আঁধারে ঢাকা ভোর পর্ব-৮

0
1653

#আঁধারে_ঢাকা_ভোর
#অধ্যায়_আট
প্রজ্ঞা জামান দৃঢ়তা

শফিক সাহেব বাড়িতে এসে অনেকটা সময় নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে শুয়ে রইলেন। কারো সাথে কথা বলেননি। সকালে কোথায় গেছেন সেটাও রেহেনা বেগমকে বা অন্যকাউকে বলেননি। আভা বুঝতে পেরেছে তার বাবা কোথায় গিয়েছিল। তিনি প্রায় ঘন্টা তিনেক পর বেরিয়ে গেলেন বাড়ি থেকে। রেহেনা বেগম তার পিছু পিছু বাড়ির সামনের রাস্তা পর্যন্ত গেলেন। তিনি একটা কথাও বললেন না, হনহনিয়ে চলে গেলেন। স্বামীর এরূপ আচরণ দেখে তার চিন্তা হচ্ছে, কী এমন হলো যার জন্য এভাবে চলে গেলেন কিছু না বলে!

আভা দুপুরে খেয়ে একটু শুয়েছিল কখন যে দু’চোখে ঘুম ভর করেছে বুঝতেই পারেনি। হঠাৎ চিৎকার করে উঠে বসে। সেদিনের ভয়ংকর স্বপ্নটা আজ আবার দেখেছে সে। ঠিক একই রকম স্বপ্নটা! পুরো শরীর ঘামে ভিজে গেছে তার। চারদিকে তখন মাগরিবের আজান দিচ্ছে। তার রুমের দক্ষিণমুখি জানালার কার্নিশে একটা কাঠঠোকরা পাখি ঠকঠক শব্দ করছে। এই পাখিটা সবসময় এমন করে। ভোরে ও সন্ধ্যায় শব্দ করে নিজের উপস্তিতির জানান দেয়।

সে বাড়িতে না থাকলে পাখিটা নাকি আসে না । অনিক প্রায় বলে আপুনি পাখিটা তোমার সই বোধহয়। নয়তো তুমি বাড়ি না থাকলে, পাখিটা কেন আসে না? তুমি না থাকলে, তোমার ঘরে আমি সারাক্ষণ থাকি। তাও পাখিটা আসে না। আমার খুব অদ্ভুত লাগে! পাখিটার তোমার সাথে কোনো সম্পর্ক আছে!

তার আজকাল মনে হয় পাখিটা তার সম্পর্কে এমন কিছু জানে, যা সে নিজেই জানে না। মনে হয় পাখিটা তার খুব আপন! খুব কাছের!

বিছানায় হাঁটু গুটিয়ে তার উপর হাত রেখে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে সে। কিছুটা সময় লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। চকিতেই পাশের ঘর থেকে চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ ভেসে আসছে। খুব মনোযোগ দিয়ে বুঝতে পারল বাবা-মায়ের গলার স্বর শোনা যাচ্ছে। হয়তো এতক্ষণ স্বপ্নের ঘোরে ছিল তাই বুঝতে পারেনি। উঠে দাঁড়াল সে! ভাবল বাবা-মা ঝগড়া করছে কেন? বাবাতো কখনো ঝগড়াঝাটি করেন না।

বরাবরই মায়ের ক্রোধের আক্রোশ থেকে নিজেকে খুবই সতর্কতার সঙ্গে বাঁচিয়ে রাখেন। আজ বাবা বাকবিতন্ডায় জড়িয়েছেন মানে বিষয় খুব সাংঘাতিক! তার মন বলছে আজ এমন কিছু একটা হতে চলেছে যা কোনো ঘূর্ণিঝড় থেকে কম নয়।

ধীর পায়ে বাবা-মায়ের ঘরের পাশে এসে আড়ালে দাঁড়ায় সে। মায়ের কথার ধরণ দেখে বেশ বুঝা যাচ্ছে অশান্তি তাকে নিয়েই হচ্ছে। মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে থেকে সে খুবই সাবধানে নিজের ঘরে চলে গেল। মায়ের বলা বাক্যগুলো ধারালো ছুরির মতো তাকে আঘাত করতে লাগল। সেখানে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না।

মায়ের এতো কিসের ঘৃণা তার প্রতি! এতদিন সে জানত মা স্বভাবতই রাগী, মনে অগাধ মায়া। কিন্তু আজ বুঝা গেল মায়ের মনের কোথাও সে নেই। খুব কষ্ট হতে লাগল তার। জীবন ক্রমশই তাকে এমন কঠিন সব সত্যির সামনে দাঁড় করাচ্ছে, যেখানে সে এসবকিছুর জন্য প্রস্তুতই ছিল না। মায়ের গলার স্বর ক্রমশ উপরে উঠতে লাগল। তার কথার বাণ আভার কান ভেদ করে মস্তিষ্কে আঘাত করছে।

উন্মাদের মতো নিজের ঘরের সবগুলো জানালা, দরজা বন্ধ করে দিল। সবকিছুকে উপেক্ষা করেও মায়ের বলা কথাগুলো তার মস্তিষ্কে বারংবার বাজতে লাগল। বিছানায় বসে অনবরত কাঁপছে সে। সবসময় মানুষের কটুকথা শুনে বড় হয়েছে। এতটা কষ্ট তার কোনোদিন হয়নি! আজ চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। যে মাকে সবসময় নিজের মায়ের মতো ভালবেসে এসেছে, সে মায়ের মনে কোথাও সে নেই! যদি এতটাই ঘৃণা তবে তাকে লালন-পালন করার কী দরকার ছিল? নানা ভাবনায় তার শরীর শিথিল হয়ে আসলো, কখন জ্ঞান হারাল বুঝতেই পারেনি।

★★★

শফিক সাহেব বসে আছেন আভার মাথার ডানে, অনিক বসেছে বামে।
সে খুব দূর্বলভাবে চোখ দুটো মেলার চেষ্টা করে বাবা ও ভাইকে দেখল। শফিক সাহেব উদ্বিগ্ন গলায় বললেন , “এখন কেমন লাগছে মা?”

“ভালো বাবা।” আভা হাসার চেষ্টা করে দূর্বল গলায় বলল।

অনিক বোনের একহাত নিজের দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে ভেজা গলায় বলল, “তুই ঠিক আছিস আপুনি?”

সে অন্য হাত ভাইয়ের গালে রেখে জড়ানো গলায় বলল, “ধুর বোকা কাঁদছিস কেন? আমি এত তাড়াতাড়ি মরব না।”

এই একটি বাক্য বাবার মনকে বিচলিত করে তুলল। তিনি বুঝতে পারলেন এই একটা কথার ভেতর কতটা যন্ত্রণা লুকিয়ে আছে। কতটা শূন্যতা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে মেয়েটার ভেতরটা। তার অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল। মেয়ের এই কষ্টের না বলা কথাগুলো, কেমন করে যেন তিনি খোলা বইয়ের মতো পড়ে ফেললেন।

ভাবলেন যতই আমি তোকে ভালবাসা দেই, আমি জানি মায়ের ভালবাসার অভাব তুই ক্ষণে-ক্ষণে অনুভব করিস। জীবনের একটা নির্দিষ্ট সময় পর মেয়েরা মায়ের কাছে সব বন্ধুর মতো বলে, অথচ তোর ভাগ্যে তার কিছুই জুটল না। ছোট বেলা থেকে মায়ের বঞ্চনা পাওয়া যে কতটা কষ্টের তা আমি বুঝি মা। আচমকা আভার কথায় ধ্যান ভাঙে তার। সে বলল, “কয়টা বাজে বাবা?”

তিনি বললেন, “দুটো বাজে মা।”

আভা খুব অবাক হলো এতটা সময় সে অজ্ঞান ছিল! শফিক সাহেব বললেন, “শরীর খারাপ বলিসনি কেন? দরজা বন্ধ করেই বা শুয়েছিলি কেন? রাত আটটায় বাজার থেকে এসে দেখি তোর ঘর অন্ধকার, দরজা বন্ধ। অনিক তোকে নাকি অনেকবার ডেকেছে, তুই কোনো সাড়া দিসনি। তাই আমাকে কল করে। তোর সাড়া না পেয়ে দরজা ভেঙে দেখি তুই বিছানায় এলোমেলো হয়ে পড়ে আছিস। গায়ে হাত দিয়ে দেখি জ্বরে পুড়ে যাচ্ছিস। তাড়াতাড়ি ডাক্তার পলাশ বাবুকে নিয়ে আসলাম। তিনি দেখে বললেন, তুই বেশি চিন্তা করছিস। শরীর খুব দূর্বল, ঠিকমতো খাচ্ছিস না।”

একটু থেমে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

” আমি সারাক্ষণ দোকানে থাকি। তাই বলে তুই নিজের দিকে খেয়াল রাখবি না মা? এখানে তোর খেয়াল তোকেই রাখতে হবে। আগামী সপ্তাহে পরীক্ষা ভুলে যাচ্ছিস তুই? তোর স্বপ্নটাকে পূরণ করার জন্য হলেও তোকে ভালো থাকতে হবে। আমার জন্য তোকে সুস্থ থাকতে হবে।”

বাবার কথা শুনে চোখের কার্নিশ বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল তার। সে জানে না কথাগুলোতে কী ছিল, কিন্তু নিজেকে সুস্থ করে তুলতে খুব ইচ্ছে হলো। মনে হলো পৃথিবীটা সুন্দর! অসম্ভব সুন্দর! বেঁচে থাকতে হবে, এই মানুষটির জন্য বেঁচে থাকাটা খুব জরুরী। এই পুরো পৃথিবীর মাঝে এই একজন মানুষ যদি তার পাশে থাকে তবে সে সব করতে পারে, সব!

দুইদিন পর আভা শরীর সুস্থ হয়। এই দুইদিন শফিক সাহেব দোকানে যান নি, শুধু নামাজটা মসজিদে পড়ার জন্য বেরিয়ে ছিলেন, সারাক্ষণ মেয়ের সেবা শুশ্রূষা করে গেছেন। এর মাঝে আভাকে পড়া রিভিশন দিতে সাহায্য করেছেন। আজ তিনি নিজে মেয়েকে নিয়ে চট্টগ্রাম যাবেন। পাঁচদিন পর ভর্তি পরীক্ষা।

চট্রগ্রাম যাওয়ার সময় আভা মাকে সালাম করতে গেলে, তিনি অনেক কথা শুনিয়ে দিয়ে পাশের বাড়ি চলে যান। তার ভাষ্যমতে শফিক সাহেব কখনো তার সাথে ঝগড়া করেননি। শুধু মাত্র তার জন্য তাদের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। সে যদি তাদের জীবনে না আসত তবে কোনো সমস্যাই থাকত না। শফিক সাহেব এসব কথা শুনে মেয়েকে নিয়ে নীরবে বেরিয়ে যান।

★★

চট্রগ্রাম এসে তাকে হোস্টেলে উঠিয়ে দিয়ে তিনি চলে গেলেন। পরীক্ষার দিন আসবেন বলে যান।
এই পাঁচদিন আভা দিন রাত এক করে পড়াশোনা করেছে। শরীর কিছু খারাপ লাগলেও সে পাত্তা দেয়নি।

এত প্রতিকূলতার মাঝেও কোচিং, পড়াশোনা বন্ধ করেনি সে। তার জীবনের একটাই লক্ষ্য পাবলিকে পড়াশোনা করা। স্বপ্ন পূরণ করার জন্য সে সব করতে পারে।

শফিক সাহেব সকাল আটটার মধ্যে চট্টগ্রাম চলে আসলেন। আভা তৈরি হয়ে বেরিয়ে দেখে বাবা দাঁড়িয়ে আছেন তার অপেক্ষায়। সে খেয়াল করল শ্যাম বর্ণের ভেতর গোলাকার মুখশ্রী, মোটা ফ্রেমের চশমার আড়ালে বুদ্ধিদীপ্ত দুটি চোখে রাজ্যের মায়া! কাঁচাপাকা দাড়িতে বাবার যে, বয়স বাড়ছে তা বুঝা যাচ্ছে।

আয়নার মতো স্বচ্ছ এক প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে। আজ সে আবিষ্কার করল তার বাবার হাসিটা খুব সুন্দর! আরেকটু সুক্ষ্মভাবে দেখে বুঝতে পারল এমন হাসি, সে আর কখনো দেখেনি। চশমার আড়ালেও চোখের নিচে পড়া কালো দাগ স্পষ্ট হয়ে আছে। সে ভাবল বাবা কী আজকাল বেশি চিন্তা করেন? নয়তো এমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন! হঠাৎ বুকের ভেতর যন্ত্রণা অনুভব করল।

তিনি মেয়ের দিকে তাকিয়ে ভুবন ভোলানো হাসি দিয়ে বললেন, “কিরে মা দাঁড়িয়ে আছিস কেন? দেরি হয়ে যাচ্ছে তাড়াতাড়ি চল?”

সে তাড়াতাড়ি করে হেঁটে বাবার কাছে চলে গেল। তিনি আগেই সিএনজি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। পথে যেতে যেতে আভা বইয়ের পাতাগুলোতে একবার করে চোখ বুলিয়ে নিল।

যথাসময়ে তারা এসে পৌঁছাল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে। আভার সিট এখানেই পড়েছে। হাতে সময় খুব একটা নেই। বাবাকে সালাম করে আসছি বলে চলে গেল সে। পেছনে ফিরে তাকালে সে দেখতে পেত, বাইরে এক স্নেহশীল পিতা স্বপ্নের দুয়ারে দাঁড়িয়ে চোখের জল বিসর্জন দিয়ে প্রাণভরে মেয়ের জন্য দোয়া করছেন। জীবনে যে বঞ্চনা তার মেয়ে পেয়েছে, সব যেন ধীরে ধীরে গুছিয়ে দিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারে।

পরীক্ষা শেষ হওয়া পর্যন্ত তার খুব অস্বস্তি হতে লাগল। এক জায়গায় তিনি স্থির হয়ে বসতে পারছেন না। দেখে মনে হচ্ছে পরীক্ষাটা তিনিই দিতে এসেছেন। পরীক্ষা শেষ করে আভা বেরিয়ে আসলো। তাকে দেখে বেশ খুশি খুশি দেখাচ্ছে। তিনি উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “পরীক্ষা কেমন হয়েছে মা?”

“মোটামুটি ভালো হয়েছে বাবা।”আভার গলার স্বর স্বাভাবিক।

শফিক সাহেব একটু নিশ্চিন্ত হলেন। কারণ তিনি জানেন তার মেয়ে মোটামুটি ভালো বলা মানে অনেকটা ভালোই হয়েছে। সে সবসময় এমন নিজের বিষয়গুলো কমিয়ে বলতে ভালবাসে।

তিনি আভাকে নিয়ে একটা খাবার হোটেলে গিয়ে খেয়ে নিলেন।
আভাকে বললেন, ” আমারা এখন বাড়ি যাব। টিকিট কেটে রেখেছি। ট্রেনে যাব, তোর তো অনেক পছন্দের ট্রেন জার্নি।”

আভা কিছু বলতে গিয়েও বলল না। বাবাকে আজ একটু অন্যরকম খুশি দেখাচ্ছে। তাই তার যে বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে না, তা সে চেয়েও বলতে পারল না।

ট্রেনের জানালার পাশে বসতেই শীতল বাতাসের ঝাপটা এসে তার মনের ভেতর অন্যরকম সুখ বইয়ে দিল। চোখ বন্ধ করে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিল। অনেকদিন পর নিজেকে অনেকটা সতেজ বলে মনে হচ্ছে। শফিক সাহেব মেয়ের হাসি মাখা উজ্জ্বল মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে শান্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। অনেকদিন পর মেয়ের মুখে এমন প্রাণবন্ত হাসি দেখে নিজেই তৃপ্তি পেলেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here