প্রণয় প্রহেলিকা পর্ব-৬

0
1388

#প্রণয়_প্রহেলিকা
#৬ষ্ঠ_পর্ব

কিন্তু কথায় আছে, “যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়”। দীর্ঘ প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলে ক্লাসের দিকেই পা বাড়াতেই মুখোমুখি হলো দিগন্তের। তীর্যক নয়নে সে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটি তার বন্ধুদের একজন। ধারা কিছু বলার পূর্বেই সে শান্ত স্বরে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
“অনল স্যারের সাথে তোর কি সম্পর্ক?”

প্রশ্নটি শুনতেই পিলে চমকে উঠলো ধারার। চুরি করতে যেয়ে অপরিপক্ক চোরেরা ধরা পড়ে গেলে যেমন আমতা আমতা করে ঠিক তেমন আমতা আমতা করতে লাগলো সে। মস্তিষ্কটা হুট করেই যেনো ল্যাপটপ এর উইন্ডোজ শাটডাউনের মতো বন্ধ হয়ে গেছে। উত্তরটা অতি সরল তবুও যেনো ভাষা হারিয়ে ফেলেছে ধারা। আমতা আমতা করে বললো,
“কিসের সম্পর্ক, কোনো সম্পর্ক নেই! উনাকে তো এর আগে আমি দেখি নি”
“অনল স্যারের বাইক থেকে তোকে নামতে দেখেছি আমি, ঝেড়ে কাশ। লুকিয়ে লাভ নেই”

শীতল অবিচলিত কন্ঠে কথাটা বললো দিগন্ত। ধারা বুঝলো মিথ্যের পাহাড় বানিয়ে লাভ নেই। দিগন্তের শ’কু’নী নজর তাকে দেখে ফেলেছে। দিগন্তের এই পেইজ থ্রি রিপোর্টারদের মতো সকল জায়গায় উপস্থিত হবার ব্যাপারটা বড্ড অপছন্দ ধারার। যখন ই কিছু হয় সবার আগে সেটা তার নজরেই পড়তে হয়। উপরন্তু সেই খবরটা বিবিসি চ্যানেলের মতো সারা ক্লাসে ছড়াবার মতো মহান কাজটিও সে নিজ দায়িত্ব মনে করে পালন করে। একটা ছেলে যে এতোটা চু’গ’ল’খোর হতে পারে ওকে না দেখিতে ধারা জানতো না। তবুও তার সাথে ধারার সখ্যতা আছে। কারণ ব্রেকিং নিউজ শুনতে কার না ভালো লাগে। ল্যাব স্যাশনের মাঝে হুট হাট কে কাকে প্রপোজ করলো, কোন মেয়ের কোন সিনিয়রের উপর ক্রাস, কোন জোড়া কপোত কপোতী স্যারের নজরে পড়লো, কোন কোন গ্যাং মা’রা’মা’রি করে মাথা ফা’টা’লো ব্যাপারগুলোর মশলাদার গল্প শুনতে খুব একটা মন্দ লাগে না। ছাত্র হিসেবে ডাহা ফেলু হলেও খবর প্রচারে সে একশ তে একশ। এখন তাকে যদি ধারা জানায় সে শ্রদ্ধেয় নতুন স্যারের স্ত্রী, তাহলে পরদিন সকালে সে হয়ে যাবে ভার্সিটির জমজমাট খবর। ধারা চায় না হট টপিক হতে। বন্ধুমহলে আলোচনা, সমালোচনার মধ্যমনি হওয়াটা ততটা খারাপ নয় যতটা তাকে এড়িয়ে চলাটা। স্যারের বউ এর সাথে কে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলবে! যা একটু অনলের নামে দু চারটি সমালোচনা শুনে কান জুড়াতো আর হিহি হাহা করতো সেটাও হবে না। গাল ফুলিয়ে একটা ছোট নিঃশ্বাস ছাড়লো সে। হতাশ গলায় বললো,
“আর লুকিয়ে লাভ নেই তাই তো”
“ঠিক তাই চাঁদ, বলে ফেলো। কেনো তার বাইকে চড়ে এলি? কে হয় উনি?”
“দেখ তুই তো জানিস আমি মামাবাড়িতে মানুষ”
“হ্যা, তো?”
“অনল ভাই, মানে আমাদের অনল স্যার আমার বড় মামার ছেলে। উনি আমার মামাতো ভাই। সে কারণেই তার বাইকে চড়ে আসা। যদি আমার ইচ্ছে ছিলো না, কিন্তু কি করবো বড়দের কথার অমান্য করা আমার স্বভাবে নেই”

ধারার কথা শেষ হবার আগেই তীব্রর স্বরে দিগন্ত বলে উঠলো,
“স্যার তোর মামাতো ভাই আগে বলিস নি কেনো?”

সাথে সাথে ধারা তার মুখ চেপে ধরলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“এজন্য বলি নি, তোর পেট তো ফাটা ঢোল। একটা কথা চেপে রাখতে পারিস না। শুধু মাহি জানে, কারণ ও আমার স্কুলের বান্ধবী। আর খবরদার দিগন্ত, ক্লাসে কেউ যদি জানে আমি তোর দাঁত ভে’ঙ্গে দিবো”

নিজ মুখ ছাড়াতে ছাড়াতে দিগন্ত বলে উঠলো,
“এতে এতো লুকোচুরির কি আছে! বরং এটা তো আরোও ভালো! ক্লাসের লোক তোকে মাথায় তুলে নাচবে”
“হ্যা, কিন্তু যখন দেখবে ওই অনল স্যার আমাকে দু পয়সার দাম দেয় না সেই মাথা থেকেই আছাড় মেরে ফেলে দেবে। তুই ভাই আমার, একটু চুপ করে থাক। সময় হলে আমি নিজেই বলবো”
“তোর ভাই হতে আমার বয়েই গেছে”

মিনমিনিয়ে কথাটা বললো দিগন্ত। ফলে ধারার কানে গেলো না। সত্যি লুকানোকে কি মিথ্যের কাতারে ফেলা যায়! প্রশ্নটির উত্তর জানে না ধারা। তবে ভার্সিটি জীবনে খানিকটা শান্তির জন্য এই পথটাই বেশি উপযুক্ত লাগলো তার কাছে। হৃদয়ের অন্তস্থলে কিঞ্চিত খচখচানি থাকলো অবশ্য, ঠিক কেনো জানা নেই! হয়তো অব্যক্ত অর্ধেক সত্যিখানাই কারণ। ধারা বেশি ভাবলো না। দিগন্তের সাথে পা বাড়ালো ক্লাসের পানে। এদিকে তাদের দুজনকে প্রগাঢ় দৃষ্টিতে এতোসময় লক্ষ্য করছিলো কেউ। দৃষ্টিটি প্রখর এবং সুচালো, যতসময় তাদের দেখা যায় ঠিক ততসময় তাকিয়ে থাকলো সে। তারপর গমন করলো নিজ গন্তব্যে________

ক্লাসে আজ বেশ রমরমা পরিবেশ। কেক আনা হয়েছে, একটা প্লাস্টিকের ছু’রির ব্যবস্থাও করা হয়েছে। আজ একটা বিশেষ দিন। আজ প্লাবণ স্যারের জন্মদিন। গত সেমিস্টারে মানুষটি তাদের ক্যামিস্ট্রি কোর্স নিয়েছিলো। ধারার মতো পুরো ক্লাস তার ভক্ত। কারণ পয়তাল্লিশ মানুষের একজন ও ফেল করে নি। বরং সবার কোর্সে গ্রেড ছিলো ভালো। তাই সকলের তার প্রতি ভালোবাসাটাও মাত্রাতিরিক্ত। ফেসবুকের জামানায় স্যারে জন্মদিন জানা কোনো কঠিন ব্যাপার নয়, সে তো অনল স্যার নন যার ফেসবুক আসে কি না ব্যাপারটা সন্দিহান। আর পছন্দের স্যারের জন্মদিন পালন করা আজ একটা ফ্যাশন ই বলা যায়। ফলে প্লাবণ স্যারের জন্মদিন পালনের জন্য ই এতো আয়োজন। ধারাও ঠিক সে কারণেই হালকা সেজেগুজে এসেছে। কিশোরী মনের আবেগ ই হোক না, তাকে যত্ন করতে দোষ কোথায়! সে তো আর মনের কথাটা উজার করে বলছে না। শুধু মানুষটার বিশেষদিন পালন করবে। প্লাবণ ভাই এর জন্য সে একটা উপহার ও কিনেছে। কেক কাটার পর দিবে। ক্লাসের ক্লাস রিপ্রেজেনটেটিভ প্লাবণকে ডেকে আনলো। প্লাবণের ক্লাস না থাকায় সে এলোও। এতো চমৎকার আয়োজন দেখে আবেগে আপ্লুত ও হলো। কিন্তু ধারার উপহার দেওয়াটা হলো না। সব পরিকল্পনায় পানি ঢেলে দিলো একটাই মানুষ অনল, কেক কাটার সাথে সাথেই সে তার ক্যালকুলাসের বই নিয়ে হাজির হলো। প্লাবণ কোনো মতে বললো,
“সবাইকে অনেক ধন্যবাদ, এমন বার্থডে হবে জানতাম না। সত্যি ভালো লেগেছে। কেকটা কেটে তোমরা খেয়ে নাও। অনল স্যার যেহেতু দাঁড়িয়ে আসেন আর আমি সময় নিবো না। আরো একবার বলবো ধন্যবাদ”

প্লাবণ বেড়িয়ে গেলে ছাত্ররা কেক খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সবাই খেলেও ধারা খেলো না। কারণ তার স্বযত্নে আনা উপহারটি এখন তার হাতেই রয়ে গেলো। প্লাবণকে দেওয়া হলো না। এদিকে চরম বিরক্তি ফুটে উঠলো অনলের মুখে। একেই গরমে শার্টখানা ভিজে গেছে অথচ তার ক্লাসের বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। ছাত্ররা মনের সুখে কেক খাচ্ছে, এদের কারোর ই হয়তো মনেও নেই আর দু মাস পর সেমিস্টার ফাইনাল। বা হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি ঘষতে ঘষতে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর বললো,
“হয়েছে তোমাদের?”
“জ্বী স্যার”

অনল সময় নষ্ট না করেই ভেতরে প্রবেশ করলো। তারপর নির্বিকার ভঙ্গিমায় বললো,
“এই যে পেপার। প্রত্যেকে পাস করে দাও। আজ তোমাদের সারপ্রাইজ টেস্ট নিবো”

সারপ্রাইজ টেস্টের কথাটা বিশাল এট্যোম বো’ম্ব এর মতো কাজ করলো। ছাত্রছাত্রীদের উল্লাসগুলো মূহুর্তেই উবে গেলো। রিপ্রেজেনটেটিভ আমতা আমতা করে বললো,
“স্যার, সারপ্রাইজ টেস্ট?”
“হ্যা, দশ মার্কের। এটা ক্লাস এস্যাসমেন্টের সাথে যুক্ত হবে। ফাস্ট পেপার পাস করো”

সকলের মুখ থমথমে। পরীক্ষা শুরু হলো, অনল পায়চারি করছে। ধারার বেঞ্চের সামনে এসেই সে দাঁড়িয়ে গেল। সূঁচালো চোখে দেখলো ধারার সফেদ খাতা। রোল ব্যাতীত একটা লাইন ও লেখা নেই। সে প্রশ্ন ও তুলে নি। অনল কিছুসময় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রয়োগ করলো। যার অর্থ, “তুই ক্লাসে কি একটু মনোযোগী হতে পারিস না! আমার বউ এতো গ’বে’ট কেনো!” কিন্তু তার দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ধারা তার সাদা খাতা কাটাকাটি খেলতে লাগলো। সন্তপর্ণে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো অনল। তারপর আবার হাটতে লাগলো। ব্যাপারটা দিগন্তের চোখ এড়ালো না।

ক্লাস শেষে বন্ধুমহল বসলো ক্যাফেটেরিয়ায়। আজ ল্যাব নেই। সব ক্লাসের ঝামেলাও শেষ। নীরব ক্যাফেটেরিয়ার কাউন্টারের রফিক মামাকে বললো,
“মামা, সবাইকে সামুচা আর তরমুজের শরবত দাও তো”
“দেতাছি, বসো। এই ছোটন, পাঁচ নম্বর টেবিলে পাঁচটা সামুচা আর ৫টা জুস দে”

এর মাঝেই অভীক বলে উঠলো,
“অনল স্যার আজ কি কাজটা করলো? সারপ্রাইজ টেস্ট! আরে জানিয়ে পরীক্ষা নিলেও পাই দশে দুই সেখানে সারপ্রাইজ টেস্ট নেবার কি মানে? আমি সাদা খাতা জমা দিয়েছে। নীরবকে উঠিয়ে দিলো। ধ্যাত”
“ভালো হয়েছে, তোমরা লেকচার তুলবা না আর মার্ক চাবা সেটা তো হবে না। এটা পরশুদিন ই করিয়েছিলো ক্লাসে”
“এজন্য তো তোকে এতো ভালোবাসি। আজ নোট খাতাটা নিয়ে যাবো”

নীরব এবং অভিকের কথার মাঝেই দিগন্ত বলে উঠলো,
“ধারা তো নিশ্চয়ই দশে দশ পাবি!”
“এটা কেনো মনে হলো?”
“অদ্ভুত তোর ভাই তোকে জানায় নি, এটা হতে পারে?”

যে ভয়টা পাচ্ছিলো সেটাই হলো। দিগন্ত কথাটা ফাস ই করে দিলো। অমনি সকলের দৃষ্টি তার দিকে ঘুরে গেলো। দিগন্তের দিকে কটমট করে চাইলেও সে তা উপেক্ষা করে বললো,
“ক্লাসে কেউ পাস না করলেও ধারা ঠিক ই পাস করবে”
“অনল স্যার তোর ভাই? আগে বলিস নি কেনো?”
“এতো বড় কথাটা তুই চেপে গেলি?”

সকলের প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে উঠলো ধারা। তাই বাধ্য হয়ে খোলসা করলো তার এবং অনলের সম্পর্কটি। সব শুনে অভীক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“ঠিক বলেছিস, এই কাজিনগুলো নষ্টের গোড়া। দেখ না আমার কাজিন জিআরই তে ভালো নম্বর পেয়ে জার্মানি তে স্কোলারশিপ পেয়েছে। আমার ফুপু সুন্দর মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে হাজির। ফলে সেই মিষ্টিতে ভ্যাজানো কথাগুলো আমার নসিবে জুটলো। বাবা তো বলেই দিয়েছে এবার যদি আমি রিটেক খাই সোজা বাড়ি ছাড়া করবে”

এতো আলোচনার মাঝেও মাহিকে দেখা গেলো চুপচাপ। সে গভীর চিন্তায় ডুবে আছে। ধারা দু চার বার জিজ্ঞেস করলেও উত্তর দিলো না। ম্লান হেসে বললো,
“কিছুই হয় নি”

হঠাৎ সে উঠে বললো,
“তোরা খা, আমি একটু আসছি”
“কোথায় যাস”
“কাজ আছে”

আর প্রশ্ন করলো না ধারা। নির্বাক চাহনীতে মাহির যাওয়া দেখলো। তখন ই উপহারের কথা স্মরণ হলো। সেও বললো,
“তোরা খা, আমি ওয়াশরুম থেকে আসছি”

ক্যাফেটেরিয়া থেকে বের হয়েই একাডেমিক বিল্ডিং এর দিকে হাটা দিলো ধারা। তার ভার্সিটির একাডেমিক এ উলটো দিক থেকে যেতে কোথায় একটা মাঠ পড়ে, সেখানে নরম ঘাসের উপর বসে আড্ডা দেয় ছাত্ররা। দুপুর বেলায় মাঠটা প্রায় থাকে নির্জন। সূর্যের জ্বলন্ত রোদ সরাসরি পড়ে বিধায় এই সময়ে এখানে কেউ আসে না৷ তাই এই পথটাই বেছে নিলো ধারা। প্লাবণ ভাইকে উপহার দেওয়াটা কারোর নজরে না পড়াই ভালো। ধারা বিল্ডিং এর দিকে বাক নিতেই থেমে গেলো সে। মাঠের এক কোনায় দুটো পরিচিত মুখের দর্শন পেতেই তার পা থেমে গেছে। অনল এবং মাহিকে দেখা যাচ্ছে। মাহি মাথা নিচু করে আছে। লাজুক দৃষ্টি তার। ধারা একটু এগিয়ে গেল। লুকিয়ে এক কোনায় দাঁড়ালো সে। তখন ই মাহির মৃদু স্বর কানে এলো,
“অনলভাই, আমি আপনাকে বহুদিন যাবৎ পছন্দ করি………

চলবে

(গতকাল গল্প দেই নি, তাই আজ দুটো পর্ব দিবো। আগামী পর্ব রাতে পোস্ট দিবো)

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here