#অনুভবী_হিয়া
#মাইশাতুল_মিহির
৩৬.
মিহিরের বিদায়ের সময় কান্না কাটির রেশ পরে। মাহিন রাশেদা কোনো রকম সামলে মিহিরকে গাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যায়। গাড়িতে উঠার আগে মিহির মাহিনকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদে। মাহিনের ভিতরের কলিজা যেনো কেউ ছিনিয়ে নিয়েছে। চোখ ভিজে আসে মাহিনের। এই প্রথম মাহিনকে কাঁদতে দেখে শান্ত। পুরো টা সময় হাসিখুশি মুখে ছিলো সবুজ।
মিহিরের একহাত শুভর হাতে রেখে বলে শান্ত গলায় বলে মাহিন, ‘ছোট থেকে এখন পর্যন্ত, এমনকি বাবা মা:রা যাবার পর থেকে আমার বোনের চোখে পানি আসতে দেয়নি আমি। আজ তার দায়িত্ব আমি আপনাকে দিচ্ছি। হাসিখুশি, স্বযত্নে আগলে রাখবেন আমার বোনকে। মনে রাখবেন মাহিন কখনো তার বোনের চোখের পানি সয্য করতে পারে না। পুরো দুনিয়া উল্টে ফেলবে সে। কিয়ামত বাধিয়ে ফেলতে দ্বিতীয় বার ভাববে না। আশা করি বুঝতে পেরেছেন।’
রাহুল সামিরকে নিচু স্বরে বলে, ‘ভাই এটা কে বলে ঠান্ডা মাথায় জলজ্যান্ত থ্রে:ট দেওয়া।’ সামির এক হাত মুখের সামনে এনে খুকখুক করে কেশে ফেলে।
মিহিরকে গাড়িতে উঠিয়ে দেয় মাহিন। মিহির কাঁদছে, বার বার বলছে সে যাবে না। মাহিন তার কপালে চুমু একে বলে, ‘লক্ষি বোন আমার। আমি কাল ঢাকা যাবো তো। তখন তোকে নিয়ে আসবো। কাঁদিস না প্লিজ। তুই জানিস তোর কান্না দেখলে তোর ভাইয়ের অনেক কষ্ট হয়। তুই কি ইচ্ছে করে তোর ভাইকে কষ্ট দিচ্ছিস?’
মিহির মাথা দুলিয়ে না বলে। মাহিন আবার বোনকে দুই হাতে আগলে বলে, ‘সাবধানে থাকিস। আই লাভ ইউ মাই লিটল প্রিন্সেস সিস্টার। লাভ ইউ সো মাচ।’🖤
ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দেয়। চলতে থাকে গাড়ি ঢাকার উদ্দেশ্যে। প্রথম গাড়িতে আছে শুভ মিহির আর সুহা। অন্য গাড়িতে আয়াজ রায়হান, সামির, আদিল আর রাহুল আছে।
_________________
ঘড়ির কাটা তখন রাত দুইটা ছুঁই ছুঁই। চারপাশ পিনপিন নিরবতা বিরাজমান। স্থব্ধ হয়ে আছে পরিবেশ। দূরের আকাশের মেঘে ঢেকে থাকা চাঁদের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সবুজ। কষ্ট হচ্ছে তার। হয়তো ভালোবাসার মানুষকে হারানোর কষ্ট। মিহির যখন ক্লাস এইটে পরতো তখন লাল শাড়ি গাঁয়ের বধূদের মতো পরেছিলো। সেইদিন থেকে ভালোলাগা কাজ করে সবুজের মনে। আজ পর্যন্ত মিহিরের অজান্তে তাকে খুব করে ভালোবেসে ছিলো সে। সে জানতো শুভর কথা। যখন মিহিরের রিলেশন ছিলো তখন মিহিরের খুশীর কথা চিন্তা করে দূরে সরে যায় সে। যখন ব্রেক’আপ হয় তখন যেনো অন্ধকার গুহায় এক এক চিলতে রোদ এসেছিলো তার মনে। আজমির যখন বিয়ে ঠিক করলো মিহিরের সাথে তখন সবুজ খুব বেশী খুশি হয়েছিলো তার ভালোনাসার মানুষকে পাবে বলে। কিন্তু যখন ছাদে মিহিরকে কেঁদে বলতে শুনেছে তখন যেনো তার পুরো দুনিয়া থেমে গিয়েছিলো। বেড়িয়ে গিয়েছিলো বাড়ি থেকে। রাস্তার পাশে বসে হাউমাউ করে কেঁদেছিল সে। পরে শুভর সাথে যোগাযোগ করে সে।
হাতে থাকা সিগারেট শেষ হওয়ায় পকেট থেকে আরেকটা সিগারেট বের করে লাইটার দিয়ে জ্বালায় সবুজ। মুখে নিয়ে টান দিয়ে মুক্ত আকাশে ধোয়া উড়ায়। তখন নিশব্দে পাশে বসে মাহিন। কিন্তু সবুজের মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। সে আগের মতোই নির্বিকার, নিস্থব্ধ।
‘খুব ভালোবাসতে তাই না ভাই?’
হেসে ফেলে সবুজ। এই হাসির মধ্যে রয়েছে একরাশ চাপা আর্তনাদ। ফিচেল গলায় বলে, ‘এটা কি তোর অজানা?’
মৃদু আওয়াজে হাসে মাহিন। তারপর বলে, ‘তাহলে শুভর সাথে বিয়েটা না দিলেও পারতে।’ শীতল চাহনী দেয় মাহিনের দিকে সবুজ। ছাদে গা এলিয়ে দুইহাত মাথার নিছে রেখে মুক্ত আকাশের পানে তাকিয়ে নরম গলায় বলে সবুজ, ‘ভালোবাসলেই পেতে হবে এমন তো নয় মাহিন। দূর থেকেও ভালোবাসা যায়। ভালোবাসার মানুষটার সুখটাই সব চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। মিহুপরি ভালো তো আমি ভালো, মিহুপরি খুশী তো আমি খুশী, মিহুপরি ব্যথিত তো আমিও ব্যথিত। ভালো থাকুক সে। আকাশের লক্ষ তারার মতো সুখ ভেয়ে আসুক তার জীবনে। আমি দূর থেকেই তাকে দেখে আজীবন ভালোবেসে যাবো।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাহিন। অন্তত্য সবুজের মতো এতো ভালো মানুষ, ধৈয্যশীল নয় সে। নিজের ভালোবাসার মানুষকে অন্য কেউ বিয়ে করবে আর সে চুপচাপ দেখবে এমন ইহকালে কখনোই হবে না। নিজের জিনিস নিজেই আদায় করতে জানে মাহিন। বাকা হাসে সে। সঙ্গ দেয় সবুজের একাকিত্বের।
_________________
রাত তখন দুইটা পনেরো। শুভর রুমে বসে আছে মিহির। একটু আগে শুভর মা মিথিলা তাকে বরণ করে হাতে একটা সুতি শাড়ি দিয়ে শুভর রুমে দিয়ে যায়। রাত হয়ে যাওয়ায় মিথিলা কথা বাড়ায় নি। সকালে নাহয় জমিয়ে কথা বলা যাবে। লম্বা দম ফেলে মিহির। ভিতরে কেমন জড়তা ভয় কাজ করছে তার। ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে শাড়ি বদলায় সে। খয়েরি রঙের শাড়ি লাল পার পছন্দ হয়ে মিহিরের। চোখ ঘুরিয়ে পুরো রুম টা দেখছে মিহির। টেবিলের কর্নারের উপরে তার একটা ছবি দেখে থমকে যায় সে। ছবিটা হাতে নিয়ে দেখে অনেক আগে যখন ভার্সিটিতে নতুন ভর্তি হয় মিহির তখনের। পুরো ভার্সিটিতে তো শুভর দাপট ছিলো বেশ। ভার্সিটির সামনে বা পাশে একটা বড় শিমুল গাছ আছে সেখানে শুভরা আড্ডা দিতো। একবার মিহিরকে সেখানে ডেকে একপ্রকার জোড় করে শুভর পাশে বসিয়ে রেখেছিলো। মিহির বিরক্ত হয়ে দুই গালে হাত দিয়ে মুখ ফুলিয়ে রেখেছে আর শুভ তার দিকে হাস্যউজ্জল চেহারায় তাকিয়ে আছে। হয়তো তখন কেউ একজন তাদের ছবি তুলে ছিলো। আর সেই ছবি শুভ এখনো যত্ন করে রেখেছে। হেসে ফেলে মিহির।
‘শুধু ছবি দেখে হাসলেই চলবে আমাকেও তো দেখতে পারো।’ পিছে তাকিয়ে দেখে শুভ দরজায় হেলান দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এবার যেনো ভয়টা মিহিরকে আরো আকরে ধরেছে।
শুভ রুমে এসে বিছানায় বসে। পরনে তার হুয়াইট কালার টি-শার্ট। হঠাৎ শুভর আহত হওয়ার কথা মাথায় আসতেই মিহির শুভর পাশে বসে প্রশ্ন ছুঁড়ে, ‘আপনাদের কি হয়েছে? চারজনই আহত কেনো?’
শুভ মিহিরের দিকে তাকিয়ে ত্যাছড়া ভাবে বলে, ‘বিয়ে তো করতে যাচ্ছিলে। তাড়াতাড়ি কুমিল্লা যাওয়ার সময় ছোট খাটো একটা এক্সিডেন্ট হয়।’ মিহির কিছু বলবে তার আগেই ফোন বেজে উঠে। নিশব্দে কল রিসিভ করে বলে মিহির, ‘হ্যালো?’
অপর পাশ থেকে মিতু অস্থির হয়ে বলে, ‘হারামি কুত্তি কি করছিস? বিয়ে করে ফেলছিস তুই? আমাকে জানালি না?’ মিহির চোখ ছোট ছোট করে উত্তর দেয়, ‘ ফাজিল মাইয়া এইসব জিজ্ঞেস করতে কল দিয়েছিস?’
হেসে বলে মিতু, ‘দোস্ত একখান কথা জানাবার লাইগা কল দিছিলাম। আগামী এক সাপ্তাহ ভাইকে তোর আশেপাশে ঘেঁষতে দিস না।’
চোখ ছানাবড়া করে বলে, ‘কি? ফাজিল মেয়ে।’
‘আরে তোরে যে এতো দিন কষ্ট দিছিল তার শোধ নিবি না? যা বলছি তাই কর। বেশি বুঝিস না।’
মিতুর কথায় মিহির আহাম্মকের মতো বলে উঠে, ‘এটা আবার কেমন কথা?’
মিতু হেসে বলে, ‘আরে একটু রিভেঞ্জ নে না ভাই। মজা হবে। আমি আয়না এসে একদিন বাসর ঘর সাজিয়ে তোর জামাইর কাছ থেকে টাকা হাতাবো। ততোদিন পর্যন্ত ওয়েট কর।’
মিহির নাক মুখ কুঁচকে বলে, ‘তুই বেশি নেগেটিভ বইন। এমন কিছুই হবে না। ফোন রাখ।’
মিতু মুচকি হেসে আন্তরিকতার সাথে বলে, ‘আচ্ছা আচ্ছা এবার রাখি। হ্যাপি ম্যারিড লাইফ দোস্ত।’
মিতু কল কাটার পর শুভর দিকে তাকায় মিহির। তারপর শুকনো ঢুক গিলে বলে, ‘আমার ঘুম পাচ্ছে গুড নাইট।’ বলেই তড়িঘড়ি করে বিছানার একপাশে শুয়ে পরে মিহির। শুভ অবাক হয়ে যায়। সেও অপরপাশে শুয়ে পিছন থেকে মিহিরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পরে।
চলবে..???
[সবাই কিপ্টুস। কেউ গিফট দেওনি তোমরা। 😒😒]