#শরতের_বৃষ্টি
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–৪০
আনিকা একা একা হেটে কলেজে যাচ্ছে। আঁখি এখন বেশিরভাগ দিনেই সাজ্জাদের সাথে কলেজে যায় তাই ওকে একাই যেতে হয়। সাদিয়াও কেমন জানি হয়ে গেছে ওকে রেখে একা একাই চলে। সাদিয়ার মতিগতি ঠিক বুঝে না আনিকা। তবে ওর মনে হয় সাদিয়ার মাঝে কোনো গন্ডগোল আছে। সবাই কেমন জানি বদলে গেছে। আঁখিও বিয়ের একটু পাল্টে গেছে। আনিকার নিজেরও অনেকটা বদলে গেছে। এখন বেশিরভাগ সময় ওর শুধু অর্নবের কথা মনে পড়ে। ওকে নিয়ে ভাবতে ওর ভালোলাগে। অনেকদিন হয়েছে অর্নবকে দেখে না। প্রতিদিনেই খুব দেখতে ইচ্ছা করছে ওকে। হঠাৎ করেই ওর অদ্ভুত ইচ্ছা করায় আনিকা অবাক হলো না। আগের মতো ও আর নাই সেটা আনিকা আগেই বুঝতে পারছে। অর্নবের প্রতি ও এখন অনেকটাই দূর্বল সেটা বুঝতে পারছে। এতটাই দূর্বল হয়ে গিয়েছে যে, অর্নবের মেসেজ না পেয়ে ওইদিন ও নিজে থেকে ওকে মেসেজ করেছিলো কিন্তু কোনো রিপ্লাই পায়নি। আনিকা সেজন্য অনেক রেগে আছে। ও জানে অর্নব ওর মেসেজে খুশি হয়েছে কিন্তু ওকে কষ্ট দেওয়ার জন্য রিপ্লাই করছেনা ওর সামনে আসছে না। আগে যেমন ও অর্নবকে কষ্ট দিয়েছে এখন হয়তো তা অর্নব ওকে বোঝাচ্ছে।
আনিকা মন খারাপ করে কলেজের সামনে যাচ্ছে। সত্যি বলতে প্রিয় মানুষকে না দেখার কষ্ট খুব বেশি। তার অবহেলা তো আরও কষ্ট দেয়। আনিকা কলেজের গেইট দিয়ে ভিতরে ঢুকতে যাবে তার আগেই একটি পরিচিত মুখ দেখে থমকে গেলো। ওর পা আর সামনে আগালো না। অনেক দিন পর দেখলো এই মুখটি। এতদিন মনে মনে ভেবেছিলো এই মানুষটাকে দেখলে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিবে কিন্তু এখন সে ইচ্ছা করছে না। আনিকা আবেগে কেঁদেই দিয়েছে। চোখে পানি টলমল করছে। একটু হলেই গড়িয়ে পড়বে। টলমলে চোখে আনিকা ধীর পায়ে সামনে আগাতে লাগলো। অর্নব ওখানে দাড়িয়ে ঠোঁট বাকিয়ে হাসছে। ওর মনের আশাটা এবার পুরন হয়েছে। আনিকাকে এতকাল ও দেখার জন্য ছটফট করতো এখন আনিকাও ওকে দেখার জন্য পাগল হয়ে থাকে। এটাই তো চেয়েছিলো ও। অর্নব মুচকি হেসে আনিকার কাছে এসে বললো।
“কেমন আছো?”
অর্নবের কথা আনিকার কর্নপাত হলো না। ও শুধু অর্নবের হাস্যোজ্জ্বল মুখটাই দেখতে পেলো। ওকে হাসতে দেখে আনিকার খুব রাগ হলো। ও কষ্টে মরে যাচ্ছে আর এই লোকটা হাসছে? হেসে গুষ্ঠি উদ্ধার করে দিচ্ছে। “দাড়া হাসাচ্ছি তোকে!” মনে মনে কথাটা বলেই আনিকা রেগে চোখের জলটা মুছে ফেললো। অর্নবকে পাত্তা না দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে লাগলো। অর্নব এবার বুঝে গেছে আনিকা খুব রাগ করেছে। ও দৌড়ে আনিকার সামনে গিয়ে পথ আগলে দাড়িয়ে বললো।
“আরে কোথায় যাচ্ছো? তোমার জন্য অফিস বন্ধ দিয়ে আসলাম আর তুমি চলে যাচ্ছো? জানো অফিসে আমার কত গুরুত্বপূর্ন কাজ আছে?”
আনিকা অন্য দিকে তাকিয়ে রেগে রাগ ফুলিয়ে বললো।
“আপনাকে কে আসতে বলেছে শুনি? আমি আসতে বলেছি আপনাকে? আসছেন কেন? যান চলে যান!”
“জান…”
আনিকা রেগে চোখ গরম করে তাকাতেই অর্নব চুপ হয়ে গেলো। মাথা চুলকে হালকা কেশে বললো।
“কেউ একজন দেখার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছিল। তাকে যেনো পাবনা যেতে না হয় তাই এসেছি। এসে দেখি সে গাল ফুলিয়ে আছে। যদিও গাল ফুলালে তাকে খুবেই সুন্দর লাগে তবে আমি তার হাসি দেখতে এসেছিলাম। ভাগ্য খারাপ দেখতে পারিনি তাই চলে যাচ্ছি। ভালো থেকো!”
অর্নবকে যেতে দেখে আনিকার একটুও ভালো লাগছে না। ও চেয়েছিলো অর্নবের সাথে একটু গল্প করবে কিন্তু ও তো চলে যাচ্ছে। একবারও ওকে সরি বললো না। কি আর করার আনিকার রাগ হলেও রাগ করতে পারলো না তাতে ওরেই লস। ও তাড়াতাড়ি করে পিছন থেকে বললো।
“এতদিন কি সত্যি অফিসে গিয়েছিলেন?”
কথাটা শুনে অর্নব ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো। ও জানে আনিকা ডাক দিবে। অর্নব সামনে ঘুরে মুচকি হেসে বললো।
“সন্দেহ আছে? তাহলে চলো আমাদের অফিসে!”
“নাহ যাবো না। এতদিন আসলেন না কেনো?”
“কথায় আছে অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয়। এতদিন আসলে তো আজ তোমার চোখে আমার জন্য ভালোবাসা দেখতাম না।”
মুচকি হেসে কথাটা বললো অর্নব। এভাবে সরাসরি বলায় আনিকা একটু লজ্জা পেলো। হালকা কেশে ধরা খাওয়া চোরের মতো করতে লাগলো। পরক্ষনেই আমতা আমতা করে বললো।
“কে বলছে আমি আপনাকে ভালোবাসি? মোটেও না। আমি আপনাকে একটুও ভালোবাসি না।”
“চোখ যে মনের কথা বলে!”
চোখে মুখে দুষ্ট হাসি ঝুলিয়ে কথাটা বললো অর্নব। আনিকা এবার বেশ লজ্জা পেলো। মাথা নিচু করে চুপ করে রইলো। অর্নব ঠোঁটে হাসি নিয়ে আনিকার লজ্জা রাঙা মুখটা দেখছে। আনিকার হাসিমাখা মু্খের চেয়ে লজ্জা রাঙা মুখটা বেশি সুন্দর লাগে। অর্নব ওকে আরও লজ্জা দিতে বললো।
“বাবা কি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবে?”
আনিকা মাথা নিচু করে চুপ করে রইলো। অর্নব ঠোঁট বাকিয়ে হেসে বললো।
“চুপ থাকা সম্মতির লক্ষণ। তোমার বাবা তোমাকে বিয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলেও এভাবে চুপ থাকবে বুঝেছো? তাহলেই বিয়েটা হয়ে যাবে। আগেরবার তোমার না না করার জন্য হয়নি। তুমি রাজি হলে অবশ্যই এতদিনে দু বাচ্চার বাবা হয়ে যেতাম। আহ কি দুঃখ! ”
অর্নব দুঃখী দুঃখী ভাব করছে আর এদিকে আনিকা লজ্জায় মরে যাচ্ছে। ভেবেছিলো কতকথা বলবে কিন্তু অর্নবের সামনে এসে কিছুই বলতে পারছে না। আনিকা লজ্জা পেয়ে দৌঁড়ে কলেজের ভিতরে চলে গেলো। অর্নব হালকা হেসে পিছন থেকে বললো।
“সম্মতি যখন পেয়েছি তখন আজেই প্রস্তাব পাঠাবো। বিয়ের জন্য তৈরি থেকো।”
কথাটা শুনে আনিকা হালকা হেসে থেমে গেলো। একটু পিছনে তাকিয়ে আবার সামনে চললো। অর্নব হাসতে হাসতে ওর গন্তব্যে চলে গেলো।
—————————–
বিকাল বেলা। নিরব ছাঁদে বসে হুমায়ূন আহমেদের ‘অপেক্ষা’ বইটি পড়ছে। সত্যি অপেক্ষা করাটা খুবেই কঠিন। অপেক্ষার প্রতিটি প্রহরে থাকে গভীর শ্বাস আর উদাসীনতা। নিরব খুব মন দিয়েই বইটি পড়ছে হঠাৎ একটি ছায়া বইয়ের উপরে পড়লো। নিরব ছায়া দেখেই বুঝেছে এটি মানুষের ছায়া। উপরে তাকাতেই চমকে পিছিয়ে গেলো। সাদিয়া হালকা শব্দ করে হেসে বললো।
“কি হলো? এভাবে ভুত দেখার মতো চমকে দূরে সরে গেলেন যে? দেখেন তো আমাকে কি ভুতের মতো দেখাচ্ছে?”
সাদিয়া হালকা মেরুন রংয়ের একটি শাড়ি পরেছে। মুখে অনেক বেশি না হলেও মোটামুটি মেকআপ করেছে। কালো চুলগুলো খোপা করে তাতে গাজরা গুঁজেছে। হাতে কতগুলো ম্যাচিং কাচের চুড়ি পড়েছে। সাদিয়াকে একদম বড় বড় লাগছে আজ। নিরব পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বললো।
“নাহ ভুতের মতো লাগছে না। হঠাৎ শাড়ি পড়া দেখে চমকে গিয়েছিলাম। আগে কখনও তো দেখিনি। এই বিকালে ছাদে কি করো? পড়তে বসতে পারো না? তোমার না এপ্রিলে পরীক্ষা? ঢং ছেড়ে যাও গিয়ে পড়তে বসো!”
নিরবের ধমকে সাদিয়া মন খারাপ করলো। এত করে সাজলো তবুও কিছুই বললো না। একটু সুন্দর ও বললো না? আজ আঁখি হলে তো ঠিকই প্রশংসায় ভাসিয়ে দিতো। ওর সব কিছু জোর করেই পেতে হবে, প্রশংসাটাও। সাদিয়া নিরবের দিকে দু’পা এগিয়ে এসে বললো।
“বলুন আমাকে কেমন লাগছে? সুন্দর না?”
কথাটা বলে সাদিয়া মুচকি হেসে মডেলদের মতো করে দাড়ালো। নিরব মাঝে মাঝে ওর কাজে খুবেই বিরক্ত হয়। ভালো লাগলে এমনিতেই লাগবে এভাবে বাঁকিয়ে দাড়ানোর কি আছে? ও জানে সাদিয়া এটা মজা করছে। সাদিয়া ছোট বুঝে না কোনটা করলে কে খুশি হবে। এখনও ম্যাচিউর হতে পারেনি তাইতো ওকে এত জ্বালাচ্ছে। লজ্জা না পেয়ে ওর পিছনে পরে আছে। অন্য ম্যাচিউর মেয়ে হলে এটা করতো না। নিরব জানে এখানে থাকলে ওকে আরও জ্বালাবে সাদিয়া। তাই ছাঁদ থেকে যেতে যেতে বললো।
“ভালোই লাগছে। তবে পরেরবার মেকআপ কম করো!”
নিরব কথাটা বলতে বলতে ছাদ থেকে চলে গেলো। সাদিয়া ওর পিছনে যেতে যেতে বললো।
“আরে আরে কই যাচ্ছেন? আমার কয়টা পিকচার চুলে দিয়ে যান! যাহ চলেই গেলো?”
সাদিয়া কথাগুলো বলার আগেই নিরব হাওয়া। ও মন খারাপ করে ছাদে বসে রইলো। নিরব ওর সাথেই এমন করে। কেনো ওকে বুঝে না? আজ আঁখি হলে এখানে বসে সারা বিকাল গল্প করতো আর ওর বেলাতেই পালিয়ে যায়।
————————–
আমিনুর রহমান সোফায় বসে টিভি দেখছিলেন। মিসেস রোকেয়া রহমান তার পাশে বসতে বসতে বললেন।
“এভাবে আর কতদিন রাগ করে থাকবে বলো? ও না হয় একটা ভুল করে ফেলেছে তাই বলে এভাবে রাগ করে থাকবে?”
আমিনুর রহমান রেগে নিজের স্ত্রীর দিকে তাকালেন। তিনি জানেন রোকেয়া রহমান লুকিয়ে আঁখির সাথে কথা বলে। তার জন্য এমনিতেই রেগে আছেন। এখন আবার এসব শুনে প্রচন্ড রেগে বললেন।
“রোকেয়া! কোনটাকে তুমি ভুল বলছো? এটা ভুল! ও অবুঝ বুঝেনা কোনটা ভুল আর কোনটা অপরাধ? ছোট থেকে ওর ভুলগুলো ক্ষমা করে এসেছি সেজন্য ও অন্যায় আর ভুলের মাঝে পার্থক্য করতে পারেনি। ছোট থেকে এত আদর ছাড় দেওয়ার মূল্য এই দিলো? আমার মানসম্মান কিছুই রাখলো না ও। লোকজনের কথা শুনতে শুনতে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। মেয়েরা দুদিনের ভালোবাসার জন্য পালিয়ে যায়, বাবা মায়ের এতকাল ভালোবাসার কথা ভাবেনা। তাদের মানসম্মানের কথা ভাবে না। ওকে ছোট থেকে ক্ষমা করেছি বলে ও ভেবেছে ওর অন্যায়টাও ক্ষমা করে দিবো? কখনও না। অন্যায় সবসময় অন্যায়। এর শাস্তি পেতেই হবে। যার জন্য গিয়েছে তাদের বাড়িতেই থাক! আমার বাড়িতে ভুলেও যেনো পা না রাখে। যে এসব করার আগে একটা বার আমার কথা ভাবেনি আমি তার কথা ভাবতেও চাইনা। আর কখনও ওর কথা যেনো এই বাড়িতে না উঠে।”
কথাটা বলেই আমিনুর রহমান রেগে রুমে চলে গেলেন। রোকেয়া রহমান হতাশ নিশ্বাস ফেলে কপালে হাত দিয়ে বসে রইলেন। কে জানে কবে তার অভিমান ভাঙবে?
ইনশাআল্লাহ চলবে…..