নিরালায় ভালোবাসি
কলমে: তুহিনা পাকিরা
২.
– ” ডিভোর্স পেপারটায় তাড়াতাড়ি সাইন করে বাড়ি থেকে বিদায় হো। আমি তোকে সারাজীবনের জন্য বউ করে আনিনি। যদিও বা তোর যোগ্যতাও কোনোদিন হয়নি আমার বউ হওয়ার।”
চুলের মুঠি ধরে থাকা শক্ত পেশিবহুল হাতটা থেকে নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে কঁকিয়ে উঠলো ইচ্ছে। মুখে শুধু তার এক বুলি, ” দয়া করে আমাকে তাড়িয়ে দেবেন না। আমি এইখানেই থাকবো। যেমন ছিলাম তেমনই থাকবো, কাজের লোকের মতোই। দয়া করুন, ডিভোর্স দেবেন না।”
গত পনেরো মিনিট ধরে শোনা একই বুলিতে অতিষ্ট হয়ে উঠছে উপস্থিত সকলে, বিশেষ করে চুলের মুঠি ধরে থাকা ব্যাক্তিটি। তার ইচ্ছে তো করছে ইচ্ছের গলা টিপে ধরতে। এই মেয়ের জন্মের মতো বুলি বন্ধ করে দিতে। মানুষটি যেনো রাগে আরও কিড়মিড় করে উঠলো। ইচ্ছের চুলের গোছা ছেড়ে গলার দিকে হাত বাড়ালো।
হুরমুর করে উঠে বসলো ইচ্ছে। স্বপ্ন, ভয়ঙ্কর এক স্বপ্ন। অসম্ভব পরিমাণে কেঁপে চলেছে সে। বারবার গলায় হাত বুলিয়ে চলেছে। চোখে মুখে ফুটে উঠেছে আতঙ্ক। পাশের টেবিল থেকে বেজে ওঠা অ্যালার্ম ঘড়িটা সকাল 5 টা বাজার পাশাপাশি জানান দিচ্ছে কারোর অস্তিত্বের। বারবার একটা ধ্বনি ঘরের দেওয়াল জুড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, ” জলদি ওঠ ইচ্ছে কুণ্ড, জলদি ওঠ ইচ্ছে কুণ্ড।”
কিন্তু ঘড়িটা বন্ধ করার মতো যিনি এই ঘরে উপস্থিত, তিনি তো এখন সেই পরিস্থিতিতেই নেই। দ্রুত গতিতে সে হয়তো তার হৃদযন্ত্রের কম্পন অনুভব করছে।
–” ইচ্ছে, এই ইচ্ছে উঠেছিস? দাদা ডাকছে বাইরে….”
বলতে পারলেন না নবনীতা দেবী। ইচ্ছেকে দেখেই তিনি দৌড়ে গিয়ে মেঝেতে বসে গেলেন। ইচ্ছে মেঝেতে বসে কাঁপছে। তিনি বুঝেছেন ইচ্ছে আবারও মেঝেতে শুয়েছে। এই ঠাণ্ডায় যেখানে মানুষ সোয়েটার ছাড়া থাকতে পারছে না, সেখানে এই মেয়ে মেঝেতে শুয়ে রয়েছে। তাও যদি গায়ে গরমের পোশাক থাকতো। তাও তো পড়েনি। নবনীতা দেবী হাত বাড়িয়ে বিছানা থেকে ব্লাংকেটটা নিয়ে ইচ্ছের গায়ে ভালো করে জড়িয়ে দিলেন। ইচ্ছে তখনও কেঁপে চলেছে।
তার ছেলে রাতে তাকে বলেছিল আজ সে ইচ্ছেকে ঘুমের ঔষধ খেতে দেইনি, ডক্টর আস্তে আস্তে ওষুধটা বন্ধ করতে বলেছে। কিন্তু এখন তার ছেলের উপর রাগ হচ্ছে। মেয়েটাকে একটু তার সামলাতে দেওয়া উচিত ছিল। মেয়েটা যখন এক মাস আগে হসপিটাল থেকে ফিরলো রোজ তাকে শুইয়ে দিয়ে চলে গেলে দেখা যেতো ও মেঝেতে শুয়ে রয়েছে। তারমধ্যে ডিসেম্বরের ঠাণ্ডা। ঘুমের ঔষধ খেয়ে শুলে ওর আর হুশ থাকতো না। কিন্তু কাল ঔষধ না খাওয়ায় হয়তো পড়ে আবারও ভয়ে ও মেঝেতে শুয়েছে। এমনিতে নবনীতা দেবী ইচ্ছের সাথে রাতে ঘুমায় এখন। কিন্তু কাল রাতে নিজের ঘরে কিছু কাজ করতে করতে তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তাই আর তার এইঘরে আসা হয় নি।
– ” কী হয়েছে মা? স্বপ্ন দেখেছিস! ভয় লাগছে!”
ইচ্ছে কে নিজের বুকে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন নবনীতা দেবী। ইচ্ছেও ভয়ে গুটি শুটি হয়ে বড়মাকে জড়িয়ে ধরলো।
– ” ঠিক আছিস ইচ্ছে।”
নিজেকে যতটা পারলো শান্ত করলো ইচ্ছে। কিন্তু ভয় তার মনের মধ্যে এখনও রয়েছে। যেই ভয় তাকে কখনোই পিছু ছাড়ে না। যেই ভয় ওকে ভিতর থেকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে।
অ্যালার্ম ঘড়ি তখনও বেজে চলেছে। নবনীতা দেবী সেই দিকে তাকালেন। হাত বাড়িয়ে ঘড়িটা নিয়ে আলার্মটা বন্ধ করলেন। তার স্পষ্ট মনে আছে ইচ্ছের কোনো এক জন্মদিনে ধীর আর নীরব মিলে এই ঘড়িটা ইচ্ছেকে ওরা উপহার দিয়েছিল। আর নীরব গলার সাউন্ডটা রেকর্ড করে রেখেছিল।
– ” চল ওঠ, নীচে বসতে হবে না। ধীর নীচে বসে রয়েছে। আজ কী যাবি মর্নিং ওয়ার্কে?”
ঘাড় নেড়ে সায় দেয় ইচ্ছে।
———_——-
– ” মা দরজাটা একটু বন্ধ করে দাও। ”
নীরব বাড়ির গেটের সামনে এগিয়ে গিয়েছিল। পিছন থেকে রুমা দেবী ডেকে উঠলেন,
– ” এই ভোরে তুই কোথায় যাচ্ছিস নীরব? এখনও তো চারিদিকে কুয়াশা, আলোও ফোটে নি।”
– ” মা বুঝছো না– কাল তো ফিরলাম আজ মনে হচ্ছে সবার সাথে বসে আড্ডা দিই। ”
– ” একটু রেস্ট নিয়ে তারপর বেরোতে পারতিস।”
– ” আর রেস্ট নিতে ভালো লাগছে না। সবাই কে মিস করছি। যখন ওখানে ছিলাম তার থেকেও এখানে এসে যেনো আরও বেশি মিস করছি। ইচ্ছে, ধীর ওদের সঙ্গে দেখা করবো। আচ্ছা মা ইচ্ছে নিশ্চয় এখন শ্বশুর বাড়িতে! ”
কালো হয়ে গেল রুমা দেবীর মুখ, ঢোক গিলে বললেন,
-” ইচ্ছে কে কেনো দরকার তোর?”
-” ওকেও মিস করছি সকলের মতো। ওর বিয়ের পর তো আমি বাইরে গেলাম। তারপর না দেখা আর না কথা, কিছুই হয়নি। মা ও এখানে আসে?”
রুমা দেবী কিছুক্ষণ ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। পড়ে কিছু না বলেই সদর দরজা আটকে ভিতরে চলে গেল। নীরব হাঁ করে সেইদিক তাকিয়ে রইল।
——————
শীতের কুয়াশা ভরা সকালে একটু দূর থেকে কাউকেই আর দেখা যায় না। সকলেই আড়াল হয়ে যায়। ধীর প্রতিদিন সকালে ইচ্ছেকে নিয়ে বাড়ির সামনের পার্কটা পর্যন্ত হাঁটে। সেখানে অনেকেই আসে হাঁটতে। আজও প্রতিদিনের ন্যায় বোনকে নিয়ে ধীর সেই দিকে রওনা দিয়েছে।
যত কুয়াশা কে পেরিয়ে তারা সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে ততই তাদের মাথার সামনের চুলগুলো কুয়াশায় ভিজে যাচ্ছে। ধীরের বেশ লাগছে, অবশ্য প্রতিদিনই লাগে। চুলে যেই জল জমে ওমনি ও হাত দিয়ে তা মুছে ফেলে। আবার পরক্ষণে জল জমে গেলে একই কাজ পুনরায় করতে থাকে। আজও সেই একই কাজ করতে করতে সামনে একটু এগিয়ে যায় ধীর।
পিছনে পড়ে যায় ইচ্ছে। পাশেই ঘোষালদের বাড়ির মোড়ে এসে থমকে দাঁড়ায় সে। ভেসে আসছে ঘোষাল কাকুর মেয়ের গলা। সকাল সকাল রেওয়াজে বসেছে সে। ইচ্ছের মনে পড়ে যায় নয়মাস আগেও সে এই কাক ডাকা ভোরে উঠে রেওয়াজ করতো। বুকের মধ্যে দিয়ে ওর এক তীব্র বেদনা বেরিয়ে আসতে চায়। চোখ দুটি জ্বলে ওঠে ওর। কিন্তু চোখে বৃষ্টি নামে না। কুয়াশা মুখর সকালে হয়তো বৃষ্টি এসে বিপদে পড়তে চায় না।
– ” আমাদের সব ইচ্ছে যে পূরণ হবে এমন কথা কোথাও লেখা নেই। আমাদের উচিত ইচ্ছে দিয়ে নতুন ইচ্ছেকে আমাদের মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করা। হবে আবারও কিছু, নতুন কিছুর উদ্ভব।”
শান্ত চোখে ধীরের দিকে তাকায় ইচ্ছে। ওর তো আর কোনো ইচ্ছে নেই। শুধু নামটাই অবশিষ্ট রয়েছে,
‘ ইচ্ছে ‘।”
তারা আবারও এগিয়ে চলে সামনে। ইচ্ছের মনে হয় এই চলাটা হয়তো অনন্তের চলা। এই চলার যেনো শেষ নেই। জন্মের পর থেকে একটা শিশু যখন পুরোপুরি চলতে শিখে যায় তখন থেকেই শুরু হয় তার জীবনের চলা। বাকি অবশিষ্ট জীবনের জন্যে এই চলা কার্যকরী হয়ে যায়।
হঠাৎই পাশ কেটে কেউ ছুটে বেরিয়ে যায়। ইচ্ছের মন বলে ওঠে সেই চেনা কিছুর সাথে এইমাত্র তার পরিচয় হতে গিয়েও যেনো হলো না। পিছন ফিরে সেই গতির দিকে তাকিয়েও কোনো লাভ হয় না। ইচ্ছের জীবনের গুরুত্তপূর্ণ কেউ হয়তো কুয়াশার মাঝে হারিয়ে গেলো।
ইচ্ছের জানা রয়েছে কেবল রাতের আঁধারে কেউ ওর জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। সেই যেনো ইচ্ছে কে কোনো অন্ধ কুঠুরির মাঝে নির্বাসন দিয়েছিল। কিন্তু ইচ্ছের হয়তো জানা নেই রাতের আঁধারে হারিয়ে গেলেও ভোরের কুয়াশা কেটে আবারও সূর্য ঝলকানি দেয়।
—————————
দুপুরের দিকে মুড অফ করে শুয়ে রয়েছে নীরব। আজ ওর ধীরের সঙ্গে যখন দেখা হলো, তখন ধীর ওকে কতকটা এড়িয়েই চলে যায়। একটা কথাও ও বলেনি। ইচ্ছের বিয়ে থেকেই ধীর ওর সাথে ভালো মতো কথা বলতো না। কিন্তু আজ ওকে এতদিন পর দেখে কেনো যে পাত্তা দিলো না তা নীরব বুঝতে পারছে না।
– ” দাদা মামীমা তোকে ডাকছে।”
দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাথৈ। ভিতরে যাওয়া যেনো তার জন্যে পাপ। কপাল থেকে হাত সরালো নীরব, কিন্তু উঠে বসলো না। ধমকের সুরে বলল,
” ভিতরে আয়।”
নড়লো না তাথৈ, ওইভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। না সে ঘরে গেলো আর না সেখান থেকে চলে গেল। নীরব রাগী ভাব ধরে উঠে দাঁড়ালো। তাথৈ এর কাছে গিয়ে ওর কানটা ধরে টেনে আনলো ঘরের মধ্যে।
– ” আমাকে রাগাবিনা তাথু। আমি কাল রাতে এসেছি , বাড়িতে থাকা সত্বেও আমি একবারের জন্যও তোকে দেখিনি। আর আজ তুই আমার সাথে দেখা করছিস দুপুরবেলা, তাও দরজার আড়ালে। কী করেছি কী আমি? যে আমার সাথে তুই, মা, ধীর ভালো করে কথা বলেছিস না। কাকু ( ইচ্ছের বাবা ) বললো ইচ্ছে ধীরের সাথে বেরিয়েছে। মানে ইচ্ছে এইখানে এসেছে, তাহলে ইচ্ছে কেনো আমার সাথে দেখা করলো না?
চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো তাথৈ। মুখে ওর কোনো কথা আসছে না। ওর ভালো লাগছে না এখানে। তার থেকে ও বাড়িতে ভালো ছিল। আগে যখন মামার বাড়ি আসতো সকলের সঙ্গে কতো মজা করতো। বাড়ি যাওয়ার সময় তো ওর কান্না পেয়ে যেত। এখানের সেই মজা, আনন্দ সব শেষ হয়ে গেছে। ওর ইচ্ছে দিদিও আর ওর সাথে কথা বলেনা। রোজ ওর কাছে গিয়ে এটা ওটা বলে তাথৈ। কিন্তু ইচ্ছে তো যেনো শোনেই না। চুপ করে থাকে। ওর বলা মজার জোকস শুনেও হাসে না। কেনো হাসে না তা তাথৈ জানে না। শুধু জানে ইচ্ছে দিদির বিয়ের পর থেকে এই সব হচ্ছে। কেউ আর হাসি – খুশি নেই।
নীরব এবার চিৎকার করে উঠলো,
– ” কী রে কথা বলেছিস না কেনো? স্পিক আপ।”
রুমা দেবী নীরবের ঘরে এলো। তাথৈ এর দিকে তাকিয়ে বললো, ” তাথু নীচে যা। তোর কাপ কেক এতক্ষণে রেডি হয়ে গেছে। ”
———————–
– ” মা তুমি কি পাগল হলে, আমি কেনো ইচ্ছেকে বিয়ে করবো। মানছি ওর স্বামী আর নেই। কিন্তু ওকে বিয়ে করা আমার পক্ষে অসম্ভব।”
রুমা দেবী উঠে দাঁড়ালেন। কিছুক্ষণ আগেই তিনি নীরব কে ইচ্ছেকে বিয়ের কথা বলেছে। তার মতে ইচ্ছের মনের মধ্যে যে ভয় রয়েছে তার জন্যে ওর বিয়ে দেওয়াই ঠিক হবে। ওর একজন ভালোবাসার মানুষের এই মুহূর্তে খুব প্রয়োজন। কিন্তু নীরব কিছুতেই বুঝতে পারছে না, ইচ্ছের ভয়টা কীসের?
– ” তুই বলেছিলিস আমার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করবি। আর আমার পছন্দ কেবল ইচ্ছে। তোকে জোর করতে চাইছি না। যদি মনে হয় তুই বিয়েটা ইচ্ছেকে করবি না, তাহলে নিজের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করতেই পারিস। সেক্ষেত্রে আমার কিছু করার নেই। তোর জীবন তোর ইচ্ছে। তোর কথাই প্রাধান্য পাবে এক্ষেত্রে।”
– ” মা ওকে আমার বউ হিসেবে পছন্দ নয়। ও খুব বকবক করে। আমার ভালো লাগে না। ”
রুমা দেবী হাসলেন, মানুষের অপছন্দ অনেক কিছুর
উপর থাকে। কিন্তু এই প্রথম কারোর মুখে এমন একটা কারণ হয়তো তিনি প্রথম শুনলেন। যাকে হয়তো কারণের দলেও ফেলাও অনুচিত হবে।
-” বললাম তো তুই তোর যা মনে হয় আমাকে বলে দিতে পারিস। একবার আশা রাখিস নি, এবারেও নাহয় রাখিস না।”
উভয়েই চুপ রয়ে গেলেন। নীরব মাথার চুলগুলো চেপে বসে রইলো। রুমা দেবী পুনরায় বললেন, “আমি কি না ধরে নেবো!”
নীরবের এই মুহূর্তে ইচ্ছের চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। হাতের কাছে থাকা বালিশটা ঠাস করে মাটিতে ফেলে নীরব বিছানায় উঁবু হয়ে শুয়ে পড়লো। হেডফোনটা কানে গুজে কম্বলে মুখ চাপা দিয়ে দিলো। এখন ওর শান্তি চাই, যার জন্যে ওকে গান শুনতে হবে।
বালিশটা বিছানায় রাখলেন রুমা দেবী।
– ” নীরব, তোকে একদিন বলেছি না, নিজের রাগ জিনিসপত্রের উপর দেখাবি না।”
তিনি ছেলেকে আরও কিছু বললেন। যার কোনো উত্তর নীরব দিলো না। তাই রুমা দেবী ভাবলেন ছেলে রাজি না তাহলে আর কী! আবারও নাহয় আফসোস করবেন তিনি। তবে নীরব একদিন ইচ্ছের অভাব ঠিকই বুঝবে, তা উনি জানেন। তখন হয়তো হাজার চেষ্টা করেও ওকে পাবে না। মানুষ কোনো জিনিস না চাইতেই পেয়ে গেলে তার দাম দেয়না। রুমা দেবী আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে চাইলেন না। নিজেকে কেমন তার রোবটের মতো লাগছে। বাবা মায়েরা হয়তো সবসময় এটাই চায় তার ছেলে মেয়েরা তাদের কথা শুনে চলবে। কিন্তু তা তো আর সবসময় হয় না।
– ” মা!”
সাড়া দিলেন না রুমা দেবী। চুপ করে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মায়ের সাড়া না পেয়ে নীরব মাথা থেকে কম্বল তুলে সামনে তাকালো। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় মায়ের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বললো,
– ” আমি ইচ্ছেকে বিয়ে করবো। তবে ঘরোয়া ভাবে। তবে ভেবোনা বিয়ের খরচ থেকে রেহাই পাবে। বিয়েতে যা খরচ হওয়ার কথা ছিল সব টাকা আমাকে দেবে আমি কাশ্মীর ঘুরতে যাবো। ” কথাগুলো বলেই গানের সাউন্ড ফুল দিয়ে মাথা কম্বলে মুড়ে নিলো।
খুশি হলেন রুমা দেবী। ছেলে তার পাগল জাতীয়। তার এখন অনেক কাজ। ইচ্ছের বাবাকে জানাতে হবে এখনই।
রুমা দেবী যেতেই নীরব উঠে দাঁড়ালো, ইচ্ছেকে দেখতে ইচ্ছে করলো ওর হঠাৎ। কিন্তু ইচ্ছে এখন বাড়ি নেই, হসপিটালে গেছে। কয়েকদিন আগে নাকি ওর অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল। তারমানে ওই অ্যাক্সিডেন্টেই সুবীর মারা গেছে। নীরব দুই – দুই এ চার করলো। কিন্তু আসল ঘটনা, বিষয় নীরবের দুই-দুই এ চার করার চেয়েও কঠিন। ও হয়তো ভাবতে পারছে না ওর অবর্তমানে কী কী হয়েছে। যদি কখনো জানতে পারে সেই দিন কী করবে সে? সেটা সময়ে দেখা যাবে।
——————
হালকা ধূসর রঙা শাল গায়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইচ্ছে। লম্বা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পিঠে ছড়িয়ে রয়েছে। ওর গায়ে কোনো অলঙ্কার অবধি নেই। মায়াময় মুখশ্রী দেখলে মনে হবে অনেকক্ষণ হয়তো কেঁদেছে। কিন্তু ইচ্ছে অনেকদিন হলো চোখের জল ফেলেনি। আর ফেললেও সেই কান্নার কোনো শব্দ ছিল না।
নীরব বুকের মধ্যে দুই হাত গুজে বারান্দার দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দৃষ্টি তার নীচে, ইচ্ছের দিকে। এইতো কয়েক সেকেন্ড আগে নীরব দেখলো ধীর ওদের বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে নেমে দাঁড়ালো। পরমুহূর্তেই ইচ্ছেকে নামিয়ে বাড়ির পিছনের গ্যারেজে চলে গেল গাড়িটা পার্ক করতে। এখনও ও এসে পৌঁছায় নি। ইচ্ছে এখনও যেখানে ছিল সেই খানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। নীরবের মনে হলো, যেনো কোনো পুতুল চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। যার কোনো নড়াচড়া নেই।
নীরবের ইচ্ছে করলো, একবার ইচ্ছেকে ডাকতে। কিন্তু পারলো না। প্রথমে তো গলার স্বর বেরোচ্ছিল না। যদিবা স্বর বেরোলো ধীর ততক্ষনে ইচ্ছেকে নিয়ে বাড়িতে চলে গিয়েছে।
মুখ ফুলিয়ে ফেললো নীরব। ততক্ষণে তাথৈ ওর পাশে দাঁড়িয়েছে। হাতে থাকা কাপ কেকটা দাদার দিকে এগিয়ে দিয়ে লাজুক হাসলো সে। নীরবের রাগ হলো।
– ” হাসছিস কেনো? হাসবিনা একদম। তোর বানানো কাপ কেক আমি খাবো না। নিশ্চয় খুব খারাপ বানিয়েছিস! আমাকে ওইটা খাইয়ে চেক করতে এসেছিস! তাই জন্যে হাসছিস না! তুই খুব খারাপ বোন। যা এখান থেকে। সারাদিনে কথা বলেনি, এখন এসেছে দাদার কাছে, যা বেড়ো এখান থেকে।”
তাথৈ পুনরায় হাসলো। সামান্য লাফিয়ে নীরবের গাল গুলো টেনে দিয়ে বললো, ” তোর দ্বারা রাগ হবে না দাদা। পুরোনো কথা বাদ দে। তোর বিয়ে ইচ্ছে দিদির সাথে, আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে কী বলবো তোকে! ”
তাথৈ ফটর ফটর করেই চলেছে। নীরব চুপ করে বাইরের দিকে তাকালো। ইচ্ছে করছে ওর পাশের দাঁত বের করা মেয়েটাকে এই রেলিং থেকে নীচে ফেলে দিতে। কিন্তু ও যদি ওকে এইখান থেকে ফেলার কথা চিন্তা করছে ওর মা জানে, তাহলে ওকেই না এখান থেকে ফেলে দেয় ওর মা। নীরব মনে মনে শোক প্রকাশ করলো, জীবনে সে কিলার হতে পারলো না মায়ের ভয়ে। ছোটো বেলায় বাবার সাথে খেলতে গিয়ে ও হতো কিলার, যে সবাইকে মেরে চলে যায়। আর ওর বাবা পুলিশ হয়ে ওকে ধরতে ছুটতো।
( চলবে )
{ বিঃ : আগের দিন গল্পে ‘রব ‘ শব্দটি ব্যবহারের জন্যে আমি সত্যিই দুঃখিত। আমার কাউকে হার্ট করার ইন্টেনশন ছিল না। আমি এই ভুল পুনরায় আর করবো না। ক্ষমা করবেন। গল্পে অনেক ঝটকা আছে। তবে সেটা আস্তে আস্তে বলবো। আর পরের পর্বে ইচ্ছে, নীরবের বিয়ে। আর সবাই প্রার্থনা করবেন নীরব যেনো কাশ্মীর ঘুরতে পারে। আপনারা ওদের বিয়েতে কেউ গিফট হিসেবে কাশ্মীরের ট্রিপ টা দিতে পারেন। তাহলে নীরব খুশিই হবে। কাল গল্প দিতে না পারায় আজ বড়ো করে দিয়েছি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।}।