#শরতের_বৃষ্টি
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–২৯
যখন মানুষ অতিরিক্ত অবাক হয় তখন কথা বলার ভাষা একেবারেই হারিয়ে ফেলে। কি থেকে কি বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা। কোনো অজানা পরিস্থিতি কিংবা যখন আমাদের নিরাপত্তাবোধ হুমকির মুখে- এ ধরনের কোনো বিষয় যখন আমাদের চিন্তায় আসে তখন আমদের শারীরিক এবং মানসিক কিছু পরিবর্তন ঘটে। বিবর্তনের ধারায় মানুষের শরীরবৃত্তীয় এবং মানসিক এই পরিবর্তনগুলোর একটি নির্দিষ্ট ধারা তৈরি হয়ে আছে। এই পরিবর্তনগুলো দিয়ে মানুষ পরিস্থিতি সম্পর্কে সতর্ক হয়, নিজের নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে পারে। ‘বিপদ আসন্ন’ বা ‘খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে’ এই অনুভূতিগুলো এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তন সব কিছু মিলিয়েই প্রচলিত অর্থে আমরা উদ্বেগ বা ইংরেজিতে ANXIETY বলে থাকি। ভয় এবং উদ্বেগের পার্থক্য হচ্ছে প্রথমটি নির্দিষ্ট একটি চেনা পরিবেশ বা বস্তুর প্রতি হঠাৎ সতর্ক হয়ে যাওয়া আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে অচেনা, মনের ভেতরের, বিবাদমান পরিস্থিতিতে হওয়া অনির্দিষ্টভাবে সতর্ক হওয়ার অনুভূতি। আঁখির অবস্থাও সেরকম হয়েছে। নিরব একদম নিশ্চুপ ভঙ্গিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। না কথা বলছে না কিছু জিজ্ঞাসা করছে। নিরবের এই চুপ থাকাটাই আঁখির মনে ভয় জেগে উঠছে। আঁখি মনে মনে ভাবছে নিরব কি ওকে থাপ্পড় দিবে নাকি বকবে? আঁখি মনে৷মনে আল্লাহ আল্লাহ করতে লাগলো। আঁখি কখনও বুঝতে পারেনি ওকে এমন পরিস্থিতিতে পরতে হবে। আঁখি হাত কঁচলে আবারও নিরবের দিকে তাকালো। নিরব একেই ভঙিতে তাকিয়ে আছে। আঁখি গবার জোরপূর্বক হাসলো। ওর হাসিতে নিরবের কোনো রূপ পরিবর্তন হলো না। নিবর থমথমে গলায় আঁখি কে উদ্দেশ্য করে বললো।
“যা শুনেছি তা কি সত্যি? ”
নিরবের গলা কেমন যেনো শোনাচ্ছে। মনে হচ্ছে কথা বলতে পারছেনা। গলায় বেজে বেজে আসছে। এবার আঁখি কি বলবে ভেবেই পাচ্ছেনা। উওর দেওয়ার মতো কিছুই নেই। আঁখি এদিক ওদিক তাকিয়ে আমতা আমতা করতে লাগলো। নিরব ঠোটঠোঁট দিয়ে জিহ্বাটা ভিজিয়ে বললো।
“এত আমতা আমতা করার তো কিছু নেই। আমি জাস্ট সত্যিটা জানতে চেয়েছি। আমাকে সত্যিটাই বলবে! মিথ্যা বলে কাউকে খুশি করার চেয়ে সত্যি বলে খুন করাটাও উওম। এতে লোকটা মরেও স্বস্তি পায়। আমি একজন পুলিশ অফিসার, সকল পরিস্থিতি সহ্য করার শক্তি বা সাহস দুটোই আমার আছে। কোনো অজুহাত ছাড়াই বলো!”
নিরব মুখে এ কথা বললেও ভিতরে একেবারেই ঠিক নেই। অনেক কষ্টে এই কথাগুলো মুখ দিয়ে বের করেছে। ওর গলা কেমনযেনো শুকিয়ে আসছে। জীবনের প্রথম ওর এত ভয় লাগছে। এই প্রথম কোনো কথা শুনতে ওর হৃদয় কাপছে। হাত পা অবশ হয়ে আসছে৷ জীবনে এত ভয়ংকর লাশ দেখেছে তাতেও এতটা ভয় পায়নি। নিরব থরথর করে কাপছে। আঁখি একটু ঠিক হয়ে বললো।
“হ্যাঁ সত্যি! আমার বিয়ে হয়ে গেছে।”
কথাটা যেনো বর্জপাতের ন্যায় নিরবের কানে আঘাত করেছে। ওর পুরো শরীর কেঁপে উঠছে। ও যেনো থরথর করে কাঁপছে। ও কাঁদছে না। ওর চোখে একেবারেই পানি আসছেনা। ও স্থির! ভিতর থেকে দুমরে মুচড়ে আসছে। ওর মনে হচ্ছে আঁখির কথাটা মিথ্যা হতো। ও এখনি বলতো এসব মিথ্যা। আখি শুধুই ওর। কিন্তু নাহ! আঁখিতো কিছুই বলছে না। চুপ করে আছে। নিরবের মনে হলো এসব মিথ্যা। ও কথা বলতে পারছেনা তবুও অনেক কষ্টে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো।
“তুমি মিথ্যা বলছো তাই না? সাজ্জাদ.. সাজ্জাদ তোমায় জোর করে বিয়ে করেছে তাইনা? ওকে ডাকো!”
আঁখি মাথা ঝাকালো। মানে বোঝালো মিথ্যা না। কিন্তু নিরব মানতে নারাজ। ওর মন কিছুতেই মানতে পারছেনা। নিরব আঁখির হাত ধরে বললো।
“তোমার ভয় পেতে হবে না। ওকে ডাকো! আমি মানিনা এই বিয়ে। তোমার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। আজ বিকালে আমাদের ঘুরতে যাওয়ার কথা ছিলো। এই দেখো এই হিজাবটা আজ বিকালে তোমার পড়ার জন্য কিনেছি। সুন্দর না? এটা পড়ে আজ আমার সাথে ঘুরতে যাবে।”
নিরব ওর প্যান্টের পকেটে গোজা একটা হিজাব দেখিয়ে পাগলের মতো করে এসব বলছে। আঁখির খুব খারাপ লাগছে কিন্তু ওরেই বা কি করার আছে। কে জানতো এমন হবে? আঁখি হাত ছাড়াতে চেষ্টা করছে। কিন্তু নিরব ওকে ছাড়ছেই না বরং টেনে বাইরে নিয়ে যেতে লাগলো। কেউ দেখলে খুব খারাপ হবে তাই আঁখি রেগে বললো।
“এটা কি ধরনের অসভ্যতা? আপনি না আইনের লোক? তবে নিয়ম কানুন মেনে চলেন না কেনো? অন্যের বউয়ের হাত ধরে টানাটানি করা কিসের ভদ্রতা? আমি খুবেই বিরক্ত হচ্ছি আমার হাত ছাড়ুন! আর কখনও আমায় বিরক্ত করবেন না। যা হয়েছে তা মেনে নিয়ে চলে যান!”
আঁখির কথায় নিরব খুব কষ্ট পেলো। কষ্ট পাওয়া যতটুটু বাকি ছিলো তা এখন কানায় কানায় পূর্ন হলো। যে মানুষকে নিয়ম কানুন শেখায় তাঁকেই আজ অন্য কেউ শিখাচ্ছে? সময় কতটা বদলে গেছে তা নিরব বুঝতেই পারেনি। আঁখির দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হেসে বললো।
“অন্যকে উপদেশ দেওয়া খুবেই সহজ কিন্তু ওই পরিস্থিতি নিজের কাধে আসলে বোঝা যায় তা মানা কতটা কঠিন। আমায় ভদ্রতা শিখাতে হবে না। আমার অভ্যাস খারাপ নয়! তোমায় দেখে একটু খারাপ হতে চেয়েছিলো। ভেবেছিলাম তুমি তো আমারই। জীবনে কখনও কাউকে ভালোবাসিনি। নিজের দায়িত্বকেই বড় মনে করে পালন করেছি। মেয়ে মানুষ মনের ভিতরে স্হান দেইনি দায়িত্বে অবহেলা হতে পারে ভেবে। কিন্তু তোমায় দেখে কি হলো জানিনা। ভালোবাসা আপনা আপনি হৃদয়ে স্হান পেলো। আজ তার মাশুল দিচ্ছি। জানিনা কতদিন দিতে হবে।”
এতটুকু বলে থামলো নিরব। মলিন হেসে আঁখি হাতে হিজাবটা দিতে দিতে বললো।
“তোমার জন্য কিনেছিলাম। কখনও কিনিনি ভালো হয়নি।তোমার বিয়েতে আমার দেওয়া উপহার মনে করে এটা রেখে দাও ইচ্ছা হলে পইড়ো!”
নিরব এমন ভাবে বললো যে আঁখি না করতে পারলোনা। নিরব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হতাশ ভঙ্গিতে বললো।
“আজ মনে হচ্ছে ভালোবাসা খুব কঠিন। খুব ভয়ংকর জিনিস। যা শক্ত পাথরকেও গলিয়ে ফেলে। ভালোবাসা সেই ভয়ংকর আগুন। মানুষের দেহ থেকে হৃদয় পর্যন্ত সব কিছুকে পুড়িয়ে ছাই করে। সেই ছাইকে আবার পোড়ায়। এভাবেই চলতে থাকে তার ধ্বংসলীলা।” এটুক বলে হালকা হাসলো নিরব। অগত্যা আবার বলতে লাগলো। “বদদোয়া করিনা। আল্লাহর কাছে দোয়া করবো তুমি যেনো পৃথিবীর সব থেকে সুখি হও! আসি!”
কথাটা বলে মলিন হেসে সিড়ি বেয়ে নেমে গেলো নিরব। আঁখি অসহায় ভঙ্গিতে ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। ও কখনও ভালোবাসেনি তার কষ্টও বুঝতে পারেনা। আজ নিরবকে কাছ থেকে দেখে বুঝলো কি ভয়ংকর জিনিস। অন্যের কষ্ট হয়তো অনুভব করা যায়না তবে কিছুটা হলেও উপলব্ধি করা যায়। নিরব এতটা কষ্ট পাবে ও বুঝতেই পারনি। পারলেই কি হতো ও তো ইচ্ছে করে কিছু করেনি। জীবনে অনেক জিনিস ঘটে যা আমরা কখনই চাইনা বা আমাদের কল্পনাতেও ভাবিনি। কি আর করার বাস্তবতা তো মেনে নিতেই হবে। জীবন চলার পৎে বাস্তবতা সত্যি খুবেই কঠিন। যা মেনে নিতে মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হয়। আঁখি দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে আকাশ পাতাল ভাবছে। এর মাঝেই ওখানে সাদিয়া আর আনিকা উপস্থিত হলো। আঁখির হাতে হিজাবটা দেখেই সাদিয়া চিনে ফেললো। এটা ও নিরবের হাতে দেখেছিলো। নিরবের হিজাবটা কিছুতেই আঁখির হাতে সহ্য করতে পারছেনা ও। ছো মেরে আঁখির হাত থেকে হিজাবটা নিয়ে মুচকি হেসে বললো।
“ওয়াও ভাবি! হিজাবটা অনেক সুন্দর। তুমি পড়বে না হয় আমায় দাও! আমার খুব পছন্দ হয়েছে।”
আঁখি অবাক চোখে তাকালো। আনিকাও একটু অবাক হলো। আঁখি কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। সাদিয়াকে দেওয়ার ইচ্ছা ওর একেবারেই নেই কিন্তু কি করবে ইচ্ছা না থাকলেও অনেক সময় হাসি মুখে দিতে হয়। আঁখি মুচকি হেসে তাকালো। মানে ও সম্মতি দিয়েছে। সাদিয়া হাসতে হাসতে ভিতরে চলে গেলো। ও যেতেই আনিকা আঁখির দিকে তাকিয়ে বললো।
“কিরে? এসব কি করে হলো? আমার জানা মতে সাজ্জাদ ভাইয়াকে তুই নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করোছনি। কেউ কি জোর করেছে? কি হয়েছে কাহিনী আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা।”
“অনেক লম্বা কাহিনী রে! ভিতরে আয় আস্তে আস্তে সব বলছি।”
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কথাটা বলে ভিতরে গেলো আঁখি। অগত্যা আনিকাকে সব খুলে বললো। সব চুনে আনিকা গালে হাত দিয়ে বসে রইলো। কি আর করার, আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে। এর মাঝেই কলিংবেল বেজে উঠলো। আঁখি উঠে গিয়ে দরজা খুললো। দরজা খুলতেই দেখলো বাইরে অর্নব, আশিক, রনি আর সাজ্জাদ দাড়িয়ে আছে। আঁখি কে দেখেই রনি দাত কেলিয়ে বললো।
“কেমন আছেন ভাবি? শরীরটা ভালো নাকি?”
আখি ওর কথা শুনে একটু আনিজি ফিল করলো। সাজ্জাদ ধারীম করে ওর পিঠে কিল বসিয়ে দিলো। রনি পিঠ ঢলতে ঢলতে বললো।
“আর কত মারবি? সেই তখন থেকে মেরেই চলেছিস। এবার থাম ইয়ার। এমন কেনো তুই? মিষ্টির বদলে মার খাওয়াচ্ছিস।”
“তোকে মারবো না তো আদর করবো? তুই খবরটা লিক করেছিস্। আমার জীবনটা তেনা তেনা করে দিছোছ। খাওয়ায়নি মানে? এই যে দুপুরের খাবার খাওয়াতে নিয়ে এলাম। তুইতো নিমকহারাম।”
কথাটা বলতে বলতে সাজ্জাদ আঁখির হাতে প্যাকেটটা ধরিয়ে দিলো। আঁখি ওর বন্ধুদের মাঝে আর দাড়ালো না। ভিতরে চলে গেলো। ওরা সবাই ভিতরে প্রবেশ করলো। অর্নব ভিতরে যেতেই আনিকার দিকে চোখ পড়লো। আপনা আপনি ওর মুখে হাসি ফুটলো। এখানে এসে এত সুন্দর উপহার পাবে ভাবতেই পারেনি। আনিকাকে বাইরে যত ভালোলাগে আাসায় এলোমেলো আরও দিগুন ভালোলাগে। অর্নব বুঝেনা এই মেয়েটার মাঝে কি আছে। যতই দিন যাচ্ছে ততই পালগ হয়ে যাচ্ছে ও। এবার মনে হচ্ছে অপেক্ষা করাটা কঠিন হবে। যে করেই হোক বিয়েটা করে নিতেই হবে। দরকার পরলে সাজ্জাদের মতো কাহিনী করতে হবে। অর্নবকে ওভাবে তাকাতে দেখে রনি ওকে ঠেলা মারলো। দেখায় ব্যাঘাত ঘটায় অর্নব বিরক্ত নিয়ে কপাল কুচকে রনির দিকে তাকালো। বিনিময়ে রনি দাঁত কেলিয়ে একটা হাসি দিলো। ওদের শব্দ শুনে আনিকা মাথা তুলে তাকালো। সামনে তাকাতেই অর্নবের দিকে ওর চোখ গেলো। আনিকা সাথে সাথেই চোখ ফিরিয়ে নিলো। আনিকা সোফা ছেড়ে উঠতে উঠতে আঁখি কে উদ্দেশ্য করে বললো।
“দুপুর হয়ে গেছে রে আমি আসি!”
কতাটা বলে আঁখি কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আনিকা একপ্রকার পালিয়ে চলে গেলো। অর্নব ইদানিং লক্ষ্য করেছে আনিকা কেমন যেনো ওকে এড়িয়ে চলে। কাছে থাকতে চায়না, চোখের দিকে তাকায় না। আগে তো ওকে পাত্তাই দিতো না। ও থাকলেও কিছু বলতো না, না থাকলেও কিছু বলতো না এখন পালিয়ে যায় কেনো? ব্যাপারটা অর্নবের খটকা লাগলো। ও বিষয়টা জানতে আনিকার পিছু নিলো। সবাই ব্যাপারটা দেখেও মাথা ঘামালো না। সাজ্জাদ সোফা ছেড়ে উঠে বললো।
“তোরা বস আমি গোসল করে আসি!”
কথাটা বলে যেই না উঠতে যাবে তার আগেই আঁখি সাজ্জাদের আগে দৌড়ে রুমের দিকে চলে গেলো। সাজ্জাদ বুঝে গেছে আঁখি কেনো এত তাড়াতাড়ি যাচ্ছে। ও নিজেও আঁখির পিছে দৌড় লাগালো। ব্যাপারটা কারও মাথায় ঢুকলো না। সবাই বুঝতে না পেরে হা করে তাকিয়ে রইলো।
ইনশাআল্লাহ চলবে…
(রি-চেইক করিনি ভুলত্রুটি মাফ করবেন। শুভ রাত্রি গাইস্)