নিরালায় ভালোবাসি
কলমে : তুহিনা পাকিরা
১৭ .
ইচ্ছের মন এই কয়দিনে একটা কথাই বলেছে, যে কোনো মানুষ একটা বোবা মানুষের সঙ্গে থাকতে পারে না। আর এটা তো সত্যি যে, নীরব কতকটা না জেনেই ইচ্ছে কে বিয়ে করেছে। কিন্তু যদি ও জানত যে ইচ্ছে বোবা, কথা বলতে পারে না, ইভেন কখনো পারবেনা তাহলে কি আর ওকে বিয়ে করতো। কখনো করতো না। একটা বিয়ে ইচ্ছের জীবনকে পুরো পরিবর্তন করে দিয়েছে। আরেকটা বিয়েতে ওই কিনা একজনের জীবন নষ্ট করবে এটা কীকরে হয়? হয়তো ওদের দুইজনের সংসারটা দায়িত্ত্ব কর্তব্যের মধ্যে দিয়ে ঠিক চলে যাবে ঠিক কিন্তু ভালোবাসাটা কোনোদিন থাকবেই না।
আকাশে অন্ধকার নেমেছে, সন্ধ্যার শুরু। ইরা নিজের একান্ত আপন বারান্দায় যাবে বলে অনেকক্ষণ ধরে
‘ পিকু ‘ বলে ডেকে চলেছে। কিন্তু ইচ্ছের ধ্যান নেই বললেই চলে। জীবনের পাতা গুলো বড্ড বেদনা দায়ক, চাইলেও ছিঁড়ে ফেলে দেওয়া যায় না। বই প্রেমিরা নিজের বইগুলো একটু বেশিই যত্ন করে রাখে ঠিকই কিন্তু তাতে দাগ লাগলে সেই দাগ মুছতে যেমন পারে না, তেমনি পাতাটা বাদ দিতেও পারে না। ইচ্ছের জীবনটাও বুঝি তেমন। পুরোনো পৃষ্ঠাটা যে আবার এইভাবে খুলে যাবে তা ও ভাবেই নি। নাহলে আর ধীরের বিয়ের পরের দিন সেই বাড়িটার দিকে নজর যায় ইচ্ছের। সেই বাড়ি যেখানে বিয়ে হয়ে যাবার আগে নিজের জন্যে কোনো নতুন সংসারের স্বপ্ন ইচ্ছে দেখেনি। দেখেনি স্বামী নামক মানুষটাকে ভালোবেসে যত্ন করে একসঙ্গে বাঁচার তাগিদ। তবুও বিয়ের পর আপন করতে চেয়েছিল সব কিছু। কিন্তু বিয়ের একটা সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই বুঝতে পারে যাদের আপন করতে ও চায় তারা তো শুধু কয়েকদিনের জন্য এই বাড়িতে ওকে স্থান দিয়েছে। আসলে ইচ্ছে এসেছিল সুবীরের ঠাম্মার পছন্দ হয়ে। রিনু দেবী তখন বিছানায় শয্যাশায়ী। ইচ্ছের শাশুড়ি আর ননদ ছিল যারা কোনোদিন ইচ্ছেকে দেখতে পারতো না। শ্বশুরকে এসে থেকে ইচ্ছে কোনো দিনই দেখেনি। আর সুবীর, তাকেও ইচ্ছে দেখেনি। আসলে বিয়ের দিন নিজের কষ্টে বিয়ের আসরে বরের মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাতে সে পারেনি। তবে ইচ্ছে নীরবের মুখটা দেখেছিল, মানুষটাকে দেখেই বুঝেছিল ঘাড় থেকে একটা বোঝা নেমেছে।
বিয়ের পরের দিন রাতেই সুবীর গিয়েছিল রানীগঞ্জ। সেই খানেই ছিল তার কর্মস্থল। শুধু কি কর্মস্থল! যা ইচ্ছে বুঝেছিল মাস কয়েক পরে। ইচ্ছেকে প্রতিদিন সকালে সবার আগে ঘুম থেকে উঠতে হতো। ঘরের কাজ তো শুধু না, ছিল শয্যাশায়ী রিনু দেবীর দেখাশোনা। তাকে ঠিক সময়ে ঘুম থেকে তুলে ফ্রেশ করানো, খাওয়ানো, ঔষুধ থেকে শুরু করে আরও কতো কী। এছাড়াও ছিল শাশুড়ির সেবা থেকে শুরু করে ননদের প্রতিটা ফাইফরমাশ। ইচ্ছে কাজ যে একেবারেই জানত না তা নয়। জানতো কিছুটা। কিন্তু সেই জানা দিয়ে এতো কাজ সে সামলে উঠতে কোনো কালেই পারতো না। ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠলেও সব কাজ সেরে যে একটু রেস্ট সে পাবে সেটুকুও ছিল না। রাতে ঘুমাতো ননদের ঘরের বারান্দায়। স্বামীর ঘরে সে কোনোদিনই যেতে পারে নি। আর ননদ, সে তো তাকে নিজের ঘরে বিছানা তো দুরস্থ মেঝেতেও শুতে দেয়নি। ঘরে কোনো বাইরের লোকের অনুপস্থিতে সে তো তার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে কথা বলতে পারবে না।
সারাদিনের খাটা খাটুনির পর নিজের শরীর এলিয়ে দিতো ইচ্ছে ওই বারান্দার মেঝেতে। চোখ বন্ধ করলেও কোনো দিন ঘুম হানা দিতো না। হানা দিতো অজস্র চোখের জল, ভিজে যাওয়া স্যাঁতস্যাঁতে বালিশে শুতেও অসস্তি হতো। মনে পড়ে যেত নিষ্ঠুর মানুষটার চোখদুটো, মনে পড়তো তার হাসি মুখ। যা দেখলেই মনে হতো, সে খুব ভালো আছে। পিঠের উপর থাকা বোঝা নামলে সকলের খুব ভালো লাগে। প্রতিদিন ইচ্ছে নিজেকে শাঁসিয়ে যেতো। নিজের স্বামী ছেড়ে অপর এক পুরুষকে চিন্তা করতে রোজ তার গায়ে লাগতো। রোজ নিজের কাছে নিজে লজ্জিত হতো। কিন্তু প্রতিদিন গভীর রাতে ওই পরপুরুষ নীরবের মুখটাই ভেসে উঠতো।
এই সবের মাঝেও ইচ্ছে থেকে গিয়েছিল সুবীরের বাড়িতে। ততদিনে সে বুঝেও গিয়েছিল ও শুধু মাত্র একটা বাড়তি ঝামেলা। যাকে সবাই নিজের ঘাড় থেকে দূর করতে চায়। বুঝেছিল সুবীর কর্মসূত্রের জন্যই কেবল রানীগঞ্জ থাকে না। থাকে নিজের সংসারের জন্যে, নিজের স্ত্রী, সন্তানের জন্যে। ইচ্ছের ভাবলে আজও খুব হাসি পায়, শুধু মাত্র ওকে তাড়ানোর জন্যে সবাই এমন জায়গায় ওকে বিয়ে দিয়েছে যেখানে তারা দেখেও নি সেই পরিবারটা আদৌ ভালো কী না! এখন কার দিনে বাড়িতে কাজের লোক রাখলেও যেখানে তার সকল তথ্য সংগ্রহ করা হয়। সেখানে নিজের বাড়ির মেয়েটাকে কোথায় পাঠিয়েছিল তারা জানেনি, আর না ইচ্ছে জানিয়েছিল। আসলে ও সেচ্ছায় জানায়নি, কারণ ও জানতো হয়তো এটাই শুনতে হবে যে, সুবীরের দোষ দিয়ে নীরবের কাছে ফিরে আসার চেষ্টা করছে ইচ্ছে।
রিনু দেবী জানতেন তার নাতি বিবাহিত। কিন্তু সুপ্তিকে তিনি কোনোদিন মানতে পারে নি। তাই সুবীর নিজের স্ত্রী কে নিয়ে রানীগঞ্জ থাকতো, যা রিনু দেবীকে জানায়নি কেউ। কিন্তু তিনি মারা যাবার আগে যখন জানতে পারেন যে তার একটা বংশধর ও রয়েছে, তখন তিনি গলে যান নতির উপর। তার তো ইচ্ছে ছিল নাতির ছেলে দেখে মরার। আর তাই হয়েছিল। কিন্তু ইচ্ছের জীবন নষ্ট করার কোনো শোক তার মধ্যে ইচ্ছে দেখেনি। সেই মুহূর্তে ইচ্ছে ছিল বাড়তি এক সমস্যা। যা মাথা চারা দিয়ে তো আগে থেকেই ছিল। তবে আজ থেকে বেশি হলো। আর সেই সমস্যাকে তাড়ানোর প্রক্রিয়াও ছিল অসাধারণ। যা ইচ্ছের জীবনের নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে আজও, এবং আগামী দিনেও তাই করবে।
– ” দিদি , তাড়াতাড়ি নীচে আয় নীরব দা এসেছে। ”
এই নিয়ে কম করে অনেকবারই নীর ইচ্ছেকে নীচে যেতে ডেকেছে। কিন্তু এইবারই কেবল বললো, নীরব এসেছে। ইচ্ছে খুশি হলো নীরব এসেছে শুনে। তাই পুরোনো স্মৃতির বক্সটা বন্ধ করে ও ইরাকে নিয়ে নীচে ছুটলো। নীচে তখন নীরব আর নীর কথা বলছে।
– ” শোনো নীরব দা, আমরা সকলে তপতী বৌদিদের গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি, তুমি জানো তো? ”
পাশ থেকে ধীর ধমকে উঠল, নাম ধরে বৌদি কি, শুধু বৌদি বল।
– ” ওহ হ্যাঁ, বৌদি। সে যাইহোক। নীরব দা তুমি কিন্তু ইচ্ছে দিদিকে দেখে রাখবে। আমরা তো কেউ কয়দিন থাকবোনা। মনে থাকবে? ”
নীরকে পাশে এনে বসিয়ে দেয় নীরব।
– ” আচ্ছা, আমি তোর দিদিকে সাবধানে দেখে রাখবো হয়েছে। ”
ইচ্ছেকে নীচে নামতে দেখে তপতী ওকে ডাকে ওকে, ” এই তো ইচ্ছে এসে গেছে। দেখো তোমাকে নীরব নিতে এসেছে। না দেখে থাকতে পারছে না তো।”
লজ্জা পেয়ে যায় ইচ্ছে। নীরব উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ” তেমন কিছু না বৌদি। আসলে মা ও তো তোমাদের সাথে যাবে। মায়ের তো প্যাকিং এখনও হয়নি তাই ইচ্ছেকে ডাকলো। ”
নীরবের পিছু পিছু ইচ্ছেও বেরিয়ে যায়। এগিয়ে যায় নিজের সংসারের দিকে।
( চলবে )