সকাল বেলা। ভোরের আলো ফুটতেই সোজা জানালার কাঁচ ভেদ করে আলোক রশ্মি সাজ্জাদের চোখে পড়লো। সাজ্জাদ ঘুমের মাঝেই বিরক্তি নিয়ে কপাল কুঁচকে অন্য দিকে ফিরে শুয়ে পড়লো। সাজ্জাদের সকাল বেলা উঠার একেবারেই অভ্যাস নেই। সাজ্জাদের বোনেরও একেই স্বভাব। কিন্তু সাজ্জাদের বাবা আশরাফ খান পুরোই দুজনের উল্টো। তিনি প্রতিদিন সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেন হাটাহাটি করেন। তিনি একজন বিজনেসম্যান। শখ করে তিনি পাঁচতলা বাড়ি করেছেন। তিনি নিজের পরিবার নিয়ে দোতলায় থাকেন। বাকি ফ্লাট গুলো বিক্রি করে দিয়েছেন। তিনি মনে করেন ফ্লাট ভারা দেওয়া মানেই ঝামেলা। প্রতি মাসে ভারা উঠানো। ভাড়াটিয়াদের সাথে কথা কাটাকাটি আবার এটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে ওটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে ঠিক করতে হবে। এসব ঝামেলা তার ভালোলাগেনা তাই তিনি একসাথে বিক্রি করে দিয়েছেন। তিনি সকাল বেলা চা খেয়ে বাইরে গেলেন হাটতে। মিসেস আশরাফ সকালের নাস্তা বানাচ্ছেন। সকাল ৮টা বাজতেই নিজের মেয়ের রুমে গেলেন। মেয়েকে ডাকতেই মেয়ে উল্টো হয়ে শুয়ে পড়লো। বিরক্ত হয়ে তিনি ছেলের রুমে গেলেন। সাজ্জাদ কে ডাকতেই ও কানে বালিশে চেপে শুয়ে পড়লো।
মিসেস শাহনাজ বিরক্ত হয়ে চলে গেলেন।
সকাল ৮.৩০। সাজ্জাদ এখনও ঘুমের মাঝে আছে। ঘুমের মাঝে হঠাৎ বিল্ডিং কাঁপার শব্দ পেলো। ও ভাবছে হয়তো ভুমিকম্প হচ্ছে। তাই তাড়াতাড়ি ঘুম ছেড়ে উঠে পড়লো। ঘুমের রেশ একটু কাটতেই বুঝতে পারলো কোনো ভুমিকম্প হচ্ছে না। এতো তিনতলায় কেউ তুমুল জোরে লাফালাফি করছে। এটা কে করছে তা বুঝতে সাজ্জাদের এক মিনিট ও সময় লাগলো না। রেগে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। রাগ নিয়ে তাড়াহুড়ো করে তিন তলায় চলে গেলো। তিন তলার ডান দিকের ফ্লাটে কলিংবেল দিলো। রান্না ঘরে কাজ করছিলেন মিসেস রোকেয়া রহমান। কলিং বেল বাজতেই রান্নাঘর থেকে মেয়ের উদ্দেশ্যে চিল্লিয়ে বললেন।
“কিরে! কখন থেকে বেল বাজছে তা কানে যাচ্ছে না?”
আঁখি জানতো এটাই হবে। ও এটারেই অপেক্ষা করেছিলো এতক্ষণ। ওর ভাই আতিক চুপ করে বললো।
“আপু আম্মু দরজা খুলতে বলছে!”
আঁখি ওর ভাইকে ধমক দিয়ে বললো।
“চুপ কর! বেশি কথা বললে চকলেট পাবিনা। যেটা বলছি সেটা কর। চুপচাপ নাচতে থাক!”
কথাটা শুনে আতিক চুপ মেরে গেলো। আঁখি ওকে নিয়ে আবার উড়াধুড়া নাচা শুরু করলো। ওইদিকে সাজ্জাদের রাগ বেড়েই চলেছে। ও রাগ নিয়ে কলিংবেল দিয়েই যাচ্ছে। এবার মিসেস রোকেয়া রহমান রেগে বললেন।
“কিরে আঁখি! তুই আসবি নাকি আমি নাড়ুনি নিয়ে আসবো ওখানে?”
কথাটা শুনেই আঁখি চুপ হয়ে গেলো। এবার কি হবে? দরজা খুলতে যাওয়া মানেই বিপদ! তবুও ভয়ে ভয়ে দরজার কাছে গেলো। আস্তে করে দরজা খুলে দাঁত কেলিয়ে হেসে দিলো। তাকিয়ে দেখলো সাজ্জাদ রাগি চোখে তাকিয়ে আছে। পরনে কালো থ্রি কোয়াটার প্যান্ট আর সাদা সিন্টু গেঞ্জি। সাজ্জাদের চোখের দিকে তাকিয়েই আঁখি ভয় পেলো। তাড়াতাড়ি করে দরজা বন্ধ করে দিলো। দরজা বন্ধ করতেই সাজ্জাদ আরও রেগে গেলো। জোরে দরজার উপর একটা ঘুষি দিলো। মিসেস রোকেয়া রহমান রান্নাঘর থেকে চিল্লিয়ে বললেন।
“কিরে আঁখি! ওখানে কি হয়েছে রে? দরজার উপর বাড়ি মারলো কে?”
আঁখি এবার এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। কি বলবে ওর মাকে? মিসেস রোকেয়া রহমান আবারও বললেন।
“কিরে কথা বলছিস না কেনো?”
আঁখি এদিক ওদিক পাইচারি করে দাঁত দিয়ে নক কামড়ে ভাবতে লাগলো কি বলবে? হঠাৎ করেই ওর মাথায় বুদ্ধি এলো। ও মুচকি হেঁসে গলাটা ঠিক করে ওর মাকে বললো।
“আম্মু একজন ভিক্ষুক এসেছে। টাকা চেয়েছিলো আমি ৫০ টাকা দিয়েছি। তবুও যাচ্ছেনা দেখো। দরজার উপর বাড়ি মারছে। আমি কি করবো!”
মিসেস রোকেয়া অবাক হয়ে বললেন।
“কি? ৫০ টাকা পেয়েও যাচ্ছে না? এ কেমন ভিক্ষুক? মানুষ ১০ টাকা দিলে তা নিয়েই শোকর করবে আর এ দরজা ধাক্কা ধাক্কি করছে? এমন ভিক্ষুককে কিছুই দিবোনা। যা দিয়েছি তাও রেখে দিবো। দাড়া আমি ঝাটা নিয়ে আসছি।”
কথাটা শুনেই আঁখি হেসে কুটিকুটি। সাজ্জাদ কথাটা শুনে রেগে চলে গেলো। যদি ঝাটা নিয়ে আসে তবে ওর মান সম্মান সব চলে যাবে। মিসেস রোকেয়া এসে দরজা খুলে এদিক ওদিক তাকালেন। কিন্তু দেখলেন কেউ নেই। তিনি রেগে আঁখির দিকে তাকালেন। আঁখি জোর পূর্বক হেসে ওর আম্মুকে বললো।
“দেখেছো ঝাটার বারির কথা শুনেই চলে গেছে। আম্মু! তুমি কিন্তু জোশ!”
“এইসব লোকের সাথে এমনেই করতে হয়। যে যেমন তার সাথে তেমনেই হয়!”
কথাটা বলে আবার নিজের কাজে চলে গেলেন মিসেস রোকেয়া। আঁখি হাসতে হাসতে নিজের রুমে চলে গেলো৷ আবারও জোরে গান ছেড়ে দরজা বন্ধ করে উড়াধুড়া নাচানাচি শুরু করলো। ওর সাথে আতিক ও নাচছে। আঁকি একটু পরেই নাচা বন্ধ করে বললো।
“আব্বু এসে পরবে চল খেতে চাই। তোর স্কুলের সময়ও হয়ে গেছে।”
আতিক খেতে চলে গেলো। আঁখি ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং রুমে যেতেই দেখলো ওর বাবা খাবার নিয়ে বসে আছে। আতিক ও বসে আছে। মি. আমিনুর রহমান আঁখিকে দেখেই বললো।
“এত দেরি হলো কেনো? কখন থেকে বসে আছি।”
মিসেস রোকেয়া রহমান রেগে বললেন।
“ওর আর সময় হয়? সারাদিন তো নাচানাচও আর দৌড়া দৌড়ি। বলছি বিয়ে দিয়ে দেও সব থেমে যাবে।”
আমিনুর রহমান রহমান পেশায় একজন প্রফেসর। তিনি বউয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন।
“আগে পড়াটা শেষ করুক!”
আকি ওর বাবার কথা শুনে মুচকি হেসে খেতে বসে পড়লো।
——————————-
সাজ্জাদ রেগে বাড়ির ভিতরে গিয়ে শব্দ করে দরজা আটকালো। মিসেস শাহনাজ সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে বললো।
“কিরে সাজ্জাদ? কোথায় গিয়েছিলি? রুমে যে দেখলাম না? খাবার খেতে বস!”
সাজ্জাদ রেগেমেগে দাড়িয়ে আছে। সাজ্জাদের বোন সাদিয়া ডাইনিং টেবিলে বসে খাচ্ছে। ওর ভাইকে ওভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বললো।
“কি হয়েছে ভাইয়া? এমন দেখাচ্ছে কেনো তোকে? কোনো সমস্যা? এভাবে দাঁড়িয়ে আছোছ কেনো? খেতে বস!”
সাজ্জাদ রেগে বললো।
“তোমরা শুনতে পাওনা ওই লাফালাফির আওয়াজ? মেজাজ খারাপ হয়ে যায় আমার। প্রতি দিনেই এমন করে। একটুও শান্তিতে ঘুমোতে দেয়না।”
মিসেস শাহনাজ আর সাদিয়া সাজ্জাদের রাগের কারন বুঝতে পারলো। তারা একে অপরের দিকে তাকালো। সাদিয়া খেতে খেতে বললো।
“ভাইয়া তোর রুমের উপরে আঁখি আপুর রুম বলে তুই শব্দ বেশি পাছ। আমরা তো অত শব্দ পাইনা।”
“শব্দ পাছনা বলে কিছুই বলবি না?”
রাগি কন্ঠে কথাট বললো সাজ্জাদ। মিসেস শাহনাজ ছেলের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললো।
“দেখ ও নাচ প্রাক্টিজ করছে। আমরা কি বলবো বলতো? তুই যখন গান প্রাক্টিজ করোছ তখনও তো অনেকের সমস্যা হয়। কিন্তু তখন তো কেউ কিছু বলে না। এখন আমরা ওর নাচ নিয়ে বলবো কেনো?”
সাজ্জাদ রেগেমেগে বললো।
“ও নাচ প্রাক্টিজ করে? ওমন ভাবে কেউ নাচে? ওই নাচ কে দেখে বলোতো? পুরো বিল্ডিং নাড়িয়ে ফালায়। মনেহয় তিনতলার ছাদ ভেঙে আমার শরীরের উপরে পরবে। যত্তসব ফালতু মাইয়া। কি দেখে যে বাবা ওদের কাছে ফ্লাট বিক্রি করেছিলো কে জানে? আর ওই মাইয়ার রুমটা আমার রুমের উপরেই হতে হলো যত্তসব! ”
কথাগুলো বলতে বলতে নিজের রুমে চলে গেলো সাজ্জাদ। ও যেতেই সাদিয়া হেসে ফেললো। মিসেস শাহনাজ সাদিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন।
“কিরে হাসছিস কেনো?”
সাদিয়া হাসতে হাসতে বললো।
“আম্মু আঁখি আপু ইচ্চে করে ভাইয়াকে বিরক্ত করতে ওমন ভাবে নাচে। আসলেই ওবাবে কেউ নাচে না।”
মিসেস শাহনাজ কিছু বললেন না। হালকা হাসলেন। সাজ্জাদ নিজের রুমে গিয়ে রেগে এদিক ওদিক পাইচারি করছে আর বলছে।
“চক্ষুর বাচ্চা! আজ তোকে সামনে পাই তো দেখিস কি অবস্থা করি তোর। শেষ মেশ আমায় ভিখারী বানিয়ে দিলো? তোকে সামনে পাই একবার আমায় ইচ্ছে করে জ্বালানো ছুটিয়ে দিবো।”
কথাগুলো বলেই সাজ্জাদ ফ্রেশ হতে চলে গেলো।
সাদিয়া বসে বসে খাচ্ছে। এর মাঝেই আশরাফ খান এসে পরলেন। সাদিয়া নিজের বাবাকে দেখেই হাসি দিয়ে বললো।
“গুড মর্নিং আব্বু?”
আশরাফ খান এদিক ওদিক তাকিয়ে বললেন।
“শাহনাজ? এখন কি সকাল? বেলা তো প্রায় দুপুর হতে চললো। এখন কি করে গুড মর্নিং হয়?”
মিসেস শাহনাজ চুপ করে দাড়িয়ে রইলেন। সাদিয়া হালকা কেশে আবারও খাওয়ায় মন দিলো। আশরাফ খান হাত পা ধুয়ে ডাইনিং টেবিলে বসতে বসতে বললেন।
“কি ব্যাপার? সাজ্জাদ এখনও উঠেনি?”
মিসেস শাহনাজ স্বামীর প্লেটে খাবার দিতে দিতে বললেন।
“উঠেছে অনেক আগেই। হয়তো ফ্রেশ হচ্ছে।”
“ফ্রেশ হয়ে কি করবে? কোনো কাজ তো নাই। ওর বয়সে ছেলেরা চাকরি করে নাহয় বিজনেস করে। আর ও মাষ্টার্স পাস করে আড্ডা দিচ্ছে। সারাদিন রাস্তার মোড়ে নাহয় কলেজের গেইটে নাহয় চায়ের দোকানে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে বেড়াচ্ছে।”
খাবার নাড়াতে নাড়াতে কথাগুলো বললেন আশরাফ খান। সাজ্জাদ এমনিতেই রেগে আছে। ওর বাবার কথা শুনে আরও রেগে গেলো। না খেয়েই বেরিয়ে গেলো। মিসেস শাহনাজ ওর পিছনে যেতে যেতে বললো।
“সাজ্জাদ খেয়ে যা বাবা!”
” থাক যাক! আমার খাবার বেশি হয়ে যায়নি।”
আশরাফ খানের কতা শুনে মিসেস শাহনাজ বললেন।
“এখন এসব কথা না বললে হতো না?”
তিনি কিছুই বললেন না চুপচাপ খেতে থাকলেন। সাদিয়া খাওয়া দাওয়া করে আস্তে করে স্কুলে চলে গেলো।
কলেজের গেইটে বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে সাজ্জাদ। আড্ডা বললে ভুল হবে আসলে আঁখির জন্য অপেক্ষা করছে। আজ ও প্রতিশোধ নিয়েই ছাড়বে। আঁখি কলেজের গেইটে আসতেই দেখলো সাজ্জাদ কলেজের বাইরে বাইকে বসে আছে। ওকে দেখেই থমকে গেলো আঁখি। এবার ওর কি হবে? এবার ওকে কে বাঁচাবে?
#শরতের_বৃষ্টি
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
সূচনা পর্ব
ইনশাআল্লাহ চলবে……
(এখন থেকে এই গল্পটাই দিবো। আসলে চৌসর গল্পটা আমার একটুও লিখতে ইচ্ছে করে না। ওটা একেবারেই বাদ। পড়ে দেখেন গল্পটা অবশ্যই ভালো লাগবে। শুভ রাত্রি)