শরতের বৃষ্টি পর্ব-৫৩

0
2101

#শরতের_বৃষ্টি
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–৫৩

সাজ্জাদ হা করে তাকিয়ে আছে। ওর একেবারেই ধারনা ছিল না আঁখি এসব বলতে পারে। সাদিয়া ভিডিওটা সম্পূর্ণ সাজ্জাদ কে দেখায় নি। ও শুধু “হ্যাঁ আমি বুঝি… আমার সব কিছুতেই সাজ্জাদের বসবাস!” এটুকেই দেখাইছে। মিসেস শাহনাজ আর আশরাফ খান কিছুই বুঝতে পারছেন না। তা করে তাকিয়ে আছে। মিসেস শাহনাজ অবাক হয়ে সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।

“কি হয়েছে রে? কিছুই তো বুঝতে পারছি না!”

সাজ্জাদ এখনও হ্যাং হয়ে আছে। মিসেস শাহনাজের কথা কিছুই ওর কানে ঢুকছে না। আঁখির কথাগুলোই বারবার ওর কানে বাজছে। এখন ওর খুব আফসোস হচ্ছে আঁখি কে ভুল বোঝার জন্য। শুধু শুধু বিনা দোষে মেয়েটাকে কত কথা শোনালো। মিসেস শাহনাজ আর আশরাফ খান উত্তরের আশায় সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে চুপ থাকতে দেখে সাদিয়া বলে উঠলো।

“তোমার ছেলে ভাবিকে ভুল বুঝে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। ”

মিসেস শাহনাজ আর আশরাফ খান চমকে উঠলেন। কি বলছে এসব? সামান্য ভুল বোঝেবোঝির জন্য বাসা থেকে বের করে দিয়েছে? মিসেস শাহনাজ অবাক হয়ে বললেন।

“ঠিক করে বলতো কি হয়েছে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। কি এমন হয়েছে যে বের করে দিতে হয়েছে?”

“বেশি কিছু না আম্মু! ভাবি শুধু নিরব ভাইয়ার থেকে একটা গিফট নিয়েছে তাই ভাইয়া রেগে গেছে। ভাবি সারারাত ছাদে ছিলো।”

সাদিয়ার কথা শুনে আশরাফ খান অনেক রেগে গেলেন। বাড়ির বৌ রাতে বাহিরে ছিলো? তাও একা একা? এটা কি ধরনের ব্যবহার? নিজের ছেলেকে এই শিক্ষা দিয়েছেন? সামান্য করনে বৌয়ের সাথে দূরব্যবহার তিনি মেনে নিতে পারলেন না। প্রচন্ড রেগে ধমক দিয়ে সাজ্জাদকে বলে উঠলেন৷

“তোমাকে এত পড়ালেখা করিয়ে এই শিক্ষা দিয়েছি? একজন নারীর সাথে কিরকম ব্যবহার করতে হয় তাও যানো না? দু’জন মানুষ একসঙ্গে থাকার ফলে মতের অমিল হতেই পারে। নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝিও হবে। সৃষ্টির শুরু থেকে মানুষের স্বভাবই এমন। প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে ঝগড়া হওয়া আজকাল স্বাভাবিক বিষয়ে দাঁড়িয়েছে। ছোট্ট কোনও ভুল বোঝাবুঝি থেকে সম্পর্কে ফাটলও ধরে। দীর্ঘ দিনের একটা সম্পর্ক বা গভীর একটা সম্পর্ক এভাবে সামান্য কারণে ভেঙে যাওয়া কখনোই ভালো দিক হতে পারে না। সম্পর্কে ঝামেলা বা সমস্যা হলে এর সমাধানও আছে। এজন্য দু’জনকেই ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। দু’জনের মধ্যেই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার ইচ্ছা থাকতে হবে। তবেই টিকে থাকবে সম্পর্ক, যা হবে আরও মধুর। তুমি কি না বের করেই দিয়েছো?”

আশরাফ খানের ধমকে সাজ্জাদ চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।সাজ্জাদের খুব খারাপ লাগলো। ও নিজের ভুলট বুঝতে পারলো। আঁখির সাথে করা ব্যবহারের জন্য অনুশোচনা করতে লাগলো। আশরাফ খান সাজ্জাদের বিষয়টা বুঝতে পারলেন। তিনি শান্ত হয়ে ওর কাঁধে হাত রেখে বললেন।

“যা ঘটে গেছে তা ঘটে গেছে। যে সময় অতীত হয়েছে সেটা নিয়ে ভেবে অনুশোচনা করে সময় নষ্ট করা অর্থহীন। যদি তোমার দ্বারা কোনো ত্রুটি হয়ে থাকে, তবে তা থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমানকে শ্রেষ্ঠ করার চেষ্টা করা উচিৎ। যাতে ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত রাখা যায়। শোনো বাবা! আমরা রাগারাগি তোমাদের ভালোর জন্য করি। এই মানে এই না সবসময় বেশি রাগতে হবে। মনে রাখবে! রশি বেশি শক্ত করে বাধতে গেলে তা ছেড়ার সম্ভাবনাও বেশি। কোনো কিছু অগ্রিম ভাবলে সমস্যার সম্ভাবনা আরও বেশি থাকে। ধরে নিলেন সে অন্য কোনও ছেলের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করছে। অথচ বাস্তবে সে এমনটা করছেই না। তাই এ স্বভাব পরিবর্তনের চেষ্টা করো। প্রয়োজনে সরাসরি প্রশ্ন করো ওকে। উত্তর পেয়ে যাবে এবং সমস্যার সমাধানও হবে।”

এটুকু বলে আশরাফ খান থামলেন। সাজ্জাদ আহত চোখে ওর বাবার দিকে তাকালো। আশরাফ খান মুচকি হেসে বললেন।

“আমি আর তোমার মা কত বছর ধরে একসাথে আছি। আমরা কি ঝগড়া করিনি? করেছি, আবার মিলেও গিয়েছি। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে এবং মজবুত করতে দু’জনেরেই দায়িত্ব রয়েছে। প্রয়োজনে নিজেই বরফ হয়ে এগিয়ে যাবে। দেখবে সব ঝামেলা শেষ হয়েছে। পারস্পরিক দোষারোপ না করে মন খুলে কথা বলবে। এ অভ্যাস ধরে রাখতে পারলে দেখবে সম্পর্ক কত মধুর হয়। আর শোনো! দু’জন মানুষের সম্পর্কের মধ্যে কখনোই তৃতীয় কোনও ব্যক্তিকে টানবে না। এতে করে সম্পর্ক হয় ভাঙবে, না হয় তৃতীয় মানুষ তোমার সঙ্গীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানোর চেষ্টা করবে। এছাড়াও ব্যক্তিগত বিষয়ে জানতে পারলে নিজেদের দুর্বলতার সুযোগে সদ্ব্যবহার করতে পারে। তাই তৃতীয় মানুষ থেকে সাবধান। কি বলছি বুঝেছো?”

সাজ্জাদ ছলছল চোখে ওর বাবার দিকে তাকালো। ওর বাবা কত মহৎ তা নিমিষেই প্রকাশ করে দিলো। অল্প সময়ে ওকে কত কিছু শিখিয়ে দিলো। আগে রাগারাগি করতো বলে কত রাগ হতো কিন্তু আজ বুঝতে পেরেছে যা করেছে সব ওর ভালোর জন্যই করেছে। মানুষের যত বয়স বাড়বে, তাদের মা বাবা কতটা সঠিক ছিলো তা তারা ততই উপলব্ধি করতে পারবে। বাবা মানেই তো জ্ঞানের ভান্ডার। বাবা মানে আমাদের প্রথম পথ চলা। বাবা মানে অন্ধকারে আলোর আশা। বাবা মানে বিপদে আশ্রয় স্থল! সাজ্জাদ হুট করেই ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। আশরাফ খান ওর পিঠে হাত হাসতে হাসতে বললো।

“আরে কি হয়েছে? সময় নষ্ট না করে আঁখি কে নিয়ে আয়। একসাথে বসে খাই। আমাদের কত হ্যাপি ফ্যামিলি তা দেখতে হবে না?”

মিসেস শাহনাজ শাড়ির আঁচলে চোখটা মুছলেন। কতদিন বাবা ছেলের এমন ভালোবাসা দেখেন নি। শুধুই মান অভিমানে ভরপুর ছিলো। আজ তা শেষ হলো। সাজ্জাদ ওর বাকে ছেড়ে চোখটা মুছে মুচকি হেসে তাড়াতাড়ি বের হলো। সাদিয়া চুপচাপ গালে হাত দিয়ে চেয়ারে বসলো। ও সবার চোখের পানি দেখে ইমোশনাল হয়ে গেছে। পরিবারের খুশি দেখে কিছু সময়ের জন্য নিজের কষ্টের কথা ভুলেই গেলো। ওর বুকেও যে আগুন জ্বলছে তা এখন পিটপিট করছে। ওর জন্যই এসব হয়েছিলো যদি মিলিয়ে দিতে পারে তো পাপটা কিছু হলেও কমবে। ওর জীবনে হয়তো হৃদয় ভাঙার কথাই লেখা আছে নাহলে এমন হবে কেনো? সাদিয়ার চোখে পানি চলে আসলো। তা ও সবার আড়ালেই মুছে নিলো। সবাই ভালো থাকলে ও নিজেও ভালো থাকবে। যা পাবার নয় তা নিয়ে সবার মাঝে বাড়াবাড়ি করাও ঠিক না। ও একাই জানুক! ও একাই পুড়ুক! একতরফা ভালোবাসার আগুনে!

——————————

আঁখি উদাসীন হয়ে ছাদের কর্নারে বসে আছে৷ মন যেনো বারবার রাতের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। রাতের অপমানের কথা বারবার মনে করাচ্ছে। ওকে যাই বলুক না কেনো ও রাগ করতো না কিন্তু ওর নিস্পাপ চরিত্রকে কেনো দোষারোপ করলো এটাই ওর বড় ক্ষোভ! ও জানে না ওর মনে কি রাগ জমেছে নাকি অভিমানের পাহাড় গড়েছে! আঁখি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকালো। বিশাল এই আকাশের নিচে ও যেনো তুচ্ছ মানব। পৃথিবী এত বিশাল হওয়া সত্ত্বেও ওর কাছে সংকীর্ন মনে হচ্ছে। চারপাশে এত মানুষ হওয়া সত্ত্বেও ওর কেনো যেনো একলা লাগছে। একাকীত্ব যেনো বড়ই বেদনাদায়ক! এর ভার সহ্য করাও বিশাল কষ্টের। আঁখির চোখ থেকে আপনা আপনি জল গড়িয়ে পড়লো।

সাজ্জাদ ছাঁদে পা রাখতেই থমকে গেলো। আঁখিকে উদাসীন ভাবে বসে থাকতে দেখে ওর মনের মধ্যে হাহাকার করে উঠলো। আঁখিকেদেখেই ওর নিজেকে বড় অপরাধী মনে হচ্ছে। সাজ্জাদের হাটার গতি একেবারে কমে এলো। ওর পা যেনো চলছেই না, ও ধীর পায়ে আঁখির দিকে চললো। একটুখানি পথ কিন্তু এই পথ যেনো শেষেই হচ্ছে না। সাজ্জাদ মলিন স্বরে আলতো করে ডাকলো।

“আঁখি!”

আঁখি চমকে পিছনে তাকালো। সাজ্জাদ কে দেখে একটু অবাক হলো। চেহারায় কেমন যেনো একটা ক্লান্তির ভাব! উদাসীন আর মলিন মাখা চেহারা। চোখ দুটোতে কেমন অসহায় ভরে আছে। আঁখির রাতের কথা মনে হতেই আর ও দিকে তাকালো না। চোখ ফিরিয়ে আবার সামনে চুপ করে তাকিয়ে রইলো। ওর মনে আবারও রাগ দেখা দিলো। সাজ্জাদ আঁখির চোখে জল দেখে আরও থমকে গেলো। কেমন ফোলা ফোলা চোখ! মেয়েটা হয়তো অনেক কেঁদেছে। সাজ্জাদের নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। সাজ্জাদ আস্তে করে আঁখির পিছনে দাঁড়িয়ে ওর কাঁধে হাত রাখলো। সাজ্জাদের স্পর্শ পেয়ে আঁখির ভিতরে কেমন জানি করে উঠলো। আঁখি রেগে সাজ্জাদের হাতটা ঝাড়া মেরে সরিয়ে দিলো। সাজ্জাদ খুব আঘাত পেলো। ও বুঝতে পেরেছে আঁখি খুব অভিমান করেছে। সাজ্জাদ আবারও হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে রাখলো। আঁখি রেগে হাত সরাতে চাইলো কিন্তু পারলো না। সাজ্জাদ ওর গা ঘেঁসে বসে পড়লো। আঁখি একটু সরে গেলো। সাজ্জাদ আবারও ওর দিকে এগিয়ে বসলো। আঁখির খুব রাগ হলো। দাঁতে দাঁত চেপে অন্য দিকে ঘুরে থাকলো। রাগে ওর শরীর জ্বলে যাচ্ছে, কাল এত কিছু বলে আজ দরদ দেখাতে আসছে। আঁখি দাঁতে দাঁত চেঁপে বললো।

“চরিত্রহীন মেয়ের গা ঘেঁষে বসতে লজ্জা করে না?”

সাজ্জাদ বুঝেছে আঁখি ভিষণ অভিমান করেছে। যেহেতু ওর জন্য অভিমান করেছে তো যেভাবেই হোক ওকেই অভিমান ভাঙতেই হবে। ও আঁখির দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে বললো।

“আমার বৌ কে আমি চরিত্রহীন বলবো আবার গা ঘেঁষে বসবো। আবার ইচ্ছা হলে আদরও করবো। তাতে তোমার এত মাথা ব্যাথা কেনো?”

আঁখির খুব রাগ হলো। কাল কতকিছু বলেছে আজ আসছে গা ঘেঁসতে। ও মুখ বাঁকিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো। সাজ্জাদ হঠাৎ করে আঁখিকে বললো।

“বাসায় চলো! ছাঁদে আর কত থাকবে?”

আঁখি চুপ করে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো। ও কিচুতেই যাবে না এই লোকটার সাথে। কাল ওকে অনেক অপমান করেছে। ওগিলো ভুললে চলবে না। কিছুতেই না। সাজ্জাদ আবারও বললো। কিন্তু আঁখির কোনো হেলদোল হলোনা। সাজ্জাদ জোরে শ্বাস ছেড়ে আঁখিকে কোলে নিয়ে হাটা ধরলো। আঁখি যেনো একেবারেই অবাক হয়ে গেলো। ও নিজেকে ছাড়াতে ছোটাছুটি করতে লাগলো। সাজ্জাদ ঠোঁট বাকিয়ে হেসে বললো।

“কোলেই তো উঠতে চেয়েছিলো তাইতো এতক্ষন যেতে চাওনি। এখন এত লাফালাফি করছো কেনো? পরে গিয়ে কোমড় ভাঙলে কিন্তু আমার দোষ নাই।”

পড়ার কথা শুনে আঁখি চুপ হয়ে গেলো। রেগে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো৷ সাজ্জাদ দাঁত কেলিয়ে হেসে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলো। যে করেই হোক আঁখির রাগ কমিয়েই ছাড়বে ও।

ইনশাআল্লাহ চলবে….

এডিট ছাড়া পর্ব….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here