#অনুভবী_হিয়া
#মাইশাতুল_মিহির
৩০.
ছোট একটা চা’য়ের দোকানে বসে আছে শুভ, আদিল, রাহুল আর সামির। সবাই বিস্মিত হয়ে আছে।
‘ভাইরে ভাই, মাহিন একটা চিজ বলতে হবে।’ সামির বললো। আদিল হেসে বলে, ‘মাহিনের কাছ থেকে আমাদের শিখা উচিত।’
‘শালায় গাছের আগাও নিবে আবার গোড়াও খুড়াবে।’ ফিচেল গলায় বলে রাহুল। আদিল মাথায় চাপড় মেরে বলে, ‘ছোট বোন জামাইকে শালা বলে কেউ? গাদা।’
সামির সিরিয়াস হয়ে বলে, ‘শুভ তোর কি মনে হয়? মানে সুহার ব্যাপার টা কি মেনে নিবি?’ শান্ত কন্ঠে বলে শুভ, ‘সুহার কষ্ট পাক সেটা আমি জানি না।’
আদিল বললো, ‘মাহিন কিন্তু ছেলে হিসেবে ভালো। ওর ক্যারেক্টার, পারসোনালিটি, এটিটিউট সব কিছুই পারফেক্ট।’
অবাক হয়ে বলে রাহুল, ‘মানে কি ভাই? তোরা এতো সিম্পল ভাবে নিতেছিস কিভাবে? ব্যাটায় আমাদের নাকে ধরি বেধে ঘুরিয়েছে আর তোরা?’
সামির হাই তুলে বলে, ‘টিট ফর টেট বলে একটা কথা আছে ভাই।’ বাকা হাসে শুভ।
_________________
রাত নয় টা চল্লিশ! পড়ার টেবিলে বসে কলম কামড়াচ্ছে সুহা। ভয়ে খাবার খেতে যায় নি সে। শুভ এসে রাত আটটায়। এতোক্ষণে নিশ্চয় বাবা মা কে বলে দিয়েছে। ভেবেই গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। এখন নিশ্চয় সিনেমাটিক ঘটনা ঘটবে? আব্বু বাহিরে যাওয়া বন্ধ করে রুমে তালা দিয়ে রাখবে? ভাই ভিলেনের মতো মাহিনকে মারবে? আম্মু কড়া কথা শুনাবে? বিয়ে ঠিক করবে? হায় আল্লাহ!
‘কিরে সুহামনি কি করছিস?’ ভাইয়ের কথায় শুকনো ঢুক গিলে পিছে তাকায় সুহা। নিশব্দে চেয়ার ছেড়ে জড়সড় হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। শুভ বিছানায় আরাম করে বসে বলে, ‘এইদিকে আয় কথা আছে।’
চুপচাপ ভাইয়ের সামনে বসে সুহা। খারাপ লাগা সাথে ভয়ও কাজ করছে তার মাঝে। শুভ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বুঝতে পেরেছে সেটা। মুখে গম্ভীরতা রেখে বলে, ‘কত দিন ধরে সম্পর্ক তোদের?’
মিনমিনে গলায় বলে সুহা, ‘ চার মাস। ‘
‘মাহিনের সাথে কিভাবে পরিচয় হয় তোর?’
সুহা কাপাকাপা গলায় বলে, ‘কলেজের সামনে।’ শুভ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলে, ‘তুই জানিস কি করেছিস তুই?’
সুহা এবার কেঁদে ফেলে। নাক টেনে বলে, ‘আই’ম সরি ভাইয়া। আমি বুঝতে পারিনি। সো সরি। বিশ্বাস করো ভাইয়া মাহিন খুব ভাল ছেলে।’
সুহার কান্নায় হতভম্ব হয়ে যায় শুভ। একটু ভয় দেখাতে চেয়েছিলো শুধু। পরোক্ষনে হেসে সুহাকে টেনে বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘বোকা মেয়ে কাঁদছিস কেনো? আমি কি তোকে বকেছি? কাঁদিস না।’
সুহা নাক টেনে কান্না কমিয়ে বলে, ‘ভাইয়া আমি মাহিনকে অনেক ভালোবাসি। প্লিজ ভাইয়া না করো না। মাহিন খুব ভালো ছেলে আমাকে অনেক ভালোবাসে।’
শুভ মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে, ‘আমি কি একবারো বলেছি মাহিন খারাপ ছেলে? আব্বুকে তো বলতে হবে তাদের আদরের দুলালী কি করছে।’ সুহা আতংকে চট করে মাথা তুলে। ভয়ার্ত গলায় বলে, ‘প্লিজ ভাইয়া আব্বুকে এখন বলো না।’
শুভ হেসে সুহার দুই গাল টেনে বলে, ‘ওহ মাই লিটল প্রিন্সেস কাউকে বলবো না। চিন্তা করিস না তোদের ব্যাপার টা আমি সামলে নিবো।’ সুহা কান্না থামিয়ে চোখ মুখ মুছে ভালো করে বসে। শুভ তার কপালে পরে থাকা চুল হাত দিয়ে পিছে ঠেলে বলে, ‘মাহিন কে জানিস?’
‘হ্যা জানি তো। জানবো না কেনো?’
‘মাহিন যে মিহির বড় ভাই সেটা জানিস?’
‘ওহ! কি? কি বললে????’ বিস্ফোরিত হয়ে চেঁচিয়ে বলে সুহা। শুভ অবাক হয়ে বলে, ‘ওমা মাহিনের বোনের সম্পর্কেও জানিস না?’
সুহা উল্লাসিত হয়ে বিছানা থেকে লাফিয়ে বলে, ‘ওয়াও ভাইয়া এটা আমাকে কি শুনালে? জানো ভাইয়া মিহির আপুর সাথে লাইব্রেরী তে একবার দেখা হয়েছিলো। মাহিনের মোবাইল দিয়েও কয়েকবার কথা বলেছিলাম। আমি তো বিশ্বাস করতে পারছি না হবু ভাবি আমার ননদ হবে। আই’ম সো এক্সাইটেড ভাইয়া।’
‘এখন তোর একটা কাজ করতে হবে।’ সুহা শুভর পাশে বলে, ‘কি কাজ ভাইয়া?’ শুভ বাকা হেসে সুহা কে বলে। সুহা বিস্মত হয়ে যায়। অবাক স্বরে বলে, ‘ভাইয়া? আমি পারবো না।’
‘প্লিজ রাজি হয়ে যা। এটা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।’ অনুনয় স্বরে বলে শুভ। সুহা কিছুক্ষণ ঠোট কামড়ে চিন্তা করে বলে, ‘ঠিক আছে।’
_______________
রাতে মাহিন একা একা হেটে বাসায় যাচ্ছিলো। মেইন রোড থেকে তাদের এলাকার গলিতে ঢুকার রাস্তাটায় হেটে যায় সে। রাতের নিরিবিলি পরিবেশে একা হাটার আনন্দই আলাদা। কুমিল্লা তে থাকতে সে রাতে একা বেরিয়ে যেতো রাস্তায়। মাঝে মাঝে তার সঙ্গী হতো শান্ত সবুজ। আজ বিকেলের সুহা শুভ সাথে দেখা হওয়ার পর সে সোজা ল্যাবে চলে গিয়েছিলো। তারপর থেকে ব্যস্ততায় কেটেছে। সুহাকে কল দিতেও পারেনি। এতোক্ষনে নিশ্চয় মেয়েটা ঘুমিয়ে গেছে। মাহিন হাত ঘরিতে দেখে রাত এগারো টা বিয়াল্লিশ। বাসার গেইটের সামনে যেতেই হঠাৎ কেউ তার মুখ কালো কাপড় দিয়ে বেধে ফেলে। মাহিন কিছু বুঝে উঠার আগেই কয়েকজন যুবক তাকে বেধর পিটাতে থাকে। রাস্তার মাঝে ফেলে পা দিয়ে, হাতে থাকা হকিস্টিক দিয়ে মারছে মাহিনকে।
বাহিরে হট্টগোলের আওয়াজে দাড়োয়ান গেইট খুলে বের হয়। একটা ছেলেকে কয়েকজন পিটাচ্ছে দেখে চেঁচাতে থাকে। আশে পাশের বিল্ডিংয়ের দারোয়ানরা বেরিয়ে আসায় ছেলেগুলো গাড়িতে উঠে চলে যায়। আহত ছেলেটর দিকে এগিয়ে গিয়ে মুখ থেকে কাপড় সরাতেই আতকে উঠে দারোয়ান রা। কল দিয়ে মাহিনের মা রাশেদা আর মিহিরকে জানানো হয়। আহত মাহিনকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
হাসপাতালের করিডরে বসে কাঁদছে মিহির। পাশে রাশেদা শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেঝেতে। চোখের পানি যেনো শুকিয়ে গেছে তার। ভাবছে সব। মাহিনের বাবা মারা যাবার পর থেকে তার আর মিহিরের দায়িত্ব সুন্দর ভাবে পলন করে মাহিন। ছেলেটা এইটুকু বয়সে কত কিছু করেছে সেটা মুখ ফুটে না বললেও সে বুঝে। বুঝবে না কেনো সে তো মা।
ডক্টর মাহিনের কেবিন থেকে বেরিয়ে জানালো, ‘প্রেশেন্ট কে ধারালো চাকু দিয়ে বাজে ভাবে আঘাত করা হয়েছে। সম্ভবত তাকে মারার পরিকল্পনা করা হয়েছিলো। পেটের বা পাশে চাকু ঢুকার কারণে অপারেশন করতে হবে। বেশ গভীর ভাবে জখম করা হয়েছে উনাকে। ডান হাত ভেঙে গেছে আর মাথায় আঘাত পেয়েছে। আপাতত আমরা কিছু বলতে পারছি না। ইমার্জেন্সি ব্লাড লাগবে। ব্লাড গ্রুপ বি-পজিটিভ। আপনারা ব্লাড যোগাড় করুন। আমরা অপারেশনের ব্যবস্থা করছি।’
রাশেদা মুখে আচল দিয়ে কাঁদছে। মিহির প্রায় জ্ঞানশূন্য হয়ে পরেছে। কি করবে, কোথায় থেকে ব্লাড যোগার করবে বুঝতে পারছে। তার ব্লাড গ্রুপ বি-পজিটিভ কিন্তু শারীরিক ভাবে বেশ দুর্বল হওয়ায় ডক্টর বারন করে দিয়েছে। মিহির হাতের মোবাইল বের করে শান্তকে কল দিয়ে জানায় সব। তাৎক্ষণাত শান্ত সবুজ ঢাকার উদ্দেশ্যে রৌওনা হয়। হাসপাতালে আপাতত মিহির, রাশেদা আর তাদের বাড়ির দারোয়ান আছে। দারোয়ানও রক্ত যোগার করার চেষ্টা করছে।
_________________
আপন ভাইয়ের এমন অবস্থায় মিহির নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না। সে কিছুই করতে পারছে না তার ভাইয়ের জন্য। বড্ড অসহায় লাগছে নিজেকে। রক্ত কোথায় থেকে জোগাড় করবে এখন? মিহিরের মাথায় হঠাৎ শুভর কথা আসে। কি ভাবে যেনো তাকে কল দেয় সে। মাঝ রাতে মিহিরের কল পেয়ে খুশী হয় শুভ। কল রিসিভ করেই উল্লাসিত হয়ে বলে, ‘কি ব্যাপার মিহি? তুমি নিজে থেকে আজ কল দিলে?’
ঠোট ভেঙ্গে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলে মিহির। শুভ অস্থির হয়ে যায় কান্নার আওয়াজ শুনে। বিচলিত হয়ে বলে, ‘মিহি কি হয়েছে? কাঁদছ কেনো? বলো আমাকে।’
ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে মিহির, ‘শুভ ভাইয়ের জন্য ইমার্জেন্সি ব্লাড লাগবে। কিন্তু এতো রাতে ব্লাড যোগার করতে পারছি না। আমি কি করবো কিছু বুঝতে পারছি না। তুমি আসো প্লিজ। ভাইয়ের কিছু হলে আমি মরে যাবো শুভ।’
শুভ নিজেকে শান্ত রেখে বলে, ‘কোন হাসপাতাল? আর মাহিনের ব্লাড গ্রুপ কি?’
‘বি-পজিটিভ। আমি তোমাকে লোকেশন সেন্ড করে দিচ্ছি।’ শুভ ‘আচ্ছা’ বলে কল কেটে দেয়। তার পর কল লাগায় তার ফ্রেন্ড রাহুলের কাছে। মোবাইল কানে রেখেই বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। গ্যারেজ থেকে বাইক নিয়ে স্টার্ট দেয় হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।
সামির, আদিল আর রাহুলকে নিয়ে হাসপাতালে আসে শুভ। রাহুলের ব্লাড গ্রুপ সেম হওয়ার রাহুল রক্ত দিতে কেবিনে গেছে। মাহিনের বন্ধু বলে পরিচয় দেয় রাশেদার কাছে। চেয়ারে বসে মাথায় দুই হাত ঠেকিয়ে কাঁদছে মিহির। একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে শুভ। অসহায় লাগছে তার নিজেকে। এখন যদি মিহিকে বুকে জড়িয়ে শান্তনা দিয়ে বলতে পারতো ‘এই মেয়ে কেদো না সব ঠিক হয়ে যাবে।’
মাহিনের জন্য দুই ব্যাগ রক্ত লাগে। রাহুল একব্যাগ দেওয়ার পর আদিল এক ব্যাগ দেয়। অপারেশনের কাজ এখনো চলমান। শান্ত অপর পাশ থেকে বার বার কল দিয়ে খবর নিচ্ছে। তাদের আসতে আর এক ঘন্টার মতো লাগবে। যতো দ্রুত সম্ভব হাই স্প্রিডে গাড়ি চালাচ্ছে শান্ত। চোখে পানি চিকচিক করছে তার। নিজেকে দুষারোপ করছে সে। আজ যদি সে কুমিল্লা না আসতো তাহলে মাহিনের এমন হতো। সে অন্তত্য থাকতো মাহিনের পাশে। ভাই হয়ে কিভাবে সে মাহিনকে রক্ষা করতে পারেনি??
চলবে???