#পূর্ণময়ীর_বিসর্জন
#মৌমি_দত্ত
#পর্ব_১৪
কাল রাতে অনুবিকা নিজের রুমে যে ঢুকলো আর বের হয়নি। কিন্তু পূর্ণ বের হলো ঠিক সকাল ৯ টায়। পুরো ঘর চুপচাপ। এতোটা সময় হওয়ার পরেও আয়ান সাহেবকে সোফায় পেপার হাতে মগ্ন দেখে অবাক হলো পূর্ণ। তাহলে আয়ান সাহেব কি অফিসে যাননি? পূর্ণ একবার ঘাড় বাঁকিয়ে দেখলো রান্নাঘরে। নীরবে নিজের মতো করে নাস্তা তৈরি করছেন রেহানা। পূর্ণর এমন পরিবেশ একটুও ভালো লাগলো না। পূর্ণ ছুটলো অনুবিকার রুমের দিকে। কোনো কথা না বলে ধুপ ধুপ করে হাতের বাড়ি দিতেই থাকলো। অনুবিকার সারা রাত ঘুম হয়নি। নিশ্চল বসেছিলো সে খাটের মাঝখানে হাঁটুতে মুখ গুঁজে। এমন সময় দরজায় এমন ভাবে ধাক্কার ঠেলায় অবাক হয়ে নামতেই হলো তাকে। দরজার কাছে এসে দরজা খুলতেই দেখলো বত্রিশ দাঁত দেখিয়ে হাসছে পূর্ণ। অপরাধবোধ আর অনুশোচনায় অনুবিকা চোখ নামিয়ে ফেললো। পূর্ণ কিছুটা হলেও বুঝলো ব্যাপারটা। ইদানীং ঔষধ আর কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে তার মধ্যেও আস্তে আস্তে ম্যাচিউরিটি আসছে। পূর্ণ অনুবিকাকে ঠেলে রুমে ঢুকে খাটে বসে পড়লো বাবু সেজে। এরপর বললো,
– আপু! খিদা!
অনুবিকা অবাক হলো। পূর্ণ এতো স্বাভাবিক ব্যবহার করছে কেন অন্যদিনের মতো? অনুবিকা ভ্রু কুঁচকে ঠোঁট চেপে তাকালো পূর্ণর দিকে। এগিয়ে গিয়ে পূর্ণর কপালে হাত রাখলো। না! শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক। তাহলে পূর্ণ কি কালকের কথা ভুলে গেছে? অনুবিকা ভাবতে লাগলো। তখনই পূর্ণ একজোড়া কাপড় বের করে নিলো কাবার্ড থেকে। এরপর অনুবিকাকে ঠেলতে ঠেলতে ওয়াসরুমে ঢুকিয়ে দরজা আটকে আবারও খাটে বসে রইলো। পূর্ণকে নিয়ে ভাবতে ভাবতেই অনুবিকা ফ্রেশ হলো। দরজা খুলতে গিয়ে বুঝলো দরজা বাইরে থেকে আটকানো। অনুবিকা দরজায় টোকা দিলো দুইবার। কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বের হলো না। পূর্ণর নাম নিতে গিয়ে নিজের মাঝে একপ্রকার জড়তা অনুভব করলো সে। অনুবিকাকে দরজায় আঘাত করতে শুনে পূর্ণ উঠে দাঁড়িয়ে ওয়াসরুমের দরজা খুলে দিলো। এরপর অনুবিকার হাত ধরে সে রুম থেকে বেরই হচ্ছিলো। তখনই অনুবিকা পূর্ণর হাত টেনে নিজের কাছে আনলো। পূর্ণকে খাটে বসিয়ে নিজে বসলো মেঝেতে। পূর্ণর হাত নিজের হাতের মাঝে বন্দী করে নিয়ে মাথা নিচু করে রইলো অনুবিকা। পূর্ণ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এমন সময় পূর্ণর হাতের উপর একফোঁটা পানির কণা পড়তেই পূর্ণ বুঝলো অনুবিকা কাঁদছে। পূর্ণ অনুবিকার থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে অনুবিকার থুতনি ধরে মুখ উপরে তুললো।
– কাঁদছো কেন আপি?
অনুবিকা অশ্রুসিক্ত চোখে তাকালো পূর্ণর দিকে। এরপর কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।
– আমাকে ক্ষমা করে দে বোন। আমি একটুও ভালো না। আমি তোর ভালো আপি না। কিসব উজবুক চিন্তা আমার মাথায় চেপেছিলো আমি নিজেও জানিনা। আমি কিভাবে পারলাম তোকে আঘাত করতে? কিভাবে পারলাম? বিশ্বাস কর, আমার মাথায় শয়তান চেপেছিলো। আমার মনে হয়েছিলো তোকে আমার ভাইয়ের পাশে মানাবে না। আমার মনে হয়েছিলো বাবা, মা আর ভাই তোকে দয়া দেখানোর সব পর্যায় অতিক্রম করে ফেলেছে বলেই তোকে ঘরে তুলতে চাইছে চিরজীবনের জন্য। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। ওরা বিচক্ষন মানুষ। ওরা তোর মধ্যেকার নিষ্পাপ স্বত্তা আর পবিত্রতা দেখতে পেয়েছে। যা আমি কখনোই দেখতে পারিনি। আমি ক্ষমা করে দিস পূর্ণ। প্লিজ! নাহয় আমি ধুকে ধুকে মরেই যাবো।
পূর্ণ মলিন হাসলো যা চোখে পড়লো না অনুবিকার। এরপর পূর্ণ অনুবিকার থুতনি ধরে মুখ উপরে তুলে চোখের জল মুছে দিলো। মিষ্টি হেসে বললো,
– মানুষ মাত্রেই ভুল হবে স্বাভাবিক। তুমি তো জেনে শুনে ইচ্ছে করে আমাকে আঘাত করোনি। ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে বলে তুমি আঘাত করেছো। নাহয় শান্ত মস্তিষ্কে তুমি কখনোই আমাকে আঘাত করতে পারতে না। আমি জানি অতোটুকু। আর রইলো কথা ক্ষমার। আমি কিছু মনেই রাখিনি। ক্ষমা দেবো কিসের?
অনুবিকা শক্ত করে জড়িয়ে নিলো পূর্ণকে। এই মেয়েটিকে সে কিভাবে তেমন এক জঘন্য জায়গায় ফেলে চলে আসতে পারলো? কিভাবে পারলো বান্ধবীদের সাথে মিলে অপমান করতে? নিজেকে নিজের জঘন্য প্রকারের ঘৃণিত মনে হচ্ছে অনুবিকার।
-তবে হ্যাঁ! আমার একটা সাহায্য লাগবে।
অনুবিকা পূর্ণকে ছেড়ে পূর্ণর দিকে তাকালো। চোখের জল মুছতে মুছতে বললো,
– বল না তোর কি লাগবে। আমি দেবো।
অনুবিকার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো পূর্ণ। এরপর কালকে রাতের নেওয়া কঠিন সিদ্ধান্তটি জানিয়ে দিলো অনুবিকাকে। অনুবিকা প্রথমে শুনে আতকে উঠলো। কোনোভাবেই রাজি হচ্ছিলো না। পূর্ণ তখন অসহায় মুখ করে বললো,
– একটুও যদি ভালোবেসে থাকো। তাহলে সাহায্য টা তুমি করবে আমি জানি।
অনুবিকা অসহায় চোখে তাকালো পূর্ণর দিকে। পূর্ণর এই সিদ্ধান্তটা নিয়ে সে আশংকিত। তার ভাইয়ের কি হবে যদি সিদ্ধান্তটা বাস্তবায়ন হয়? অনুবিকা অসহায় ভাবে প্রশ্ন করলো,
– খুব কি প্রয়োজন এই কাজটার? ভাইয়ের কি হবে?
পূর্ণ মলিন হেসে বললো,
– ভবিষ্যৎ নির্ধারণকারী আল্লাহ।
অনুবিকা বুঝলো পূর্ণর জেদ চেপেছে। কিন্তু ভাইয়ের সাথে এমনটা করবে? তাতে সে সহমত না। আর আয়ান সাহেব ও রেহানা তার উপর এমনিতে রেগে আছেন। এখন যদি ভুল বুঝেন? অনুবিকা ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে বললো,
– বাবা মায়ের সম্মতি থাকলে আমি রাজি।
পূর্ণ আবারও হাসলো মিষ্টি করে। এরপর অনুবিকার হাত ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে এলো ডাইনিং টেবিলে। রেহানা আয়ান সাহেবকে খাবার বেড়ে দিচ্ছিলেন। পূর্ণ আর অনুবিকাকে একসাথে দেখে দু’জনে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। ভেবেছিলো পূর্ণ খুব আঘাত পেয়ে অনুবিকার থেকে সড়ে যাবে। কিন্তু এদের দুইজনকে একসাথে দেখে ভাবনার উলটোটা হওয়াতে অবাকই হয়েছে তারা। অনুবিকা এসে বসে পড়লো মাথা নিচু করে একটা চেয়ারে। আগে সে আয়ান সাহেবের সাথে বসতো পাশাপাশি। এখন দূরের চেয়ারে বসেছে দেখে আয়ান সাহেব আর রেহানা কিছু বললেন না। থমথমে মুখে নিজেদের কাজ করতে লাগলেন। কিন্তু পূর্ণ মানলো না বিষয়টা।
– এটা কি হলো? তুমি বাপির চেয়ারের পাশেরটায় বসতে। এখন এখানে কেন? নিজের জায়গায় যাও এক্ষুনি।
অনুবিকা পূর্ণর কথা শুনে অসহায় ভাবে একবার চোখ তুলে তাকালো পূর্ণর দিকে। এরপর আয়ান সাহেবের দিকে তাকাতেই দেখলো তিনি থমথমে মুখে হাতে থাকা পরোটার দিকে তাকিয়ে আছেন ভাজি না নিয়ে। রেহানাও নিজের আসনে বসে পূর্ণর থালে খাবার বেড়ে দিচ্ছেন থমথমে মুখে। অনুবিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
-থাক। সমস্যা নেই।
পূর্ণ তখনই বললো আয়ান সাহেবকে উদ্দেশ্য করে,
– কালকে আপুকে একটু বেশি বকে ফেলেছো নাকি বাপি?
আয়ান সাহেব চমকে তাকালেন পূর্ণর দিকে। মেয়েটা এখনো স্বাভাবিক আছে কি করে? তার নিজেরই তো খারাপ লাগছে। আয়ান সাহেব উত্তর না দিয়ে ভাজি ও পরোটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। পূর্ণ বুঝলো ব্যাপারটা গুরুতর। পূর্ণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
– আমার মা বাবা আমাকে একটা মাত্র কারণে আপন করে নিতে পারেনি, একটা মাত্র কারণে দুরত্ব সৃষ্টি হয়েছিলো আমাদের মাঝে। এই ” এক ” সংখ্যাটা কতো ছোট। অথচ আমার জীবনটাই তছনছ করে দিলো। অনুবিকা আপুরও নাহয় ভুল হয়েছে একটা। এই একটা ভুল কি তোমাদের মাঝেও সব শেষ করে দেবে? মানুষের নিঃশ্বাসের কোনো ভরসা নেই। এই কথাটা জেনেও কি তোমরা রাগ অভিমানে সময় অপচয় করবে বাপি?
অনুবিকা ডুকরে কেঁদে উঠলো। রেহানার চোখেও জল। আয়ান সাহেব মেয়ের দিকে অসহায় ভাবে তাকিয়ে আছেন। এরপর নরম গলায় বললেন,
– অনু? এদিকে আয়। আজ তোকে আমি খাইয়ে দিচ্ছি।
অনুবিকা কাঁদো কাঁদো ভাবে তাকালো আয়ান সাহেবের দিকে। এরপর একদৌড়ে গিয়ে বসে পড়লো আয়ান সাহেবের পাশে নিজের জন্য বরাদ্দ সিটে। রেহানা দ্রুত আয়ান সাহেবের প্লেইটে বারতি খাবার তুলে দিলেন। পূর্ণ হাসিমুখে দেখলো এই মিলন মূহুর্ত। পরক্ষনেই হাসি মুখে বললো,
– আম্মু? বাপি আপুকে খাইয়ে দিচ্ছে। তুমি আমাকে খাইয়ে দাও। হিসাব বরাবর।
রেহেনা মৃদু হেসে নিজের প্লেইটে খাবার বেড়ে নিলেন। আয়ান সাহেব অনুবিকাকে খাইয়ে দিতে লাগলো। আর পূর্ণকে খাইয়ে দিতে লাগলো রেহানা। খাওয়া শেষে অনুবিকা আয়ান সাহেবকে জড়িয়ে ধরে বসে আছেন লিভিং রুমের সোফায়। আর রেহানা তেল দিয়ে দিচ্ছেন পূর্ণর মাথায়। তখনই পূর্ণ বললো,
– বাপি, আম্মু আমার একটা জিনিস চাইবার আছে তোমাদের কাছে।
অনুবিকা চমকে উঠে বসলো। পূর্ণ কি তাহলে সত্যি সত্যিই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে? অনুবিকা মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো পূর্ণকে। কিন্তু পূর্ণ মিষ্টি হেসে নিজের সিদ্ধান্তের কথা জানালো আয়ান সাহেব ও রেহানাকে। আর সেই সাথে কারণটাও জানালো। আয়ান সাহেব আর রেহানা নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন মেয়েটির দিকে। পরক্ষনেই আয়ান সাহেব একবাক্যেই নাকোচ করলেন সিদ্ধান্তটি।
– একদম মেনে নিতে পারছি না পূর্ণ মা। তুমি এই বাসাতেই থাকবে।
পূর্ণ মিষ্টি হেসে বললো,
– বাপি? কিছু সময়ের জন্য ধরে নাও, বিষয়টা অনুবিকা আপু বলছে।
আয়ান সাহেব অসহায় ভাবে তাকালেন অনুবিকার দিকে। আর এরপর পূর্ণর দিকে। মেয়েটা বাচ্চা স্বভাবেই ভালো ছিলো। বড় কেন হতে গেলো? আয়ান সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
– ঠিক আছে। আমি কালকেই সব ব্যবস্থা করে দেবো।
রেহানা অস্থির স্বরে বললেন,
– কিন্তু রায়ান আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলে চলতো না?
পূর্ণ হেসে রেহানাকে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। এরপর বললো,
– যার ভালো থাকাকে কেন্দ্র করে এতো কষ্ট করা। তাকে নাহয় একটু কষ্ট দিলে।
রেহানা ছলছল চোখে জড়িয়ে ধরলো পূর্ণকে। আয়ান সাহেব জড়িয়ে ধরলো অনুবিকাকে। আপাতত পূর্ণর সিদ্ধান্তকে তিনি মেনে নিতে বাধ্য। কারণ সিদ্ধান্তটাই ভবিষ্যত সুন্দর করবে। কেও খেয়াল করলে বুঝতো পূর্ণ আজ ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। নিঃসন্দেহে পূর্ণও সিদ্ধান্তটা নিয়ে কষ্ট পাবে। কিন্তু একটা মানুষ তো ভালো থাকবে, রায়ান।
চলবে,