#নেশাক্ত_প্রণয়োণী
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#অন্তিম_পর্ব
আনজুমা হাতে ফ্রাইপেন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখমুখ রাগে লাল হয়ে আছে তার। আরভীক বেচারা পালানোর জন্য চোখের দৃষ্টি চৌপাশ্ব বুলিয়ে নেয়। না,পালানোর স্থান নেই। আমতা মুখে হেসে বলে,
‘প্রিটিবউ ফ্রাইপেন হাতে নিয়ে অফিসে কি করো! বুকটা ছেৎ ছেৎ করে উঠে তো নাকি!’
‘ফ্রাইপেনের বারি দেব।’
‘ও আচ্ছা তাহলে অঞ্জয়ের মাথায় দিতে পারো।’
অঞ্জয় থতমত খেল। তৎক্ষণাৎ আনজুমা ভাবীর দিকে তাকিয়ে দৌড়ে পালায়। আনজুমা তড়িঘড়ি সামনে এসে আরভীক এর মাথায় ‘ঠাস’ করে বারি দেয়। সে ‘আহ’ করে সরে দাঁড়ায়। আনজুমা চোয়াল শক্ত করে ফ্রাইপেনের মাই’র দেখিয়ে বলে,
‘এই বলদ তোকে না বলে ছিলাম রেস্ট করতে। অফিসে আসতে গেলি কেন হে! বল কোন সুন্দরী মেয়েরে দেখে তোর মন গলছে। এখনি যদি ফ্রাইপেনের বারি দিয়ে মগজ বের না করছি তাহলে আমার নামও আনজুমা নয়।’
‘নাউজুবিল্লাহ্ তোমাকে ছাড়া আজ পর্যন্ত কোনো মেয়ে কি মেয়ের মও পর্যন্ত চোখ তুলে দেখি নাই।’
‘দেন রেস্ট না করে অফিসে কি!’
আরভীক মুখটা কাচুমাচু করে বলে,
‘হানিমুনের টিকেট বুক করতে এসেছিলাম।’
কথাটা শুনে আনজুমা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়। এতে আরভীক সটান হয়ে তার মুখোমুখি হলো। হ্যাবলার মত মুখ করে ফেলে আনজুমা। আরভীক এর খুব নিকটস্থ হওয়ায় জিজ্ঞেস করে।
‘এত কাছে আসলেন কেন!’
‘ওত দূরে দাঁড়ালে গরম লাগে। আর তোমার হ্যাবলার মত মুখখানি দেখলেই!(বুকে হাত দিয়ে বার কয়েক আঘাত করে বলে)
ইশ! মনটা আমার কেমন কেমন করে!’
‘ওকে শুনেন সমাধান হলো ঠান্ডা বরফ আপনার পেছনে লাগিয়ে রাখেন।’
‘ঠাসস’ করে ফ্রাইপেনের বারি দিয়ে ভৌদৌড়ে পালায় আনজুমা। আরভীক মাথায় হাত বুলিয়ে ঠোঁট পাকাঁয়। বউ না যেন মীরখলিফা!
‘আসতে পারি মশাই!’ আদাফাত আরভীক এর কেবিনে দাঁড়িয়ে বলে। অসময়ে অফিসে আদাফাতকে দেখে ভ্রু কুঁচকায় সে। অনুমতি দেয়। আদাফাত তপ্ত শ্বাস ফেলে সিরিয়াস ভঙ্গিমায় ব্যাগ থেকে রিপোর্ট বের করে আরভীক এর হাতে দেয়। পরক্ষণে সায়াজও এসে হাজির। আদাফাত সায়াজের চোখে ইশারা করে। আরভীক শান্ত নয়নে চেয়ে আছে। কম্পিউটারের দিকে মুখ গুজে রেখে স্বাভাবিক গলায় শুধায়।
‘না হিসকিসিয়ে কথা বলে ফেললে খুশি হতাম।’
আদাফাত ও সায়াজ একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। সায়াজ বিনা শব্দে প্রস্থান করে। কারণ তার বন্ধুকে বুঝাতে শুধু আদাফাতই পারবে। আদাফাত আরভীক এর নিকট ডাবল ব্লাড গ্রুপের রিপোর্ট’স, একটি ডকুমেন্ট এগিয়ে দেয়। ডকুমেন্টটি খুব কষ্টে সংগ্রহ করে সায়াজকে স্ক্যান করাতে দিয়ে ছিল সে। ফলে সেই স্ক্যানের সময় লেখাগুলো পড়ে অবাক হয় সায়াজ। তার হাত থেকে সেগুলো গ্রাহ্য করে কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে চোখ বুলায় আরভীক। যতই তার নজর সেগুলোতে আবদ্ধ ছিল ততই আরভীক এর শরীর থরথরে কাঁপছিল। আদাফাত ঠোঁট কামড়ে চেয়ে রইল। আরভীক হয়ত চোখে ভুল দেখছে ভেবে পুনরায় চোখ বুলিয়ে নেই। আদাফাত আশ্বস্ত কণ্ঠে বলে,
‘ডুড এগুলো রিয়াল! তুই যেমনটা বলে ছিলি তেমনি সংগ্রহ করে রিপোর্ট বানিয়ে ডকুমেন্ট আকারে বের করলাম।’
আরভীক এর অবস্থা শান্ত,নিরব। সে রিপোর্ট ও ডকুমেন্টটি রেখে মাথার চুল টেনে শরীরের ভার চেয়ারে এলিয়ে দেয়। আদাফাত কি ভেবে যেন আরভীককে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘ডুড এটা বল তো তুই কেমনে বুঝলি যে, কাকাই তোর আপন চাচা!’
তার কথা শুনে বাঁকা হাসি ফুটে এলো আরভীক এর ওষ্ঠে। সে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা আদাফাতকে বলে,
‘তোর আছে সিসিক্যামেরার কথা! যেদিন আনজুমা ও আশফিকে জাফর এবং লিয়াকত ধরে নিয়ে গিয়ে ছিল। সেদিন রাজিবের কলারে মিনি সাইজের সিসিক্যামেরা ফিট করা ছিল। আমিই দিছি লাগাতে। ঐ ক্যামেরায় লিয়াকত ও জাফরের বলা প্রতিটা কথা গতরাতে বেড রেস্টে থাকাকালীন মস্তিষ্কে চওড়া করে দৃশ্যপট ভেসে উঠে। রাজিব কাজ শেষে আমার কাছেই জমা দিয়ে ছিল সিসিক্যামেরাটা। পকেটে তখনো এটা ছিল। আমার কেবিনে তখন মেয়েদের সঙ্গে তোরা চলে গেলে আমিও সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে যায়। ক্যামেরার ভিডিও অন করে রিভিউ দেয়। তখন লিয়াকতের মুখে তিন ভাইয়ের কথা শুনে মাথায় এলো। আনজুমা কে নাকি আমার ড্যাড বলে ছিল, এই চেহারাটা তার বড় ভাই ইয়াসিরের কৈশোরকালীন চেহারা। মানে যখন তার যুবক বয়সে উপনীত হওয়ার পূর্ব সময় চলে আরকি। চেহারাটা আমার মিলিয়েছে ইয়াসিরের সঙ্গে আর ব্লাডগ্রুপ মিলছে এটাও স্বাভাবিক। কিন্তু তুই কি জানিস এটা ব্লাড টেস্ট না ডিএনএ টেস্ট! গতপরশু ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে জানছি যে আমার বাবা-মা অন্য কেউ নয়। আরাজ ড্যাডের বড় ভাই আমার ইয়াসির বাবাই।’
কথাটুকু বলে দমবদ্ধ হওয়া শ্বাস ফেলে আরভীক। আদাফাত উৎসাহী দৃষ্টিতে বুঝার তাগিদে চেয়ে আছে। আরভীক তার এহেন চাহনী দেখে বলে,
‘তোর মাথায় কোন প্রশ্ন চলছে জানি। এটাই না ইয়াসির বাবাইয়ির সঙ্গে আমার ডিএনএ টেস্ট মিলছে কেমনে!’
আদাফাত শুনে জট করে বলে, ‘হ্যাঁ ভাই তাই কেমনে কি!’
আরভীক মাথা নেড়ে বলে,
‘ড্যাড রুমে ছিল না। অফিসের কাজে বেরিয়ে ছিল ব্যাংকে হয়তো টাকা জমা দেওয়ার ছিল। আমি খালি একলা বাসায় ছিলাম। আনজুমাও তার বিউটিখালার বাসায় বেড়াতে গিয়েছিল আশফিকে নিয়ে। সময়সাপেক্ষে ভাবলাম ড্যাডের রুমে যায়। সেখানে গিয়ে তাজ্জব জিনিসে চোখ আঁটকে গেল। তুই অবশ্যই জানিস ড্যাড গোপন তথ্য সিন্ধুকে ভরে রাখে। সেটা খোলামেলাভাবেই রুমের কোণায় রেখে দেয়।’
আদাফাত শুনে মাথা নেড়ে সায় দেয়। আরভীক উদগ্রীব কণ্ঠে শুধায়।
‘কৌতূহলে সিন্ধুক খুলে ঘেঁটেঘুটে দেখি। আমার নতুন চেহারার পুরাতন প্রতিচ্ছবি পার্সপোট সাইজের। সেই ছবির পেছনে ইয়াসির লিখা। তখনি বুঝলাম তৃতীয় চাচা অন্য কেউ নয় আমার আরাজ ড্যাডই ছিল। তখনো বুঝিনী যে লিয়াকতের সঙ্গে শত্রুতার সম্পর্ক কি নিয়ে ছিল! আমার জানামতে ক্যামেরায় লিয়াকত শত্রুতার প্রেক্ষাপট বলেনি। তাই কৌতূহল প্রবল হলো। সিন্ধুক হাতড়ে এক মলাটে বর্ণের প্রতিলিপির পত্রিকা পেলাম। প্রতিলিপিতে আরাজ ড্যাড এক বিজারিতে নিজের কথ্য প্রকাশ করেছে লেখালেখির মাধ্যমে। টাইটেল ছিল, ‘আপন হয়ে শত্রুর ন্যায় পরত্ব’। টাইটেল পড়ে উৎকণ্ঠা সপ্তম আকাশে পৌঁছায় আমার। প্রতিলিপির পৃষ্ঠা উল্টে দেখি। ড্যাড লিয়াকতকে প্রচন্ড ভালোবাসতেন, বড় ভাইকে যেমন সম্মান, ছোট ভাইকে তেমনি আগলে রাখতেন। তবে ছোট ভাইয়ের আচরণে বেশ নেশার আবিভূত লক্ষ করে ড্যাড। খোঁজ নিয়ে দেখে নেশাদ্রব্যগুলো রাতবিরাতে শরীরের ও মাথার মস্তিষ্ক ক্ষয় করে দেয়। তখন মানুষ কি করতে চাই বা কি করতে চাই না ভেবে পাই না! একপ্রকারের কালো স্বপ্ন যাকে বলে। দিনে সজাগ হতেই আফসোস বিহীন কিছু করার থাকে না ঐ লোকের। ড্যাড ভয় পেলো কেননা তার বাসায় কৈশোরী ও গর্ভধারিণী তার বউ ছিল মানে মম। তিনি জানে যখন তিনি অফিসে যায়। লিয়াকত সুযোগ বুঝে অসভ্যতামি করতে ভুলতো না। কিন্তু ইনিয়ে বিনিয়ে নিজেকে রক্ষা করে ফেলতো মম। লিয়াকত বেশ নেশার চোখে দেখতো মমকে। এই ভয়ে ড্যাড বড়জোড় সিদ্ধান্ত নেই। লিয়াকতকে মাদকদ্রব্য পরিহার কমিউনিটি সেন্টারে ভর্তি করায়। সেখানে থেকে বহুবছর পাড় হয়ে যায়। যখন ছাড় পায় তখন লিয়াকত মাদকনেশা থেকে প্রতিহত হলেও তার মস্তিষ্কজুড়ে প্রতিশোধের বিষ রোপিত হয়ে সুবিশাল গাছে পরিণত হয়। একনিমিষে ভেঙ্গে যাবার নয় তা। বিনা খবর জানিয়ে প্রথমেই আমার বাবাইয়ির সঙ্গে মাম্মাকে পৃথিবীর মায়ায় ত্যাগ করায়, ড্যাডের সন্তান মানে আজীবকেও চালে-জালে ফেলে মা’র’তে চেয়ে ছিল। কিন্তু ব্যর্থ হওয়ায় খুঁত খুঁজে চলছিল। সিধাসাদা আমার ভাইটাও খোঁজহীন কাজের মধ্যে লেগে যায়। পরক্ষণে লিয়াকতের চোখমুখ খুশিতে ভরে যায় যখন জানতে পারে ড্যাডের ছেলে আজীব অকালেই ভীনদেশে ফাঁসির দায়ে মা’রা যায়। ড্যাড জেনে ছিল তার ভাই রেহাই পেয়েছে। কিন্তু রেহাই পেয়ে হিতে বিপরীতে হৃদয়হীন মানব হবে সেটা বুঝতে পারেনি তিনি। ব্যবস্থা নেওয়ার পূর্বেই জাফরের সঙ্গে মিশে কালো টাকা আয়ে জড়িয়ে পড়ে। তবুও ড্যাড জাফরের চরিত্র সম্পর্কে জানতো না আমিই জানিয়ে ছিলাম স্মৃতি ফেরার পরে। লিয়াকতের ঘটনা সেদিন ধামাচাপা পড়লেও আমার স্মৃতি ফিরতেই সব স্পষ্ট হয়ে গেল মন-মস্তিষ্কে। ড্যাডের সিন্ধুক আবারো হাতড়ে ডিএনএ রিপোর্ট পায়। হয়তো তিনভাই মিলে বংশগত কারণে রিপোর্টগুলো সংগ্রহ করে রেখে ছিল। তুই জানিস আদাফাত এই সংগৃহীত রিপোর্টগুলোই আমাকে সত্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়। লিয়াকত ড্যাডকে সেদিন মা’র’তে চেয়ে ছিল যেদিন আনজুমাকে বাঁচাতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে গিয়ে ছিলাম। কিন্তু আমার লোক কৌশলে ঐ জাফরের পাঠানো লোককে গুম করে দেয়। আমার ব্লাড টেস্ট সেজন্য করে ছিলাম। যেন সত্যিই কি আমার পরিচয় ফাওয়াজ বংশের কিনা জানতে। আরাজ আমার আপন চাচা হলেও আমি তাকে ড্যাড বলেই আখ্যায়িত করব। বাবার আদর না পেলেও বাবার চেয়েও বেশি আদর পুষে দিয়েছে এই হৃদয়ে আমার ড্যাড। শোন আদাফাত এখন তোর কাজ হলো এই রিপোর্ট ও ডকুমেন্ট ড্যাডের কাছে নিয়ে যাওয়া। কথাগুলো পেশ করবি যেন তিনি বিশ্বাস করে আমি তার আপন ভাতিজা।’
আদাফাত তার শেষাক্ত কথায় ভ্রু কুঁচকে বলে,
‘তুই কি কাকাইয়ের উপর অবিশ্বাস করিস!’
‘ড্যাডকে বিশ্বাস না করলে আমি সন্তান হতে পারতাম না।’
‘তবে শেষ উক্তির অর্থ কি!’
‘আমি চাই ড্যাড আমাকে দত্তক হিসেবে গ্রাহ্য করুক। আমি আজীবন ড্যাড,আনজুমা ও আশফির সঙ্গে কাটাতে চাই।’
আদাফাত শুনে মুচকি হেসে কাগজপত্র নিয়ে ফাওয়াজ বাড়ির জন্য রওনা হয়। আরভীক তপ্ত শ্বাস নিয়ে আজকের কাজ সম্পন্ন করে নেয়। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
৫৪.
আরাজ সাহেব আরভীক এর দিকে পলকহীন তাকিয়ে আছে। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না যে, এ তার বড় ভাইয়ের প্রথম সন্তান। যাকে কিনা দেখার আকাঙ্ক্ষা পুষে রেখে ছিল মনে। আদাফাত এসেই তার কাকার কাছে সত্য পেশ করে। সকলের খুশির আমেজে আনজুমা টুগেদার পার্টির এরেঞ্জমেন্ট করে। আরভীক শুনে ভোতার মত চেয়ে তাকায়। তার মন চাচ্ছে, যে ফ্রাইপেন দিয়ে তার মাথায় বারি মে’রে ছিল বউটা। সেই ফ্রাইপেনের বারি বউয়ের মাথায় মা’রতে। আনজুমা মিটমিটিয়ে হাসছে। তার স্বামীর অসহায় মুখখানি দেখতে সেই মজা পাচ্ছে সে। আনজুমার হাসি যেন তার জ্বলন্ত রাগে ঘি ঢালছে। সেও বিরক্তমার্কা হাসি ঠোঁটের কোণায় ফুটিয়ে আনজুমার পাশে এসে দাঁড়ায়। কানের নিকটস্থ এসে ফিসফিসিয়ে বলে,
‘বউয়ের বুঝি পাখা গুজিয়েছে। ওত উড়ো না, পরাণ জ্বলিয়া যায় রে হায় জ্বলিয়া যায়!’
‘পরাণ জ্বললে ঠান্ডা পানিতে ডুব মা’রেন।’
‘ছেহ্ কি বউ তুমি! কোথায় বলবে বুকে এসে ঝাপিয়ে পড়ো তা না উল্টো পানির বুকে ডুবার আদেশ দেয়। বলি বউ কি নিরামিষ নাকি!’
‘হে আপনি বুঝি খুব আমিষে ভরা। ন্যাকামী কোনখান!’
মুখ ভেটকিয়ে পার্টির ম্যানেজমেন্ট করতে আরভীক এর পাশ কাটিয়ে চলে যায় আনজুমা। আরভীক কাঁদো কাঁদো মুখ করে চেয়ে আছে। ফাহাদরাও ইতঃপূর্বে এসে হাজির বাসায়। আরভীক রীতিমত মুখ ফুলিয়ে সোফায় বসে ফোন টিপছে আর আড়চোখে চোখ বুলাচ্ছে। আনজুমা সেই যে রান্নাঘরে ঢুকেছে। বের হবার নাম নিশানা নেই। আসরের আযান দেয় আরাজ সাহেবের বানানো প্রসাদের মত বাড়িতে ওয়াশরুম,বেডরুমের কমতি নেই। তবে ছেলেদের ওযু বানানোর জন্য বাহিরে একটি কুলের স্থান তৈরি করা আছে। দশটি কুলের স্থান সেখানে। দশজন দাঁড়িয়ে ওযু করতে পারবে। ছেলেরা একত্রিত হলো সেখানে। ছয়জনই লুঙ্গি আর শার্ট পরে আছে। আরাজ সাহেব নিজ রুমে ওযু করছে। আরভীক প্রথমে কুলের পানির টিউব চালু করে। স্বচ্ছ পানি বয়তে আরম্ভ করলে একেকজন ওযু করে নেয়। ওযু শেষে ফাজলামী করে ফাহাদ পানি ছিটকে দেয় আরভীক মুখে। সেও ক্ষিপ্ত হয়ে পানি ছিটিয়ে মা’রে। একেকটা পাগলের মত পানি ছিটিয়ে মা’রছে। করিডোর থেকে মেয়েরা দেখে হাসছে। তাদের মনে হচ্ছে, তারা কোন পাগল কে বিয়ে করতে যাচ্ছে বা বিয়ে করেছে! শ্রেয়ার পেট খারাপ করায় এককোণায় দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে। ছেলেরা ভিজে ক্লান্ত তবুও তাদের মুখে একচিলটি হাসি। আরাজ সাহেব বেরিয়ে এসে ফাজিলদের কান্ডখানা দেখে লাঠি হাতে নেয়। ব্যস,ছেলেদের অবস্থা ভয়ে নাজেহাল। অঞ্জয় তার বসকে ঠেলেঠুলে বড় মালিকের সামনে পাঠায়। আরভীক আমতা ভাব নিয়ে ড্যাডের সামনে মিছামিছি হাসি দেয়। তিনিও বিনিময়ে দাঁত কেলিয়ে হাসি দেখায়। এতে আরভীক এর হাসি চুপছে যায়। আরাজ সাহেব তিক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে লাঠিটি সমান স্থানে রেখে দেয়। ছেলেদের দিকে তাকিয়ে আদেশনুসারে বলে,
‘আগে নামাজ পড়ে আছি তারপর বুঝাব।’
ভীতিগ্রস্থ হয়ে তারা মুরব্বির পেছন অনুসরণ করে নামাজের রুমে এগিয়ে যায়। মেয়েরাও ইতিমধ্যে নামাজ পড়ে কাজে লেগে পড়েছে। আজ গেট টুগেদারে সবার বাবা-মাকে দাওয়াত করা হচ্ছে। এই দায়িত্বে শ্রেয়া ও রাজিব আছে। আনজুমা ভেবে রেখেছে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে অভিমানের পাল্লা ভেঙ্গে দেবে। কথাটি ভেবে সে পিছু ফিরে তাকায়। দেখতে পেল আরভীক এর ঘার্মাক্ত মুখখানি। নামাজ শেষ করে বাসার আয়োজনে লেগেছে সে। মানুষটার সঙ্গে আজ প্রায় কতদিন হলো কাছাকাছি আছে! সুয়াইব থেকে আরভীক! ইশ! নামের সঙ্গে কামের জোঁসও পাল্টেছে। আগের মত বোকাসোকা মানুষটির মাঝে ভাব পরিপূর্ণ। গেটের মধ্যে বেল বাজায় সকলের দৃষ্টিতে দরজার দিকে যায়। আরভীক থতমত খেল। সে গোপনে লোক ডেকেছে তার বেডরুম সাজাতে! সে চেয়েছে গেট টুগেদার পার্টির মাঝে নাইট আউট করবে বউয়ের সঙ্গে। ফলে দুজন লোককে রুম সাজানোর জন্য বুক করেছে। তারা বোধহয় এসেছে। আরাজ সাহেব সন্তপর্ণ গলায় বলে,
‘তোমরা কাজ করো আমি গিয়ে দরজা খুলছি।’
আরভীক এর চোখজোড়া ডিমের মত বড় হয়ে গেল। ‘নাহ্’ বলে এক জোরালো চিৎকার দেয়। সবার উৎসুক দৃষ্টি গিয়ে তার উপর পড়ে। বেচারার ইজ্জত ফালুদা না হয়ে জগাখিচুড়ি হয়ে যাচ্ছে। ড্যাডের আগে সে গিয়ে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
‘আ আমি খুলছি।’
দরজা খুলে উকিঁ দেয়। দেখে কয়েকজন চালের বস্তা, নানান মশলার গুড়ির পেকেট নিয়ে এসেছে। তাদের পেছনে ছন্দবেশে এসেছে বেডরুম এরেঞ্জমেন্টার্স। সে চোখের ইশারায় তাদের ‘গুড’ জানায়। তারা একদম ফরমাল গেটআপে এসেছে। চালের বস্তা একটি কাঁধে নিয়ে ইচ্ছেকৃত রান্নাঘরে নিয়ে যায় আরভীক। আদাফাতরা বিষয়টি আমলে একে অপরের দিকে মিটমিটিয়ে হাসে। আনজুমা মেইল সেফ’সের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। সে কাজ করছে আর বাকিরা কেটেকুটে দিচ্ছে। আরভীক চালের বস্তা দরজার পাশে রেখে চোখের ইশারায় সেফ’সকে বের হতে বলে। তারা ইশারা বুঝে মাথা নেড়ে প্রস্থান করে। আরভীক ঠোঁট কামড়ে ধীরস্থির পায়ে আনজুমার কোমরে হাত রেখে লেপ্টে নেয়। কেঁপে উঠে রমণী। ঢোক গিলে কাঁপান্বিত গলায় শুধায়।
‘বাহিরে যান কি করছেন আপনি! কেউ দেখে ফেলবে!’
‘আরভীক ফাওয়াজের অনুমতি বিহীন কোনো পোকাও জানতে পারবে না যে আমি এখানে!’
‘ন্যাকামো ছেড়ে যান তো।’
বেশ রুডলি বলে গরম ফ্রাইপেনের বারি দেখায় আনজুমা। নিঃশব্দে বেরিয়ে যায় আরভীক। তার প্রস্থানে আনজুমা ঠোঁট কামড়ে আনমনে বলে,
‘বেশি করে ফেললাম নাকি!’
৫৫.
রাত নয়টা পার্টির জাকজমকতায় পুরু বাড়ি গিজগিজ করছে। আরাজ সাহেবের সঙ্গে আরভীক এর বন্ধুগণের পরিবার দাঁড়িয়ে কুশল আদায়ে ব্যস্ত। আজই বিয়ের তারিখ পাকাপাকি হলো ফাহাদ-সাইবা,সায়াজ ও তার বিদেশ ফেরত মুশফিয়া এবং অঞ্জয় এর জন্য তার মায়ের পছন্দমতে কনে সুহাসিনী। অথচ এখানে অঞ্জয়ের লাভ ম্যারেজ না হলেও সুহাসিনী তার পূর্বপরিচিত। বলতে গেলে পাশের বাসার প্রতিবেশীর মেয়ে। সুশীল রমণী বটে! রমণী নাকি তাকে প্রথম দেখায় পছন্দ করে ফেলেছিল। আরভীক চোখ রাঙিয়ে বলে,
‘কি অঞ্জয় তুই তোর বসের সাথে চালাকি মার’স! ছিহ্ তোর স্যালারি কাট।’
অঞ্জয় করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে করুণ কণ্ঠে ‘বস’ বলে ডাকে। আরভীক চোখ ফিরিয়ে ভাবলেশহীন ভাব দেখায়। আদাফাতরা হেসে দেয়। পুরু বাসায় আহিফা দৌড়ে পালাচ্ছে। আশফি মাইক্রো বাসের খেলনা নিয়ে দৌড়ে এগোচ্ছে তার পিছে। আশফি রাগান্বিত নজরে তাকিয়ে আছে। সবাই পরিপাটি হয়ে ইয়াং কাপল’স একত্রিত হয়েছে। আরভীক এর চোখজোড়া মুগ্ধতায় চেয়ে যাচ্ছে তার আনজুমার সৌন্দর্যতা দেখে। আবাইয়ার উপরে তাকে যতটা স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে ততই ভেতরে সে ভয়ানক রুপে আবেদনময়ী নারী। কেননা আজ আনজুমা শাড়ি পরে সেজেছে, মুখে হালকা মেকআপের সাজে নিজেকে রাঙিয়েছে। আরভীক রুমে গিয়ে তার রুপে ফিট খেয়ে বুকে হাত লাগিয়ে বলে ছিল!
‘ওহে রমণী এমন লুকে কি তুমি আমায় খু’ন করতে চাও!’
কথার প্রেক্ষিতে লাজুকতায় নুয়ে গিয়ে ছিল আনজুমা। আপনমনে হেসে দেয়। কিন্তু হাসির পরিচ্ছেদ কেটে যায় ছেলের চিৎকারে। সে চোখ ফিরিয়ে দেখে আহিফার হাত ধরে সে মাইক্রোবাসের খেলনাটি ছিনিয়ে নিচ্ছে। এতে আহিফা কেঁদে চোখ-নাকের পানি এক করে ফেলছে। আশফি ঠোঁট ফুলিয়ে আহিফার কান্না দেখে মজা নিচ্ছে। আরভীক এসে আশফির হাত থেকে খেলনাটি নিয়ে আহিফাকে দেয়। খেলনাটি পেয়ে তৎক্ষণাৎ কান্না থামিয়ে ভেংচি দেখিয়ে পালায় আহিফা। আদাফাতের কোলে উঠে বসে পড়ে। আশফি চোখ ঘুরিয়ে তার বাবাইয়িকে বলে,
‘হাহ্ মেয়েটা পাগল বুতছো বাবাইয়ি! আমি খেলনা দিতাম। এই পাগল না বুতে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেতে দেয়। উফ গরম লাগে।’
আশফির যুবকের মত ভাব দেখে বেকুব বনে গেল আরভীক। তার ছেলে তার মতই ফাজিল,রসিক ও অন্তঃস্থলে রাগ পুষে রাখার মত ক্ষমতাশীল মানব হবে বুঝা যাচ্ছে। আরাজ সাহেব খাওয়ার জন্য সবাইকে ডেকে নিয়ে যায়। কিন্তু আশফি আজ তার দাদুর সঙ্গে খাবে আর ঘুমাবে। পরিণয়ে আনজুমা মুখ ফুলায়। যার কারণে আরভীক শয়তানি দৃষ্টিতে বউয়ের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপায়। সে দেখে ঘাবড়ে যায়। তার আজ অজান্তেই বুক ধুরুধুরু করছে! আরভীক এর নজর এড়াতে সে আড়াল হয়। অন্যথায় আরভীক হাজির। সে বউয়ের লুকানো দেখে বলে,
‘তুমিও না পাপ্পি হাগ দেওয়ার জন্য উতলা হয়ে আছো। আগে বলবে না! ইশ আমার তো প্রেম প্রেম লজ্জা লাগছে।’
বলে মুখে হাত রেখে মাথা নেড়ে লাজুকতা প্রকাশ করে। তার এহেন লজ্জাশীলতা দেখে শরীরে কাঁটা বিধঁছে আনজুমার। আরভীক এর আবৃত মুখের ফলে তার নজর ফাঁকি দিতে চেয়েও পারল না। ডানহাতে আরভীক তাকে আবদ্ধ করে রেখেছে নিজের বাহুডোরে। ঠোঁট ভিজিয়ে আনজুমার নিকটস্থ হয়ে বলে,
‘আই ওয়ান্ট লিটল প্রিসেন্স প্রণয়োণী!’
‘বাট আই ওয়ান্ট এ লিটল প্রিন্স।’
‘নো।’
‘ইয়েস!’
বেশ ভাব নিয়ে আনজুমা বলে। আরভীক তিক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে পুনরায় দুষ্টুবুদ্ধি এটেঁ বলে,
‘এটা মুখের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া বাক্য।’
‘এ্যাঁ!’
আনজুমা ভয়ে ছিটিয়ে উঠে। কারণ আরভীক এর বলা বাক্যটির অর্থ বুঝা তার কাছে কোনো ব্যাপারই না। এই বাক্যধারা পুরুষটা তার মাথা খেয়ে হজম করে ফেলবে। আরভীক সুযোগ পেয়ে বলে,
‘এটা তোমার অবুঝ মাথামোটার বাক্য।’
‘আপনাকে ভাষণ দিতে বলছি!’
‘এটা ভাষণ পাওয়ার প্রেক্ষামূলক বাক্য।’
‘চুপ করুন গাধা একটা।’
‘এটা বাকস্বাধীনতা হরণকারী বাক্য।’
‘আপনার নামে আব্বুকে নালিশ দেব।’
‘এটা অভিযোমূলক বাক্য।’
‘আপনার কাপড় ছিঁড়ে মুখে গুজে দেব বে’য়া’দব।’
আরভীক বাঁকা হেসে বলে,
‘এটা ইজ্জত লুটে নেওয়া বাক্য।’
ব্যস আনজুমা ফিট খেয়ে ঢলে পড়ে আরভীক এর বুকে। আরভীক হেসে প্রণয়োণীকে আড়ালে কোলে উঠিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে তার রুমের দিকে এগোয়। বিছানায় শুয়ে দিয়ে প্রণয়োণীর ওষ্ঠজোড়া মিলিয়ে নেয়। এতে ভেবাচ্যাকা খেয়ে সজাগ হয়ে যায় আনজুমা। দাঁত কেলিয়ে চোখের ইশারায় ‘কি’ বোঝায়। লজ্জায় আনজুমা দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। তথাপি আরভীক নিজ হাতে আনজুমার মুখে খাবার খাওয়ে দেয়। খাওয়া শেষে কিঞ্চিৎ সময়ে দুজনে মিলে এশারের নামাজ আদায় করে নেয়। আরভীক মোনাজাত শেষে খেয়াল করে দেখে তার পর্দাশীল স্নিগ্ধ বউকে। যিনি এখন মোনাজাতে ব্যস্ত। আরভীক বিনা দ্বিধায় বউয়ের ললাটে গভীর চুম্বন একেঁ দেয়।
আনজুমার মোনাজাত শেষ হলেও ললাটে গরম নিঃশ্বাসের সঙ্গে চুম্বন উপভোগ করে। আরভীক বুঝতে পেরে সময় বিলম্ব না করে তাকে কোলে উঠিয়ে বিছানার নিকট এগিয়ে যায়। মুখে আফিমময় দৃষ্টি এঁটে ওষ্ঠের কোণায় আওড়ায়,
‘আজকের রাত তোমার আমার প্রণয়োণী!’
আনজুমা তার বুকে মুখ গুজে দেয়। এই সুখসমৃদ্ধি অনুভব করতে পারার সাধ্য তার থাকলেও, দৃষ্টিকোণে চাওয়ার সাধ্য তার নেই।
১৪বছর পর…
‘মাম্মা আইম নট এ লিটল বয়।’
‘তো কিচ্চে মায়ের জন্য তুই সর্বদা ছোটই থাকবি।’
‘এককথা এত বললে তোমার গাল ব্যথা হয় না।’
আঠারো বছরের কৈশোর ছেলে আশফির কথায় চোখ রাঙিয়ে তাকায় আনজুমা। আরভীক ফিক করে হেসে দেয়। আনজুমা মুখ ফুলিয়ে বলে,
‘হাসো বাপ-বেটা মিলে আমি তো কেউ না।’
‘প্রণয়োণী তিন বাচ্চার মা হয়ে গেলে। তবুও বলছো কেউ না। বুঝছি চার নম্বর বাচ্চা আনার ব্যবস্থা করতে হবে।’
‘চুপ অসভ্য একটা!’
‘বউ এটা কিন্তু বাকস্বাধীনতা হরণকারী বাক্য।’
শুনে কান জ্বালাপালা হয়ে গেল আনজুমার। তেঁতে উঠে ফ্রাইপেন দিয়ে বারি দেয় আরভীক এর মাথায়। বেচারা এখনো বউয়ের এ অভ্যাস থেকে রেহাই পায়নি। ঝগড়া করলে বারি খেতে হয়। আশফি তার মাম্মাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘আজ চোখ-কান বন্ধ বলে দেখিও নাই,শুনিও নাই।’
আরভীক করুণ দৃষ্টিতে তার বড় ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘তুই আমারে একমাত্র বুঝিস বাপ। বাকি দুটো তো মায়ের চামচা।’
খিলখিলিয়ে হেসে দেয় দুটো প্রাণ। আশফির পর দ্বিতীয় পুত্র সন্তান আজীব যার বর্তমান বয়স চৌদ্দ এবং তৃতীয় কনে সন্তান আয়েশা বর্তমান বয়স নয় বছর। আরভীক ও আনজুমার এর প্রাণ তাদের তিনসন্তান! এখনো যেন তাদের যুবক-যুবতীর বয়স কাটেনি। আনজুমার এখনো মনে হয় তারা সেই চৌদ্দ বছর বয়সে বিবাহিত জীবনের শুরুকালীন সময়ে আবদ্ধ। আনজুমা ভেবে হেসে দেয়। আরভীক সেই হাসির দিকে প্রাণভরিয়ে দেখে। ইশ! আজীব ছেলেটা তার যত গম্ভীর স্বভাবের, হিতে বিপরীত রসিক স্বভাবের হলো আশফি। অবশ্য আশফির ব্যবহারচিত্তে অবগত আরভীক। সময়ের বিবর্তনে কেউ হারিয়ে যায়, কেউবা ব্যস্ত নগরীতে আবদ্ধ থাকে।
আশফি এইচএসসি কেন্ডিডেইটার, আজীব এসএসসি কেন্ডিডেইটার। দুভাইয়ের পড়াশুনার মাঝে জমছে লড়াই চলে। তথাপি সহায় হাত তারা একে অপরের। বোনের প্রতি তাদের অগাধ সচেতনতা। আয়েশার নাজুক স্বভাব পরিপূর্ণ মায়ের মত। তবে অর্ধ রসিকতা আরভীক এর বটে। নাস্তা শেষে আরভীক বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতে লাগে। ঐ আকাশের তারা হিসেবে ঝলমল করছে তার বাবা-মায়ের, তার আপন চাচার মত বাবা আরাজ ফাওয়াজ ও তার রক্তের ছেলে আজীব ফাওয়াজ। চোখ ফেটে দু’ফোটা অশ্রুসিক্ত হলো আরভীক এর। আনজুমা উদাসীন স্বামীর কাছে গিয়ে তার কাঁধে মাথা রেখে সোফায় বসে। আরভীক আনমনে বলে,
‘আজীব আমার ছেলে অথচ এককালীন এক ভাই ছিল। নামটাও ড্যাড রেখে ছিল শখ করে। অথচ তার বয়সের সীমারেখা আল্লাহ খুব সীমিত রেখে ছিল গো প্রণয়োণী।’
আনজুমা নিশ্চুপ। আরভীক পুনরায় বলে,
‘জম্ম,মৃত্যু বাধাধরা না থাকায় ড্যাডও মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে হাসিমুখি বিদায় নেয়। তথাপি সুস্থসবল মানুষটির বয়স পঞ্চাশ পেড়িয়েছে বলে! জানি না আমিও কবে তোমায় ছে…।’
অপরিপক্ক কথাটি শুনার পূর্বেই আরভীক এর মুখ চেপে ধরে আনজুমা। তার সহনশীলতা শক্ত বা গাড় নয়, স্বামীহীন সে অচল! আরভীক কান্নারত দৃষ্টিতে তাকায়। আনজুমা সেই দৃষ্টিকোণে চেয়ে কাঁপান্বিত গলায় আওড়ায়।
‘সময় হলে একসঙ্গে জান্নাত যাওয়ার ব্যবস্থা করব। তবুও আমায় একা করে রেখে গেলে আপনার খবর আছে হুম!’
আরভীক সন্তপর্ণে তার প্রণয়োণীকে জড়িয়ে ধরে। বাড়ন্ত বয়স বর্তমানে বার্ধক্যে এসে পৌঁচ্ছে তাদের। আরভীক আনজুমার কানে ফিসফিসিয়ে মিলিত মনধারায় শীতল কণ্ঠে আওড়ায়।
‘আমার প্রণয়োণীর প্রণয়রাজের ‘আরজুমা’ !’
৫৬.
আশফি প্রাইভেট শেষে টংবাজারে যায়। ঝালমুড়ি কিনে পার্কে বসে। একমনে খেতে থেকে চৌপাশ্বে চোখ বুলায়। হঠাৎ বাঁহাতে ফোন বের করে নোটিফিকেশন চেক করে। না, নেই তার মেসেজ! সে আজও অপেক্ষা করে প্রারম্ভিক সময়ের বাচ্চা মেয়েটির! জানে না সে, কেমন হয়েছে দেখতে মেয়েটি। তাকে কি সে মনে রেখেছে নাকি ভুলে গিয়েছে অজানা আশফির। তার ফোনের গ্যালারি থেকে ছবিটি বের করে। নাম দেওয়া ‘আশহিফা’। আহিফার ছয় বছরের ছবিটি আগলে রেখেছে সে। মেয়েটির ছয় বছর বয়সে তার বাবা অথাৎ আদাফাতের ভীষণ জরুরি কাজ পড়ে যায় ইংল্যাণ্ডে। না যেয়ে পারেনি তারা। আহিফা ভীষণ কান্নাপ্রায় আশফির কাছে থেকে যেতে চেয়ে ছিল। আশফিও ছোট আহিফাকে ছাড়া কিছু বুঝতো না। আদাফাত আঙ্কেলের বিনতির কারণে সে স্বেচ্ছায় আহিফাকে বোঝায় যাওয়ার জন্য। পুচকি কেঁদে বলে ছিল।
‘আমি কিন্তু এলে তোমাকেই চাইবো। তুমি থাকবে তো আমার জন্য!’
আশফি আহিফাকে ঝাপ্টে নিয়ে বলে ছিল, ‘তুমি শুধু এই প্রণয়প্রেমিকের রইবে।’
আহিফাকে বহুকষ্টে বিদায় দেয় সে। ইংল্যাণ্ডে যেতেই কেটে যায় প্রায় তিনমাস। তখন প্রচুর ফোনালাপ হতো আশফি ও আহিফার। কিন্তু যত বছর পেড়োয় তত যোগাযোগ ছন্নছাড়া হয়ে যায়। বিরহে যেন আশফির প্রাণ জ্বলছে যেতো। মুখ ফুটে বলতে পারত না আহিফার খবরটি কেউ দাও! আরভীক বুঝে ছিল ছেলের মনভাব! এতে সে স্বেচ্ছায় আদাফাতের সঙ্গে কথা বলে। আদাফাত আশ্বাস দেয় যে, আহিফা আশফিরই বউ হবে! কিন্তু নিয়তি কি আজও মঞ্জুর করবে তাদের কথা! আহিফা আড়ালে কথাটি শুনে চটে যায়। বিনিময়ে সে হোস্টেল ভর্তি হয়। কোনো মতেও বাসায় যোগাযোগ রাখেনা বরং আশফিকেও ব্লক দিয়ে ব্লকলিস্টে ফেলে দেয়। আশফি এখনো অব্দি জানে না তার প্রণয়োণী কোথায়, কিরুপে বিরাজ করছে! সে শুধু অপেক্ষা কাতরতার ভোগান্তি।
আশফি ঝালমুড়ির প্যাকেট ডাস্টে ফেলার পরিবর্তে ভুলবশত এক মেয়ের গায়ে ছুঁ’ড়ে দেয়। মেয়েটি ক্ষিপ্ত হয়ে তেড়ে এসে বলে,
‘ওই হাল’কাট! আমার মাথায় কেন প্যাকেট ফেলেছিস। গোসল কি তুই করিয়ে দিবি!’
থতমত খেয়ে যায় আশফি। ভ্রু কুঁচকে মেয়েটির মুখশ্রী লক্ষ করে থ হয়ে যায়। এই তো তার আহিফা! কেননা আহিফার ঠোঁটের পাশে বড় কালো তিল ছিল! যেটি ভীষণ পছন্দের আশফির। সে অবাক সহিত কণ্ঠে বলে, ‘আহিফা সুইটহার্ট!’
আহিফা আশ্চর্যের সহিতে ক্ষোভে ফেটে পড়ে। চড় লাগায় সে আশফির মুখে। বেচারা হ্যাবলা বনে যায়। তাতে কি আশফিও হাত চালিয়ে চড় বসায় আহিফার গালে। আহিফা বিক্ষোভে ফোঁস ফোঁস করে কিছু বলবে তার পূর্বেই ড্রাইভার তাকে ডাক দেয়। সে ক্ষোভপূর্ণ কণ্ঠে বলে,
‘হালকাট তোকে আমি দেখে নেব।’
আশফি শিষ বাজিয়ে উচ্চ আওয়াজে আহিফার যাওয়া দেখে বলে,
‘ওহে কিশোরী এই আশফি ফাওয়াজের বয়ান রইল, এই ‘হালকাট’ এর জায়গায় ‘প্রেমময় আপনি’ বানিয়ে দেব।’
‘চুপ অসভ্য ইতর কোনখান!’
জোরে চেঁচিয়ে বলে আহিফা। আশফিও সময় বিলম্ব না করে ফাজলামির বিকল্পে শাঁসায়।
‘ওহে কিশোরী এটা বাকস্বাধীনতা হরণকারী বাক্য।’
আহিফা গাড়িতে বসে চোখ রাঙিয়ে দেখতে থেকে চলে যায়। আশফি হেসে তার গন্তব্যের দিকে পাড়ি দেয়। সেও গড়বে তার বাবার মত এক প্রাসাদ যেখানে আহিফাকে নিয়েই সে বসতি বানাবে। অবশ্য বোঝায় যাচ্ছে কাঠখড় পোড়ানো লাগবে তার।
সাইকেলে বসে খোশমনে আহিফার গাড়ির পিছে নেয় আশফি। আহিফাও গাড়ির পেছন সাইড দিয়ে আশফিকে আগুন্তক রুপে আসতে দেখে মিটমিটিয়ে হেসে বলে,
‘আপনি আমারই প্রণয়রাজ আশফি!’
সমাপ্ত……
(এত বড় পর্ব কখনো লিখিনী। আজকে লিখলাম সাথে শেষ করলাম। নতুন গল্প শিগ্রই আনব ইন শা আল্লাহ্। এই গল্পের প্রেক্ষিতে আপনাদের মনে কি ধারণা ও কেমন লেগেছে জানাবেন আসসালামুয়ালাইকুম)