাফিসা ঘুরে দাড়ালো তার দিকে! চোখ তার ছলছল করছে! পরক্ষণেই আবার বলতে লাগলো,
– প্রশ্ন যেমনই হোক, উত্তর দিন। বিয়ে কেন করেছেন আমাকে! পৃথিবীতে এতো মেয়ে থাকতে আমাকেই আপনার পছন্দ হলো কেন? আমি কি আপনাকে বশ করে পাহাড়ি অঞ্চলে বেধে রেখেছিলাম? আমি কি আপনাকে বিয়ের জন্য তাড়া দিয়েছিলাম? আমার জ্ঞান নেই, আমি মুর্খ, পশুর সমতুল্য! না আছি রূপে আর না আছি কোনো গুনে! মাছের কাটাটা পর্যন্ত বেছে খেতে পারি না! আপনি এতো মেধাবী, স্মার্ট হয়ে আমাকে কেন বিয়ে করতে গেলেন! অন্যের জিনিস ছিনিয়ে নেওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই! কোনো লোভ নেই আমার অন্যের জিনিসের প্রতি! আমি তো আপনার কাছে আসিনি, তাহলে আপনি কেন গেলেন আমার কাছে! বলেছিলাম তো আমার কাছ থেকে দুরে সরে যেতে, তবুও কেন সরে এলেন না!
কথাগুলো বলতে বলতে নাফিসার চাপা কষ্ট অশ্রু হয়ে বেরিয়ে আসছে! মেঘ সিরিয়াস মুডে জবাব দিলো,
– তোমার সব কেন এর উত্তর একটাই, ভালোবাসি তোমায়!
– কে বলেছে এতো ভালোবাসতে? আজ আপনার জন্য, শুধুমাত্র আপনার জন্য আমাকে এসব শুনতে হচ্ছে!
– কে কি বলেছে? বলো?
– কেউ কিছু বলেনি!
মেঘ নাফিসার বাহু চেপে ধরে বললো,
– কি হয়েছে তোমার বলো আমাকে? কে কি বলেছে, বলো?
– বললাম না কেউ কিছু বলেনি!
– মেঘা, আমি সত্যিটা জানাতে চাইছি!
নাফিসা মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো! ইগনোর করাতে মেঘের প্রচুর রাগ হচ্ছে! সে নাফিসার বাহু ছেড়ে দিয়ে দরজা খুলে বৃষ্টির কাছে চলে গেলো।