নিরালায় ভালোবাসি
কলমে : তুহিনা পাকিরা
১৯ .
সুবীরের ঠাম্মা মারা গিয়েছে দুই সপ্তাহ হবে। আর তার পর থেকেই শুরু হয়েছে ইচ্ছের উপর আরেক অত্যাচার। আজ বাড়িতে সুবীর এসেছে। ঠাম্মা মারা যেতে একবার স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে এলেও আজ আবার এসেছে। নিহি আর দ্বীপ রয়েছে নিহির বাবার বাড়ি। সে এখনও অবধি জানে না ইচ্ছের বিষয়ে। তবে ইচ্ছেকে দেখে কিছুটা সন্দেহ তার মনে তৈরি হয়েছে বটে। কিন্তু সেই সন্দেহের সত্যটা বিচার করার আগেই সুবীর ওদের ওর বাবার বাড়িতে নিয়ে চলে গিয়েছিল। আজ সুবীরের এই বাড়িতে আসার অন্যতম কারণ মাথার উপর থাকা চিন্তাকে টান মেরে ফেলে দেওয়া। নিহিকে সে জানাতে চায় না বিয়ের ব্যাপারে। তাই আজ একেবারে ডিভোর্স পেপার তৈরি করেই এনেছে। সুবীর নিজে সাইন করে দিয়েছে, এইবার কেবল ইচ্ছের একটা সাইন আর পেপারটা কোর্টে জমা করলেই চলে।
– ” এই যে তাড়াতাড়ি সাইন টা করুন দেখি। আজ এটা কোর্টে জমা করতে হবে। কাল শনিবার কোর্ট বন্ধ। আমি এই বিষয়টা তাড়াতাড়ি শেষ করতে চাই।”
সুবীরের তীক্ষ্ম গলা শুনেও ইচ্ছে সাইন করলো না। গত কয়েকদিন আগেই সে ডিভোর্স পেপারটা শাশুড়ির হাত থেকে পেয়েছে। কিন্তু সাইন সে করতে চাইছে না। আবার হয়তো চায় এই সম্পর্ক থেকে মুক্তি পেতে। চোখের কোণের জল টুকু আঙ্গুল দিয়ে মুছে নিয়ে সুবীরকে দেখলো। এটাই ভালো করে সুবীরকে দেখা। বিয়ের আগে সবাই বলেছিল ছেলে একেবারে রাজপুত্র। হ্যাঁ তাই, সুবীর রাজপুত্রই বটে। কিন্তু সব রাজপুত্রের মধ্যে ভালো, স্নেহ , মায়া, মমতা লুকিয়ে থাকে না। কেউ হয় অহংকারী, খারাপ, বর্বর শ্রেণীর। আর সুবীর ও সেই গোত্রীয়।
– ” কী হলো কানে যাচ্ছে না? আমার ছেলে সেই থেকে তোমাকে সাইন করতে বলছে আর তুমি স্ট্যাচুর মত দাঁড়িয়ে আছো।”
– ” ক্ষমা করবেন মা, আমি সাইন করতে পারবো না। আপনার ছেলে ওনার স্ত্রীর সঙ্গে থাকুক আমি কোনো দিন কিছু অধিকার চাইবো না। শুধু আমি এই বাড়ি ছেড়ে যাবো না। আমি না হয় আগের মতই থাকবো। ”
সুবীর ক্রোধের আগুনে জ্বলতে শুরু করলো। বললো, ” অনেকক্ষণ ধরে আমি এক কথা শুনছি। যা বলছি তাই কর। আর আমি ডিভোর্স দিলে তোরই তো সুবিধা। পাশের বাড়ির ছেলেটাকে নাহয় বিয়ে করে ফেলবি। তাতে কী।”
ইচ্ছে ভালো মতোই বুঝেছে সুবীর কার কথা বলছে। একবারের জন্য অবশ্য নীরবের কথা শুনে বিস্মিত হয়েছিল। তবে পরক্ষণেই তাচ্ছিল্যের হাসি পেলো তার। মনের জমানো ক্ষেদ বলে দিলো, ” আমি তো তাকে বিয়ে করবো বলিনি। আমার বিয়ে আপনার সাথে হয়েছে। আর সারাজীবন তাই থাকবে। আপনি আপনার স্ত্রী কে নিয়ে থাকতে পারেন আমার কোনো সমস্যা নেই। ”
রাগের মাত্রা যেনো সুবীরের বৃদ্ধি পেলো। কথায় বলে রাগ মানুষকে ধ্বংস করে দেয়। কথাটা শতভাগ সত্যি। কিন্তু রাগের প্রভাব যার জীবনে পড়ে তাকে হয়তো রাগী ব্যাক্তির থেকেও বেশি খেসারত দিতে হয়। তাই বোধহয় সুবীর করলো ইচ্ছের উপর। রাগে ইচ্ছের গলাটা টিপে ধরলো। মাথা তার এমনিই সবসময় গরম থাকে।
– ” ডিভোর্স আমার চাই ইচ্ছে। আপনি কি বুঝতে পারছেন না!”
ইচ্ছে হয়তো বুঝতে পেরেছিল নিজের পরিণতি। আসলে ও নিজেই নিজের জীবন থেকে মুক্তি চেয়েছিল। তাইতো সুবীরকে পুনরায় রাগিয়ে দিয়ে বলেছিল, দেবোনা ডিভোর্স, দেবোনা।”
এরপর ইচ্ছের আশঙ্কাই ঠিক হলো। কোনো মানুষের সাথে খুব খারাপ হবার আগেই বোধহয় সে বুঝে যায়, যে কিছু হবে। আর তাই হলো। ইচ্ছের শ্বাশুড়ি আর ননদ তখন দাঁড়িয়ে মজা দেখতে ব্যস্ত। তারাও চায় ইচ্ছেকে তাড়াতে। নিজের পরিবার, নিজের ভালোবাসার মানুষ নীরব সকলের দূর করতে চাওয়া ইচ্ছেকে, এক ঝটকায় সুবীরই দূরে ঠেলে দিলো। হটাৎই এক তীব্র ঝাঁকুনিতে ইচ্ছে গিয়ে পড়লো সামনের কাঁচের সেন্টার টেবিলের উপর। টেবিলটা ছিল নীঁচুতে, তার উপর ছিল সুবীরের ঠাম্মার ছবি। আরও কিছু কাঁচের ফুলদানি ছিল সেখানে। যার মধ্যে রজনীগন্ধার গন্ধে মো মো করছে। হঠাৎই ঝন ঝন শব্দে কাঁচগুলো ভেঙে গেলো। উপস্থিত তিনজনেই চমকে তাকিয়ে রইল মেঝের কাঁচ ভাঙার দিকে। আসতে আসতে জায়গাটা রক্তে ভরে উঠলো।
ঠিক তখনই একরকম ছুটতে ছুটতে বাড়িতে ঢুকছিল দ্বীপ। এখন তার খুব আনন্দ। এতদিন একা একা মা বাবার সঙ্গে থাকলেও এখন ও জানে ওর একটা দিদুন আছে, পিপি আছে। কায়কদিন আগে যখন ও এই বাড়িতে এসেছিল তখন দিদুন আর পিপি ওকে খুব আদর করেছে। তাছাড়া এইবাড়িতে একটা দিদিও আছে, ইচ্ছে দিদি। যদিও বা দ্বীপ, ইচ্ছের কাছে যায়নি তবে দূর থেকে দেখে ওর ইচ্ছে দিদিকে বেশ লেগেছে। কেমন যেনো পুতুল, পুতুল। পিপি ওকে বলেছে ওই মেয়েটা ইচ্ছে, এই বাড়িতে কাজ করে, ও ছেলেধরা ওকে নিয়ে পালিয়ে যাবে। তবে দ্বীপের সেই সব মাথায় ঢোকেনি। পুতুল বুঝি ছেলে ধরা হয়! দ্বীপের মতে দিদিটা খুব কিউট। পুরো রসগোল্লার মতো মিষ্টি। নামটাও কী ভালো। দ্বীপ কে ওর মা বলেছে, ইচ্ছে যাদের নাম হয় তারা সবার ইচ্ছে পূরণ করে। ওর ও করবে। দ্বীপ তাই মাকে সঙ্গে করে এই বাড়িতে চলে এসেছে।
তবে দ্বীপের আনন্দ থেমে গেলো প্রথমে নিজের বাবাকে দেখে। পরে রক্তাক্ত ইচ্ছেকে দেখে। এতো রক্ত তার ছোটো শরীর টা সহ্য করতে পারলো না। কেমন এক শ্বাস কষ্ট শুরু হলো। ছেলের ডাকে সুবীর সহ ওর দিদুন ও পিপির ও হুশ ফিরল। তাদের মাথা যেনো ব্লাইন্ড হয়ে রয়েছে কী করবে ভেবে। নিহি গাড়ি ভাড়া মিটিয়ে বাড়িতে ঢুকে ছেলের অবস্থা দেখে ভীষণ ভয় পেলো। তবে সামনে থাকা রক্তাক্ত শরীর যেনো ওকে এক মুহূর্তের জন্যে নিষ্ক্রিয় করে দিলো। চিৎকার করে নিহি বলে উঠলো, ” কী হয়েছে মেয়েটার? ”
সুবীর, ওর মা – বোন কিচ্ছুটি বলতে পারলো না। শেষে কিনা তারা কাউকে খুন…. ভাবতেই শিউরে উঠলো ওরা। ইচ্ছে তখন কাটা মুরগীর মতো ছটফট করছে। মাথা, গলা, হাত, মুখ দিয়ে রক্তের স্রোত বইছে যেনো।
জ্বলতে থাকা হাতে কিছু স্পর্শ হতেই ব্যাথায় পিছিয়ে গেলো ইচ্ছে। ব্যথাটা কিছুক্ষণ আগের গরম চা পড়ে যাওয়ার জন্যে না সেই ভয়ঙ্কর দিনের ব্যথার অনুভূতি কিনা সেটা ইচ্ছে বুঝতে পারলো না। সামনে বসে রয়েছে নীরব। নীরব হাতটা ভালো করে ধুঁয়ে মলম লাগাতে শুরু করলো। ইচ্ছের চোখটা জলে ঝাপসা হয়ে এলো। সেই দিন ইচ্ছে মরে গেলে কি খুব ক্ষতি হতো! তবে নীরব হয়তো এই মুহূর্তে ওকে সহানুভূতি দেখাতো না।
নীরব ইচ্ছেকে উঠে দাঁড়াতে বললো। কিন্তু ইচ্ছে এক ভাবে মেঝেতে বসে রয়েছে। নীরবের কথা তার কানে যাচ্ছে না।
– ” কী রে ওঠ!”
ইচ্ছে মুখ তুলে নীরবের দিকে তাকালো। নীরব কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ইচ্ছে না ওঠায় নীরব ইচ্ছেকে কোলে তুলে নিলো। ইচ্ছেকে বিছানায় বসানোর আগেই নীরব বলে উঠলো,
” বাপরে, দিন দিন কী ভারী হচ্ছিস! ”
নীরব বোধ করি ভেবেছিল ইচ্ছে রেগে যাবে। কিন্তু সে কিছুই বললো না। চুপ করে নীরবের বসিয়ে দেওয়া জায়গায় হেলান দিয়ে বসলো।
( চলবে )