শরতের বৃষ্টি পর্ব-৩৯

0
2208

#শরতের_বৃষ্টি
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–৩৯

ধারীম ধুরীম আওয়াজে পুরো বিল্ডিং যেনো কাঁপছে। প্রথমে সবাই হয়তো ভাববে ডাকাতরা আক্রমন করেছে। মিসেস শাহনাজ রান্না ঘরে কাজ করছেন। প্রথমে ভয় পেয়ে কাজ থেকে বিরতি নিলেও পরে বুঝতে পারলেন কি হয়েছে। কি যে হচ্ছে তার বাড়িতে নিজেই বুঝতে পারেন না। কখনও ঠান্ডা পরিবেশ তো কখনও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তিনি একটু চুপ থেকে পরক্ষনেই জোরে শ্বাস ছেড়ে নিজের কাজে লেগে পরলেন। সাদিয়া ভয়ে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠলো। শব্দটা পাশের রুম থেকেই আসছে। বাসায় ডাকাত এসেছে মনে করে দৌড়ে ড্রইংরুমে চলে আসলো। হাফাতে হাফাতে এসেই তাড়াহুড়ো করে বললো।

“কি হয়েছে বাবা? শব্দ কিসের?”

সাদিয়া ঘুমঘুম চোখে ওর বাবার দিকে তাকিয়ে দাড়িয়ে আছে। আশরাফ খান চায়ের কাঁপে মুখ না দিয়ে চুপচাপ আরশের রুমের দিকে তাকিয়ে আছেন। সাদিয়া বুঝতে পারলো কি হয়েছে। কপাল কুচকে বিরক্ত নিয়ে বললো।

“এদের জ্বালায় শান্তিতে ঘুমাতেও পারবো না। আল্লাহ রহম করো! ওদের চক্করে আমাদের জীবন শেষ!”

কথাটা বলেই সাদিয়া ধাপ ধাপ করে পা ফেলে নিজের রুমে চলে গেলো।

“আল্লাহ আমার দরজাকে এবারের মতো বাঁচিয়ে নেও। ওদের স্বামী স্ত্রীর ঝগড়ায় কেনো আমার অবলা দরজাকে জড়াচ্ছো? ও বেচারার কি দোষ? ওকে রক্ষা করো!”

কথাটা বলে আশরাফ খান চুপচাপ চা খেতে লাগলেন। আঁখি ওয়াশ রুমের দরজায় পা দিয়ে বাড়ি দিচ্ছে। অনেকক্ষণ বাড়ি দেওয়ার পর যখন সাজ্জাদ বের হলো না আঁখি ক্লান্ত হয়ে গেলো। কোমরে হাত গুঁজে হাফাতে হাফাতে নিজে নিজেই বললো।

“এই লোকটি কেমন খাটাশ আল্লাহ গো আল্লাহ! এত খারাপ আগে তো বুঝিনি। এতক্ষন দরজা ধাক্কালাম তাও দরজার খোলার নাম নিচ্ছে না? ভিতরে কি ঘুমিয়ে গেলো নাকি?”

কথাটা বলে আঁখি আবারও দরজায় দু’বার টোকা দিলো। এবার আস্তেই দিয়েছে। টোকা দিয়েই জোরে চিল্লিয়ে বললো।

“এই যে মি. সাজগাজ! তাড়াতাড়ি বের হন বলছি! ভিতরে এতক্ষন কি করেন হুম? ঘুমাচ্ছেন নাকি? বের হন!”

আঁখি বলেই যাচ্ছে কিন্তু সাজ্জাদের বের হওয়ার নাম নেই। আজ দুজনের ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গিয়েছে। অগত্যা ওয়াশরুম নিয়ে দুজনের মাঝেই ঝগড়া শুরু হয়েছে। সাজ্জাদ কোনো মতে আগে গিয়েছে তাই আঁখি দরজায় ধুমছে ধুম লাত্থি মারছে। ওইদিন সাজ্জাদের রাগ করার পর আঁখি একদিন চুপ ছিলো ঝগড়া করা থেকে কিন্তু দ্বিতীয় দিন থেকে আবারও শুরু হয়েছে। আঁখি একটু অপেক্ষা করে আবারও দরজায় জোরে জোরে বাড়ি মারছে। সাজ্জাদ ভিতরে থেকেই ঠাস ঠাস শব্দে কেঁপে উঠছে বারবার। সবে মাত্র গোসল ছেড়েছে এখন বের হবে কি করে ও? আসলে সাজ্জাদ বুঝেনা এই মেয়েরটার মাথায় কি গন্ডোগোল আছে কিনা? এমন ডাকাতের মতো কেউ করে? দেখছে ও বের হচ্ছে না তবুও এমন করার কি দরকার? শান্তিতে একটু গোসলও করতে দিবে না। সাজ্জাদ তাড়াতাড়ি করে ড্রেস চেঞ্জ করতে লাগলো। আঁখি বাইরে এদিক ওদিক পাইচারি করছে আর ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। ওর খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে। সাজ্জাদ কে বারবার গালি দিচ্ছে। সাজ্জাদ রেগে ওয়াশরুমের দরজা খুললো। বের হয়ে আঁখির দিকে গরম চোখে তাকিয়ে রইলো। আঁখি এসবে পাত্তা না দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকতে নিলেই সাজ্জাদ দরজায় হাত দিয়ে আগলে ওকে আটকে দিলো। দাঁতে দাঁত চেপে রেগে আঁখির চোখের দিকে তাকিয়ে বললো।

“এভাবে পাগলের মতো দরজায় লাত্থি দিচ্ছিলে কেনো? কোনো কমনসেন্স নেই তোমার? মানুষে কি ভাবছে হুম?”

আঁখির মোটেও ঝগড়া করার ইচ্ছা নেই ওর কলেজে দেরি হয়ে যাবে। ও সাজ্জাদ কে সরিয়ে ভিতরে যেতে নিলে সাজ্জাদ আবারও দরজা আটকে দাড়ালো। আঁখি রেগে ওর দিকে তাকালো। ইচ্ছা করছে ঘুসি মেরে ওর নাক ফাটিয়ে দিতে। আপাদত ইচ্ছাটাকে দমিয়ে রাখলো। সাজ্জাদ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো।

“কি এমন হয়েছে যে এতক্ষন ডাকাতের মতো করলে?”

আঁখিকে ডাকাত বলায় ও ক্ষেপে গেলো। একটু আগে পাগল বলেছে তাতেও চুপ ছিলো। এবার আর চুপ থাকতে পারবে না। ওর মনে হচ্ছে ঘুষিটা মারাই উচিত ছিলো। তাহলে ওকে এখন এতকিছু কলতে পারতো না। আঁখি রেগে নাক ফুলিয়ে সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে বললো।

“এই যে মি. সাজগাজ! ঠিক করে কথা বলুন হু..? আপনার সাহস তো কম না, আমায় পাগল বলছেন তাতে কিছু বলিনি এখন আবার ডাকাত বলছেন কোন সাহসে?”

সাজ্জাদ স্টাইল মেরে নিজের ভেজা চুলগুলো হাত দিয়ে পিছনে ঠেলে দিলো। হালকা ঘুরে ঠোঁট বাকিয়ে ভাব নিয়ে বললো।

“আমার সাহসের ব্যপারে জিজ্ঞাসা করো না আমার সাহসটা বরাবরেই খুব বেশি তা এতদিনেও বুঝতে পারোনি? তোমার জন্য আফসোস! শোনো! আমি যা করার সামনা সামনি করি। তোমার মতো ঝগড়ায় না পেরে দরজার সাথে এমন করি না আমি বুঝলে মিসেস চক্ষু!”

আঁখি রেগে বোম হয়ে গেলো। মনে হচ্ছে এখনি ব্লাস্ট করবে। আঁখি ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে দাঁতে দাঁত চেপে বললো।

“আমি মোটেও আপনার সাথে না পেরে ওমন করছিলাম না। আপনি ভিতরে গিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন তাই জাগাচ্ছিলাম আমি।”

“ঘুমাচ্ছিলাম তাইনা? তোমার জ্বালায় ঠিকমতো গোসল করতে পারলে তো হলো। এই বাড়ির কোথাও শান্তিতে থাকার পজিশন নেই।”

আঁখি সাজ্জাদের কথা শুনে অবাক হয়ে বললো।

“এত সময় লাগে আপনার গোসল করতে? সাধে কি আমি আপনায় সাজগাজ বলি? আল্লাহ গো আল্লাহ! মেয়ে মানুষেরও এত সময় লাগে না যতটা আপনি ব্যয় করেছেন! শোনেন ফারদার আমায় আগে ঢুকতে দিবেন। আমি তাড়াতাড়ি গোসল করে বের হয়ে যাবো আপনি সারাদিন বসে বসে ওয়াশরুমে ঘুমাইয়েন টিক আছে? নাহয় এমনেই হবে বুঝেছেন?”

সাজ্জাদ পড়ছে মহা মুশকিলে। আঁখির ফাজলামি আর অত্যাচারে পাগল প্রায়। ওকে বলেও লাভ নেই। যেই লাউ সেই কদু! আবার ওর মুখ গোমড়াও ভালো লাগেনা। ওইদিন রাগারাগির পর আঁখি চুপ ছিলো তাতে সাজ্জাদের মোটেও ভালো লাগেনি। কি যে করবে ও নিজেও জানে না। সাজ্জাদ কপাল চাপরে সামনে আগাতে আগাতে বললো।

“মানুষ খাল কেটে কুমির আনে, আর আমি কোলে করে ঘরে কুমির আনছি। এবার জ্বালানি তো ভোগ করতেই হবে। কাপালে আর কি কি আছে কে জানে?”

আঁখি ওর কথা শুনে পিছন থেকে কপাল কুচকে বললো।

“What do you means?”

“I means you are a crocodile! Understand?”

দাঁতে দাঁত চেপে কথাটা বলে সাজ্জাদ বেলকনিতে চলে গেলো। আঁখি রেগে হা করে তাকিয়ে রইলো। ওকে ডাইরেক্টলি কুমির বলে গেলো? এত বড় অপমান? এর শোধ তো নিতেই হবে কিন্তু দেরি হয়ে যাচ্ছে। এখন ঝগড়া বাধানো যাবেনা। আঁখি ফোস ফোস করতে করতে তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। সাজ্জাদ কে ও পরে দেখে নিবে। সাজ্জাদ বেলকনিতে গিয়ে ঠোঁট চেঁপে হাসলো। আঁখি কে রাগাতে ওর খুব ভালোই লাগে। রাগলে ওকে খুবেই ভালো লাগে। আঁখির মুখটা এই মাত্র দেখার মতো ছিলো। সাজ্জাদ হালকা হাসতে হাসতে রেডি হতে চললো।

সাজ্জাদ হালকা খেয়ে তাড়াতাড়ি অফিসের উদ্দেশ্য বেড়িয়ে পড়লো। আঁখি তাড়াতাড়ি করে সাজ্জাদের পিছনে পিছনে বেড়িয়ে গেলো। সকালের নাস্তাটাও করলো না। টিকমতো সাজেও নি। শুধু চুলটা আচড়ে ওড়না মাথায় দিয়েই কলেজে যাচ্ছে। ওকে না খেয়ে যেতে দেখে পিছন থেকে মিসেস শাহনাজ ওকে বললেন।

“এই আঁখি! খেয়ে যাও! না খেয়ে কোথায় যাচ্ছো?”

“এসে খাবো!”

আঁখি পিছনে ফিরলো না দৌড়ে যেতে যেতে কথাটা বললো।
আঁখি তাড়াহুড়ো করে নামছে ওর ওড়না বারবার মাথা থেকে পিছলে পড়ে যাচ্ছে। একে তো সিল্কের ওড়না তার উপর ব্রুজ মারেনি তাই এই হাল। আজ হয়তো ওর হাতটা ক্লান্ত হয়ে যাবে। আঁখি কে বের হতে দেখে সাদিয়াও বের হলো। ও জানে নিরব আঁখি কে দেখার জন্য দাড়াবেই। ও প্রতিদিন দাড়ায়। সাদিয়া যতই নিরব আর আঁখি কে দূরে রাখতে চায় ততই কাছে চলে যায়। ও বুঝেনা নিরব ওকে রেখে আঁখির পিছনে পরে আছে কেনো? আখির চেয়ে ওর কি কম আছে? ওর মতো মেয়েকে রেখে কেনো আখির মতো বিবাহিত মেয়ের পিছনে পড়ে আছে? সাদিয়া সব সময় এসব ভাবে আর নিরবের পিছনে লেগে থাকে। ও যেখানে যায় সেখানেই সাদিয়া যায়। কিন্তু তবুও নিরবের মন পায় না। সাজ্জাদ নেমে গ্যারেজে চলে গেলো বাইক বের করতে। আঁখি তাড়াহুড়ো করে নামছে তাতে ওর ওড়না মাথা থেকে পড়ে গিয়েছে। আঁখিকে নামতে দেখে নিরব অবাক চোখে তাকালো। নিরব ওদের দরজার সামনেই দাড়ানো ছিলো। আঁখির সদ্য গোসল করা চেহারা খুবেই সুন্দর লাগছে ওর কাছে। আধভেজা চুল গুলোতে ওর সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। নিরব একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে। ও জানে আঁখি ওর না তবুও কেনো জানি ওকে দেখলে একটা শান্তি লাগে। কেনো যে ওর হলো না। ভাগ্য এত নিষ্ঠুর কেনো? নিরবের ভিতর হাহাকার করে উঠলো। আঁখি ওর সামনে দিয়ে যেতেই নিরব মলিন হাসলো। সাজ্জাদ চলে যাবে বিধায় আঁখি দাড়ালো না। নিরবের দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হাসে সামনে চললো। নিরব ওর দিকেই তাকিয়ে রইলো। আঁখি সাজ্জাদের বাইকে সামনে দাড়াবে তার আগেই সাজ্জাদ বাইক থামালো। আঁখি অবাক হয়ে তাকালো। কি ব্যাপার আজ বাইক থামালো কেনো? সাজ্জাদ ওর বিষয়টা বুঝতে পেরে বললো।

“জানি সামনে এসেই দাড়াবে তাই আগেই থামিয়ে দিলাম। এবার চুপচাপ উঠে বসো! বাদরের মতো লাফাবে না।”

আঁখি বাইকে উঠলো না। নিজের জায়গায় দাড়িয়ে গাল ফুলিয়ে বললো।

“আপনি আমায় সকালে অনেক ইনস্টল করেছেন। এখন আবার বাদর বলছেন। আমি যাবো না আপনার সাথে।”

সাজ্জাদের খুব হাসি পেলো ওর কথায়। ও জানে আঁখি ওর সাথেই যাবে। সাজ্জাদ নিজের হাসিকে দমিয়ে আঁখির দিকে তাকালো। দেখলো আঁখি কে আজ খুব সুন্দর লাগছে। সকালের রোদ ওর চেহারায় ঝলমল করছে। মানুষের আসল সৌন্দর্য যে তার গোসলের পরে প্রকাশ পায় তা সাজ্জাদ বুঝতে পারলো। সাজ্জাদের এভাবে তাকানোর কারন বুঝতে পারলো না আঁখি। ওকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আঁখি জোরপূর্বক হেসে এদিক ওদিক তাকালো। আঁখির মাথা থেকে ওড়না পরে যাওয়ায় ওর চুলগুলো মুখের সামনে এসে পড়ছে। এতে ওকে আরও সুন্দর লাগছে। সাজ্জাদের ইচ্ছে হলো আঁখির চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে দিতে। কিন্তু আপাতত তা করলো না অনেকেই দেখে খারাপ ভাববে। সাজ্জাদ আস্তে করে আঁখির মাথার ওড়নাটা তুলে দিলো। যাতে এই সৌন্দর্য কেউ না দেখে। আঁখি অবাক হয়ে সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে আছে। এটা কি হলো? ওর ধারনার বাইরে এসব কি হচ্ছে? মি. সাজগাজের আজ কি হলো? সাজ্জাদ আঁখির ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হালকা কেশে সামনে তাকিয়ে বললো।

“কেউ আমার সাথে যেতে চাইলে বাইকে উঠতে পারে, না হলে আমি গেলাম!”

সাজ্জাদের কথায় আঁখির ধ্যান ভাঙলো। ও তাড়াতাড়ি করে বাইকে ওঠে সাজ্জাদের কাঁধে হাত রেখে বসলো। সাজ্জাদ মুচকি হেসে বাইক স্টার্ট করলো। আসলেই মেয়েটা পাগল এই রাগ তো এই চুপ। নিরব এতক্ষণ চুপচাপ ওদের কাহিনী দেখছিলো। ওদের দেখে নিরবের হৃদয় টা পুড়ে যাচ্ছিলো। মনে চাইছিলো নিরবকে খু/ন করে ফেলতে৷ কিন্তু কি করে?ও আর সহ্য করতে না পেরে ভিতরে চলে গেলো। সাদিয়া এতক্ষণ সিড়িতেই দাড়ানো ছিলো। নিরবকে ভিতরে যেতে দেখে ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো। নিচে নামতে নামতে মনে মনে বললো। “এবার বুঝো কেমন লাগে! তোমার আঁখি তো অন্য কারো সাথে আছে তুমি তার জন্য এখনও বসে থাকবে? একদিন না একদিন তো আমার হবেই।”

ইনশাআল্লাহ চলবে….…

এডিট ছাড়া পর্ব…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here