তুমি_নামক_নেশা Part: 12 ( Last )
#Sabrina_Khanam
সময় আর স্রোত কখনো কারো জন্যে থেমে থাকেনা। এরা এগিয়ে যায় নিজের মতো। মিহির এক্সিডেন্টের পর ৩ মাস পার হয়ে গিয়েছে। মিহি এখন আয়াশের বাড়িতেই থাকে। মিহির হয়তো তার এক্সিডেন্টের আগের কোনো ঘটনাই স্মৃতিতে নাই। প্রথমে মিহির এই ঘটনায় সবাই কষ্ট পেলেও এখন সবাই খুব খুশি। মিহির জীবন থেকে অনেক ভয়াবহ একটা অধ্যায় চলে গেছে। হয়তো আর কখনো ফিরেও আসবে না। আর কেউ চায়না সেই স্মৃতি ফিরে আসুক। এতোদিনে মিহির আয়াশের প্রতি ভালোবাসা অনেক মজবুত হয়ে গেছে। ২ জনের মধ্যে বোঝাপড়া খুব ভালোই। আর আয়াশ আগের চেয়েও মিহির প্রতি বেশি দূর্বল হয়ে গিয়েছে। আবির এখনো মাহির পিছে ঘুরে। মাহিও আবিরের প্রতি দূর্বল, কিন্তু সেটা মাহি আবিরকে বুঝতে দিতে চায়না। কারণ মাহি নিজের সাথে আবিরকে জড়াতে চায়না। মিহির মামী আর রিসা এখনো আগের মতোই রয়ে গিয়েছেন। স্বভাব একটুও বদলায়নি তার। রিয়ান দেশে ফেরার পর যখন মিহিকে খুঁজে তখন মিহির মামী রিয়ানের কাছে মিহির ব্যপারে যা নয় তাই বলে। রিয়ান তার মায়ের কথা বিশ্বাস করেনি। রিয়ান মিহিকে অনেক খুজেছে। কিন্তু পায়নি। প্রথমে তো রিয়ান পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল। ১টা মাস রিয়ানের অনেক খারাপ কেটেছে। এরপর রিয়ান নিজের পরিবারের জন্য নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়েছে। দেশে ফেরার ২ মাস পরই আবার কানাডায় ফিরে যায় রিয়ান। রিয়ান আদও জানেনা মিহি বেচে আছে নাকি নেই। মিহি কেমন আছে তা জানেনা রিয়ান। সে এখন শুধু মিহির জন্যে দোয়া করে, যাতে তার ভালোবাসা যেখানেই থাকে ভালো যেন থাকে।
____________________________
ড্রইংরুমে বসে আছে মিসেস আসমা, আজান আর মায়া। তারা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলছেন। তাদের কথার প্রসঙ্গ হল আয়াশ আর মিহি। মিসেস আসমা আজানকে বললেন,,,
মিহি এখন অনেকটাই সুস্থ। আর সে আয়াশের সাথে এখন অনেক কমফোর্ট ফিল করে বলে আমি মনে করি। এখন যত জলদি আয়াশ আর মিহির বিয়েটা দিয়ে দেওয়া যায় ততই ভালো মনে হয়। কি বল তোমরা?
আজান বলল,,, মা তুমি যদি চাও আমার কোনো দ্বিমত নেই এতে। তবে আয়াশ আর মিহিকে একবার জিজ্ঞেস করে নেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।
মিসেস আসমা মায়াকে প্রশ্ন করলেন,,, আর তুমি কি বল মায়া?
মায়া বলল,,, মিহিকে যত জলদি আমি আমার জা করে নিতে পারি তত বেশি আমি খুশি। আমার এই বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই।
মিসেস আসমা বললেন,,, তাহলে আয়াশ আর মিহির থেকে জানা যাক?
আজান আর মায়া একসাথে বলল,,, হুম।
মিসেস আসমা বললেন,,, তাহলে আজান তুমি আয়াশের মত জেনে আমায় জানাও আর মায়া তুমি মিহির মতামত জেনে আমায় জানাও।
আজান আর মায়া একসাথে বলল,,, জ্বি মা।
_________________________
আজান আর আয়াশ বাগানে কফি নিয়ে বসে আছে। দুই জনের মধ্যেই নীরবতা বিরাজ করছে। আজান নীরবতা ভেঙে বলা শুরু করল,,,
ভাই তোর কি সিংগেল হয়ে জীবন পার করার ইচ্ছে আছে নাকি?
আয়াশ ভ্রু কুচকে আজানের দিকে তাকালো। তারপর হালকা হেসে উত্তর দিলো,,,
আমার সাথে মজা করছ? তুমি তো জানোই ভাইয়া।
,,,হ্যাঁ তা জানি। বিয়ে করবিনা?
,,, আমাকে যদি বল যা এখনই মিহিকে বিয়ে কর আমি রাজী।
,,,এতো বিয়ে পাগলা তুই??
,,,উহু, মিহি পাগলা আমি।
,,, মা এখন তোর আর মিহির বিয়ে দিতে চাইছে। তোর মতামত জানতে চেয়েছে মা।
আজানের কথা শুনে আয়াশ চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকালো। উত্তেজিত হয়ে সে জিজ্ঞেস করল,,, সত্যি বলছ ভাইয়া?
আজান কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল,,, নাহ আমি মিথ্যা বলছি। শুধু তুই সত্যি শুনেছিস।
আয়াশ দাড়িয়ে পরল। তারপর বলল,,, আমি রাজী ভাইয়া। তবে মিহি?
,,, মায়া জিজ্ঞেস করতে গিয়েছে ওকে। তোর কি মনে হয় মিহি রাজী হবে?
,,, অবশ্যই রাজী হবে।
,,,এতো শিউর?
,,, না করার চান্স ই নাই।
আজান ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করল,,, কেন?
আয়াশ মেকি হাসি দিয়ে বলল,,, এমনি।
মায়া আর মিহি বসে বসে গল্প করছে। আর তাদের পাশেই মায়ান খেলা করছে। তাদের গল্প মায়ানকে নিয়ে, মায়ানের দুষ্টুমিগুলো নিয়ে। মায়া এর মাঝেই মিহিকে প্রশ্ন করলো,,
যদিও আমি জানি আমার দেবরকে তোমার কেমন লাগে। তার প্রতি তোমার ফিলিংস কি? তবুও তোমায় প্রশ্ন করছি, আমার দেবরটাকে বিয়ে করবে মিহি?
মিহি মায়ার দিকে তাকালো। তারপর লাজুক হেসে চোখ নামিয়ে নিলো।
মায়া মিহির হাত ধরে বলল,,, মা জলদিই তোমাদের বিয়েটা সেরে ফেলতে চাইছে। তুমি যদি রাজী হও তবে…
মিহি প্রশ্ন করল,,, আয়াশ রাজী?
মায়া বলল,,, আমার দেবর যে এই কথা শুনে ডান্স করেছে খুশিতে কতক্ষণ সেটা আমি ভালোই জানি। সে তো খুশিতে আটখানা।
মিহি মিষ্টি করে হেসে চোখ নামিয়ে বলল,,, আমি রাজী ভাবি।
মায়া আলহামদুলিল্লাহ বলে মিহিকে জড়িয়ে ধরল। তারপর মিহিকে বলল,,, তাহলে আমার জা হওয়ার জন্যে তৈরি হন ম্যাডাম।
_____________________________
মিহি বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। সে একমনে আয়াশের কথা চিন্তা করছে। আর চিন্তা করছে তাকে কতগুলো মানুষ কিভাবে আপন করে নিয়েছে। অথচ সে এই মানুষদের চিনেই না। চাইলেও সে তার জীবনের পুরোনো ঘটনা মনে করতে পারেনা। মিহি চিন্তা করে সে তার অতীত আর মনে করতেও চাইবে না। তার বর্তমান আর ভবিষ্যৎ জুড়ে শুধুই আয়াশ। তার মন ও মস্তিষ্কে শুধুই আয়াশ বিরাজ করবে। এহেন সময় পিছনে থেকে কেউ মিহির দুই চোখ চেপে ধরল। মিহি চমকে উঠলেও পরে বুঝতে পারলো কে এই মানুষ। এই মানুষ তো এখন তার জীবনের সাথে অতপ্রোতভাবে জুড়ে যাচ্ছে। মিহি তাও একটু ভাব নিয়ে বলল,,,
আপনি কি স্বাভাবিকভাবে আসতে পারেন না আয়াশ?
আয়াশ মিহিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,,, অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে আমার জীবনে যে তুমি এসেছিলে, সেই বেলায়? এখন আমি তার শোধ তুলছি বুঝেছ?
মিহি আয়াশকে প্রশ্ন করল,,, অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে মানে?
আয়াশ বলল,,, এতো বুঝে কাজ নেই তোমার। তুমি রাজী তো আমার হতে?
মিহি চোখ নামিয়ে নিল। আর বলল,,, হুম।
আয়াশ মিহিকে জড়িয়ে ধরে বলল,,, তোমাকে নিয়ে আমার জীবনটাকে আরো রঙিন করে তুলতে চাই মিহি।
মিহি উত্তর দিলো,,, তোমার জীবন রাঙাতে পারলে আমি স্বার্থক আয়াশ।
_____________________________
আমার ভালোবাসাকে কেন গ্রহণ করতে চাইছো না মাহি? কি দোষ আমার? মাহিকে প্রশ্ন করল আবির।
মাহি বলল,,, আপনার ভালোবাসা গ্রহন করতে পারব না আমি।
,,, কেন?
,,,আমায় ভালোবাসাটা আপনার ভুল।
,,,তোমায় ভালোবাসা আমার ভুল? হাসালে।
,,,আমি সত্যি বলেছি। আমায় ভালোবেসে আপনি ভুল করেছেন। আমি কখনো আপনার হতে পারব না।
,,, কেন? কি কমতি আমার?
,,,কমতি আমার, আপনার না।
,,,কোথায় আমি তো কোনো কমতি খুজে পাইনি তোমার মধ্যে।
,,,আজ পর্যন্ত মিহিও জানতে পারেনি, আপনি কিভাবে জানবেন?
,,, মাঝে মাঝে আমার মিহি ভাবির প্রতি হিংসা হয়। আমি কেন তোমার ওতোটা আপন হতে পারিনা?
,,, যাহ মিহি তো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, ছোটবেলার বন্ধু, ওর সাথে আপনার হিংসা করলেও তো তা মিলবে না।
,,,হ্যাঁ তাইতো, আমিও তোমার পাশে থাকতে চাই। মিহি ভাবির মতো জায়গা চাইনা তোমার কাছে। শুধু চাই তোমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকতে।
,,,সেটা সম্ভব না আবির।
,,, কেন?
,,, শুনবে?
,,,হুম
,,, আপনি কিভাবে একজন ধর্ষিতাকে মেনে নিবেন আপনার জীবনে আবির?
আবির মাহির কথায় অবাক হয়ে গেল। সাথে মাহির জন্য কষ্টও পেলো। আবার রাগে নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিল আবির। তবে রাগটা সেই মানুষদের প্রতি যারা এই হীন কাজ করেছে, মাহিকে কষ্ট দিয়েছে।
মাহি আবার বলতে লাগলো। বলল,,,
একজন ধর্ষিতাকে জেনে শুনে কেউ বিয়ে করেনা আবির। আর আমি কাউকে ঠকাতে চাই না। তাই এই সত্য প্রথম আপনাকেই বললাম। আমি আসি। আল্লাহ হাফিজ।
মাহি চলে যাওয়ার জন্য পিছে ফিরলো। ঠিল তখনই আবির মাহির হাত ধরে টেনে ওকে নিজের কাছে নিয়ে নিল আর বলল,,,
কি মনে কর তুমি নিজেকে?
,,, আমি নিজেকে কি মনে করি? ধর্ষিতা মনে করি নিজেকে।
আবির মাহির ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে চুপ থাকতে বলে আবার বলা শুরু করল,,,
তুমি আমার ভালোবাসা। কোনো ধর্ষিতা নও তুমি। যারা তোমার ক্ষতি করেছে তারা ধর্ষক। আর তুমি আমার ভালোবাসা, যাকে আমি আমার চিরসঙ্গীনি করতে চাই।
মাহির চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরল। তবে সেটা আনন্দের।
আবির মাহির চোখের জল মুছে দিয়ে বলল,,,
এই চোখ থেকে যেন আর কখনো জল না পড়ে।
মাহি মুচকি হেসে আবিরকে জড়িয়ে ধরল। আবিরও মাহিকে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকে মিশিয়ে নিলো।
_______________________________
মিহি আদ্রিয়ানকে জামা পড়িয়ে দিচ্ছে। আর আদ্রিয়ান নিজের মতো দুষ্টুমিতে মেতে আছে। মিহি আদ্রিয়ানকে জামা পড়িয়ে দিতেই সে মিহিকে জিজ্ঞেস করল,,,
মাম্মা পাপা কখন ফিরবে?
,,,এইতো কিছুক্ষণের মধ্যেই বাবা।
,,,আজ কিন্তু আমি পাপার হাতেই খাব।
,,হ্যাঁ তোমার পাপা ফিরে একটু রেস্ট নিক, তারপর বলিও।
,,, আচ্ছা।
আদ্রিয়ান হল আয়াশ আর মিহির ছেলে। তার বয়স ৬ বছর। মিহি আর আয়াশের বিয়ের ১ বছর পরই তাদের কোলজুড়ে আসে আদ্রিয়ান। ইতিমধ্যে প্রায় ৮ বছর পার হয়ে গেছে। তাদের বিয়ের এক বছর পরই মাহি আর আবির বিয়ে করে নিয়েছে। এখন তাদের একটা ২টা জমজ ছেলে আছে। নাম জাহিদ আর জিহাদ। কিছুক্ষণ পর আয়াশ ফিরে এলো। মিহি আয়াশকে জিজ্ঞেস করল,,,
আজ দিন কেমন কাটলো স্যার এর?
,,, ভালো, তোমাদের?
,,,হুম ভালো।
,,, আমার আদ্রিয়ান কই?
,,,বসে আছে, তোমার হাতে খাবে বলে।
,,,ওহ, খাবার রেডি কর, আমি আসছি।
আয়াশ ফ্রেশ হতে চলে গেল। আর মিহি চলে গেল তার কাজে। রাতে সবাই খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ল।
রাতে মিহি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। সে চিন্তা করছে কিভাবে এতোগুলো বছর কেটে গেল। এখন তার নিজের সংসার আছে, সাজানো সুখের একটা জীবন তার। আয়াশ এসে পিছন থেকে মিহিকে জড়িয়ে ধরল। মিহি আয়াশকে জিজ্ঞেস করল,,,
আদ্রিয়ান তো ঘুমিয়ে গিয়েছে?
,,, হ্যাঁ, আজ তার বাবার প্রতি বেশি ভালোবাসা আসছিল।
,,,হুম।
,,, কি চিন্তা করছ?
,,, চিন্তা করছি যে এখন আমি পরিপূর্ণ। আপনি আমায় নারী হিসেবে পুর্ণতা দিয়েছেন।
,,, তুমিও তো তোমার নেশায় আমায় পরিপূর্ণ করেছ মিহি।
,,,হুম।
,,,মিহি?
,,,বল।
,,, আমি কখনো চাইনা আমার এই তুমি নামক নেশা কখনো কেটে যাক।
,,, আমিও চাইনা।
…………………………………………….
এবার তো একটা বিয়ে করে নে রিয়ান,,, ফোনে রিয়ানকে তার মা বলল।
রিয়ান উত্তর দিল,,, মা আমি আমার কর্মজীবন নিয়ে অনেক ভালো আছি। আমায় প্লিজ এসবে জড়িয়ো না।
,,, এভাবে তো জীবন চলেনা বাবা।
,,, আমার সাথে এটা নিয়ে কথা বলোনা প্লিজ। ভালো থেকো। রাখলাম।
রিয়ান তার মাকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দিল। তারপর মিহির ছবি বের করে বলল,,,
জানিনা তুই কোথায় আছিস? যেখানেই আছিস ভালো থাকিস। তোর প্রতি যে তুমি নামক নেশা কাজ করে সেটা অন্য কাউকে বিয়ে করলেও যাবেনা। আমি কাউকে ঠকাতে চাই না। আমি তো এভাবেই খুব ভালো আছি। তাও শুধু তোর কমতি রয়ে গেল। তাও আল্লাহ যাতে তোকে পরিপূর্ণ রাখে। তোর প্রতি এই তুমি নামক নেশা আর তোর স্মৃতি নিয়েই কাটুক না আমার জীবন।
_________________সমাপ্ত___________________
[ আপনারা এই গল্পটাকে যে পরিমান ভালোবেসেছেন আমি সত্যিই খুব খুশি। কিছু সমস্যার কারনে আমায় জলদি এই গল্পটা শেষ করে দিতে হল। আসলে আমার নিজেরই মন ভালো নেই। কিছু না পাওয়ার দুঃখ আর হারিয়ে ফেলার ভয় আমায় গ্রাস করছে। দোয়া করবেন আমার সকল দোয়া যাতে কবুল হয়। আমি আবার ৩ মাস পরে আবার এলো যে সন্ধ্যা নাম নিয়ে নতুন গল্প নিয়ে ফিরে আসব। আমায় আবার কেউ ভুলে যাইয়েন না। আজ সাইলেন্ট রিডার্সদের সাড়া চাই আমি। সবাই ভালো থাকবেন। আল্লাহ হাফিজ। ]