শরতের বৃষ্টি পর্ব-৩৭

0
2134

#শরতের_বৃষ্টি
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–৩৭

সকাল হতেই আঁখি রান্নাঘরে শ্বাশুড়ির সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করছে। বাবার বাড়ি বসে খেতে কিছুই মনে হয়না কিন্তু এখানে বসে খেতে একেবারেই কেমন লাগে। সবাই আর চোখে তাকায়। এখন তো আঁখি আরও খুশি যে সাজ্জাদ জব পেয়েছে। এখন থেকে ও আর বেকারের বৌ নেই। ১০টায় সাজ্জাদের অফিস। শুধু ওরেই না। ওর বাবা আশরাফ খানও ১০টায় বের হন। আঁখি সাদিয়ার কলেজও ১০টায়। তাই সকালের নাস্তাটাও তাড়াতাড়ি তৈরি করতে হবে। সকাল সাড়ে আটটা। সবাই টেবিলে নাস্তা করতে বসেছে। আশরাফ খান খেতে খেতে মিসেস শাহনাজের দিকে তাকিয়ে বললেন।

“বুঝেছো শাহনা! আমার অভদ্র আড্ডাবাজ ছেলেটা বিয়ে করে যদি এত চেঞ্জ হতে পারে তবে আমারও বিয়ে করা উচিত। একবার ভাবো আমি চেঞ্জ হলে কতটা চেঞ্জ হতে পারি। একেবারেই হুজুর হয়ে যাবো তাইনা?”

আশরাফ খানের কথা শুনে মিসেস শাহনাজ চোখ গরম করে তাকালো। সাজ্জাদ মুখে খাবার দিচ্ছিলো ওর বাবার কথা শুনে থমকে গেলো। খাওয়া রেখে ওর বাবার দিকে অবাক হয়ে তাকালো। আঁখি আর সাদিয়া ঠোঁট হাসছে। মিসেস শাহনাজ রেগে ফোসফাস করে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন।

“এত অজুহাত না দেখিয়ে আসল কথা বলো যে, তোমার বিয়ে করার শখ জাগছে।”

আশরাফ খান ভয় পেয়ে আমতা আমতা করে বললো।

“আরে চ্যাতো কেনো। তোমায় নিয়ে এত বছর সংসার করলাম তোমায় কি ভোলা যায়? এটা তো মজা। জাস্ট ফান! তোমায় হিংসা ইংরেজিতে কি জানি বলে..”

“জেলাস বলে বাবা!”

লাফ মেরে মাঝখান থেকে কথাটা বললো সাদিয়া। আশরাফ খান মনে পড়ার ভঙ্গিতে বললেন।

“হ্যাঁ হ্যাঁ জেলাস ফিল করানোর জন্য বললাম। আর তুমি সত্যি সত্যি ক্ষেপে গেলা। তুমি সেই আগের মতোই আছো একটুও রাগ কমেনি তোমার।”

মিসেস শাহনাজ কিছুই বললেন না। আশরাফ খানকে চোখ গরম দিয়ে চুপচাপ খেতে লাগলেন। আশরাফ খানও হাসতে হাসতে খাচ্ছেন। সাজ্জাদও গম্ভীর হয়ে খাওয়া শুরু করেছে। আঁখি একবার আশরাফ খানের দিকে তাকালো তো একবার সাজ্জাদের দিকে তাকালো।দুজনকে দেখে ভাবছে দুজনের মধ্যে কত পার্থক্য। ওর শ্বশুর কত বুড়ো হয়ে গিয়েছে তবুও কত মজা করে আর এর ছেলে এই বয়সেই গোমড়ামুখো। বুড়ো হলে কি হবে কে জানে? আঁখি চুপচাপ খেতে লাগলো। খাওয়া শেষে সবাই সবার কাজে চলে গেলো। আঁখি সাজ্জাদের দেওয়া একটা পোশাক পড়ে ওড়না দিয়ে হিজাব বেঁধে নিলো। বইগুলো হাতে নিয়ে দৌড়ে তাড়াহুড়ো করে নিচে চলে গেলো। নিচে যেতেই দেখলো সাজ্জাদ গ্যারেজ থেকে বাইক বের করছে। আঁখি দৌড়ে ওর বাইকের সামনে গেলো। হঠাৎ সামনে আসায় সাজ্জাদ থতমত খেয়ে গেলো। যদিও বাইক জোরে চলছিলো না তবুও থামতে গিয়ে সাজ্জাদ পড়েেই যেতে নিলো। কোনোমতে ঠিক হয়ে আঁখির দিকে তাকিয়ে বললো।

“এই মেয়ে এখাবে বাদরের মতো লাফিয়ে বাইকে সামনে আসলে কেনো? যদি কিছু হয়ে যেতো তো কে দায় নিতো?”

আঁখি কপাল কুচকে তাকালো। ওকে বাদর বলছে? তাহলে ও নিজে কি? আঁখি সাজ্জাদের কাছে এসে এক হাতে বই আগলে অন্য হাত কোমড়ে গুঁজে বললো।

“এই আপনি আমাকে বাদর বললেন কেনো? আমাকে কি বাদরের মতো মনে হয়? আমার কিছু হলে দায় নিবে কে মানে? সব দায় আপনার, আপনাকেই জেলে যেতে হবে।”

“কথায় কথায় পুলিশের ভয় আমাকে দেখাবে না চক্ষু! আমি মোটেও ভয় পাইনা। সামনে থেকে সড়ো! দেরি হয়ে যাবে।”

সাজ্জাদের কথা শুনে আঁখি লাফ মেরে ওর বাইকের পিছনে চড়ে বসলো। সাজ্জাদ নিজেও চমকে গেলো অবাক হয়ে বললো।

“একি? আমার বাইকের পিছনে উঠছো কেনো? আমার সাথে অফিসে যাবে নাকি? ফাজলামির একটা লিমিট থাকে, দিনদিন তোমার ফাজলামো বেড়েই চলছে। নামো বলছি তাড়াতাড়ি!”

আঁখি নামবে কি আরও চেঁপে বসলো। সাজ্জাদ রেগে ঘার হালকা বাকিয়ে বললো।

“কানে কি কম শুনো? নামতে বলছি। উঠতে বলিনি।”

“আমি কানে ঠিকই শুনি। বাইক স্টার্ট দিন নাহয় দেরি হয়ে যাবে। আমি এখানে নামবো না। আমি কলেজে নেমে পড়বো। আমায় না নিয়ে গেলে এখন কিন্তু এখানে চিল্লিয়ে সবাইকে জড়ো করবো।”

সাজ্জাদ দাঁতে দাঁত চেপে বাইক স্টার্ট করলো। ওকে দিয়ে বিশ্বাস নেই। দেখা যাবে চিল্লিয়ে বিল্ডিংয়ের সবাইকে জড়ো করবে তখন আরেক ঝামেলা। আঁখি সাজ্জাদকে ধরে বসেনি সাজ্জাদ আস্তে আস্তে বাইক চালাচ্ছে। নিরব দূর থেকে ওদের দুজনকে যেতে দেখলো। আজ সাজ্জাদের জায়গায় ওর থাকার কথা ছিলো। ও থাকলে কতনা ভালো হতো। সবটা অন্যরকম হতো। অজান্তেই ওর চোখে পানি এসে পড়লো। ও চুপচাপ বাসায় গিয়ে ওর রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিলো। এখন কিছুক্ষণ দুঃখ বিলাস করবে ও। আজ হয়তো রুম থেকেই বের হবে না। সাজ্জাদ আস্তে বাইক চালাতে চালাতে ভ্রু কুচকে বললো।

“আমায় ধরতে অসুবিধা আর আমার বাইকে উঠতে অসুবিধা নেই তাই না? পড়ে গেলে কি হবে হুম? এই পিচ রাস্তায় পড়ে তোমার মাথা ফাটলে হসপিটালে কে দৌড়াবে? ভাব না নিয়ে চুপচাপ ধরে বসো!”

আঁখি ভাব নিয়ে মুখ বাকিয়ে ঘুরে গেলো। সাজ্জাদ মনে মনে বললো। “এই মেয়ের ঘাড়ের রক হয়তো দুটো বাঁকা আছে। সোজা কথায় শুনতেই চায়না। শুধু ভাব নেয়। দাঁড়াও ভাব নেয়াচ্ছি তোমায়।” কথাটা বলেই সাজ্জাদ ঠোঁট বাকিয়ে হেসে জোরে বাইক স্টার্ট করলো। হঠাৎ জোরে চলতেই আঁখি পড়তে পড়তে সাজ্জাদ কে জড়িয়ে ধরলো। পরক্ষনেই আঁখি আমতা আমতা করে হালকা কেশে সাজ্জাদ কে ছেড়ে ওর ঘাড়ে হাত রাখলো। সাজ্জাদ নিঃশ্চুপ হয়ে ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো। আঁখির কাহিনী গুলো ওর ভালোই লাগে। ইদানিং মাঝে মাঝে ও ইনজয়ও করে।

————————

সাজ্জাদ আঁখি কে নামিয়ে দিয়ে ওর কলেজে চলে গেলো। আঁখি ক্লাস করে একাই ফিরছে। সাদিয়া আর আনিকা আগেই চলে এসেছে। আসলে কলেজের সামনে আতিকের সাথে দেখা হয়েছে তাও ওর দেরি হয়েছে। অনেকদিন পর আতিকের সাথে দেখা হয়েছে। তাই আজ দু ভাই বোন মিলে একসাথে গল্প করেছে। ফুচকা আইসক্রিম খেয়েছে। আজ আর ঝগড়া হয়নি। আতিক পড়ে ওর বন্ধুদের সাথে চলে গিয়েছে। আঁখির এখনও খারাপ লাগছে। ও মন খারাপ করে বাসায় ফিরছে। আঁখি বাসার সামনে আসতেই নিরবের সাথে দেখা হলো। নিরবের দিকে তাকিয়ে আঁখি থমকে গেলো। ওকে কেমন যেনো লাগছে। আগের মতো স্মার্ট নেই। শুকিয়ে গেছে। ওর চুল এলোমেলো, চোখের নিচে কালি পড়েছে। আঁখি নিরবের দিকে অবাক হয়ে বললো।

“কি হয়েছে আপনার? আপনাকে এমন লাগছে কেনো?”

নিরব জোরপূর্বক হাসলো। তবে ওর ভালোই লাগলো যে আঁখি ওর দিকে নজর দিয়েছে। নিরব আমতা আমতা করে বললো।

“কিছুনা। এমনি আর কি! তোমার দিনকাল তো ভালোই চলছে। দোয়া করি এভাবেই সুখে থাকো।”

নিরব ঠিক করে কথা বলতে পারছেনা। ওর গলায় আটকে আসছে। আঁখি নিজেও জোরপূর্বক হাসলো। নিরবের কষ্টটা ও ভালোভাবেই বুঝতে পারছে। তাই কথা না বাড়িয়ে নিরবকে বাই বলে চলে এলো। সাদিয়া উপর থেকে সবেই দেখেছে। রেগে একাকার হয়ে যাচ্ছে। আঁখির উপর তো রাগ হচ্ছেই নিরবের উপরেও রাগ হচ্ছে। আখির সাথে কি সুন্দর করে কথা বলে আর ওর সাথে কথাই বলতে চায়না। আজ সকালে ওর নিরবের সাথে কথা বলতে গেলে নিরব ব্যস্ততা দেখিয়ে চলে গেলো। এখন হেসে কথা বলছে। আঁখিও কেমন যে পরপুরুষের সাথে কথা বলে। সাদিয়া রেগে আঁখির রুমে গেলো। দরজাটা চাপিয়ে রেগে বললো।

“তুমি কলেজে কি করতে যাও ভাবি? পড়তে নাকি পরপুরুষের সাথে হেসে হেসে কথা বলতে?”

আঁখি সবে মাত্র বাসায় ফিরছে সাদিয়ার কথা শুনে চমকে পিছনে তাকালো। এসব কথা সাদিয়া ওকে বলছে? কিন্তু কেনো? পকে এসব কতা বলার মানে কি? ও আবার কি করলো? সাদিয়া ওর সাথে এমন করে করে কেনো? আঁখি অবাক হয়ে বললো।

“সাদিয়া! তুমি এভাবে কথা বলছো কেনো? এসব কি বলছে? তোমার মাথা ঠিক আছে তো?”

“আমার মাথা ঠিকেই আছে তুমি তোমার মন ঠিক করো ভাবি! তুমি বিয়ের পরও অন্য ছেলের সাথে সম্পর্ক রাখছো। ভাইয়া কে ঠকাচ্ছো তুমি!”

সাদিয়া রেগে কথা গুলো বললো। আঁখি আরও অবাক হলো। কি বলে এসব? ও আবার কার সাথে সম্পর্ক রাখছে? বিয়ের আগেই তো ওর সম্পর্ক ছিলোনা এখন থাকবে কিভাবে? সাজ্জাদ কে কোথায় ঠকালো ও? আবোল তাবোল কি বলছে? আঁখি অবাক হয়ে হালকা হেসে বললো।

“সাদিয়া তুমি মাথা ঠান্ডা করো! এসব কি যা তা বলছো? বিয়ের আগেই তো আমার রিলেশন ছিলো না। সেটা তুমি নিজেও জানো। এখন কোথা থেকে আসবে? ইদানীং এমন করছো কেনো? তোমার কি কিছু নিয়ে মন খারাপ?”

“আমার সাথে ভালো সাজতে এসো না। তুমি মোটেও ভালো না। আগে তোমার চরিত্র ঠিক করো। নোংরা মনের মানুষ তুমি। আমার ভাইকে বোকা পেয়ে ঠকাচ্ছো।”

সাদিয়ার কথা শুনে আঁখি খুব রেগে গেলো। ওর চরিত্র নিয়ে কথা বলছে? একটা মেয়ের চরিত্রে দাঁগ লাগালে তার মাথা ঠিক থাকে না। একটা মেয়ের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ তার চরিত্র, ওই চরিত্রের দিকে যখন কেউ আঙ্গুল তুলে তখন মাথা ঠিক থাকে না। আঁখি রেগে সাদিয়ার দিকে এগিয়ে বললো।

“আজ তুমি সাজ্জাদের বোন নাহলে থাপ্পড়ে সব দাঁত ফেলে দিতাম। অসভ্য মেয়ে! তোমায় ভালো ভেবেছিলাম কিন্তু তুমি একটা খারাপ মেয়ে যে অন্য মেয়ের চরিত্রে মিথ্যে দাগ লাগাতেও একবার ভাবে না। বেড়িয়ে যাও রুম থেকে। আর কখনও আমার বিষয়ে নাক গলাবে না।”

“নাক যখন আছে তখন তো গলাতেই হবে। তোমার বিষয়ে না গলালেও আমার ভাইয়ের বিষয়ে তো গলাবোই। আজ ভাইয়া আসুক তার সাথেই সব বলবো। তোমার পাখনা আমি ছেটেই ছাড়বো।”

কথাটা বলেই সাদিয়া চলে গেলো। আঁখি রেগে তাকিয়ে রইলো। ও বুঝেনা সাদিয়া এমন করে কেনো? কি করেছে ও? যদি সাজ্জাদ কে বলে প্যাচ লাগায়? তাহলে ওর কি হবে? আঁখি মাথায় হাত দিয়ে বিছানায় বসে পড়লো।

ইনশাআল্লাহ চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here