#অনুভবী_হিয়া
#মাইশাতুল_মিহির
৪০.
সকালের কোলাহলে ঘুম ভাঙ্গে সুহার। চোখ মুখ কুঁচকে আশে পাশে তাকিয়ে দেখে সে রুমে একা। মাহিন উঠে পরেছে ভেবে সুহা নিজেকে গুছিয়ে ওয়াশরুমে যায়। গোসল শেষে লাল রঙের ওয়ান পিস জামা, কালো জিন্স পরে বের হয় রুম থেকে। হাতে থাকা রক্তিম মেহেদীর রঙের সাথে পরিহিত লাল জামা নববধূ লাগছে। শুধু শাড়ি মিসিং আরকি। ডাইনিং টেবিলেং টেবিলে গিয়ে দেখে সকলে উপস্থিত। সুহা চুপচাপ নিজের চেয়ার টেনে বসে পরে। তখন মিথিলা জিজ্ঞেস করে, ‘একা এলি যে মাহিন কোথায়?’
প্লেটে খাবার নিতে গিয়ে থেমে যায় সুহা। কপালে সূক্ষ্ম চিন্তার ভাজ ফেলে বলে, ‘ঘুন থেকে উঠে তো দেখি নি। তোমরা জানো না?’
তখন রাশেদা বলে উঠে, ‘ছেলেটা এমনই। কখন বের হয়, কখন আসে কিছুই জানি না। হয়তো গোয়েন্দাগিরি করতে গেছে। এসে পরবে ইন’শা’আল্লাহ।’
মিহিরও সম্মতি জানায় রাশেদার সাথে। সুহা চিন্তার ভাজ এক পাশে রেখে খাবারে মন দেয়।
রুমে এসে পায়চারী করছে সুহা। বারবার মাহিনের নাম্বারে ডায়াল করছে কিন্তু মাহিন কল ধরছে না। এবার যেনো তার চিন্তা রিরি করে বেরে গেলো। কাল রাতের কথা মনে পরতেই বুকটা ধক করে উঠে। কু ডাকছে মন। শেষ রাতে সুহা খুব বাজে একটা স্বপ্ন দেখে। কেউ একজন মাহিনকে ধারালো চাকু দিয়ে জখম করে। এমন ভয়ানক স্বপ্ন দেখে তাৎক্ষনাৎ শুয়া থেকে উঠে বসে। পাশে মাহিনকে ঘুমাতে দেখে মন টা একটু শান্ত হয় তার। টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি ঢক ঢক করে খেয়ে নেয়। মাহিনের পাশে শুয়ে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সুহা। রাত থেকেই কেমন কু ডাকছে তার মন। বারবার মনে হচ্ছে খারাপ কিছু হবে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। মোবাইলটা বিরক্তি নিয়ে বিছানায় ফেলে বসে পরে সুহা। কিছুই ভালো লাগছে না তার। তখন মোবাইলে টুংটাং আওয়াজ কানে আসে। তড়িৎ শক্তিতে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে আননোন নাম্বারে ম্যাসেজ এসেছে। ম্যাসেজে মাহিনের কিনা সদ্য নতুন এপার্টমেন্টের ঠিকানা দিয়ে লিখা,
‘তাড়াতাড়ি আসো সারপ্রাইজ আছে। অপেক্ষা করছি তোমার জন্য সুহামনি!’
ম্যাসেজ টা দেখে খুশী হয় সুহা। তারমানে মাহিন আমাকে সারপ্রাইজ দিতে সকাল সকাল কাউকে না বলে বেরিয়ে গেছে? আর কিছু ভাবলো না সে। তাড়াতাড়ি করে কাউ কে কিছু না বলে বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে। বাড়ির গাড়ি নিয়েই বের হয় সুহা। ড্রাইভার কে কাঙ্ক্ষিত জায়গা দেখিয়ে গাড়ি চালাতে বলে। বৃদ্ধ ড্রাইভার করিম আড় চোখে একবার সুহা কে দেখে। তারপর ওখানে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে সুহা হাসিমুখে উত্তর দেয়, ‘মাহিন আমাকে সারপ্রাইজ দিতে তার এপার্টমেন্টে যেতে বলেছে। আই’ম সো এক্সাইটেড চাচা।’
বিনিময়ে করিম মলিন হাসে। কারন সকালে মাহিন বেরিয়ে যাবার সময় করিম জিজ্ঞেস করতেই মাহিন বলেছিলো ইনভেস্টিগেশনের জন্য একটা জায়গায় যেতে হবে আর সেটা খুব আর্জেন্ট। কিন্তু সুহার কথা শুনে করিম বিশ্বাস করতে পারলো না। মনে সন্দেহের ছাপ রেখেই ড্রাইভে মনোযোগ দেয় সে।
দীর্ঘ ৪০ মিনিট ড্রাইভ করার পর কাঙ্ক্ষিত স্থানে এসে পৌছায় সুহা। ড্রাইভার চাচা কে বিদায় জানিয়ে নয়তলার বিল্ডিং’য়ের ভিতরে ঢুকে সে। সুহা যেতেই করিম মাহিনের নাম্বারে কল দেয়। দুইবার রিং হবার পরেই মাহিন কল রিসিভ করে। তখন করিম জিজ্ঞেস করে, ‘বাবা কোথায় আছো তুমি?’
মাহিন স্বাভাবিক ভাবে বলে উঠে, ‘কাকা আপনাকে না সকালে বললাম?’
থমথমে খায় করিম। ফিচেল গলায় বলে, ‘তাহলে সুহা বললো যে তুমি তাকে সারপ্রাইজ দিচ্ছো।’
মাহিনের কপালে সূক্ষ্ম ভাজ পরে তখন। তারপর বলে, ‘আমি বলেছি মানে? সুহার সাথে তো আমার এমন কোনো কথা হয়নি।’
‘তাহলে সুহা যে আমাকে নিয়ে এলো এখানে।’
মাহিন চিন্তিত কন্ঠে বলে, ‘কোথায় আছেন আপনারা?’
‘তুমি যেই এপার্টমেন্ট নিয়েছ সেখানে। বাবা আমার কেমন সন্দেহ হইতাছে। তাড়াতাড়ি আসো।”
মাহিন আর এক মিনিটও দাঁড়ায় না। কাউকে কিছু না বলে ছুটে বিরিয়ে আসে সে। বাইক স্টার্ট দিয়ে তুমুল ভেগে চালাতে থাকে।
.
মাহিন কল কাটতেই করিম শুভর নাম্বারে কল দিয়ে সব বলে। শুভর পাশে মিহিরও ছিলো বিধায় সে সব শুনেছে। শুভ চিন্তায় পরে যায়। কারণ মাহিন বলেছিলো সুহা আর মিহিরের লাইফ অনেক রিক্সে আছে। শুভ বেরিয়ে যাবার সময় বাধ সাদে মিহির। সেও যাবে শুভর সাথে। বাধ্য হয়ে মিহিরকে নিয়ে বের হয় শুভ।
________________
লিফটে উঠে চার নাম্বার বাটন চাপে সুহা। মনটা বেশ ফুরফুরে তার। উত্তেজনায় টান টান অবস্থা। চার তলায় লিফট থামতেই বেরিয়ে যায় সুহা। বাসার সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল বাজায় সে। কিন্তু দরজা খুলে না কেউ। পরপর কয়েকবার বাজানোর পরেও যখন দরজা খুলে না তখন সুহা হাত বারিয়ে লক ঘুরায়। দরজা খুলতেই অবাক হয়ে যায় সে। লম্বা দম ফেলে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে। পুরো ফ্লাট ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢাকা। সুহা কয়েকবার মাহিন বলে ডাক দেয়। এগিয়ে যেতেই হঠাৎ কিছু একটার সাথে পায়ে উষ্টা খায়। ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠে সে। তখন পুরো ফ্লাটের লাইট অন হয়ে যায়। সুহা পুরো ফ্লাট টাতে চোখ বুলায়। সোফায় চোখ যেতেই থমকে যায় সে। কেউ একজন পায়ের উপর পা তুলে আয়েশি ভঙ্গিতে আপেল খাচ্ছে। সুহা ভয়ার্ত গলায় বলে, ‘কে আপনি?’
আপেলে কামড় বসিয়ে রসালো কন্ঠে উত্তর দেয়, ‘জিহান কবির!’
সুহা ভয়ে শুকনো ঢুক গিলে। অতঃপর শক্ত গলায় বলে, ‘আপনি এখানে কেনো? মাহিন কোথায়?’
জিহান নির্বিকার ভাবে উত্তর দেয়, ‘মাহিন এখানে থাকবে কেনো? আমি তোমাকে আসতে বলেছি যেহেতু আমিই থাকবো তাই না সুহামনি?’
বিস্মিত চোখে তাকায় সুহা। অবাক কন্ঠে বলে, ‘আপনি ডেকেছেন মানে?’
বাকা হেসে ফেলে জিহান। তারপর বলে, ‘ইয়াহ্ আমি তোমাকে ম্যাসেজ করেছিলাম কিউটি। আর তুমি? হুরহুর করে এসে পরেছো।”
সুহা তড়িঘড়ি করে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে চাইলেই তার আগে জিহান দরজায় গিয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে উঠে, ‘বাহ্ মাহিনের চয়েজ আছে বলো। তুমি তো দেখছি আসলেই অনেক হট বেবস। আসো আজ এঞ্জয় করি মাহিন কিছু জানবে না ট্রাস্ট মি।’
রাগে অপমানে শরিল রিরি করে উঠে সুহার। জিহানের থেকে এমন বাক্য শুনে হাত উঠিয়ে থাপ্পড় দিতে যাবে তখন জিহান সুহার হাত ধরে তাকে ঘুরিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। সুহা নিজেকে ছাড়ার চেষ্টা করতেই জিহান বলে উঠে, ‘উহুম বেবি এতো সহজে ছাড়ছি না তোমায়। মাহিনের সাথে সব হিসেব নিকেশ আজ তোমাকে দিয়ে চুকাবো সুহামনি।’
সুহার বুক ধক করে উঠে। তাহলে মাহিনের সাথে শত্রুতামী করে জিহান তাকে ব্যবহার করছে? আজই তাহলে সুহার শেষ দিন? আত্মসম্মান আজই বিসর্জন হবে সুহার? নিজেকে শান্ত করে সুহা হঠাৎ জিহানের পায়ে লাথি দিয়ে সামনে দৌড় দেয়। জিহানও সাথে সাথে সুহার পিছে দৌড় লাগায়। সুহা একটা রুমে গিয়ে দরজা লাগাতে নিলেই জিহান হাত দিয়ে আটকে ফেলে। সুহা দরজার কাছ থেকে দূরে গিয়ে একটা কাচের ফ্লাওয়ার ব্যাজ হাতে নিয়ে বলে, ‘খবরদার একদম কাছে আসার চেষ্টা করবি না।’
উচ্চস্বরে হেসে ফেলে জিহান। তারপর বলে উঠে, ‘দেখা যাক।’ এগিয়ে যায় সুহার কাছে। সুহার হাত ধরতেই সুহা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। ধস্তাধস্তির কারনে পুরো রুম লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। স্বজোড়ে একটা থাপ্পড় দেয় সুহার গালে জিহান। তাল সামলাতে না পেরে ফ্লোরে পরে যায়। জিহান সুহার চুল ধরে বলে, ‘কি ভেবেছিস তোকে বেড পার্টনার বানাতে এনেছি? চাইলেই পারতাম কিন্তু আমি এতো টাও নিকৃষ্ট না। তোকে মেরে আমি আমার মায়ের প্রতিশোধ নিবো। মাহিন যেমন আমার মাকে দূরে নিয়েছে ঠিক তেমনি মাহিনের কাছের মানুষকে মেরে প্রতিশোধ নিবো। তোকে মেরে মিহির কে মারবো।’
তীব্র ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠে সুহা। হাতের পাশে থাকা কাচের টুকরো হাতে নিয়ে জিহানের বাহুতে ঢুকিয়ে দেয়। জিহান ব্যাথায় হাত আলগা করে ফেলে। সুহা দৌড়ে অন্য দরজা দিয়ে বের হয়। সামনে এসে দেখে সে বারান্দার এসেছে। শিট কত বড় ভুল করলো সে। পালাতে পিছে ঘুরে দেখে জিহান বাকা হেসে দাঁড়িয়ে আছে। সুহা দুকদম পিছিয়ে রেলিং’য়ের কাছে গিয়ে বলে, ‘প্লিজ আমাকে মেরো না।’
জিহান এগিয়ে এসে সুহার দু পাশে হাত রেখে ঝুকে বলে, ‘বেবি, আজকে তোমাকে কেউ বাচাতে পারবে না। সো সরি কিউটি। সত্যি কি জানো? তুমি খুব সুন্দর কিন্তু মাহিনের বউ। এটাই সবচেয়ে বড় ভুল তোমার।’
বলেই সুহার মুখের কাছে মুখ নেয় জিহান। সুহা মুখ কুচকে ফেলে। এক হাতে সুহার মুখ উপরে তুলে গালে চুমু দিয়ে বলে, “গুড বাই সুহামনি!’ তখন মাহিনের কন্ঠ কানে আসে সুহার। অস্ফুটিত কন্ঠে সুহা কাপাকাপা গলায় ‘মা’হি’ন’ বলে। জিহান দাতে দাত চেপে ধাক্কা দেয় সুহাকে। ‘আ/হ’ বলে চেঁচিয়ে উঠে সুহা।
চলবে??