শরতের বৃষ্টি পর্ব-২১

0
2360

#শরতের_বৃষ্টি
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–২১

“নিরবকে তোমার কেমন লাগে?”

কথাটা শুনে চমকে ওর বাবার দিকে তাকালো আঁখি। আমিনুর রহমান উৎসুক চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। খাটে হেলান দিয়ে বই হাতে বসে আছেন তিনি। আঁখি ঠিক তার সামন বরাবর একটু দূরে খাটে বসে আছে। ঘুম থেকে ওঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করতেই ওর মা ওকে বলছে ওর বাবা ওকে জরুরী কথা বলবে। কিন্তু ওর মনে কখনও এটা জাগেনি ওর বাবা এসব কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারে। আঁখি বুঝতে পারছেনা হঠাৎ ওর বাবা নিরবের কথা জিজ্ঞাসা করছে কেনো। নিরবকে ওর কেমন লাগে তা দিয়ে ওর বাবা কি করবে? আঁখি কি উওর দিবে বুঝতে পারছে না। নিরবকে ওর খারাপ লাগে তেমন কিছু না। নিরব খুব ভালো ছেলে কিন্তু আঁখির গায়ে পড়ে কথা বলাটা একটু খারাপ লাগে। কিন্তু এই কথাই কিভাবে বলবে? ও নিঃশ্চুপ থাকাটাই শ্রেয় মনে করলো। অনেক সময় সম্মান বাঁচাতে চুপ থাকতে হয়। কিন্তু এখানে আঁখি কে লজ্জা থেকে বাঁচতে চুপ থাকতে হচ্ছে। একটা ছেলেকে কেমন লাগে এই বর্ননা কখনও ওর বাবাকে দিতে পারবে না। কোনো মেয়েই তার বাবাকে এই কথা বলতে পারবেনা। আঁখিকে চুপ থাকতে দেখে ওর বাবা সজাগ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন।

“আমার সিক্সসেন্স বলছে ওকে তোমার খারাপ লাগেনা। আসলে ও খারাপ লাগার মতো কেউ না। যাইহোক আসল কথায় আসি। ওর সাথে যদি তোমার বিয়ে ঠিক করি তবে বিয়েতে তোমার মতামত কি সেটা বলো?”

আঁখি এবার হাজারগুন চমকে উঠলো। তার মানে ওর বিয়ের কথা বলা হয়েছে? ও বুঝতেই পারেনি ওকে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিবে। বিয়ের কথা শুনেই আঁখির একটু খারাপ লাগলো। ও পড়াশোনা শেষ করার আগে এসব ভাবতে চায়নি। আঁখিকে আবারও চুপ থাকতে দেখে আমিনুর রহমান গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন।

“আঁখি! আমি চুপ থাকা পছন্দ করিনা। যদি তোমার পছন্দ না হয় তবে না বলে দেও। যদি সময়ের প্রয়োজন হয় তবে বলো তোমার সময় প্রয়োজন। আমি তোমাকে জোর করছি না, জিজ্ঞাসা করছি। এভাবে চুপ থাকাটা শিক্ষিত লোকের কাজ নয়। শিক্ষা মানেই তুমি ভয় কে জয় করবে। নির্ভয়ে সবার মাঝে কথা বলবে। সব বাধা পেরিয়ে নিজের স্বপ্ন লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে।”

আঁখি ওর বাবার কথায় একটু ভয় পেলো। তিনি এমনিতে বেশি রাগেন না। ছেলে মেয়েদের যথেষ্ট ছাড় দেন কিন্তু উল্টা পাল্টা কাজ একদমেই পছন্দ করেন না। আঁখি মাথা নিচু করে নিম্ন স্বরে বললো।

“আব্বু আমি পড়া লেখাটা শেষ করতে চাই।”

আমিনুর রহমান ওর কথায় একটু চুপ থাকলেন। গম্ভীর স্বরে কিছুক্ষণ ভাবলেন। অগত্যা আঁখি কে উদ্দেশ্য করে বললেন।

“যদি বিয়েতে অমত থাকে তবে আমাকে বলতে পারো। পড়া শোনার দোহাই দিয়ে বিয়ে আটকানোর বৃথা চেষ্টা করো না। নিরবদের বাসার সবাই শিক্ষিত। তারা তোমার ইচ্ছা অনুযায়ী পড়া লেখা করতে দিবে। আমাদের একথা বলে গিয়েছে। যদি অন্য কাউকে পছন্দ করো তবে নির্ভয়ে বলতে পারো। আমি মোটেও রাগ করবো না।”

মুচকি হেসে শেষের কথাটা বললেন আমিনুর রহমান। আঁখি তৃপ্তির চোখে ওর বাবার দিকে তাকালো। ওর নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। ওর বিয়ের বিষয়ে ওর মতামতকে প্রাধান্য দিয়েছে। এখনও অনেক পরিবার আছে যেখানে মেয়েকে বিয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হয় না। জোর করে নিজেদের পছন্দ কে মেয়ের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। মেয়ের কান্না আর না বলাকে কখনই গ্রাহ্য দেয়না। তারা মনে করে তারা যেখানে দিবে সেখানেই ভালো থাকবে। এটাকে বিয়ে দেওয়া বলে না। এটাকে বলে মেয়েকে জোর করে জ্বলন্ত চিতায় উঠানো। অনেকেই এটা বোঝেনা। তাদের মতে বিয়ে হয়ে গেলে ঠিকই মেনে নিবে কিন্তু মেয়েটার হৃদয়ের নিরব কান্না তারা দেখে না। তারা বুঝেনা মেয়েটা ভিতরে ভিতরে মৃত লাশ হয়ে গেছে। আঁখি একটু ভাবলো। ওর পছন্দের কারো নাই। নিরব মোটেও খারাপ ছেলে না। যেহেতু ওর বাবা মা ওকে পছন্দ করে তো ওর বিয়েতে না করার প্রশ্নই উঠেনা। আঁখি নির্ভয়ে ওর বাবার দিকে তাকিয়ে বললো।

“আব্বু আমার কোনো পছন্দ নেই। তোমার আর আম্মুর পছন্দই আমার পছন্দ। আমি জানি তোমরা আমার জন্য বেস্ট জিনিসেই পছন্দ করবে।”

“আমাদের কথা ভেবে আবার এসব বলছো নাতো? নিজের মন থেকে বলো? এখন এসব বলে মনে মনে সারাজীবন আমাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রাখতে পারবে না কিন্তু!”

আঁখি মুচকি হেসে ওর বাবার দিকে একপলক তাকিয়ে উঠে দাড়ালো। রুম থেকে বের হতে হতে বললো।

“বুদ্ধিমানের জন্য ইঙ্গিতেই যথেষ্ট!”

কথাট বলেই মুচকি হেসে আঁখি রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। আমিনুর রহমান মেয়ের কথায় শব্দ করে হাসলেন। মেয়েটার সাথে কথায় পারবে না। তার কথা তাকেই ফিরিয়ে দেয়। রোকেয়া রহমান দরজার পাশেই ছিলেন আঁখি বেড়িয়ে যেতেই তিনি রুমে প্রবেশ করলেন। মুচকি হেসে স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বললেন।

“তোমার অনুমতি নেওয়া হয়েছে? নাকি আরও বাকি? যদি শেষ হয় তবে কথাটা জানিয়ে এসো!”

আমিনুর রহমান তৃপ্তির হাসি দিলেন। তার খুব খুশি খুশি লাগছে। মেয়েকে একটা সঠিক পাত্রের হাতে তুলে দিলে কোনো বাবারেই চিন্তা থাকেনা। আমিনুর রহমান মনে মনে ভাবলেন জুম্মার নামায পড়তে গেলেই আশিকুর রহমানের সাথে দেখা হবে তখনেই কথাটা জানানো যাবে।

———————————-

জুম্মার নামায পড়ে ঘরে ঢুকলেন আশরাফ খান। সাথে তার বন্ধু কে নিয়ে এসেছেন। তারা আসতেই মিসেস শাহনাজ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আশরাফ খান খেতে খেতে বন্ধুর সাথে কথা বলছেন। খাওয়ার সময় সাজ্জাদ কেও ডেকেছিলেন কিন্তু সাজ্জাদ একটু আগে খেয়েছে বলে খাবে না বলেছে। খাওয়া শেষে সোফায় বসে কথা বলছেন আশরাফ খান। সাজ্জাদ আজ রুম থেকে বের হচ্ছে না দেখে তিনি মনে মনে রেগে আছেন। গম্ভীর স্বরে সাদিয়াকে বললেন।

“সাজ্জাদ কে এখানে আসতে বলো! ”

কথাটা বলেই তিনি আলোচনায় ডুবে গেলেন। সাদিয়া ওর ভাইকে ডাকতে যেতেই দেখলো সাজ্জাদ রুমে নেই। তারমানে বারান্দায়! ও বারান্দায় গিয়ে দেখলো সাজ্জাদ রেলিং ধরে স্থির হয়ে দাড়িয়ে আছে। সাদিয়া ওর ভাইয়ের পাশে দাড়িয়ে হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো।

“বিয়ে তো তোর ইচ্ছা নাই জানি। কিন্তু কি করবি বল? আম্মু আর বাবা তো চায়। এমন তো না যে তোর বয়স হয়নি। বয়স তো হয়েছে এবার বিয়েটা করে নে। তোর বউ দেখার খুব ইচ্ছ আমাদের।”

সাজ্জাদ ঘাড় ফিরিয়ে সাদিয়ার দিকে তাকালো। রেগে ওর দিকে তাকিয়ে বললো।

“এই তুই কি আমাকে সান্ত্বনা দিতে এসেছিস্ নাকি বিয়ের জন্য রাজি করাতে এসেছিস? একটা কথা ছাপ ছাপ বলে দিচ্ছি দুটোর একটা করেও লাভ নাই। বিয়ে হবে না বুঝলি? এই বিয়ে ঠেকিয়েই ছাড়বো আমি। তোকে না তাড়িয়ে আমি বিয়ে করবো না।”

সাদিয়া গাল ফুলিয়ে ওর ভাইয়ের দিকে তাকালো। একটু জোরে রেগে বললো।

“তোর বউকে না জ্বালিয়ে আমি বাড়ি ছেড়ে নরছি না। বাবা ডাকছে আয়!”

কথাটা বলেই সাদিয়া মুখ বাকিয়ে চলে গেলো। সাজ্জাদ কিছুই বললোনা ডাকছে যখন দেখা করেই আসুক বিয়ে তো ও করবেই না। ওর নিজের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করবে ও। যাকে পছন্দ না তাকে বিয়ে করবে কিভাবে? সাজ্জাদ জোরে শ্বাস নিয়ে ড্রইংরুমে চলে গেলো। ওখানে গিয়ে ভাব নিয়ে সোফায় বসে পড়লো। সামনে তাকিয়ে বললো।

“আসসালামু আলাইকুম! আমি সাজ্জাদ নিশান্ত খান!”

ওর কথা শুনে ওর বাবা আর ওর বাবার বন্ধু ওর দিকে তাকালো। আশরাফ খানের ওর ব্যবহারটা পছন্দ হয়নি। বসতে না বলতেই ও বসছে কেনো? ওর নাম জিজ্ঞাসা না করতেই বললো কেনো তাই তিনি সাজ্জাদের দিকে গরম চোখে তাকালেন। সাজ্জাদ কোনো কেয়ারেই করলো না। ভাব নিয়ে বসে রইলো। আশরাফ খান নিজের বন্ধুর দিকে জোর পূর্বক হেসে তাকালেন। আশরাফ খানের বন্ধু সালামের জবাব নিয়ে সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো।

“তো বাবা! তোমার ভবিষ্যত প্লান কি? সবসময় বাবার বিজনেসেই সামলাবে নাকি নিজের কিছু করার ইচ্ছা আছে!”

সাজ্জাদ ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো তার মানে ওর বাবা বলেছে ছেলে বিসনেজ সামলায়? সাজ্জাদের খুব হাসি পেলো কিন্তু নিজের হাসিকে দমিয়ে হালকা গলা ঝাড়া দিলো। সাজ্জাদ কি বলে ফেলে তাই ওর কিছু বলার আগেই আশরাফ খান জোরপূর্বক হেসে বললেন।

“এই বিশাল সম্পত্তি সবই তো ওর। কি দরকার এত ঝামেলা নেওয়ার? তাই আমরাই চাচ্ছিনা অন্য কিছু করুক। ও তো বিজনেসটাকে আরও এগিয়ে নিতে চাচ্ছে। আমরাই চাপ নিতে নিষধ করছি!”

সাজ্জাদ ওর বাবা আর তার বন্ধুর দিকে তাকিয়ে জোর পূর্বক হাসি দিলো। সাজ্জাদ মনে মনে দাঁত চেপে বললো। ” তুমি যতই চাও এই বিয়ে হচ্ছে না। শুধু শুধু মিথ্যে বলে কি লাভ যেখানে পাত্র নিজেই বিয়ের ভাঙানি দিবে!” কথাটা বলেই সাজ্জাদ মুচকি হাসলো। লোকটি কিছুক্ষণ কথা বলে চলে গেলো। লোকটি যেতেই সাদিয়া সোফায় ওর ভাইয়ের পাশে বসে পড়লো। সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে ভ্রু উচিয়ে বললো।

“কি বল? বিয়েটা তাহলে হয়েই যাচ্ছে?”

সাজ্জাদ কিছুই বললো না। টিভি অন করতে করতে ঠোঁট বাকিয়ে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে হাসলো। মিসেস শাহনাজ সোফায় বসে বললেন।

“পরশু মেয়ে দেখতে যাচ্ছি!”

সাজ্জাদ কিছুতেই কান দিচ্ছে না। সোফায় বসে মন দিয়ে টিভি দেখছে। মনে হচ্ছে টিভি তে ওর দরকারি কিছু আছে। আশরাফ খান তার বন্ধুকে বিদায় দিয়ে এসে সোফায় বসতে বসতে বললো।

“এইমাত্র শুনে এলাম আমাদের চারতলার আমিনুর রহমানের মেয়ে আঁখির বিয়ে ঠিক হয়েছে।”

কথাটা বর্জপাতের ন্যায় সাজ্জাদের কানে প্রবেশ করলো। ও চমকে ওর বাবার দিকে তাকালো। কি বলছে ওর বাবা? ও ভুল শুনছে না তো? কথাটা দ্বিতীয় বার সঠিক ভাবে শোনার জন্য অধীর আগ্রহে ওর বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো। মিসেস শাহনাজ উৎসুক হয়ে বললো।

“সত্যি নাকি? তাহলে তো ভালোই।”

আশরাফ খান কিছু বলতে যাবে তার আগেই সাদিয়া বেস উৎসুক হয়ে হাসি মুখে বললো।

“কার সাথে বাবা?”

“নিচতলার নিরবের সাথে!”

কথাটা শুনেই সাদিয়ার হাসি মুখ সাথে সাথেই মিলিয়ে গেলো। ওর চেহারায় এসে ভীর করলো একরাশ কালো মেঘ। ওর মনের মধ্যে একটা অস্থিরতা কাজ করতে লাগলো। ওর মন বলছে এটা কি হওয়ারি ছিলো? না হলে কি খুব ক্ষতি হতো? সাদিয়া জোরপূর্বক হেসে সোফা থেকে উঠে নিজের রুমে চলে গেলো। ওর হঠাৎ চলে যাওয়ার বেশ অবাক হলেন আশরাফ খান ও মিসেস শাহনাজ। সাজ্জাদের এসবে খেয়াল নেই। ও এখনও থম মেরে বসে আছে। তারমানে সত্যি বিয়ে ঠিক হয়েছে? ওর বিয়েটা কি হওয়ারেই দরকার ছিলো? এমনেই তো ভালো ছিলো। ওর ভাবনার মাঝেই আশরাফ খান ওকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন।

“এবার কার সাথে ঝগড়া করবে? কাজ ফেলে কার পিছনে পরে থাকবে বলো?”

সাজ্জাদ কিছু না বলে রেগে বাসা থেকে বেড়িয়ে গেলো। দরজা এমন ভাবে আটকালো যেনো ওর রাগ দরজার উপর মিটাচ্ছে। ওর এমন রেগে যাওয়ার কারন দুজনের কেউই বুঝতে পারলেন না। হা করে তাকিয়ে রইলো!

ইনশাআল্লাহ চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here