আমি কাউকে বলিনি সে নাম তামান্না জেনিফার পর্ব ৩

আমি কাউকে বলিনি সে নাম
তামান্না জেনিফার
পর্ব ৩
___________________________

দুদিন আগে নয়ন বাড়িতে এসেছে এক মাস পর ৷ নয়ন রূপার চাচাতো ভাই ৷ বয়স আঠারো বছর ৷ মুখে এখনো ক্ষুর না লাগা নরম দাড়ি গোঁফের হালকা আস্তর ৷ গায়ের রঙ শ্যামলা , লম্বা কিন্তু লিকলিকে গড়ন ৷ জেলা শহরে কলেজে ভর্তি হয়েছে নয়ন এ বছরেই ৷ বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান সে , আলেয়া বেগম কাকবন্ধা ৷ একটা সন্তান জন্ম দেবার পর আর সন্তান জন্ম দিতে পারেননি তিনি ৷ ডাক্তার কবিরাজ এমন কী জ্বিনের চিকিৎসাও নিয়েছেন কিন্তু আর গর্ভধারণ করা হয়নি তার ৷ একমাত্র সন্তান নয়ন যেন তার নয়নেরই মনি ৷

কিন্তু ছেলেটা বড্ড একরোখা ৷ কেমন যেন নির্লিপ্ত ধরনের স্বভাব ৷ মায়ের আদর ভালোবাসা তাকে তেমন ছোঁয় না , বরং খানিকটা বিরক্তই হয় ৷ কথাবার্তাও খুব কম বলে , সারাক্ষন গম্ভীর হয়ে থাকে ৷ রূপা বড্ড ভয় পায় নয়নকে , তাকে দেখলেই দৌড়ে পালায় সেখান থেকে ৷

চুলোর আগুনের তাপে আলেয়া বেগমের ফর্সা গালটা লালচে হয়ে উঠেছে ৷ আজ তার অনেক রান্না বান্না করতে হচ্ছে ৷ পাঁচ কেজি গরুর মাংস রান্না করে পাতিলটা চুলা থেকে নামাতে গিয়ে হঠাৎ করেই কোমড়ে ব্যথা পেয়েছেন তিনি ৷ তারপরও ব্যথা চেপে গজগজ করতে করতেই রান্না করছেন ৷ রূপাকে অনেকক্ষন আগে বলেছেন পোলাওয়ের চাল ঝেড়ে দিতে , মেয়েটা আচ্ছা বলে হারিয়েছে সেই কখন ! বাড়ন্ত মেয়ে , আলেয়া বেগম চেষ্টা করেন সারাক্ষনই তাকে চোখে চোখে রাখতে … কিন্তু সম্ভব হয় কই ! মেয়েটা চোখের নিমিষে কখন যে কোথায় চলে যায় টেরও পান না তিনি ৷

আজকাল রূপাকে দেখলেই তার বুকের মধ্যে চাপধরা ব্যথা হয় ৷ এই বয়সটা বড্ড ভয়ঙ্কর ! এই বয়সের মেয়েদের উপর শত শত শকুনের চোখ লেগে থাকে ৷ কখন কোন বিপদ হয় কে জানে ! কত সাবধানে তাকে রাখতো তার মা , তারপরও নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন কই তিনি ! দুপুরবেলা খেলতে গিয়েছিলেন এমন সময় মুখে গামছা বেঁধে চারজন তাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো … ইশ ! কী অবর্ননীয় কষ্ট …. আলেয়া বেগম কাঁদতে শুরু করেন ….. এই স্মৃতি যতবার তার মনে হয় ততবার নিজেকে নোংরা লাগে তার , মনে হয় মরে গেলে ভালো হতো সেদিনই ৷ পুরো বিষয়টা আলেয়া বেগমের পরিবার নিঃশব্দে চেপে গিয়েছিলো ৷ বিচার চাইলেও বিচার পাওয়া যায় না দেশে , সে দেশে বিচার না চেয়ে চেপে রাখাটাই হয়তো তাদের কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছিল ! এই ঘটনার মাস ছয়েক পর সম্পূর্ণ সত্য গোপন করে আলেয়া বেগমের বিয়ে হয়ে যায় মানিক মিয়ার সাথে ৷ বিয়ের পর এখন পর্যন্ত বহুবার মানিক মিয়াকে কথাগুলো বলতে চেয়েছেন তিনি , কিন্তু পারেননি ৷ হয়তো সংসার হারানোর ভয়ে , হয়তো নিজেকে স্বামীর চোখে ছোট হতে দেখার অপমান সহ্য করতে না পারার ভয়ে … নিজের ভেতরের এই রাগ জেদ সব একসাথে বেড়িয়ে আসে পরিবারের বাকীদের উপর ৷ মেয়ে সন্তান তার দুচোখের বিষ ! মেয়ে মানেই অনিশ্চিত জীবন , মেয়ে মানে বাবা মায়ের অতিরিক্ত দায়িত্ব ! এজন্যই বাপ মা মরা রূপাকে সহজভাবে নিতে পারেননি তিনি কখনোই ৷ তাকে তো তার বাবা মা নিরাপত্তা দিতে পারেনি , তাহলে সে কিভাবে পারবে রূপাকে নিরাপত্তা দিতে ! রূপা তার মানসিক চাপের কারণ , তার ভেতরের ভয়ের কারণ ….. শুধু একটা মানুষের উপরই আলেয়া বেগমের প্রবল ভালোবাসা , তার সন্তান নয়ন , অথচ নয়ন তার সাথে হাসিমুখে দুটা কথাও বলে না কখনো ….

রূপা রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখলো তার চাচী কাঁদছে ! ভয়ে ভয়ে সে চাচীকে জিজ্ঞেস করলো

—চাচী , বড় চাচায় জিগাইছে রান্ধন শ্যাষ হইছে কী না

—শ্যাষ , খালি পোলাও রান্ধন বাকী ৷ যাইয়া ক বড় ভাইজানরে …

—আইচ্ছা

—ঐ খাড়া , বান্দীর ঘরের বান্দী ! তোরে যে কইছিলাম পোলাওয়ের চালকটা ঝাইড়া দে , কই পলাইছিলি কামচোর কুনহানকার !

—নিপা আপায় ডাকছিল ৷

—সেইটা কইয়া যাইতে পারিস নাই ! চাল নামায়ে দিয়া যা ৷ আর নিপারে গিয়া ক গুসোল দিয়া আমার ঘরে আইতে ৷ চুল বাইন্ধা সাজায়ে দিমু ৷

—আইচ্ছা

—যাইয়া আবার গফ জুরিস না , তড়পায়ে যাবি তড়পায়ে আসবি ৷

—আইচ্ছা ৷

আজ নিপাকে দেখতে আসবে ৷ এজন্যই এ বাড়িতে এত আয়োজন ৷ নিপার মা তো আর এসব পারে না , এই দায়িত্বও তাই আলেয়া বেগমের ঘাড়েই জুটেছে ৷ বউ হয়ে আসার পর থেকেই এ সংসারের কলুর বলদ সে ৷ বিয়ের পর প্রথম দুই বছর টানছে অসুস্থ শ্বশুর , এরপর আরো বছর তিনেক টানছে অসুস্থ শাশুড়ি , আর বড় জা পাগল হবার পর থেকে ঐ সংসারের বড় বড় সব কাজও তারই করা লাগে ৷ এ সংসারে একটা মানুষই তার কষ্ট বুঝতো , তাকে সত্যিকারেই ভালোবাসতো …. তার বড় জা ! নিয়তির বিধানে আজ সে শিকলে বন্দী বদ্ধ উম্মাদ !

আলেয়া বেগম আবার গজগজ করতে করতে কাজ করতে থাকেন ৷ এত রাগ তার ঠিক কার উপরে কে জানে ! সবাই জানে সে ভীষণ মুখরা , বদরাগী একজন মহিলা , কিন্তু তার ভেতরেও যে কত অনল জ্বলছে সে খবর কে রাখে ….

রান্নাবান্না শেষ করে গোসল করে ঘরে গিয়ে তিনি দেখেন নিপা তার বিছানার উপর বসে আছে ৷ মেয়েটার চোখ দুটো ফোলা , হয়তো অনেক কেঁদেছে ৷ আলেয়া বেগমের মনটা ভার হয়ে গেলো কিন্তু নিমেষেই নিজেকে কঠিন করে রাগী গলায় বললেন ‘” একেতো তর গায়ের রং ময়লা , মায়ে পাগলী , তার উপরে কাইন্দা কাইন্দা চোখ গাঞ্জুট্টিগো লাহান লাল কইরা ফালাইছোস ! কার বাপের ঠেকা পড়ছে তরে বিয়া করবো ! নবাবজাদী হইয়া ঘুরলেই হইতো না , গায়ের চামড়ার যত্তন নেওনও লাগে ৷ পাগলীর বেটি তুই , ভুইলা যাইস না …”

নিপা উঠে দাঁড়িয়ে বলে “হ , আমি নবাবজাদী পাগলীর বেটি ৷ লাগতো না আমার সাজন ৷ আপনেই সাজেন চাচী…” তারপর গটগট করে হেঁটে বেড়িয়ে যায় সে ৷
খাটের উপর বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন আলেয়া বেগম ৷

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here