অনুভবী হিয়া’ পর্ব-২

0
4393

#অনুভবী_হিয়া
#মাইশাতুল_মিহির

২.

ভোরের পাখির কিচিরমিচির। শিশিরে ভিজে যাওয়া পাতা থেকে চুয়ে পানির ফোটা পরছে। গতকাল সন্ধ্যায় বৃষ্টি হওয়ায় সকালের পরিবেশটা বেশ মনোরম লাগছে। এখনো রাস্তাঘাট বৃষ্টির পানিতে ভিজে আছে। ঘুম থেকে উঠেই আড়মোড় ভেঙে ফজরের নামাজ পড়ে গায়ে পাতলা শাল পেঁচিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো মিহির। সাধারনত ভোরে ঘুম থেকে উঠা তার নিত্যদিনের অভ্যেস। ভোরের আলো ফোটার মুহূর্তটা তাকে মুগ্ধ করে। মন ভালো করার এক মহা ঊষুধ মিহিরের কাছে। বারান্দায় থাকা ফুল গাছে আলতো ভাবে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সে। যেনো তার হাতের ছুঁয়া পেয়েই সকাল শুরু হয় তাদের। বারান্দায় দীর্ঘ সময় পার করার পর রুম থেকে বের হয়ে রান্না ঘরে গেলো মিহির। উদ্দেশ্য চা বানাবে। এক কাপ চা না হলে এই শুভ্র সকাল টা কিভাবে শুরু করবে? অন্তত্য তার মতো চা’খোরের জন্য তো কখনোই সম্ভব না।

মাইশাতুল জামান মিহির। অনার্স ৩য় বর্ষের ছাত্রী। মা রাশেদা বেগম। ভাই আয়াত হাসান মাহিন, অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। মাহিন আর মিহির যমজ ভাইবোন। বাবা রাহিম হাসান গত হয়েছে দেড় বছর আগে। মা-ভাইকে নিয়েই তার সুখী পরিবার।
________________

সকালে নাস্তা বানাতে মা কে সাহায্য করে রুমে গিয়ে তৈরি হয়ে নিলো মিহির। উদ্দেশ্য অফিসে যাবে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কাজল দিচ্ছে চোখে। পরনে পিংক কালারের জর্জেট জামা। সাথে সাদা ওড়না, সাদা জিন্স। পিংক কালারের হিজাব পড়া। সাজ বলতে মুখে রেগুলার ব্যবহার করা ক্রিম, চোখে হালকা কাজল, ঠোঁটে লিপজেল। ব্যাস বাহিরে যাওয়ার জন্য তৈরি মিহির।

রুম থেকে বেড়িয়ে টেবিলে বসে মা’য়ের উদ্দেশ্যে বললো,

‘মাহিন কোথায় আম্মু? সকাল থেকে দেখছি না যে।’

‘আমি কি জানি। ছেলেটা দিন দিন কেমন বেয়াদব হয়ে যাচ্ছে। আমার কোনো কথা শুনে? সকাল সকাল দেখলাম ব্যাট দিয়ে বাহিরে যাচ্ছে ক্রিকেট খেলতে। এখনো পড়তে দেখলাম না মহাশয় কে। কুমিল্লা থেকে এসে উড়নচণ্ডি হয়েছে। বারণ করলাম তাও শুনলো না। আমার কথার দাম আছে নবাবজাদার।’ রেগে ফুঁশ করতে করতে বললো রাশেদা। মা’য়ের কথা শুনে হেসে ফেললো মিহির। পরোটা ছিঁড়ে মুখে দিয়ে মা’কে বললো,

‘আম্মু, তুমি এতো চিন্তা করো কেনো বলো তো। মাহিন কি এখনো ছোট? ও নিজের খেয়াল নিজেই রাখতে পারে। ভাই খেলতে গেছে তো খেলতে দাও। পরিক্ষা এখনো অনেক দেড়ি। চিন্তা করো না তুমি।’

মেয়ের কথা শুনে আর কিছু বললো না রাশেদা বেগম। কিভাবে বুঝাবে মায়ের মন। ছেলে-মেয়ের জন্য তো চিন্তা হবেই।

‘আম্মু, আমার খাওয়া শেষ। আমি বের হচ্ছি।’ চেয়ার থেকে উঠার সময় বললো মিহির।

‘তোর অফিস তো ৯:০০ টায়। বাসা থেকে বের হোস সাড়ে ৮ টায়। আজ এতো তাড়াতাড়ি যাবি যে?’

‘আসলে আম্মু লাইব্রেরিতে যাবো কিছু কেনার আছে।’

‘আচ্ছা সাবধানে যা।’

মা’কে বিদায় দিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়ালো রিকশার জন্য। প্রথমে লাইব্রেরী তে যাবে তারপর অফিস। মিহিরের বাসা থেকে অফিসের দূরত্ব প্রায় ২০-৩০ মিনিট। হাত ঘড়িতে সময় দেখে ডাক দিলো রিকশাচালক কে।

______________________

কোলাহলপূর্ণ শহর। অলিগলি তে মানুষের ভীড়। যে যার উদ্দেশ্যে নিজেদের গতিতে চলছে রাস্তায়। কৃষ্ণচূড়ার ফুল গুলো আপন মনে ঝরে পরছে নিচে। বড় কৃষ্ণচূড়ার গাছটির নিচে কাঠের ব্যঞ্চে বসে কয়েকজন যুবক অপেক্ষা করছে তাদের প্রানপ্রিয় বন্ধুর জন্য। কারোর তর আর সইছে না কখন আসবে তাদের জানের জিগার। অবশেষে বিরক্ত নিয়ে বললো রাহুল,

‘কিরে শা:লা, আর কতক্ষন অপেক্ষা করতে হবে?

‘আরে আইবো তো একটু ওয়েট কর না ভাই।’ প্রতি উত্তরে বললো আদিল।

‘হু, হের লাইগা দেড় বছর ধইরা ওয়েট করতে করতে আমরা শহিদ হইয়া যাইতাছি দেখোছ না।’ বিরক্ত নিয়ে বললো সামির।

হঠাৎ বাইকের ব্রেক কষে নামলো শুভ। মাথা থেকে হেমলেট নামিয়ে এগিয়ে গিয়ে ব্যঞ্চে বসে বললো,

‘হেই গাইস, ওয়াট’স আপ?

প্রতি উত্তরে তিন জনই ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো শুভর দিকে। শুভ কিছুটা ইতস্ততভোধ করে বললো,

‘আরে ইয়ার, এমন ভাবে তাকাই আছোস যেনো ডাকাতি কইরা আসছি। একটু লেইট হইছে বেশি কিছু হয় নাই তো। এইভাবে তাকানোর কিছু নাই। অন্য দিকে তাকা।!

‘এই তোর একটু খানি লেইট? পাক্কা ১ ঘন্টা ১২ মিনিট পরে আসছেন আবার বলেন একটু?’ সামিরের কথা শেষ হতেই রাহুল বললো,

‘মামাহ্, তোমার বাড়ি থেইকা এইখানে এইতে ৪০ মিনিট লাগে। বাকি ৩২ মিনিট কই আছিলা তুমি? হাছা কইরা ক? আমি কাউরে কমু না।’ বলেই ভ্রুঁ নাঁচিয়ে দাঁত কেলালো রাহুল।

‘গাঞ্জা খাইতাম গেছিলাম। তুই খাইবি? দেই?’ স্বাভাবিক গলায় বললো শুভ।

শুভর স্বাভাবিক উত্তর ঠিক হজম হলো না রাহুলের। ভ্রুঁ কিঞ্চিত বাঁকা করে ব্যঞ্চে পিঠ ঠেকিয়ে বসলো রাহুল। এতো দিন পর দেখা হওয়াই চার জনই কুষল বিনীময় করলো। কথার মাঝে চোখ ছোট ছোট করে শুভর দিকে তাকিয়ে সামির বললো,

‘কিরে ভাই, তুই দেখি দিন দিন ফর্শা হইতেছোস। সত্যি কইরা কো রুপের রহস্য কি। মাইয়া গো মতোন কি মাখোস মুখে? আমারেও ক ক্রিম মাইখা ফর্শা হইয়া মাইয়া পটাই’

‘চোখ সরা। তোর নজর ভালো না। আমার মতো হ্যান্ডসাম ছেলে দেইখা তোর হিংসা হইতাছে বুঝছি। মাশা’আল্লাহ বল।’ ভাব নিয়ে বললো শুভ। আদিল শুভর সাথে পিঞ্চ মেরে সামিরকে বললো,

‘মামাহ, খালি রাতের বেলা ভূতের ছবি দেখা বন্ধ করে দাও তাহলেই সব ঠিক হইয়া যাইবো’ উচ্চস্বরে হাসে দিলো আদিল রাহুল শুভ। সামির রেগে আদিলকে বললো,

‘নিজের মতো সবাইকে ভাবিস নাকি। তাও তো ভালা, তুমি যে মিয়াহ তলে তলে টাংকি চালাও। গার্লফ্রেন্ড নিয়া যে রুম ডেটে ধরা খাইছিলা তার বেলা?’ লাস্ট কথা কিছুটা খোঁচা মেরে বললো সামির। সামিরের কথা শুনে চোখ বড় বড় আদিলের দিকে তাকালো শুভ। আদিল অসহায় চোখে তাকিয়ে বললো,

‘তোদের মতো হারামি থাকলে লাইফে আর কি লাগে ভাই।’

‘ভাই, তোরে আমি সৎ পুরুষ ভাবতাম। ছিঃ দূরে যা, দূরে যা, উপ্রে উপ্রে ভালো সেজে ভিতরে ভিতরে এইসব চালাও তাহলে। ইয়াক।’ ইচ্ছে করে নাকমুখ কুঁচকে আদিল কে পঁচিয়ে কথা টা বললো শুভ। সামির রাহুল হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি করার অবস্থা। শুভ কাহিনী কি জানতে চাইলে আদিল বললো,

‘ভাই আর বলিস না। মিতু কে মা দেখতে চাইছিল তাই বাসায় নিয়ে গেছিলাম। মা’য়ের সাথে দেখা করানোর পর ওরে আমার রুম দেখাচ্ছিলাম। তখনই এই সামির আর রাহুলের বাচ্ছার আগমন ঘটেছিলো। মহিলাদের মতো তিল থেকে তাল বানিয়ে আমার কাছ থেকে যে কতো বার টাকা মারছে তার হিসেব নাই।’ শেষের কথা গুলো দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বললো আদিল। তখন হাসি থামিয়ে সিরিয়াল ভাবে শুভ বললো,

‘ভাইই, আমিও কিন্তু পাই। তখন ছিলাম না তাই মিস করলাম। এখন যেহেতু আছি তাই এখন সব সুদে আসলে পূরণ কর।’

‘তোরা সব হারামি সব। কষ্ট কইরা টাকা কামাই আমি, সব মারো তোমরা। বাহ জীবন বাহ!’ আরেক দফা হাসির রুল পরলো চার বন্ধুর মাঝে। রেস্টুরেন্টে গিয়ে আদিলের পকেট খালি করতে তারা তিন জনই যতেষ্ট ছিলো। অসহায় ভাবে গালে হাত দিয়ে সামনে বসে থাকা রাক্ষসদের দেখছিলো আদিল। এইভাবেই খুনসুটির আড্ডায় দিন পার করলো তারা।

_____________________

বিকালে বাসায় ফিরে লম্বা শাওয়াল নিয়ে ঘুম দিলো মিহির। খুব টায়ার্ড আজ। হবে না কেনো প্রথমে লাইব্রেরি থেকে অফিস, তার পর অফিস থেকে ভার্সিটি গিয়েছিলো নোট আনার জন্য। খাবার খাএয়ার জন্য রাশেদা বেগম অনেক বার ডাকাডাকি করেছিলো কিন্তু মিহির উঠেনি। এত্ত ঘুম মিহিরের যে মা’য়ের ডাক কান পর্যন্ত যায় নি। হয়তো এতো ঘুমের কারনেই কেউ একজন তাকে ঘুমকাতুরে ঘুম কুমারী ডাকতো।

চলবে..!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here