#শরতের_বৃষ্টি
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–৮
তপ্ত দুপুর। রক্তিম সূর্য ঠিক মাথার উপরে। ক্লান্ত পিপাসিত সকল মানুষের মন। সূর্যের তাপে সতেজ মাটি শুকিয়ে শুষ্ক হয়ে গেছে। গাছের পাতাগুলো নেতিয়ে পরেছে। দুপুরের সময়টা কিছু কিছু মানুষের জন্য যতটা সুন্দর আবার অনেকের কাছেই অতটা বিরক্তির। সকাল বিকালের সময়টা একটা উপকারী সময়। সময় স্রতের মতোই বহমান। তা কখনোই কারও জন্য অপেক্ষা করেনা। সময়ের মুল্য সবসময়েই বেশি সেটা দুপুর হোক কিংবা রাত। দুপুরের হাওয়া যতটা গরম থাকে মানুষের মনটাও অতটা খারাপ থাকে। দুপুরের সূর্য গাছের পাতা ভেদ করে আঁখির বেলকনিতে এসে পৌছেছে। আঁখির বেলকনিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাদা মাটি গুলো সূর্যের তাপে শুকিয়ে গেছে। কলেজ থেকে নাচে নাম দিয়েই তাড়াতাড়ি বাড়িতে চলে এসেছে আঁখি। মনের মধ্যে ওর ভয় জমে আছে। যদি ওর মা কোনো ক্রুমে ওর বেলকনিতে যায় তবে ওকে ওকিলের মতো জেরা করতে করতে ওকে শেষ করে দিবে। ও কি উওর দিবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না। সাজ্জাদের কথাতো কিছুতেই ওর মাকে বলতে পারবেনা। ওর মা মানবেও না। রাগি চোখে বললো। ” সাজ্জাদ কি ছোট? যে বাচ্চাদের মতো তোর বেলকনিতে কাদা ছিটাবে? আর সাজ্জাদ কি উড়াল জানে? উড়ে এসে তোর বেলকনিতে কাদা ছিটিয়েছে?” তখন আঁখি কিছুই বলতে পারবে না। চুপচাপ মাথা নিচু করে ওর মায়ের সামনে দাড়িয়ে থাকতে হবে। এসব ভেবেই আখি আনিকাকে রেখেই তাড়াতাড়ি ওদের ফ্লাটের সামনে চলে গেলো। আনিকা ওর তাড়াহুড়োর মানে বুঝতে পারলোনা। তবুও কিছু জিজ্ঞাসা না করে চারতলার সিঁড়িতে পা বাড়ালো। আখি কলিংবেল দিতেই ভিতর থেকে মিসেস রোকেয়া রহমানের চিল্লিনোর আওয়াজ শোনা গেলো। হয়তো তিনি চিল্লিয়ে বলছেন এই অসময়ে কে এলো। তার কাজে বাঁধা দিলো। তিনি রেগে এসেই দরজা খুললো। দরজা খুলে আঁখিকে বাইরে দাড়িয়ে থাকতে দেখে আরও রাগ করলো। কপাল কুচকে আঁখির দিকে তাকিয়ে বললো।
“তুই? এই সময়ে তুই কিভাবে এলি? আজও ক্লাস ফাঁকি দিয়েছিস?”
আঁখি রেগে ভিতরে প্রবেশ করলো। ওর মায়ের সামনে এগিয়ে জোরে চিল্লিয়ে বললো।
“আম্মু সবসময় দোষ দিবে না। সামনে ২১এ ফেব্রুয়ারী। কলেজে বড় অনুষ্ঠান হবে। আজ থেকেই প্রস্তুতি চলবে। তাই আজ থেকেই ক্লাস হবে না।”
কথাটা শুনে মিসেস রোকেয়া রহমান কিছুই বললেন না। আখির দিকে একপলক তাকিয়ে নিজের কাজে চলে গেলেন। আঁখি রেগে ওর রুমে চলে গেলো। রুমে গিয়েই তাড়াতাড়ি করে দরজা আটকে ফেললো। তাড়াহুড়ো করে ব্যাগটা রেখে বেলকনিতে চলে গেলো। বেলকনিতে গিয়েই ওর মথায় হাত। সব কাদা শুকিয়ে গেছে। এখন তো আরও কষ্ট হবে। এগুলো উঠাতে হবে। আখি রেগে কোমড়ে হাত দিয়ে বললো। “সাজগাজ! তোকে আমি এর থেকে দিগুণ খাটাবো দেখিছ।” আঁখি মোটা কাগজ দিয়ে মাটি গুলো সরাতে লাগলো। মাটিগুলো সরিয়ে ভিজে কাপড় দিয়ে মুছতে লাগলো। দুপুরের রোদ্রের তাপে আঁখি ঘেমে একাকার। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। আঁখি হাত দিয়ে ঘামগুলো মুছে আবার ফ্লোর মুছতে লাগলো। সব কাজ শেষ করে আঁখি ফ্লোরে বসে পড়লো। গরমে যেমন ও ঘেমে গেছে তেমনি রেগে আছে। কি করে ও সাজ্জাদ কে শাস্তি দিবে সেটাই বুঝতে পারছেনা। কিছুক্ষণ ভেবে ও একটা বুদ্ধি পেলো। ওয়াশরুমে গিয়ে একটা মগ আনলো। মগে ওর কলমের কালি পানির সাথে মিশালো। মিশিয়ে ভাবলো কি করে ও সাজ্জাদের বেলকনিতে ওগুলো মারবে? হাত দিয়ে চেষ্টা করতে লাগলো। অনেকক্ষন চেষ্টা করলো কিন্তু কিছুতেই হাত অত নিচে পর্যন্ত নিতে পারছে না। হাত দিয়ে মারলে ওর দেয়ালেই লাগবে। ওর হাতটা একটু বড় হলে ভালো হতো। আঁখি বিরক্ত হয়ে বসে পরলো। মগটা রেখে ভাবতে লাগলো কি করবে? পরক্ষনেই ওর মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। আঁখি তাড়াতাড়ি করে রুম থেকে বের হলো।দরজা খুলে বাইরে বের হতেই মিসেস রোকেয়া রহমানের সামনে পরলো। আঁখি চুপচাপ দাড়িয়ে গেলো। ওকে দাড়িয়ে থাকতে দেখেই বললো।
“কিরে? দাড়িয়ে আছিস কেনো? কি কাজে তাড়াহুড়ো করে রুম থেকে বের হলি?”
মিসেস রোকেয়া রহমানের কথা শুনে আঁখি এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। এখন দরজা খুলো বাইরে যাওয়া মানেই ওর মায়ের হাজার প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া। কি বলবে? আঁখি চুপচাপ ভাবতে লাগলো। কিছুক্ষণ ভেবে জোর পূর্বক হেসে বললো।
“আম্মু আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে। তাই তাড়াহুড়ো করে খেতে এসেছি।”
কথাটা বলেই আঁখি ডাইনিংয়ের চেয়ারে বসে পরলো। ওর কথা শুনে মিসেস রোকেয়া রহমান অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। মনে হয় তিনি আকাশ থেকে পড়েছেন। কিছুক্ষণ আঁখির দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন।
“কি হয়েছে? প্রতিদিন তো ডাকতে ডাকতে তোকে ডাইনিং টেবিলে আনা লাগে। এমনকি এই খাওয়ার জন্য তোর কলেজেও লেট হয়। প্রতিদিন সকালেও দেরি করে আসোছ। আজ হঠাৎ কি হলো? খাওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগলি কেনো?”
আঁখি জোর পূর্বক হেসে ওর মায়ের দিকে তাকালো। এবার বুঝতে পারলো ও কতবড় ভুল করেছে। ও ভুল জায়গায় ভুল ডায়লগ দিয়েছে। রেল বলতে গিয়ে বেল বলে ফেলেছে। এবার তো আরও প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে ওকে। এসব ভেবেই আঁখি কপালে হাত দিলো। আমতা আমতা করে ওর মায়ের দিকে তাকালো। মিসেস রোকেয়া রহমান ওর এখনও ওর দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে। আঁখি ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো।
“এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো? এভাবে তাকিয়ে থাকার মানে কি আম্মু? শোনো? তোমার গোয়েন্দাগীরীটা এবার একটু বন্ধ করো। এভাবে তাকিয়ে থেকো না। আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে খাবার দেও!”
মিসেস রোকেয়া রহমান কিছুক্ষণ আঁখির দিকে তাকিয়ে থেকে খাবার সার্ভ করতে লাগলেন। আঁখির প্লেটে অনেক বেশি করে খাবার দিলেন। খাবারের দিকে তাকিয়ে আঁখি ঢোক গিলতে লাগলো। ওর মা খাবার দিতে দিতে বললো।
“যদি সব খাবার শেষ না করে উঠেছিস তো বুঝবি মজা!”
কথাটা বলেই তিনি পাশো সোফায় বসে পরলেন। আঁখির চেহারা পুরো কাঁদো কাঁদো হয়ে গিয়েছে। কি করবে এখন ও? এই খাবার তো ও দু বেলায় খায়। এখন এক বেলায় খাবে কি করে? যে করেই হোক খাবারগুলো শেষ করতে হবে। খাবার প্লেটে হাত দিয়ে এসব ভেবে চলেচে আঁখি। ওকে বসে থাকতে দেখে মিসেস রোকেয়া রহমান ধমক দিয়ে বললেন।
“কিরে? খাবারে হাত দিয়ে বসে আছোস্ কেনো? তোর না অনেক ক্ষিদে লেগেছে? তাড়াতাড়ি খা!”
আঁখি এবার চুপচাপ খেতে লাগলো। কিছুটা খাবার খেয়েই আঁখির পেট ভরে গেলো। ওর খুব পানি খেতে ইচ্ছে করলো কিন্তু ও পানি খেলো না। পানি খেলেই খাবার খাওয়ার ইচ্ছে একেবারই শেষ হয়ে যাবে। তাই চুপচাপ খেতে লাগলো। অনেক কষ্ট করে সব খাবার খেলো। খাবার গুলো শেষ করে দাঁড়াতেই ওর মনে হলো পেটের ভারে নিচে পরে যাচ্ছে। ও আস্তে আস্তে হেটে নিজের রুমে চলে গেলো। ওকে ওভাবে যেতে দেখে মিসেস রোকেয়া রহমান হেসে ফেললেন। তিনি বুঝছেন আঁখি অন্য কিছু করতে যাচ্ছিলো কিন্তু ভুলে এ কথা বলেছে। তিনি মুচকি হেসে টিভিতে খবর দেখতে লাগলেন। আঁখি অনেক কষ্টে নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লো। মানুষের পেট খালি থাকলে যতটা কষ্ট লাগে, বেশি ভরে গেলে আরও বেশি কষ্ট লাগে। আঁখি ওর মাকে হাজারটা গালাগাল দিতে দিতে ঘুমাতে লাগলো।
—————————
সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। এখন সূর্যের উত্তাপ অনেকটাই কমে গেছে। বলতে গেলে একেবারেই নাই। পশ্চিমাকাশ থেকে কিছুটা সূর্যের রশ্মি বিচ্ছুরিত হচ্ছে।পড়ন্ত বিকাল বেলা। এই শহরে মানুষ নানা কাজে ব্যস্ত। কিছু কিছু মহিলারা বসে গল্প করছে। প্রায় বাচ্চারা খেলছে। খেলা করার জন্য বিকেলটা উপযোগী একটা সময়। বিকাল বেলা মিসেস রোকেয়া রহমানের ডাকে আঁখির ঘুম ভাঙলো। আঁখি তাড়াতাড়ি করে উঠে বসলো। উঠতেই ওর প্লানের কথা মনে হলো। আঁখি দৌড়ে ওয়াশরুমে গেলো। ফ্রেশ হয়ে চুলটা বেধে বেরিয়ে গেলো। মিসেস রোকেয়া রহমান কিছুই বললো না। কারন আঁখি বিকালে ছাঁদে যায়। বিকাল বেলা সবারই একটু ঘোরা ফেরা দরকার। আঁখি তাড়াতাড়ি করে নিচে নামতে নিলো। দোতলায় যেতেই সাদিয়ার সাথে দেখা হলো। আঁখির তাড়া আছে তাই ও তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছিলো। সাদিয়া আঁখির কাছে গিয়ে বললো।
“কি ব্যাপার আপু? এত তাড়াহুড়ো করে কোথায় যাচ্ছো?”
সাদিয়ার কথা শুনে আঁখি থেমে গেলো। মনে মনে একটু বিরক্ত হলো। কারন তাড়াহুড়োর সময়েই সবাই বিরক্ত করে ওকে। তবুও সাদিয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো।
“কিছুনা এমনিতেই নিচে যাচ্ছি। তোমার কি অবস্হা?”
সাদিয়া আঁখির ২বছরের ছোট। এবার ইন্টারে পড়ে তাই আঁখি তুমি করেই বলে ওকে। সাদিয়াও ওকে আপু বলে তুমি করে বলে। ওদের মধ্যে খুবেই ভালো সম্পর্ক। সাদিয়া মুচকি হেসে বললো।
“আলহামদুল্লিলাহ ভালো আছি। তুমি একাই যাচ্ছো আপু?”
“হুম! তুমি যাবে? তাহলে চলো!”
কথাটা আঁখি একেবারেই বলতে চায়নি। এটা না বললে খারাপ দেখায় তাই বলেছে। কিন্তু মনে মনে দোয়া করচে যেনো সাদিয়া একেবারেই না যেতে চায়। আঁখি মনে মনে আল্লাহ আল্লাহ করছে এর মাঝেই সাদিয়া বলে উঠলো।
“আমি যেতে পারবো না আপু। এইমাত্রই নিচ থেকে এসেছি। সরি! আম্মু ডাকছে। আসি আপু!”
কথাটা শুনেই আঁখি এক আকাশ খুশি হলো। খুশিতে লাফাতে ইচ্ছে করছে কিন্তু তা করলোনা। সাদিয়া গেলে কিছুতেই কাজটা করতে পারতো না। আঁখি সাদিয়া কে বিদায় দিয়ে নিচে চললো নিজের কাজ করতে। আঁখি নিচের বাগান থেকে খুঁজে একটা লাঠি আনলো। ওটা অনেক কষ্টে লুকিয়ে ওর রুমে আনলো। লাঠিটা এনেই দরজা আটকে দিলো। জোরে একটা শ্বাস ছেড়ে খুশিতে লাফাতে লাগলো। কিছুক্ষণ লাফিয়ে লাঠিটার মাথায় মগটা শক্ত করে বেধে নিলো। এবার বেলকনিতে গিয়ে লাঠি নাচের দিকে নামাতেই দেখলো ভালোভাবে সাজ্জাদের বেলকনিতে লাটি পৌঁছেছে। এবার আঁখি হাত দিয়ে নাড়িয়ে নাড়িয়ে সাজ্জাদের বেলকনিতে কালি মারতে লাগলো। অনেকক্ষন পর মগের সব কালি শেষ হলো। আঁখি মগটা তুলে নিলো। ও শুধু ভাবছে সাজ্জাদের বেলকনি দেখতে কেমন হয়েছে? ওর খুব দেখতে ইচ্ছে করছে কিন্তু চাইলেও পারবেনা। তবে অনেক খারাপ হয়েছে সেটা ও বুঝতে পারছে। সাজ্জাদের রিয়াকশনের কথা ভেবেই আঁখির হাসি পাচ্ছে চরম হাসি! আঁখি নিচে সাজ্জাদের গোলাপ গাছের দিকে তাকিয়ে কোমড়ে হাত রেখে নিজে নিজেই বললো।
“বলেছিলাম না মি. সাজগাজ? আপনাকে আমার থেকেও বেশি খাটাবো। এবার এসে দেখেন। হুহ!”
কথাটা বলে মুখটা ভেংচিয়ে ওর রুমের ভিতরে চলে গেলো।
ইনশাআল্লাহ চলবে…..
(গল্পটা কে কে চান বলেন তো?)