#নেশাক্ত_প্রণয়োণী
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_১৯
আনজুমার চোখ বেয়ে শীতল অশ্রুসিক্ত হচ্ছে। এই কাকে দেখছে সে! অপরপ্রান্তের ব্যক্তিদ্বয়ের চোখজোড়াও অশ্রুে ভরপুর। তবুও তার কাছে এদের চোখের পানি স্নেহ-মায়ার নয়, ন্যাকার লাগছে। আরভীক এর হাত শক্ত করে চেপে ধরে মুখ লুকিয়ে বলে,
‘কেনো এসেছো তোমরা আমি মরে গেছি, না বেঁটে আছি সেটা দেখতে এসেছো!’
আরভীক মিছামিছি রাগের কণ্ঠে শুধায়।
‘এটা কেমন বিহেভর মিসেস ফাওয়াজ! নিজের বাবা-মায়ের সাথে এরুপ বিহেভর বেমানান।’
‘মা আমার এভাবে বলিস না। তোর বাবা-মায়ের ভুল হয়েছে। মাফ করে দেয় মা।’
‘এই মাফ চাওয়ার ভাবনাটা তোমাদের ভুল আব্বুআম্মু। যারা নিজ সন্তানকে পরগাছা ভাবে তারা মন থেকে ভালোবাসার হক যাতায় না। নিশ্চয় জরুরি উদ্দেশ্যে এসেছেন। যাই হোক আমার ভালো লাগছে না। আপনারা আসছেন এসে সুন্দর করে চলেও যাবেন।’
তিক্ত কথাগুলো বলে কাঁপুনি ধরা শরীর নিয়ে আরভীক এর রুমে চলে যায় আনজুমা। ইতিমধ্যে সে দেখল তার ছোট বাচ্চাটি ঘুমানোর জন্য ঝিমুচ্ছে। আশফিকে বিছানার উপর রেখে তার পাশ ঘেঁষে হেলান দিয়ে বসে। মনে মনে দীর্ঘ ছক কাটে। সুয়াইবের সঙ্গে বিয়ের পর পুরুপুরি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ছিল তার পরিবার। কালের বিবর্তনে চার বছর পর দেখল সে তার বাবা-মাকে। সচল,স্বচ্ছ লাগছে সবার মুখশ্রী। অথচ যখন সে ছিল তখন তাদের মুখে ছিল অসহায়,বিরক্তির ছাপ। যেন আপদ হিসেবে সে পৃথিবীতে জম্মে ছিল। কই সে তো কখনো আফসোস করেনি! পড়ানোর ক্ষমতা ছিল না তার বাবার। তাই বলে সেও পড়ার প্রতি ভীষণ জোঁক থাকলেও দূরে সরে এলো। বিয়ে না হয় ভাগ্যের জোরে দিয়ে ছিল সুয়াইবের সঙ্গে। পুলিশের চাকরী করার সত্ত্বে ধনাঢ্য ভেবে দিয়ে ফেলে দিল। একটুখানি খোঁজ নেওয়ারও প্রয়োজনবোধ করেনি তারা। কেমন বাবা-মা তারা! জম্ম দিলেই কি দায়িত্ব শেষ। সে তো প্রতিটা মোনাজাতে আল্লাহর কাছে মানত করেছে তার বাবা-মায়ের সুস্থতার কাতিরে। কিন্তু এর বিন্দুমাত্র স্নেহের পরশ হয়তো দেয়নি তার বাবা-মা। সে বোঝা ছিল যা ঘাড় থেকে নামতেই দায়িত্ব শেষ। সে তো অমানুষ নয়! সে চিরঞ্জীব দোয়া করবে তার বাবা-মায়ের জন্য। বড় হওয়ার আগ পর্যন্ত স্নেহ পায়নি বাবা-মায়ের,প্রারম্ভীক বয়সে যেখানে বাচ্চারা মায়ের আঁচল গুজে লুকিয়ে স্নেহ চাই সেখানে সে বালিশকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতো! শুধু একটুখানি প্রণয় পাওয়ার লোভে। আল্লাহ্ প্রণয়রাজ হিসেবে সুয়াইবকে প্রেরণ করে ছিল ঠিকি। তবে বেশিদিন তার কপালে স্থায়ী রাখেনি। লিখে রেখেছিল চলে যাওয়ার আক্ষেপন! চোখ বুজে থাকা অবস্থায় আনজুমার আঁধারে ঘনিত নয়নে সুয়াইবের হাস্যমুখশ্রী ফুটে উঠেছে। আকস্মিক সুয়াইবের চেহারার মাঝে অন্য রুপ ভেসে এলো। আরভীক এর রুপে পরিণত হলো চেহারার অবয়বটি।
আরভীক এর চেহারা দেখে চট করে চোখ খুলে সে। সামনে দেখতেই ভূত দেখার মত চিৎকার দিয়ে উঠে। আরভীক বেচারা বউয়ের কাছে এসে ছিল ফাস্ট নাইটের স্টোরি নিয়ে আলাপ করতে। অন্যথায় চিৎকারের সম্মুখীন হয়ে বেকুব বনে গেল। বিনাবাক্যে চিৎকার বন্ধ করতে মেয়ের ওষ্ঠজোড় চেপে ধরে সে। চিৎকার বন্ধ হয়ে গেল, পরিবেশ নির্জীবতা পালনে ব্যস্ত হলো। গাড় হলো পারস্পরিক শ্বাসপ্রশ্বাস, হাতে হাত রাখা হলো ঘনিষ্ঠভাবে। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
‘উম পাপ্পা।’
আচমকা ছেলের কণ্ঠ পেয়ে ছিটকে সরে যায় আনজুমা। ঘুমের ঘোরে আশফি কথা বলে উঠেছে। নিজের চেহারা চোরের মত লুকানোর জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠে আনজুমা। দিগিদ্বিক না পেয়ে সুতির থ্রিপিচ নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে। তার লুকানোর লাজুক আচরণ দেখে মুগ্ধতায় ছেয়ে গেল আরভীক এর হৃদয়। অনুভূতিপ্রবণ ছিল এ ওষ্ঠের মিলনে। তার কাছে ওষ্ঠের এ স্বাদ অমৃত পানসুধা মনে হলো। কত বছর যেন এ স্বাদ থেকে সে বঞ্চিত হয়ে এসে ছিল!
আজ পেয়ে ছাড়বে না কখনো। আশফির নাকে ওষ্ঠ ছুঁয়ে চুলগুলো শুদ্ধভাবে টেনে দেয় সে। ফিসফিসিয়ে বলে,
‘পাপ্পার রোমান্সে ডিস্টার্ব করতে নেই চ্যাম্প! না হলে বোন বা ভাই তোমার সাথে রাগ করবে হুম।’
‘বাচ্চাকে এসব বলতে লজ্জা লাগে না আপনার।’
আনজুমার কণ্ঠ পেয়ে সূক্ষ্ম নেশাবুদ দৃষ্টিতে তাকায়। ভড়কে যায় সে। হৃদয়ের ধুকপুক তেজ হলো। আরভীক এর নেশালো চাহনী হৃদয় ঘায়েলকারক। এ চাহনী থেকে বাঁচা দুষ্কর। বিধেয় তার মাঝে আমতা ভাব এলো। আশফির পাশ ঘেঁষে শুয়ে পড়ে। চোখ বুজে নিল কিন্তু বে’হা’য়া চোখজোড়ায় আরভীক এর রিয়েকশন কেমন সেটা দেখার কৌতূহলে অভিপ্রায় জম্মেছে। পিটপিট করে আড়চোখে দেখে সামনে কেউ নেই। মাথা উঠিয়ে চর্তুপাশ্ব নজর বুলিয়ে তাকে না দেখে বিনা দ্বিধায় বালিশে মাথা গুজে নুয়ে পড়ে। অতঃপর শীতল শক্ত পুরুষের ছোঁয়া কোমরে পড়তেই সে নিজেকে শক্তভাবে এঁটে রাখে। ভেবে ছিল আরভীক এতে সহজে তাকে কাছে টেনে নেবে না। হিতে বিপরীত হলো হেঁচকা টান দেওয়ার অভিভূতে সে তার স্বামীর বাঁপাশে বুকের পাজোঁরের উপর পড়ে মাথা রাখে। ভয়ে কেঁপে এলো শরীরের রক্তপ্রবাহ শিরা। নড়বড়ে হলো তার মনের কোণায় জমে থাকা তীব্র অনুভূতির প্রজাপতির ঘুমন্ত স্বপ্ন। জেগে গেলে যেন তারা ডানা ঝাপ্টে উড়াল দিতে চাইবে। তখন কি সে পারবে তার আবেগ,অনুভূতি দমিয়ে রাখতে, যা দীর্ঘ চারবছর ধরে আগলে রেখে ছিল। সেগুলোর মাঝে তার সঙ্গীর অভিমূর্তি প্রদান করতে। চোখ বেয়ে অশ্রু গড়ায় তার গালে। আরভীক সূক্ষ্ম হেসে অশ্রুগুলো চুষে নেই। তার ওষ্ঠের উপর মৃদু স্পর্শের ছোঁয়া দিয়ে বলে,
‘জানি ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তোমার। আমাকে সুয়াইবের স্থানে বসাতে। তবে আমি বলব না এত জলদি আমাকে আগলে নাও। শুধু বলব পাশে থেকো। এই বুকে মাথা রেখো। এই হৃদয়ের আগুন শীতল করার দুটি পরম শান্তিময় ব্যক্তি তুমি আর আশফি। ব্যস এটুকু চাওয়া! ভালো তখনি বেসো যখন তুমি বুঝবে আমি তোমার সুয়াইব প্রণয়োণী।’
শেষ শব্দটি বলার সময় আরভীক এর ঘোর লেগে এসে ছিল আনজুমার গোলাপী ভেজা ওষ্ঠ দেখে। মন চেয়েছে মন বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেয় এই ওষ্ঠজোড়া। যদি শিহরণ জাগে এই প্রণয়োণীর প্রতি! তাহলে মন্দ কোথায়! তার আর আনজুমার ওষ্ঠজোড়া প্রায় কাছাকাছি ছিল। ছুঁই ছুঁই দশায় এসে আনজুমা তার শার্টের কলার টেনে বোতাম খুলে দেয়। ঘাড়ের মধ্যে কিছু পায় কিনা বারংবার খোঁজতে থাকে। আরভীক থতমত খেয়ে যায়। সে বিমূঢ়তায় অবাক! মেয়েটার হলো কি, বাঘিনীর মত ঘাড়ে কি খোঁজে যাচ্ছে! আনজুমাকে টেনে দূর করতে চেয়েও পারছে না। সে ক্ষেপে কি যেন খোঁজেই চলেছে। কাঙ্ক্ষিত খুঁতটি না পেয়ে হতাশ হয়ে সরে এলো। তার কানের মধ্যে ঝংকার তুলে দিয়ে ছিল ‘প্রণয়োণী’ শব্দটি। এই শব্দ সুয়াইবের মুখেই মানানসই। বিয়ের প্রথম মধুররাত্রির ডাকে তার হাস্যমুখশ্রীর হতে এই শব্দ বের করে ছিল। তাহলে আজও ব্যতিক্রম নয়। বিয়ের প্রথম মধুরাত্রি। সে আছে, তার স্বামী আছে। তবে মানুষটার রুপ ভিন্ন। আহ্লাদী চোখে তাকায় আরভীক এর প্রশ্নাত্মক চাহনীর দিকে। মানুষটার রুপ অমায়িক ফর্সা না হলেও হলুদে ফর্সা, চোখের গাড় বাদামী আইব্রু ও মণিজোড়া জ্বলমল করছে, মুখের মধ্যে কোনো রুপ ব্রুনের ছাপ নেই, তবে একটি ঘন কালো দাগ আছে কানের নিচে, দাগটি কিসের অজানা তার, জামকালো ওষ্ঠের মিলনে চেহারার উপর আফিম মিশিয়ে রেখেছে সে। আনজুমা সেদিক ভ্রুক্ষেপ না করে রুপের চেয়ে মায়া বেশি জম্মিয়েছে আরভীক এর প্রতি তার মনে। সে তার কানের নিচে আলতো ছোঁয়া দেয়। বিব্রতবোধ করে আরভীক। আনজুমা যে তার কানের নিচের দাগে হাত বুলাচ্ছে বুঝতে বেগ পেতে হলো না তার। আলতো ছোঁয়ার মধ্যে আনমনে বলে,
‘আপনার এ দাগ কিসের!’
গম্ভীর মুখশ্রী ভাব চলে এলো আরভীক এর মাঝে। নিরুত্তরে চোখ বুজে নেয়। ভাবলেশনপূর্ণ রুপ এমন যে, প্রয়োজন নেই এ প্রশ্নের উত্তর জানার। আনজুমা ক্ষণিক সময়ের মত চেয়ে রইল উত্তর পাওয়ার আশায়। নিরাশাপূর্ণ হলো সে। নিশ্চুপে আরভীক এর বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে।
সে ঘুমালেও জেগে ছিল আরভীক। তার নিদ্রা উড়ান ছুঁ। কেননা সে বুঝেছে তার প্রাণপাখি সত্য জানার পিছু নেবে। সে বেশিদিন লুকিয়ে থাকতে পারবে না। অনেক হলো খেলা! এবার যাকে তার স্থান বুঝাতে হবে। আজ সে উপলব্ধি করেছে আনজুমার চোখে তার বাবা-মায়ের প্রতি তীব্র অভিমান!
সেই ছিল যে আনজুমার বাবা-মায়ের তথ্য জেনে, তাদের খোঁজে এনে ছিল আনজুমাকে সারপ্রাইজ হিসেবে দেবে বলে! ভেবেছিল সে খুশিতে আপ্লুত হবে। কিন্তু হলো বিপরীত প্রতিক্রিয়া। আনজুমা অভিমানিত্ব বজায় রেখে কথাহীন রুমে চলে গেল। তার রুক্ষ ব্যবহারে তার বাবা-মার হৃদয় ব্যতীত হলেও আরভীক আশ্বস্ত করে যে, সে সুখী রাখবে তাদের মেয়েকে! তাদের অশ্রুসিক্ত চোখজোড়া মিথ্যে বলছিল না! তারাও প্রায় চারবছর ধরে যে কাতর ছিল তা বুঝতে পেরেছে। বউয়ের পারিবারিক দ্বন্দ্বতায় সে জড়াবে না। তবে বুদ্ধি দিবে যেন সরল মনে কথা ফলে সব জেনে তারপর বিচার ন্যায় করে কথা বলবে কি বলবে না এর সিদ্ধান্ত নিতে! তাই আরভীক তার বাবা-মা ও বোনের জন্য থাকার ব্যবস্থা করে দেয় তার ফার্মহাউজে। সায়াজ তাদেরকে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে আছে। প্রয়োজন স্বরুন কনটাক্ট নাম্বার দিয়ে গেল। তপ্ত দহনহীন শ্বাস ফেলে
আনজুমার ঘনিষ্ঠত্বে তার পিঠে হাত রেখে শক্ত করে জড়িয়ে নেই।
ভোরে ফজরের আযান হতেই জেগে উঠে আরভীক। আনজুমা গভীর নিদ্রামগ্ন ছিল। তার শান্তির ঘুম ভাঙ্গতে মন চাইনি আরভীক এর। সে বেরুতেই সামনে পেল পাঞ্জাবী পরিহিত পুরুষ হিসেবে তার বাবাকে। সেও মৃদু হেসে পাঞ্জাবী পরে বের হলো বাবার সঙ্গে মসজিদে রওনা দিতে।
নামাজ শেষে ফিরতি পথে আরাজ সাহেব বলে,
‘বাবা বউমাকে কি বলবি তুই!’
‘জানিনা ড্যাড।’
‘লুকিয়ে লাভ নেই কখনো না কখনো জেনে যাবে। তখন অভিমান হলেও সামান্য হবে। এখন তুই লুকিয়ে রেখে পরে সে অন্যকারো থেকে জেনে গেলে তখন তোর উপর থেকে বিশ্বাস উঠে যাবে বউমার।’
‘কি করব ড্যাড বিশ্বাস চলে গেলেও তার আমার কাছেই থাকতে হবে!’
‘তুই বললে ক্ষমা পেয়ে যাবি।’
‘বলতে পারব না ড্যাড। যতদিন সত্যটা আড়ালে থাকবে ততদিন শত্রুপক্ষ নিজেকে মুক্তপাখির ন্যায় ডানা ঝাপ্টে যাবে। মোক্ষম সুযোগে আমিও হাতছানি করব না। ডানা কেটে খাল খনন করে পুঁতে দেব।’
‘তোর কবে মনে পড়ছে সব!’
মুচকি হেসে আরভীক। আরাজ সাহেবের দৃষ্টিকোণে প্রশ্নাত্মক চাহনী নিয়ে দেখছে। তিনি জানার তাগিদ প্রকাশ করছে তার ভুলের প্রায়শ্চিত্তের জন্য। কেননা তিনি শ্রেয়া মেয়েটার সঙ্গে বিয়ের বন্ধনে জড়িত করতে চেয়ে ছিল আরভীক এর। যদিও তিনি জানতো না আরভীক এর আজও কোনো পরিবার,বউ-বাচ্চা ছিল কিনা। আরভীক তার বাবার কাঁধে হাত রেখে বলে,
‘আপনি হচ্ছেন আমার ড্যাড! জানি কি চলছে আপনার মনে। এই ‘কবে’ প্রশ্নের উত্তর দেবার সময় এখনো আসেনি। আজ না হয় কাল আমি বিস্তৃত এক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চলেছি। এবার শেষ দুজনকে আমি হাতের মুঠোয় এনে নাচাব। যে রাত্রি আমার জন্য কাল হয়ে ছিল ঠিক সেই রাত্রির মত হত্যাকান্ডের ধুম বাজাব।’
আরাজ সাহেব অশ্রুসিক্ত চোখে জিজ্ঞেস করে।
‘তুইও কি পরে আমাকে একা করে চলে যাবি।’
‘আপনাকে কখনো ছেড়ে যেতে পারি নাকি ড্যাড!’
‘যাস নে বাবা, তোদের ছাড়া আর কেউ নেই আমার। সন্তানহীন বাবা হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে তোদের বাবা হয়ে বেঁচে থাকা শতগুণ ভালো বটে।’
‘হুঁশ ড্যাড নো মোর ক্রাই!’
আরভীক আরাজ সাহেবকে জড়িয়ে ধরে বাসার ভেতর প্রবেশ করে।
৩৮.
রাজিব আমতা আমতা করে চোরা চোখে তাকিয়ে আছে শ্রেয়ার দিকে। সে ক্ষেপেছে, মারাত্মক ক্ষেপেছে। এর কারণের মূলবিন্দু অন্য কেউ নয় বরং সে নিজেই অথাৎ রাজিব। শ্রেয়া গোসল করতে ঢুকে ছিল ওয়াশরুমে। তখন রাজিব ইচ্ছেকৃত রুমের মধ্যে এসে বিছানায় বসে নিবিড়ভাবে ফোন টিপাটিপি করে। চল্লিশ মিনিট পর শ্রেয়া শরীরে তাওয়াল বিহীন মাথা মুছতে থেকে বের হলো। কোনো দিক না তাকিয়ে বস্ত্রহীন হয়ে দাঁড়ায় আলমারির সম্মুখে। রাজিব বেচারা ‘থ’ হয়ে গেল। কামুকতা চওড়া ভাবে শরীরে নাড়া দিচ্ছে। সে বে’হা’য়া চোখজোড়া সরিয়ে নিতে চেয়েও পারছে না। পা বাহিরের দিকে এগোচ্ছে না। বারংবার নজর যেন ঐ বিবস্ত্র রমণীর উপর পড়ছে। শ্রেয়া আলমারির থেকে শর্ট স্কার্ট ও টিশার্ট পরে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। কিন্তু আয়নার প্রতিবিম্বে দ্বিতীয় ব্যক্তির অবয়ব দেখে চোখ বড় বড় হয়ে যায় তার। পিছু ঘুরে চমকে উঠে। রাজিব হা করে তাকে দেখে চলেছে। সে ভাবে হা করে তাকানোর কি হলো! পরক্ষণে তার মনের কোণায় প্রশ্নের ভীড় জমলো। রাজিব কবে থেকে তার রুমে বসে আছে! সে তো ওয়াশরুম থেকে তাওয়াল বিহীন বেরিয়েছে। তবে কি…..!
রাগে চোয়াল শক্ত করে রাজিবের মুখোমুখি হলো। বেচারার ভয়ে জান কবজ বেরিয়ে আসার উপক্রম। মেয়ের কটমট চাহনীতে যেন সে ভস্ম হয়ে যাবে। হাসার চেষ্টা করে বলে,
‘হেই আমি ত তো তোমার সা সাথেই দেখা করত করতে আসছি।’
‘কখন থেকে বসে আছিস তুই!’
পরিণতিতে কপালে বিন্দু ঘাম জমে এলো রাজিবের। পালানোর পথধারা বন্ধ করে রেখেছে শ্রেয়া। বিনা বাক্য ব্যয় করে ড্রয়ার থেকে পি’স্ত’ল হাতে নেই সে। দেখে কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে যায় রাজিবের। তিক্ষ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করে।
‘গার্ন নিয়েছো কেনো!’
‘সহজ প্রশ্ন আমাকে ন্যাকেড দেখেছিস নাকি না!’
ঢোক গিলল রাজিব। গার্নটি শ্রেয়া তার কপাল বরাবর রেখেছে কিঞ্চি ফাঁক রেখে দাঁড়িয়েছে। যদি হ্যাঁ বলে নিশ্চিত তার হায়াতকে মরণে পরিণত করে দেবে! শ্রেয়া উত্তর না পেয়ে গার্নটি ঠেকাল রাজিবের কপালে। তবুও সে নিরুত্তরে শান্ত করল নিজেকে। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে শ্রেয়ার চোখের পলকে চেয়ে থাকে। শ্রেয়ার আকস্মিক হাত কাঁপছে পি’স্তল চালাতে। অথচ কত বুলেট বের করে কার না কার প্রাণ ছিনিয়েছে অগণিত হিসেব নেই! রাজিবকে মা’রতে পারছে না সে। কিছুক্ষণ আগেও তার হাত কাঁপছিল না। অথচ এখন যেন সে বশবর্তী হয়ে পড়ছে রাজিবের। তার শিহরণময় চোখের নয়নে যেন শ্রেয়ার ঘোর লেগে আসছে। ডুবে যাবে সে এই চাহনীর মাঝে। পি’স্ত’ল চালাতে না দেখে রাজিব মৃদু হেসে শ্রেয়ার কনুই চেপে তার ঘনিষ্ঠত্বের জন্য টেনে আনে। বিন্দুমাত্র ফাঁকা নেই তাদের মাঝে। দুজনে লেপ্টে থাকার মত দাঁড়িয়ে আছে। অথচ হাত দিয়ে পারস্পরিক জড়ানো বাদে! রাজিব আফিমময় কণ্ঠে শুধায়।
‘তুই আমাকে মা’রতে চেয়েও পারবি না। আমি এমনি তোর রগরগে বসবাস করি।’
কথাটি বলে অপ্রতিভ আচরণ করে বসে সে। শ্রেয়ার ওষ্ঠের উপর মৃদু স্পর্শ দিয়ে তৎক্ষণাৎ প্রস্থান করে তার রুম থেকে। মন কাঠিন্যময় নারীর হৃদয় দোলছে আজ! রাজিবের আজকের ছোঁয়ায় সে অন্যরকম অনুভূতি পেয়েছে। জাফর সাহেব কোথার থেকে এসে মেয়েকে শুধায়।
‘শুনো মামুনি আমাদের এখনি ফাওয়াজ ম্যাশন যেতে হবে।’
শ্রেয়ার ভাবনার সুতো কেটে পড়ে তার বাবার কথার বদৌলতে। প্রশ্নাতীত চোখে দাঁড়িয়ে রইল। তার বাবা রুমের মধ্যে পায়চারী করে আলমারী থেকে শাড়ি ও বোরকা বের করে বিছানার উপর রাখে। আনমনে বাবার কার্যসিদ্ধি পরখ করে গেল সে। জাফর সাহেব মেয়ের বিছানায় রাখা কাপড়গুলো ঠিক আছে কিনা ভালো করে পরখ করে নেই। শুদ্ধভাবে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
‘তোর জম্মদিনে কিছু করা হয়নি বলে আফসোস করিস না মামুনি। আরভীকের বাসায় যাব। সেখান থেকে পাক্কা খবর নিয়েই পার্টি করবি।’
সন্দেহ কাটিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করল শ্রেয়া। তার হবু স্বামী হবে শুধু আরভীক! রাজিব মাত্রই বডিগার্ড! বাবার তাড়াহুড়ো করে দেখে জিজ্ঞেস করে।
‘আমার কি করা উচিৎ এখন!’
‘ড্রেস রেখেছি ফিমেইল মেইড এসে শাড়ি পরিয়ে দেবে। তুই গহনাগাটিঁ পরে সেজেগুজে রেডি হয়ে ডাকিস আমাকে। বোরকাও পরে নিস কিন্তু।’
চটজলদি কথার প্রেক্ষাপট শেষ করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল জাফর সাহেব। নিজ রুমে এসে লিয়াকত সাহেবকে কল দেয়। তার ঘরে সে প’তি’তা মেয়ে এনে সময় কাটিয়ে শান্তির ঘুম দিয়ে ছিল পুরু রাত। কলের শব্দে সে জেগে উঠে। দেখে তার পাশে বস্ত্রহীন কালো বর্ণের রমণী পড়ে পড়ে ঘুম মারছে। সে টাকা নিয়ে ছু’ড়ে দেয় তার শরীরে। রমণী জেগে উঠে। টাকা পেয়ে হাস্যজ্জ্বল মুখ নিয়ে বস্ত্র উঠিয়ে চলে যায়। লিয়াকত তার লুঙ্গি ঠিকঠাক করতে থেকে কলটি উঠায়।
‘শুন লিয়াকত জলদি রেডি হয়ে বাসার সামনে আয়। আজই শ্রেয়ার সাথে আরভীক এর বিয়ে পাকাপাকি করতে হবে।’
চটে গেল সে। কর্কশ গলায় শুধায়।
‘ওত জলদি কেন করতে যাবি!’
‘হা’লার বলদ জানস না কি হয়ছে! আরভীক খবরাখবরে এসে এক আনজুমা নামের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে রচিয়ে ফেলছে। শ্রেয়া জানেও না। আমি গতকাল রাতেই খবরে দেখছি। এখনো খবরটা চলছে। তুই এখনি আয়। আজকে ফায়সালা করেই ছাড়ব।’
কল কেটে দেয় অপরপ্রান্ত থেকে। কথাগুলো শুনে মস্তি করা রাতের কান্ড ভুলেই গেল লিয়াকত সাহেব। এ মুর্হুতে তার মেজাজ আগুনের লাভা মত ফুলে ফেঁপে উঠছে। এত দিনের বানানো খেলায় পানি ঢেলে দিল ঐ আরভীক এর বাচ্চা! সেও সটান মনে পণ নিল আনজুমা মেয়েটাকে স্বামীহারা করে দেবে। ফোঁস ফোঁস করে রেডি হতে গেল।
রাজিব ওয়াইনের গ্লাস নিয়ে করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে। জাফর সাহেবের গাড়ি সুন্দরভাবে মুছে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। হয়তো কোথাও যাবে সে! নজরদারি গাড়তাপূর্ণ করতে এগিয়ে গেল। জাফর সাহেব তখনি বাসার দরজা দিয়ে বের হলো। সঙ্গে শ্রেয়াও।
শ্রেয়া দেখে দুনিয়ার কোনো কিছুই নজরে এলো তার। সর্বোচ্চ হুঁশ হারিয়ে ফেলে রাজিব। প্রথমবার সে বাঙালি নারীর সৌন্দর্য্যে মোড়ানো শ্রেয়ার মত নারীকে দেখছে। মেয়েটা মর্ডান রুপে যতটুকু আবেদনময়ী লাগে বাঙালি সাজে ততই মায়াবিনী লাগে। রাজিব পলকহীন তাকিয়ে রইল। শ্রেয়া ভ্রু কুঁচকে একপলক তাকিয়ে নজর সরিয়ে নিল। যেন সে পাত্তাই দেয় না তাকে। ব্যাপারটা হজম হলো না রাজিবের। সে শ্রেয়ার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়। কেননা জাফর সাহেব গাড়ির মধ্যে কি যেন কাজ করছে।
রাজিব ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করে।
‘আপনারা কই যাচ্ছেন!’
‘আমার হবু স্বামী আরভীকের বাসায়।’
অনড় হয়ে গেল রাজিবের আচরণ। অস্বাচ্ছন্দ্যের দৃষ্টিপাতে শ্রেয়ার নেত্রপল্লবের দিকে রক্তিম চাহনী নিক্ষেপ করে। শ্রেয়া অসম আচরণে রীতিমত কেঁপে উঠে। রাজিবের দৃষ্টি উপেক্ষা করে তার বাবার গাড়িতে উঠে বসে। তিনি আজ রাজিবকে সঙ্গে নিল না। কেননা সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে আজ অনেকে অনুপস্থিত। রাজিব মনমরা হয়ে গাড়ির চলে যাওয়া দেখল।
ঠোঁট পাঁকিয়ে বাঁকা হেসে ফোন বের করে কল লিস্ট চেক করে সে। কাঙ্ক্ষিত পুরুষের নাম্বার পেয়ে কল দেয়। অপরপ্রান্তে দুবার রিং হওয়ার পর কল রিসিভ হলো। দু’ব্যক্তি নিশ্চুপ পারিপার্শ্বিক অক্ষমতায়। অপরপ্রান্তের ব্যক্তি তার কার্যের নৈমিত্তিক সময় বিলম্ব না করে জিজ্ঞেস করে।
‘জরুরি তলব আছে কি!’
‘বিয়ের পাকাপাকি হবে মনে হচ্ছে!’
‘দিজ ইজ জাস্ট এ ড্রিম!’
‘থ্যাংকস!’
‘নো থ্যাংকিউ !’
কথাটি বলে অপরপ্রান্তের ব্যক্তি তৃপ্তির হাসি দেয়। কলটি কেটে রেখে দেয়।
রাজিব তার ঠোঁটের কোণায় শয়তানি হাসি বজায় রেখে ফোনটি পকেটে গুঁজে নেই। মনে মনে জাফর সাহেবের নীতি ভেবে বলে,
‘সে অপছন্দ হলেও মিত্র হিসেবে মন্দ নয়।’
চলবে….