#শেষ_থেকে_শুরু
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
#বোনাস_পর্ব
হৈমন্তী পুরোপুরি এক সপ্তাহ হাসপাতালে ভর্তি। মাঝেমাঝে জ্ঞান ফিরছে,এলোমেলো কথাবার্তা বলছে তারপর আবারও অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। বর্তমান অবস্থা মোটামুটি ভালো। আমেনা বেগম বাড়িতে অতিষ্ঠ করে ফেলছে সবাইকে। হৈমন্তীকে দেখতে যাবেন। রাজীব শেষমেশ উপাই না পেয়ে মাকে নিয়ে হৈমন্তীকে দেখতে চলল। মায়ের মন সন্তানের জন্য কাঁদে সবাই এটা বুঝে। আমেনা বেগম পুরাতন দিনের মানুষ। নানা রকম কুসংস্কারের প্রতি বিশ্বাস উনাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। তাছাড়া শাশুড়ির আদর্শ বউমা হিসেবে বেশ খ্যাতি ছিল উনার। সেসব কারণেই উনার মনের এই বেহাল অবস্থা। আবির হৈমন্তীর বেডের পাশে বসে আছে। এমন সময়ে হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন আমেনা বেগম। এসেই মেয়েকে জড়িয়ে একঘর কাঁদলেন। আবির গোলগোল চোখে তাঁকিয়ে আছে। ভদ্রমহিলাকে চেনার চেষ্টা করছে। তারপর অনুমান হলো ইনি হৈমন্তীর মা হবেন। উনি কালো বোরকা পরে আছেন। উনাকে কাঁদতে দেখে আবির হন্তদন্ত হয়ে আমেনা বেগমকে ধরতে গেলো কিন্তু রাজীব বাধা দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
>হাত দিও না আগুন লেগে যাবে।
আবির রাজিবের কথায় অর্থ বুঝতে পারলো না। কিসের আগুনের কথা বলছে জিঞ্জাসা করতে চাইলো কিন্তু ততক্ষণে রাজীব ওর পাশ থেকে সরে গেছে। কেউ আমেনা বেগম কে শান্ত করতে চাইছে না। উনি কান্নাকাটি নিজের ইচ্ছেতে থামাবেন এমন ইচ্ছে। আবিরের বিরক্ত লাগছে। মেয়ের পাশে এভাবে মরাকান্না কেনো করছে আল্লাহ্ ভালো জানেন। এই সময় মেয়েটার আশেপাশে আওয়াজ করা ঠিক না তাই ভেবে একটু শব্দ করে বলল,
> আন্টি একটু থামুন। হৈমন্তী ঠিক আছে এভাবে কান্নাকাটি করবেন না।
আমেনা বেগম হুট করে কান্না থামিয়ে ফেললেন। পাশের ছেলেটা উনার একদম অচেনা লাগলো। উনি আবিরের পা থেকে মাথা পযর্ন্ত খুব ভালো করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিয়ে বললেন,
> তুমি আমার মেয়ের ঘরে কি করছো?তোমাকে আমাদের কোনো আত্মীয় বলে তো মনে হচ্ছে না।
আবিরের মুখটা চুপসে গেলো। কি উত্তর দিবে বুঝে উঠতে পারলো না। অরিন পাশ থেকে বলল,
> আমি হৈমন্তীর বন্ধু। আর এটা হচ্ছে আমার ভাই।
আমেনা বেগম চুপচাপ কিছু কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
> তোমরা একটু বাইরে যাও আমার ছেলেদের সঙ্গে কিছু কথা বলবো।
আবির অরিণকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে রুমের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হলো। আরাফাত বাইরে ছিল ওষুধ কিনতে গিয়েছিল। ও ওষুধ নিয়ে এসে দেখলো আবির আর অরিন বাইরে বসে আছে দরজা বন্ধ। আরাফাত ভ্রু কুচকে আবিরের কাছে জিঞ্জাসা করলো,
> তোমরা বাইরে আছো তাহলে ভেতরে কে?
> আন্টি এসেছেন। ভাইয়াদের সঙ্গে কি একটা গোপন আলাপ করছে।তাই আমাদের বাইরে অপেক্ষা করতে বললেন।
আরাফাত বিষয়টা বেশ ভালোকরে বুঝে ফেলল। ও দরজায় শব্দ করে আঘাত করে বলল,
> দরজা খোলো আমি ভেতরে আসবো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজা খুঁলে গেলো। আমেনা বেগমের মুখটা কেমন থমথমে হয়ে আছে। রাজীব ভ্রু কুচকে রেখেছে। মাসুদের মুখেও বিরক্তি। আরাফাত ভেতরে গিয়ে প্রশ্ন করলো,
> আম্মা তুমি এখানে কেনো এসেছো? হৈমন্তীকে দেখি তুমি কবর পযর্ন্ত পৌঁছে না দিয়ে শান্তি পাবে না। বাড়িতে অশান্তি করে হয়নি এখানে চলে এসেছো।
আরাফাতের কথা শুনে আমেনা বেগম রেগে গিয়ে বললেন,
> তুমি ভুলে যাচ্ছ আমি হৈমন্তীর মা। মা হয়ে সন্তানের খারাপ চাইবো ভাবলে কিভাবে? আমি তো শুধু চেয়েছি মেয়েটার একটা সংসার হোক। ভালো থাকুক স্বামী সংসার নিয়ে।
> দয়াকরে বাড়িতে যাও। এখানে ঝামেলা করোনা। তোমার এই অতিরিক্ত চাওয়ার জন্য মেয়েটার এই অবস্থা। ছেলেমেয়েদের জন্য খুব করেছো আর করতে হবে না। তোমার এই ভালো চাওয়ার জন্য আমি কষ্ট পেয়েছি এখন আমার বোন কষ্ট পাচ্ছে। আমার মনে হয় আমরা তোমার সন্তান না।
আরাফাত নিজের জমিয়ে রাখা রাগটা এক নিমিষেই প্রকাশ করে ফেলল। রাজীব ওকে জোরকরে বাইরে নিয়ে গেলো। রাগে ফুলছে আরও কিছু কঠিন কথা বলে ফেলবে তখন আম্মাকে আর সামলাতে পারবে না। তাছাড়া বাক্য দ্বারা মানুষকে জীবন্ত দাফন করা যায়। পরে আফসোস করতে হবে। আবির কিছু বুঝতে পারছে না। আমেনা বেগম কথা বলছে না। চুপচাপ মেয়ের পাশে বসে আছে। কিছুক্ষণ থেকে চলে যাবেন। উনি ছেলেদের এতক্ষণ ধরে বকছিলেন পরের বাড়ির দুজন ছেলেমেয়েকে হৈমন্তীর কেবিনে আসার অনুমতি দিয়েছে এই জন্য। তাছাড়া আবির ছেলেটা যুবক ছোট না সে কিভাবে হৈমন্তীর কেবিনে থাকতে পারে এটা নিয়ে উনি বিরক্ত। লোকজন জানলে কি ভাববে। রাজীব বুঝিয়ে বলেছে অরিন আছে। তাছাড়া হৈমন্তীর জ্ঞান নেই। মরার মতো পড়ে আছে। নীল চাঁদরে পা থেকে গলা পযর্ন্ত ঢেকে রাখা এসব বুঝিয়ে বলল কিন্তু সেই এক কথা ধরেই বসে আছে উনি। আবির মোটামুটি আরাফাতের কাছ থেকে ঘটনার সংক্ষেপে যেনে নিলো। অরিন ভেতরে যেতে ভয় পাচ্ছে। আবির ওকে নিয়ে ভেতরে গিয়ে দাঁড়ালো। কেবিনে আমেনা বেগম ছাড়া কেউ নেই। বাকিরা বাইরে আছে। আবির আমেনা বেগমের দিকে তাঁকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
> আন্টি জামাই হিসেবে আমি খারাপ হবো না। কথা দিচ্ছি হৈমন্তী সুস্থ হলে আমি নিজ দ্বায়ীত্বে ওকে একটা সুন্দর সংসার উপহার দিব। আগামী বছর ছোটছোট নাতি নাতনি নিয়ে ঘুরবেন। এতো রাগারাগী শরীরের জন্য ভালো না। পানি খাবেন? মাথা ঠান্ডা থাকবে।
আবির পানির বোতল এগিয়ে দিতে গেলো কিন্তু উনি নিলেন না। আমেনা বেগমের মেজাজ চরম খারাপ হলো। এই ছেলেটা ঠোঁট কাটা স্বভাবের। উনি আগেই সন্দেহ করেছেন। তাহলে এই ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ের পায়তারা চলছে। এই জন্য রাজীব উনাকে এখানে আনছে না। আমেনা বেগম আবিরের কথার উত্তর না করে গটগট করে বেরিয়ে গিয়ে রাজীবকে বলল বাড়িতে রেখে আসতে। এখানে থাকবেন না। থাকার ইচ্ছে চলে গেছে। রাজীব আর কথা বাড়ালো না। চলে গেলো। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সময় লাগলো। অরিন ভাইয়ের দিকে রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
> এ জীবনে তোমার বিয়ে হচ্ছে না আমি সিউর। কি দরকার ছিল আন্টিকে রাগিয়ে দেওয়ার?
> তোর আন্টি এমনিতেই রাগে। কথাগুলো না বললে উনি এখানেই বসে থাকতো। উনাকে কদর করলে উনার হজম হতো না। হজম শক্তি কম আমি উনার হজম শক্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবো। বিয়ে উনি না দেবার কে। হৈমন্তী ঠিক থাকলে পৃথিবী উল্টে গেলেও বিয়ে হবে। ও একবার আমাকে বলুক দেখবি সব বদলে দিব।। মেয়েটা বিছানা নিয়েছে উঠার নাম নিচ্ছে না। আমাকে মারতে চাইছে।
অরিন কিছু বলতে চাইলো কিন্তু পারলো না ডাক্তার চলে আসলো।
____________________
এভাবে দীর্ঘ এক মাস পার হলো। হৈমন্তী মোটামুটি সুস্থ। বাড়িতে নেওয়া হয়েছে। অতীত বর্তমান নিয়ে ও কাউকে কিছুই বলছে না। সব কিছু স্বাভাবিক। ওর ইচ্ছা হলে কথা বলছে, না হলে বলছে না।কেউ কিছু জিঞ্জাসা করছে না। তবে হাসপাতাল থেকে এসে ও রনির আশেপাশের ঘেঁষছে না। রনিকে দেখলে এড়িয়ে যাচ্ছে। আমেনা বেগম ফরহাদকে নিয়ে তেমন কিছু বলতে পারেনি। সামনে অরিণের বিয়ে। এতোদিন বিয়েটা পিছিয়ে ছিল হৈমন্তীর জন্য। তাছাড়া ওরা বাড়ি আর হাসপাতাল করে ক্লান্ত ছিল। ছেলে বাড়ির লোকজন আর অপেক্ষা করতে চাইছে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়েটা দিতে চাইছে। হৈমন্তী ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছে অরিনের বিয়েতে যাবার জন্য। বিয়ের পাঁচ দিন বাকি আছে। হৈমন্তীর লাগেজ গোছাতে ব্যস্ত এমন সময় আরাফাত ভেতরে আসলো। ও এসে হৈমন্তীর সঙ্গে কাপড় ভাজ করতে শুরু করলো। নিরবতা কাটিয়ে আরাফাত মুখ খুলল,
> পা ঠিক হয়নি ওখানে গিয়ে অসুবিধা হবে না?
> অসুবিধা কেনো হবে অরিন আর আন্টি আছে আমাকে সাহায্য করবে। আন্টিকে দেখেছো দারুন একজন মানুষ। সব সময় হাসিখুশি থাকে।
> হুম। উনার জন্যই হয়তো ছেলেমেয়েগুলো এমন ভালো। যাইহোক আম্মা কিন্তু মুখ ভার করে রেখেছে। তুই বাড়ি ছেড়ে বন্ধুর বাড়িতে যাচ্ছিস। বিষয়টা উনি ভালো চোখে দেখছে না।
> উনার কথা আপাতত পাত্তা দিচ্ছি না। অরিন আমার খুব ভালো বন্ধু। আমার কোনো বন্ধু ছিল না। ওই একমাত্র মেয়ে যে আমাকে নিজের বোনের মতো ভালোবাসে তাঁর জীবনের এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ দিনে আমি থাকবো না ভাবতে পারবো না ভাইয়া। তাছাড়া আমি একা না তুমিও যাচ্ছ। আমি তোমার লাগেজ গুছিয়ে রেখেছি। তুমি দেখে নিও আরও কিছু যদি লাগে।
আরাফাত বোনের কথা শুনে ভ্রু কুচকে বলল,
> আমি কেনো? বিয়ে বাড়িতে যায়না আমি তুই ভালো করে জানিস। তাছাড়া আমি গিয়ে কি করবো?
> তোমাকে রেখে যাবো কেনো ভাইয়া এটা আগে বলো? আমি তো চেয়েছিলাম বাড়ির সবাইকে নিয়ে যাবো। কিন্তু ওরা কি ভাববে। দরকার নেই বিয়ের দিন বাকিরা যাবে। তুমি যাও লেট করোনা।
হৈমন্তীর পা কেটে গিয়েছিল এক মাসে কিছুটা ঠিক হয়েছে তবে পুরোপুরি ঠিক হয়নি। হাটতে চলতে একটু সমস্যা হচ্ছে। হৈমন্তী ঝটপট লাগেজ গুছিয়ে বেরিয়ে গেলো। আরাফাত নিজের রুমে গিয়ে চেঞ্জ করছে। তাছাড়া পরে ভেবে দেখলো হৈমনকে একা ছাড়া ঠিক হবে না। সব সময় মেয়েটার আশেপাশে থাকা দরকার। হৈমন্তী ছোট ভাইকে নিয়ে সবাইকে বলে বেরিয়ে আসলো। মাসুদ পুরোদমে ডিউটি করছে বাড়িতে থাকতে পারছে না।
***
হৈমন্তী অরিনদের বাড়ির সামনে লাগেজ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আবির দোতলার বেলকনিতে বসে গেটের দিকে তাঁকিয়ে আছে।আর মাঝেমধ্যে কফির মগে ঠোঁট ঢুবিয়ে দিচ্ছে। কফিটা আজ হয়তো একটু বেশিই টেস্ট হয়েছে। ফারজানা হক অরিণকে সঙ্গে নিয়ে হৈচৈ করে হৈমন্তীকে রিসিভ করে বাড়ির ভেতরে নিয়ে আসলো। আরাফাত পেছনে আছে। হৈমন্তী খুঁড়িয়ে হাঁটছে। তাছাড়া আগের থেকে শরীর অনেকটাই দুর্বল। হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। হৈমন্তীর এমন শান্ত থাকাটা নিয়ে সবাই চিন্তা করছে। বিয়ে বাড়িতে আত্মীয়স্বজনে ভরপুর হয়ে আছে। আরাফাতের বেশ অসুবিধা হচ্ছে। ওর জন্য আলাদা রুমের ব্যবস্থা করা হয়েছে। হৈমন্তী অরিণের সঙ্গে থাকবে। ওকে একা রাখার সাহসও কারো নেই। রুমে ঢুকেই অরিন হৈমন্তীকে জড়িয়ে ধরে বলল,
> খুব ভালোবাসি তোমাকে। তুমি ছাড়া আমাকে কেউ এতো ভালো বুঝেনা। তোমার জন্যই আমি এতো সুন্দর একটা জীবন পেয়েছি।
হৈমন্তী ওর পিঠে হাত রেখে বলল,
>তুমি এমনিতেই এতো এতো ভালো। খারাপ বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা করে মাথাটা একটু বিগড়ে গিয়েছিল এখন তো ঠিক আছে।
অরিন ওকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
> সৎ সঙ্গে সত্যি স্বর্গ বাস করে। তুমি বিশ্রাম করো
আমি আসছি।
অরিণ চলে গেলো। হৈমন্তী ওর যাওয়ার দিকে তাঁকিয়ে ভাবছে সেই পুরাতন দিনগুলোর কথা। বিদেশের মাটিতে প্রথম পথচলা এতোটা সহজ ছিল না। গ্রামের স্কুল,কলেজ থেকে পড়াশোনা করা একটা মেয়ে হঠাৎ আমেরিকা গিয়ে সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে হাজার বার হারতে হয়েছে। হৈমন্তীর সঙ্গে অরিনের দেখা হয়েছিল তখন অরিন এমন ছিল না। ওর চাল চলন চলাফেরা ছিল অন্যরকম।
চলবে
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।