আঁধারে ঢাকা ভোর পর্ব-২০

0
1608

#আঁধারে_ঢাকা_ভোর
#বিশ
প্রজ্ঞা জামান দৃঢ়তা

ভেতরের রুমে গিয়ে দেখে আভা এলোমেলো হয়ে ঘুমিয়ে আছে। চুলগুলো সামনের দিকে চোখের উপর ছড়ানো। একটা বালিশকে জড়িয়ে রেখেছে। পা অর্ধেক খাটের বাইরে।

ফারহা তুষারকে কল দিয়ে তাকে জানিয়েছিল আভা তাদের বাড়ি গিয়েছিল মায়ের সাথে হওয়া সব কথা বলেছে। তাই সে চিন্তিত। পাশে বসে আভার কপালে হাত দিয়ে মৃদুস্বরে ডাকল।

অনেকটা সময় ডাকার পর ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল আভা। তুষারকে দেখে এক লাফে উঠে বসল। মনে হলো সে স্বপ্ন দেখেছে। দু’হাতে চোখ কচলে আবার তাকায় সামনে থাকা মানুষটার দিকে। স্বপ্ন নয়! সত্যিই তার জীবনের আরাধ্য মানুষটা তার সামনে বসে আছে।

সে মানুষটার চোখে আজ অসহায়তা দেখছে। তুষার তাকে জড়িয়ে ধরতেই সম্বিৎ ফেরে তার। ধীরে ধীরে তার হাত জোড়াও তুষারকে আবদ্ধ করে ফেলে। আজ যেন কোনো নিয়মের বালাই নেই। সমাজের ভয় নেই। সব ভালো-খারাপের উর্ধ্বে চলে গেছে। সবসময় তার মাঝে যে নীতিবোধের দেয়াল ছিল তা যেন মুহূর্তে ঝনঝনিয়ে ঝরে পড়ে গেল। মনে হলো এখন শুধু এই মানুষটিই তার জীবনের একমাত্র নীতি, ধ্যান জ্ঞান সব!

অন্ধকার ঘরে ল্যাম্পশেডের হলুদ আলোয় আবছা হয়ে আছে চারপাশ। পুরো ঘরে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। শুধু দুটো মানুষ একে অপরের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনছে। একে অন্যকে জড়িয়ে রেখেছে ভালোবাসার চাদরে। সে চাদরে মোড়ানো দীর্ঘশ্বাস, সমুদ্র সমান যন্ত্রণা। যা এই পৃথিবীর ঘুমিয়ে থাকা মানুষগুলো শুনতে পাচ্ছে না।

কেমন লাগবে যদি কেউ সব হাতে পেয়েও হারিয়ে ফেলে? যদি অযুত, লক্ষ, কোটি স্বপ্ন দেখে সে স্বপ্ন ভেঙে যায়? নিশ্চয়ই তা সহজ কিছু নয়। আর এমন দুটো মানুষের জন্য তো না-ই। যারা তিলেতিলে স্বপ্নের পাহাড় গড়ে তুলছে।

তুষার আভার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে ক্ষীণ গলায় বলল, “আমরা কালই বিয়ে করব অরনী। এই পৃথিবীর সবাই আমাদের বিরুদ্ধে চলে গেলেও আমরা এক হবই। তোমার সেই স্বপ্নের সুন্দর সংসারটা তুমি নিজে হাতে সাজাবে। মা আজ নয় কাল মেনে নেবেন। আর যদি না মানেন তাহলেও সমস্যা নেই। আমি তোমাকে নিয়ে আলাদা বাসা নিয়ে থাকব। মা, ফারহাকেও আমিই দেখব। তুমি চিন্তা করো না। আমার কোনো দ্বায়িত্বে আমি অবহেলা করব না।”

আভা চুপচাপ তুষারের কথা শুনছে। কিছু বলছে না।

তুষার আবার বলল, “কাল বাবা আসলে আমাদের বিয়েতে থাকবেন। উনি আসলে আমরা একসাথে বসে কথা বলব। আশাকরি তিনি অমত করবেন না। আমাদের দেখা সব স্বপ্ন পূরণ হবে অরনী। তুমি একদম চিন্তা করবে না, যা কাঁদার এখনই কেঁদে নাও। কাল থেকে আর কাঁদতে দেব না তোমাকে। তোমার চোখের প্রতিটি অশ্রু অমূল্য। যেমন তেমন খাতে তা খরচ করো না। এ জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছ তুমি। কষ্টের দিন শেষ, সুখের দিন শুরু। আমাদের সুখের নীড় কেউ ভাঙতে পারবে না, কেউ না।”

তুষারের প্রতিটি কথা আভার বুকের ভেতরটা ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে। আবার আশায় বুক বাঁধতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সে যে একজন মাকে কথা দিয়ে এসেছে। কী করে মা থেকে সন্তানকে আলাদা করবে! তাছাড়া বাবা মাকে কষ্ট দিয়ে আর যাই হোক সুখে ঘর করা যায় না। সে ঘর হয় নড়বড়ে, যা হালকা হাওয়ায় ভেঙে পড়ে যেতে পারে।

এখন যে তুষারের প্রতিটি কথায় আবার স্বপ্ন দেখতে মন চাইছে। আবার সেই সুখের রাজ্যের রানী হতে ইচ্ছে হচ্ছে। কী হতো যদি পারভীন বেগম তাদের সম্পর্কটাকে মেনে নিতেন? খুব অসুবিধে হয়ে যেত কী? এই মানুষটা যে তাকে বড্ড ভালোবাসে। তার অনুপস্থিতিতে সে কীভাবে থাকবে?

সে নিজেও মানুষটায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে। জীবনে প্রথম কোনো পুরুষকে সে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছে। যার সর্ব প্লাবী প্রেম তাকে প্লাবিত করেছে গভীর থেকে গভীরভাবে।

এই যে একটা দিন আগেও দুজনে একসাথে কত স্বপ্ন দেখেছে। আভা অনলাইন থেকে ঘরের জিনিসপত্রের ছবি নামিয়ে বলেছে দেখো এগুলো আমাদের ঘরের জন্য কিনব। পর্দার রঙ নীল হবে, বিছানার চাদর সাদা হবে। নীল রঙের ড্রিম লাইট থাকবে। সুন্দর ল্যাম্পশেড থাকবে। এত এত সাজানো স্বপ্নগুলোকে কী করে মাটি চাপা দেবে? আভার কান্না ক্রমাগত বাড়ছে। কান্নার ধমকে কেঁপে কেঁপে উঠছে সে।

তুষার তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আবার কেন কাঁদছো? বলছি না আর কাঁদতে পারবে না?”

তার কথা শুনে কান্নার বেগ আরও বেড়ে গেল । শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। তুষার অনুভব করল এতটা শক্ত করে তাকে আভা ধরেছে মনে হচ্ছে ছেড়ে দিলেই বুঝি হারিয়ে যাবে। এমন কঠিন সময়েও তার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে ওঠল। নিবিড় একটা সুখ অনুভব করল। এই মেয়েটাও যে এভাবে জড়িয়ে ধরতে পারে তার জানাই ছিল না। সে মৃদুহেসে বলল, “বাহ! তোমার শরীরে এত শক্তি জানাতাম না তো?”

আভা তার কথায় কান না দিয়ে একইভাবে কেঁদেই চলল। তুষার ভেবেছে হয়তো এমনিতেই কাঁদছে তাই ভাবল নিজেকে হালকা করুক। ধীরে ধীরে আভার কান্না কমে আসলো।

“অরনী, এ্যাই অরনী?” তুষার ডাকল তাকে।

সাড়া না পেয়ে মুখ তুলতেই দেখতে পেল সে তার বুকে সুখে ঘুমিয়ে পড়েছে। তুষার অনেকটা সময় ধরে অপলকভাবে তাকিয়ে রইল তার ঘুমন্ত মায়াভরা প্রিয়তমার দিকে। নিজের অজান্তেই হাসল সে। ঘুমানোতে তার চোখের দীর্ঘ পল্লব গুলো আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। ঘুমালে যে কাউকে এতটা অপূর্ব লাগে জানতো না সে।

আভাকে বালিশ ঠিক করে শুইয়ে দিয়ে। নিজে খাটের হেডবোর্ডের সাথে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে ঘুমন্ত মায়াবতীকে দেখতে লাগল। এই রাতটায় পৃথিবীর অন্য কোনোকিছু এক মিনিটের জন্য তার মনে আসেনি। শুধু তার স্বপ্নের মানসীকেই দেখে গেছে। স্বপ্নের জাল বুনেছে।

প্রেয়সীর সমগ্র জীবনের যন্ত্রণা কখনো তাকে পীড়া দিয়েছে নিদারুণভাবে। সব শেষে যে তারা এক হতে পারছে এই তো তার কাছে অনেক। মনে মনে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছে এই মেয়েটাকে আর কষ্ট পেতে দেবে না সে। ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখবে তার জীবন। একটা স্বপ্ন জীবন কাটাবে তারা। যেখানে সব হবে স্বপ্নের মতোই সুন্দর!

পাশের রুমে শুয়ে নানা ভাবনায় ভোরের দিকে তুষারের চোখে ঘুম নেমে এলো। সকাল নয়টায় আভার ঘুম ভাঙে, আড়মোড়া ভাঙতেই তুষারকে দেখে অবাক হয়ে যায়। রাতের কথাগুলো মনে হতেই হঠাৎ তীব্র সুখ তাকে ঘিরে ধরল। কিন্তু সে সুখ বেশিক্ষণ স্থায়ী থাকল না। বিরহের যন্ত্রণারা মাথাচাড়া দিতেই চোখ ছলছল করে ওঠে তার। মানুষটার মসৃণ চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিতেই দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে তার গালে। খুব সাবধানে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়।

তুষার ফ্রেশ হয়ে আসলে দুজনে নাস্তা করতে বসে। আভা ছোট পড়ার টেবিলের উপর নাস্তার প্লেট রাখতেই তুষার ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে তাকে পেছন থেকে বলল, “বাহ! তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। একদম আমার বউ বউ। যদিও একটুপর সত্যিই বউ হয়ে যাবে।”

আভা স্মিত হেসে তুষারের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, “চল নাস্তা করে নাও। তোমার প্রিয় চিতই পিঠার সাথে শুটকির ভর্তা।”

দুজনে নাস্তা করে নেয়। আভা অবশ্য অর্ধেক পিঠা কোনোরকম গিলেছে। তার গলা দিয়ে কোনোভাবেই খাবার নামছে না।

তুষার হাত ধুয়ে এসে দেখে আভা কিছু একটা খুঁজছে। সে বলল,

“অরনী তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। আমরা এখনই বেরিয়ে যাব। তোমার জন্য কিছু কেনাকাটা করব। বিয়েতে অনেক কিছুই তো লাগে। রাতে রিগান, নিলয়, চৈতি, ফারহা সবাইকে বলে দিয়েছি সব ব্যবস্থা করতে। ওরা আমাদের জন্য কাজি অফিসে অপেক্ষা করবে। আর তোমার বাসায় এক্সট্রা চাবি আছে তো? সেটা ওদের দিতে হবে। তারা আমাদের ফুলশয্যার জন্য ঘর সাজাবে এখানে। আসলে একদিনে তো বাসা খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই দুই একদিন এখানে থাকতে হবে। তারপর তোমার পছন্দমত একটা বাসায় উঠে যাব আমরা। শুরু হবে আমাদের সুখী দাম্পত্য জীবন। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে তোমাকে দেখতে পাব এটা ভাবতেই একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি হচ্ছে।” তুষারকে খুব খুশি দেখাচ্ছে।

আভা ধীর পায়ে তুষারের পাশে বসে। কিছুক্ষণ শান্ত স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে মানুষটার দিকে। তার সুন্দর মুখের আদলে কাঙ্ক্ষিত সুখ প্রাপ্তির রেখা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে।

আভা অনিমেষ দৃষ্টিতে চেয়ে শান্তস্বরে বলল, “আমরা বিয়ে করছি না তুষার।”

কথাটা মনে হলো তুষার শুনেনি সে বলল, “এই তাড়াতাড়ি করো না। একটুপর বাবা চলে আসবেন তার আগেই কেনাকাটা শেষ করতে হবে।”

আভা এবার জোরে চিৎকার করে বলল, “আমাদের বিয়ে হচ্ছে না। আমি কী বলছি তুমি কী শুনতে পাচ্ছো না?”

তুষার যেন থমকে গেল। ব্যাথাতুর চোখে তাকিয়ে দেখল সামনে থাকা মায়াবতীর দিকে। বলল, “কী বলছো এসব? এখন কিন্তু মজা করার সময় নয়?”

“আমি মজা করছি না। আগামী সপ্তাহে আমার ফ্লাইট। আমি ইউএসএ চলে যাচ্ছি। গতমাসে ভিসার সব কাগজপত্র হাতে পেয়েছি। ভেবেছিলাম তোমাকে বিয়ের দিন রাতে সারপ্রাইজ দেব। কিন্তু সে দিনটাই তো আর আসবে না। তাই আজ জানিয়ে দিলাম তোমায়।” আভা শান্ত গলায় বলল।

তুষারের চোখেমুখে হতাশার রেখা ফুটে ওঠল। চোখ দেখে মনে হচ্ছে পৃথিবীতে অবাক হওয়ার এরচেয়ে বেশি কিছু হতেই পারে না। তার নিজেকে বুদ্ধিভ্রষ্ট মনে হলো।

মুখ দিয়ে অস্ফুটে বের হলো, “কী বলছ এসব অরনী?”

আভাকে একটুও বিচলিত দেখাল না। আগের শান্ত ভাবটা বজায় রেখে বলল, “প্লিজ তুমি শান্ত হয়ে আমার কথাগুলো শোনো। আমি অনেক ভেবেছি। আমাদের কাছে দুটো অপশন আছে। এক আন্টির বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করা। দুই আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়া।

যদি এক নম্বরটা করি তবে আন্টিকে কষ্ট দেয়া হবে। আমি নিশ্চিত আন্টি আমাকে কোনোদিন মেনে নেবেন না। এটা তুমিও জানো। উনার দিক থেকে উনি একদম ঠিক। আসলে সব মা চাইবে তার সন্তান ভালো থাকুক। সেক্ষেত্রে আন্টির চাওয়া অন্যায় নয়। আমার তো মনে হয় আমি হলে এটা একদমই মেনে নিতাম না।

যেখানে তুমি অলরেডি একজন পারফেক্ট মানুষ। এখানে আন্টি অনেক বড় মনের পরিচয় দিয়েছেন। তাছাড়া মায়ের দোয়া ছাড়া আমরা সুখী হব এটা ভাবাটাও বিলাসিতা বৈ কিছু নয়। তাই আমি একজন মা থেকে ছেলেকে আলাদা করতে পারি না”

আভার কথা শেষ না হতেই তুষার বলল,

“কিছু সময় পর মা মেনে নেবে তুমি চিন্তা করো না অরনী, এখন চল?”

” আমরা কোনো টিনএজ বাচ্চা নই যে এভাবে সবাইকে কষ্ট দিয়ে বিয়ে করে ফেলব। আমাদের সব বুঝার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। আমরা এটা করতে পারি না। দেখো সব সম্পর্ককে পূর্ণতা পেতে হবে এমনটাও নয়। কিছু ভালোবাসায় পূর্ণতা না পেলেও সারাজীবন একইরকম থেকে যায়। আমরা যথেষ্ট ম্যাচিউরড তাই আমাদের উচিত বাস্তবতা মেনে নেয়া। কিছুদিন গেলে বিয়ে করে নেবে। সংসারের টানাপোড়েনে আমাকে তুমি ভুলে যাবে, আর আমি তোমাকে। হয়তো মাসে বা বছরে কোনো এক নির্জন একাকী রাতে তুমি আমাকে, এবং আমি তোমাকে ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলব। এমনটা অহরহ হয়। এতে কারো জীবন থেমে থাকে না। সব ঠিক হয়ে যাবে। ঠিক হয়ে যায়।”

“পাগল হয়ে গেছো তুমি! কী প্রলাপ বকছো?” তুষারের গলা ক্রমশ চড়তে লাগল।

“আমি একদম ঠিক আছি তুষার। আন্টিকে কথা দিয়েছি তোমার থেকে আলাদা হয়ে যাব, এখন আমার ওয়াদা পালনের সময় এসে গেছে। প্লিজ তুমি সবটা মেনে নাও।”

তুষারের চোখে মুখে অগ্নি স্ফুরণ হচ্ছে মনে হচ্ছে চাইলেই সে জ্বালিয়ে দিতে পারে এমন একশোটা পৃথিবী। সে গমগমে আওয়াজ করে বলল, “এসব বাজে কথা রেখে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও। সবাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে?”

আভা কাঠকাঠ গলায় বলল, “আমি যাব না। আমাকে এখন টিকেট কনফার্ম করতে যেতে হবে।”

তুষারের চোখ ছলছল করছে কেমন উন্মাদ দেখাচ্ছে তাকে।

সে বলল, “আমার জীবনে তোমার আগে কখনো প্রেম আসেনি। আমি কোনোদিন ভাবিনি কাউকে এতটা ভালোবেসে ফেলতে পারব। কেউ আমাকে তোমার মতো করে বুঝবে। তোমার সবকিছুতে আমি ছন্দ খুঁজে পাই অরনী। সেখানে কে কী বলেছে তাতে আমার কিছুই যায় আসে না। শুধু জানি আজ আমাদের বিয়ে হবেই। তুমি না চাইলে জোর করে বিয়ে হবে।”

কথাগুলো বলতেই গলা ধরে আসলো তার। আভার হাত ধরতেই, সে হাতটা ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিয়ে আভা বলল, “পাগল হয়ে গেছ তুমি? কী করছো? প্লিজ সবটা বুঝার চেষ্টা করো। এটা হওয়ার নয়।”

তুষার মাথায় হাত দিয়ে মেঝেতে বসে পড়ল। আভাকে সে জানে তার মায়ের মতোই জেদি। একবার না বলেছে মানে সেটাকে কেউ হ্যাঁ করতে পারবে না। খাটের সাথে হেলান দিয়ে মাথাটা খাটের উপর রাখল তুষার। চোখ দিয়ে অনবরত টপটপ করে পানি পড়ছে।

আভা তা দেখে এতক্ষণ নিজেকে কঠিন প্রমাণ করার ভান ধরেছিল। সে খোলস ভেঙে গেল। বুকের ভেতর শুরু হলো প্রমত্ত কম্পন, সে কম্পনে যন্ত্রণাগুলোকে জাগিয়ে দিল শতভাগে।

তার জন্য কোনো পুরুষ এভাবে কাঁদবে সে কখনো কল্পনাই করেনি। তার জীবনে ভালোবাসা আসবে সেটাও কোনোদিন ভাবেনি। এমন রাজপুত্র তার মতো ঘুটেকুড়েনির কপালে এসেও ভাগ্য ছিনিয়ে নিল! হায় কপাল!

তুষারের সামনে হাঁটুগেড়ে বসে দু’গালে হাত দিয়ে সে বলল, “এভাবে বাচ্চাদের মতো কাঁদছো কেন? তুমি কী মনে করো দূর থেকে ভালোবাসা যায় না?
আমি যেখানেই থাকি তুমি আমাকে মিস করলেও আমি টের পাই। তুমি এভাবে কেঁদো না প্লিজ? আমি তোমাকে এভাবে দেখে অভস্ত্য নই। আমার সহ্য হচ্ছে না।”

কথাটা শেষ না করতেই তুষার তাকে আচমকা জড়িয়ে ধরল। আভাও আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি দুজন-দুজনের জড়িয়ে পাগলের মতো কাঁদতে লাগল।

তুষার জড়ানো গলায় বলল, ” চলো অরনী সবকিছু বাদ দিয়ে দাও, আমি তোমাকে ছাড়া থাকতেই পারব না।”

কথাটা শেষ করতেই বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। আভা ডানে-বাঁয়ে মাথা নাড়ল। দুজনে আবারও হিতাহিতজ্ঞানশূন্য মানুষের মতো কেঁদেই চলেছে।

অনেকটা সময় এভাবে কেটে যাওয়ার পর তুষার হাতে উল্টো পিঠে চোখ মুছে বলল, “আমাকে ছেড়ে থাকতে পারবে?”

“থাকতে হবে।”

“মিস করবে না আমাকে?”

“জানি না।”

“বড় আইনজীবী হয়ে আমাকে কী ভুলে যাবে?”

“হয়তো।”

“আমার সাথে যোগাযোগ রাখবে তো?”

“হয়তো রাখব।”

“আমি চলে যাব। তবে তোমাকে কথা দিতে হবে আমার সাথে যোগাযোগ রাখবে, যখন ইচ্ছে ভিডিও কল দিব। তুমি বারণ করতে পারবে না।”

“করবো না।”

“সংসার করবে?”

“হয়তো হ্যাঁ, নয়তো না!”

“আমার খুব ইচ্ছে করবে তোমার সাজানো সংসারটা দেখতে অরনী। সময় করে একদিন ইউএসএ চলে যাব তোমার সেই স্বপ্ন সংসার দেখতে। দেখার সুযোগ দিবে তো?”

“মোস্ট ওয়েলকাম!” আভা নির্লিপ্তভাবে বলল।

অথচ তার আঁখিতে মুক্ত দানার মতো জল চিকচিক করছে। সে জলে লুকিয়ে আছে এক আকাশ শূন্যতা, আছে পৃথিবী সমান অগ্নি যা তাকে ধীরে ধীরে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিচ্ছে। মানুষের জীবন এমন কেন? কেন সব হাতের মুঠোয় পেয়েও হারিয়ে যায়? কেন সর্বস্ব দিয়েও একটু ভালোবাসার দেখা মিলে না? এটাই কী তবে জীবনের ধর্ম? ভালোবাসার বিরহে দুজন মানুষ পীড়িত হচ্ছে, অন্তর-আত্মা জ্বলে যাচ্ছে! এমন কেন ভালোবাসা? তবে কী ভালোবাসার ধর্মই পোড়ানো? যদি তাই হয় বিধাতা কেন মানুষের মনে প্রণয়ের সুখ পাঠায়? দিনশেষে সেটা কেড়ে নেয়ার জন্য? এমন যন্ত্রণা কী না দিলেই নয়!

তুষার মেঝের দিকে তাকিয়ে অনেকটা সময় নীরবে অশ্রু ঝরাল, বলল, “আমি তো তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না অরনী। কাল রাত অবধি আমি শুধু তোমার আমার সুখের স্বর্গের স্বপ্ন বুনেছি। আজ কীভাবে সে স্বপ্নকে চোখের পর্দা থেকে সরিয়ে দিব? আমি চাইলেও আমার মন কী আমার কথা শুনবে? সে যে বড্ড বেহেয়া, আমি চাইলেও যে তোমাকে ভুলে থাকতে পারব না।”

দু’হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছে আভার মুখটা ধরে বলল, “প্লিজ তুমি যেও না। আমি মাকে মানিয়েই তোমাকে বিয়ে করব। প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেও না অরনী। আমি সত্যিই মরে যাব।”

কথাটা শেষ করতেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠে তুষার। তা দেখে আভার বুকটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে কেউ এলোপাথাড়ি তার বুকের ভেতর চুরি চালিয়ে যাচ্ছে একের পর এক।

তুষার তাকে ভালোবাসে এটা সে বরাবরই জানে। কিন্তু, এতটা গভীরভাবে ভালোবাসে জানাই ছিল না। যে মেয়ের জন্য কোনো ছেলে অশ্রু ঝরায় সে মেয়ে নাকি খুব ভাগ্যবতী হয়। তবে সেও কী ভাগ্যবতী? এ কেমন ভাগ্য তবে? ভালোবাসার মানুষটা কেঁদে চলেছে আর তার কান্না থামানোর উপায় তার কাছে নেই। তবে কী সে নারীর জীবন ব্যর্থ যার জন্য তার প্রেমিক পুরুষের চোখে অশ্রু ঝরে অথচ তার ক্ষমতা নেই সেই অশ্রু মুছে দেয়ার। তবে এ কেমন ভাগ্য!

যদি সত্যিই পারভীন বেগম তাদের সম্পর্ক মেনে নিতেন তবে সে অবশ্যই তুষারের জন্য অপেক্ষা করত। কিন্ত সেটা যে অসম্ভব। সে ভালো করেই জানে।

তাই তুষারের হাত নিজের মুঠোয় বন্দী করে বলল, “আমাকে ক্ষমা করো, আমাদের পথ চলা এতটুকুই ছিল। ভাগ্যের বাইরে কে যেতে পারে বলো? নিয়তিকে কেউ বদলাতে পারে না। দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে সময়ের সাথে সাথে। কারো জন্য কিছু থেমে থাকে না।”

অনেকটা সময় কাঁদার পর তুষার চোখ মুছে বলল, “অধিক ভালোবাসা শুধু কাছেই টানে না, মাঝে মাঝে দূরে সরিয়ে দেয়। এতটা দূরে যে চাইলেও ছুঁয়ে দেখা যায় না। আমি কিন্তু তোমাকে অনুভব করব। আজ আমি চলে যাচ্ছি। তোমার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাচ্ছি। আমি জানি তুমি পৃথিবীর যেখানেই থাকো ভালো থাকবে না আমাকে ছাড়া। তুমি প্রতি মুহূর্তে জ্বলে পুড়ে যাবে, নিজেই শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু চাইলেও আমার কাছে আসতে পারবে না। এতটা ভালো হতে নেই অরনী, এতটা ধৈর্যশীলও হতে নেই, যার যত সহ্য ক্ষমতা বেশি, তাকে ততটাই কষ্ট পেতে হয়।

দোয়া করি তুমি সুখী হও। তোমার সব স্বপ্ন পূরণ হোক। যদি এই জনমের পর আর কোনো জনম থাকে তবে আমি তোমাকেই চাইব।”

কথাগুলো বলার সময় বারবার তার গলা ধরে আসছিল। হাসার চেষ্টা করে তুষার আবার বলল, “বেস্ট অফ লাক ডিয়ার।”

কথাটা বলেই তুষার হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

আভা ঠায় দাঁড়িয়ে রইল, তার শরীরের শিরায় শিরায় আগুন জ্বলছে। সে অগ্নিতে দাহ করছে নিজের সমস্ত সুখকে। মেঝেতে বসে সর্বহারার মতো কাঁদতে লাগল। নিজেকে অসহায় লাগছে তার। যেদিন জেনেছিল তার বাবা মায়ের পরিচয় নেই, সেদিনও এতটা একা মনে হয়নি নিজেকে। আজ মনে হচ্ছে সে একা, বড্ড একা! তার কেউ নেই, কিচ্ছু নেই।

তুষারের দৃঢ বিশ্বাস আভা তাকে ছেড়ে থাকতে পারবে না। সে ঠিক তার কাছে ছুটে যাবে।

ইনশাআল্লাহ চলবে

বিঃদ্রঃ আসসালামু আলাইকুম। প্রিয় পাঠক, ভেবেছিল আজকের পর্বে শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু শেষ করা গেল না। আরেকটি পর্ব বাড়াতে হলো। ইনশাআল্লাহ এরপর শেষ পর্ব পাবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here