অনুভবী হিয়া পর্ব-২৯

0
1603

#অনুভবী_হিয়া
#মাইশাতুল_মিহির

২৯.

ফাইভ স্টার রেস্টুরেন্টে পায়ের উপর পা তুলে চেয়ারে আয়েশি ভঙ্গিতে বসে আছে জিহান। একহাত চেয়ারের ঠেকিয়ে থুতনিতে রেখে গভীর মনোযোগ সহকারে টেবিলের উপরে থাকা ধোয়া উঠা কফির কাপে তাকিয়ে আছে। প্রাইভেসির জন্য পুরো ফ্লোর বুক করেছে সে। কমফোর্টেবলের জন্য এই ফ্লোরে তিন চার কাস্টোমার কে এলাউ করতে বলা হয়েছে ম্যানেজার কে।

‘মিঃ জিহান কবির! এম আই রাইট?’

চোখ তুলে তাকায় জিহান। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মাহিনের উদ্দেশ্যে সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বলে, ‘ইয়াহ্ ইউ আর রাইট। প্লিজ সিট দেয়ার।’

মাহিন এগিয়ে এসে চেয়ার টেনে বসে পরে। হুয়াইট কালার শার্টের উপর ব্ল্যাক কালার ব্লেজার পরে আছে সে। নির্বিকার হয়ে বসে টেবিলের উপর দুই হাত ভাজ করে রাখে। স্টার্ফ এসে অর্ডারকৃত কফি দিয়ে যায়। জিহান গভীর দৃষ্টিতে মাহিনকে পর্যবেক্ষণ করছে। কফির কাপ হাতে নিয়ে এক চুমুক বসিয়ে বলে মাহিন, ‘তো আমার সাথে দেখা করার কারণ?’

স্বাভাবিক ভাবে বলে জিহান, ‘সেটা নিশ্চয় অজানা নয় আপনার!’

প্রতি উত্তরে হেসে কফিতে চুমুক বসিয়ে টেবিলে রাখে। জিহানের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলে, ‘আপনার মুখ থেকে শুনতে চাইছি।’

জিহান চেয়ারে গা এলানো অবস্থায় ফিচেল গলায় বলে, ‘মমের জামিন। আমি চাই মমের বিরুদ্ধে থাকা সকল এভিডেন্স ভুল প্রমান হোক। আর সেই কাজ টা আপনি করবেন!’

চোখে মুখে গম্ভীরতা বজায় রেখে বলে মাহিন, ‘এমন টা চাওয়ার কারণ?’ জিহান চোখ মুখ শক্ত করে বলে, ‘আমি মম কে যেকোনো মূল্যে জেলের বাহিরে দেখতে চাই!’

অবাক হয়ে যায় মাহিন কিন্তু তা প্রকাশ করে নি। খানিকটা ভ্রু বাকিয়ে বলে, ‘আপনার মা একজন খুনি। সে আপনার বাবাকে খুন করেছে। আর একজন খুনি তার প্রাপ্য শাস্তি না পেয়ে জেলের বাহিরে থাকবে সেটা নিশ্চয় আইন মেনে নিবে না।’

জিহানের মাথায় রক্ত উঠে যায়। কপালের রগ ফুলে কালচে বর্ণ ধারন করে। টেবিলে এক হাত স্বজোড়ে রেখে গলা হেকিয়ে বলে, ‘মাইন্ড ইউর ল্যাঙ্গুয়েজ মিঃ মাহিন। আমার মা খুনি নয়। উনাকে খুনি বললে জ্বীব টেনে ছিড়ে ফেলবো।’

জিহানের আকর্ষীক রাগে চোখ ছোট ছোট করে তাকায় মাহিন। পরোক্ষনে বললো, ‘কিন্তু এটাই সত্যি উনি আপনার বাবাকে মার্ডার করেছে!’

‘ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন, ওই ব্লাস্টার আমার বাবা নয়। দেশে থাকলে আমি নিজেই মেরে পুতে দিতাম। দূর্ভাগ্যবশত আমি ছিলাম না নাহলে পৃথিবীর সব থেকে বেশি কষ্ট দিয়ে মারতাম।’

বিস্ময়ের পর বিস্ময় হচ্ছে মাহিন। নিজের বাবার প্রতি কেউ এমন ক্ষোভ পোষণ করবে এটা তার ধারণার বাহিরে ছিলো। উপরে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে তীক্ষ্ণ চোখে সবটা বুঝার চেষ্টা করছে সে।

জিহান শক্ত গলায় বলে, ‘উনাকে মারার যতেষ্ট কারণ ছিলো। দিনের পর দিন মম কে ঠকিয়েছে। বিশ্বাসঘাতকতা করেছে আমাদের সাথে। মম জীবিত থাকা অবস্থায় তাকে ঠকিয়ে কাউকে না জানিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেছ। তারপরেও অন্য নারীর সাথে পরকিয়ার লিপ্ত ছিলো। সব কিছু সবাই জেনে যাওয়ার পরেও লোকটার মধ্যে ভাবান্তর আসে নি। মম প্রতিবাদ করেছে বিধায় মমের গায়ে হাত তুলে। ঠিক কতটা নিকৃষ্ট হলে একটা মানুষ দিনের পর দিন এমন জগন্য কাজে লিপ্ত থাকে? মেরে ফেলেছে তো বেশ করেছে।”

মাহিন তপ্তশ্বাস ফেলে। টেবিলে দুই হাত রেখে শান্ত কন্ঠে বলে, ‘আপনার মা নিজের হাতে খুন করেছে। উনি আইনের সাহায্য নিতে পারতো। এখন আমাদের কারোর কিছু করার নেই যা করার আদালত করবে।’

‘আপনি মমের জামিনের ব্যবস্থা করবেন। আমি উকিলের সাথে আলাপ করেছি। আপাতত আপনার কাজ সকল প্রকার এভিডেন্স মুছে ফেলা।’

‘আই’ম সো সরি মিঃ জিহান। আমি কখনো অন্যায় কে পশ্রয় দেই না। এটা কখনোই সম্ভব না। আশা করি বুঝতে পেরেছেন! এখন আসি!’ বলেই উঠে দাঁড়ায় মাহিন। বাকা হেসে বলে জিহান, ‘তাহলে আমাকে অন্য রাস্তা দেখতে হবে!’

জিহানের কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে মাহিন টেবিলে একহাত রেখে খানিকটা ঝুকে বলে, ‘প্রফেশনাল ম্যাটারকে পারসোনাল ম্যাটারে টানা বোকামো নয় কি মিঃ জিহান? আশা করি আপনি এতো টাও নির্বোধ নন। আপনি ইট মারলে আমিও পাটকেল মারতে জানি।’

রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে যায় মাহিন। চোয়াল শক্ত করে বসে আছে জিহান।
________________

ডিপার্টমেন্টে বসে আছে মাহিন শান্ত। তাদের সামনে চেয়ারে হেলান দিয়ে চিন্তিত মুখে বসে আছে উজ্জ্বল আহসান। ফিচেল গলায় বলে,

‘এমন কে হতে পারে যে এতো বড় চাল দিবে। ভাগ্যিস সব চুরি হওয়ার আগেই ধরা পরেছিলো নাহলে সব প্রমান ভ্যানিস হয়ে যেতো। আর আজকে আদালতে প্রমান দেখাতে না পারলে মিসেস হোসাইন নির্দোষ প্রমান হয়ে বেরিয়ে যেতো।’

শান্ত টেবিলে দুই হাতের কুনইয়ের ভর দিয়ে বলে, ‘হতে পারে হোসাইন কবিরের স্ত্রীর কাছের কেউ যে উনাকে বাঁচাতে চেয়েছিলো।’

‘হুম হবে। দেখেছো ঠিক কিভাবে কাজটা কম্পলিট করতে চেয়েছে। ব্রিলিয়ান্ট বটে!’

‘স্যার! রায় তো হয়েই গেছে তারা এখন চাইলেও কিছু করতে পারবে না। সো এইসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। নেক্সট ইনভেস্টিগেশনের জন্য প্রিপারেশন নেওয়া ভালো।’

‘হাহা ঠিক বলেছো। তা ঢাকা আর থাকবে কত দিন?’

‘কাল চলে যাবো! কুমিল্লাতে অনেক কাজ পরে আছে। সেদিন টা সামলাতে হবে।’……..

পুরোটা সময় মাহিন চুপ ছিলো। সে মনে মনে অন্য ছক কষছে। কাজটা যে জিহান করেছে সেটা বুঝতে সময় নেই নি তার।
_________________

রাস্তায় পাশাপাশি হাটছে মাহিন সুহা। বেশিরভাগ সময় তারা দুইজন রাস্তায় হেটে হেটে সময় কাটায়। সুহা মাহিনের হাত ধরে হাটছে। হঠাৎ কেউ সুহার উদ্দেশ্যে ডাক দেয়।

‘সুহা এখানে কি করছিস?’

সুহা পিছে তাকিয়ে শুভ আর রাহুলকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে যায়। শুকনো ঢুক গিলে আমতা আমতা করতে থাকে। শুভ রাহুল দুইজন মাহিন কে দেখে বিস্মিত হয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। শুভতো বিস্ফোরিত হয়ে আছে। মানে তাকে নাকে ধরি দিয়ে ঘুরিয়ে তারই বোনের সাথে মাহিন প্রেম করছে? বিশ্বাস করা যায় এইগুলো??

মাহিন নিজেও অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে কিন্তু উপরে ভাব এমন যে এটাই স্বাভাবিক। মাহিন শুভর দিকে তাকিয়েই বলে,’তোমার ভাই কোনটা?’

শুভ চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। তারই বোনের সাথে প্রেম করে বেড়াচ্ছে অথচ তাকেই চিনে না। সুহা কিছু বলার আগেই শুভ বলে, ‘যার সাথে প্রেম করছো তার ভাইকেই চিনো না? স্ট্রেঞ্জ!’

বাকা হাসে মাহিন। তারপর বললো, ‘জানতাম কিন্তু সে যে আপনি হবেন সেটা ধারনার বাহিরে ছিলো।’

শুভ সুহার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘পড়াশোনা বাদ দিয়ে এসব কি সুহা?’ সুহা ভয়ার্ত চোখে তাকায়। মাহিন ইশারায় সুহাকে বলে, ‘সুহা তুমি বাসায় যাও!’ সুহা মাহিনের দিকে তাকিয়ে একবার ভাইয়ের দিকে তাকায়। পরোক্ষনে ভাবে এখান থেকে কেটে পরলেই চলে। যেই ভাবা সেই কাজ চলে যায় সে। যা একপ্রকার পালিয়ে যাওয়া বলে।

সুহা যেতেই রাহুল বলে, ‘ মানে ভাই আপনি গাছের আগাও নিবেন আবার গুড়াও খুড়াবেন। বাহ্ তালিয়া!’ হেসে ফেলে মাহিন।

শুভ মনে মনে কিছু একটা ভাবছে। তার চোখে মুখে রাগ ফুটিয়ে শক্ত গলায় বলে, ‘আমি যদি ভুল না হয় তো তুমি কি রিভেঞ্জের জন্য সুহাকে ব্যবহার করছো?’ বিস্মিত চোখে তাকায় রাহুল। উচ্চস্বরে হেসে ফেলে মাহিন। কিছুক্ষণ পর হাসি থামিয়ে সিরিয়াস হয়ে বলে, ‘আপনাদের ব্যাপার আর আমার সুহার ব্যাপার সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে রিভেঞ্জের কোনো প্রশ্নই উঠে না। সুহা কে আমি ভালোবাসি সেটা অনেক আগে থেকেই। আর সুহা আপনার বোন আমি জানতাম না আর জানার প্রয়োজনবোধ করছি না। সে যেই হোক আই রিয়েলি লাভ হার।’

রাহুল তাচ্ছিল্য করে বলে, ‘ নিজের বেলা ষোল আনা পরের বেলা এক আনাও না। এখন আমরা যদি সুহা আর তোমার সম্পর্ক মেনে না নেই?’

মাহিন পকেটে দুই হাত গুঁজে তীক্ষ্ণ চোখে শান্ত কন্ঠে বলে, ‘আই ডোন্ট কেয়ার!’ এটিটিউট দেখিয়ে চলে যায় এখান থেকে।

শুভ অবাকের পর অবাক হচ্ছে। রাহুল হতভম্বের মতো বলে, ‘ভাইরে ভাই কি এটিটিউট দেখছোস?’
_____________

চিন্তিত মুখে নখ কামড়ে পুরো রুম জোড়ে পায়চারী করছে সুহা। সেই বিকাল থেকে মাহিনকে কল করছে কিন্তু মহাশয় কল ধরছে না। তার মাথায় শুধু এটাই ঘুরছে ভাই আর মাহিনেএ মাঝে কি কথা হয়েছে? ভাই কি মেনে নিবে? নাকি সুহা মাহিনের প্রেমে ভিলেনের মতো এন্ট্রি নিবে? ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে সাতটা বিশ। শুভর আসার সময় হয়ে গেছে। ভয়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। কপালে জমছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। কিছুক্ষণ পর পর পানি খাচ্ছে সুহা।

চলবে..!!

[মাহিন সুহার জুটি কেমন লাগে আপনাদের? আমার তো ওদের অনেক ভালো লাগে! হ্যাপি রিডিং🧡]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here