#শরতের_বৃষ্টি
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–৫৬
নিরব বাড়িতে আসেনা তিন বছর। সেই যে গেছে আর ফিরে আসেনি। ওর মা বাবা খুবেই রিকোয়েস্ট করে কিন্তু ও আর আসেনি। এখানে আসলেই অতীত ওকে কুড়ে কুড়ে খাবে সেই ভয়ে। ওর মনের মাঝে কোনো কোনায় এখনও আখির বসবাস। ওকে দেখলেই হয়তো আবেগী হয়ে পরবে। বুকের কোথাও শূন্যতা অনুভব হবে। কথায় আছে জীবনের প্রথম প্রেম কখনও ভোলা যায় না। প্রেম সবার জীবনেই আসে। শুধু বয়সের একটা ব্যবধান থেকে যায়। সবার জীবনে নির্দিষ্ট এক সময়ে প্রেম আসে না। তবে যাই হোক, প্রেম তো আসে। প্রথম প্রেম বা ভালোবাসা প্রতিটি মানুষের কাছেই একটু বেশিই স্পেশাল। ‘চাইলেই কি প্রথম প্রেম ভুলা যায়?’ এ প্রশ্নের উত্তর হবে কখনোই সম্ভব নয়। জীবনের একটি নতুন অধ্যায়ের কথা কেউ কোনো দিন চাইলেও ভুলতে পারে না। যে কারণে জীবনে হাজারবার প্রেম আসলেও প্রথম প্রেমের জায়গা কেউ দখল করে নিতে পারে না। প্রথম প্রেমের স্মৃতি দীর্ঘদিন দাগ কেটে যায় হৃদয়ে। মধুময় কিছু যন্ত্রণা, কিছু পাওয়া না পাওয়ার অনুভূতি আচ্ছন্ন করে রাখে মনকে। হৃদয়ে এতোটাই জায়গা করে নেয় যে কারণে কয়েক যুগ পরও মানুষের স্মৃতি আবেগী হয়ে উঠে সেই প্রথম প্রেমের কথা মনে পড়ায়।
নিরবের মাঝে মাঝে সাদিয়ার কথা খুব মনে পরে। ওর দুষ্টামি গুলো খুব মিস করে কিন্তু ওটা কি ঠিক ভালোবাসা না? হয়তো মেয়েটার প্রতি সহানুভূতি। নিরব খুব চেষ্টা করছে সব পিছনে ফেলে সাদিয়াকে মেনে নিতে কিন্তু আঁখি কে কিছুতেই ভুলতে পারছে না। তিন বছর সময় নিলো তবুও পারছে না। এই তিন বছরে সাদিয়াকে অনেক মেসেজ করেছে ও। সরিও বলেছে বারবার কিন্তু সাদিয়া কোনো রিপ্লাই দেয়নি। নিরব বুঝতে পেরেছে মেয়েটা খুব কষ্ট পেয়েছে। ভালোবাসার কষ্ট ও নিজেও বুঝে। হয় তো সাদিয়া এখনও ওর অপেক্ষায় আছে? নিজেই একা একা নিরবে চোখের জল ফেলছে। নিরব এবার ঠিক করে নিয়েছে বাড়িতে ফিরবে। অনেক তো হলো? আর কত চলবে এভাবে জীবন? আঁখি পরে থাক মনের কোনো কোণে, সাদিয়ার জন্যও তো ওর মনে জায়গা আছে। তো কেনো ওকে মানতে পারবে না? অবশ্যই পারবে। এসব ভেবেই নিবর মুচকি হেসে সাদিয়াকে মেসেজ করলো।
সাদিয়া এবার অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। সবার মাঝে বেশ হাসি খুশি দিন কাটে ওর। কিন্তু গভীর রাতে ওর বালিশ ভিজানোর কথা আজও সবার অজানা। সাদিয়া টেবিলে পড়তে বসেছে৷ পড়তে বসলেও মনটা বেখেয়ালি হয়ে এটা ওটা ভাবছে। হঠাৎ মেসেজের টুংটাং শব্দে ওর ধ্যান ফিরলো। টেবিলে সাইড থেকে ফোনটা হাতে নিতেই দেখলো নিরবের মেসেজ। ও মেসেজটা আর পড়লো না। জোরে শ্বাস ছেড়ে ফোনটা রেখে দিলো। ও জানে হয়তো সরি বলা কোনো মেসেজ। বছরে দু একবার করে। এসব না করে একবার কি ভালোবাসি বলে মেসেজ করতে পারে না? বলতে পারে না আমি ফিরে আসবো? এবকার ফিরে এসে ওর সামনে দাঁড়ালে ও সব কষ্ট ভুলে যেতো। সাদিয়ার মনে কষ্ট গুলো জীবিত হয়ে উঠলো। ওর মন আর পড়তে দিবে না ওকে। সাদিয়া ভেজা চোখে খাটে গিয়ে বালিশে শুয়ে পড়লো। ওর চোখের কর্নিশ গড়িয়ে জল পড়ছে। ওর জীবনটা কি অন্যরকম হতে পারতো না? নিরব কি ফিরে আসতে পারতো না? এভাবে কেটেছে অনেকটা সময়। সাদিয়ার মনে বারবার আনচান করছে নিরবের মেসেজটা দেখার জন্য। প্রতিবার বলে দেখবে না কিন্তু না দেখা অব্দি ও শান্ত হতে পারে না। সাদিয়া অনেক যুদ্ধের পর ফোনটা হাতে নিলো। মেসেজ ওপেন করে দেখলো লেখা আছে–
“তুমি চাইলে শরৎ হয়ে তোমায় ছুঁয়ে দিবো।
মনের সব বিষাদগুলো দূর করে দিবো।
হাত বাড়িয়ে অপেক্ষা করো, গভীর সানন্দে,
শরতের বৃষ্টি হয়ে, নামবো তোমার অঙ্গে!”
মেসেজটা পড়ে সাদিয়া কিছুক্ষণ থম মেরে রইলো। নিরব কি সত্যি আসবে? শরতের বৃষ্টি হয়ে ওকে কি ভিজিয়ে দিতে আসবে? নাকি সবেই শুধু ছন্দ!
——————————-
আঁখির জীবন কাটছে মহা সুখে। হইহুল্লোর আর আনন্দ করতে করতে ওর সময় শেষ। ওর বাবা ওকে মেনে নিয়েছে এর থেকে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে। আঁখি এখন ওদের বাসায় প্রায় যায়। ওর মা বাবা আতিকও আসে। আঁখি অনার্স শেষ করেছে। কিন্তু সাজ্জাদের জন্য চাকরি করা হয়না ওর। সাজ্জাদ ওকে চাকরি করতে দিবে না। সাজ্জাদ এখন আর চাকরি করেনা। নিজে একটা ছোট বিজনেস শুরু করেছে। আস্তে আস্তে ওর বাবার মতো বড় করবে সেই আশায়। ফোনো এর্লাম বাজতেই আঁখি লাফিয়ে উঠলো। তাড়াতাড়ি করে এর্লামটা কেটে দিলো যেনো নুর আর সাজ্জাদ জেগে না যায়। ও আস্তে করে উঠে দুজনের দিকে তাকালো। দুজনেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন! কি সুন্দর বাবা মেয়ে মিলে ঘুমাচ্ছে আঁখির খুব ভালো লাগছে। মেয়েটা ঠিক বাবার মতোই রাগি আর খুব অভিমানি। কিছু হলেই গাল ফুলায়। বড্ড বাবার পাগল মেয়েটা। বাবার মতোই সুন্দর করে হাসে। ওর সুন্দর হাসির জন্য সাজ্জাদ ওকে সুহাসিনী (যে নারীর হাসি সুন্দর তাকে সুহাসিনী বলে) বলে ডাকে। আঁখি মুচকি হেসে মুলটা খোঁপা করতে করতে উঠে পড়লো। নিঃশব্দে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে সকালের নাস্তা বানাতে চলে গেলো। মিসেস শাহনাজ চা বানাচ্ছেন আশরাফ খানের জন্য। আঁখি রান্না ঘরে গিয়ে আঁটা সেদ্ধ করতে পানি বসালো। মিসেস শাহনাজ ওর দিকে তাকিয়ে বললেন।
“সারারাত ধরে নুর তোমায় অনেক জ্বালায়। তোমাকে ঘুমাতে দেয়না। সকালে একটু দেরি করে উঠলেও তো হয়। এত তাড়াহুড়ার কি দরকার? আমি তো নাস্তা বানাতেই পারি। একটু পর রোজিনা খালাও আসবে সাহায্য করতে।”
“সমস্যা নাই মা! মিলেমিশে করলে ভালো লাগে। দুপুরে তো কাজ করতে দেয়না নুর। শুধু কান্না করে কোল থেকে রাখা যায়না। তাই এখন ও ঘুমে থাকতে এটুক করি।”
মুচকি হেসে কথাটা বললো আঁখি। মিসেস শাহনাজ হাসি মুখে বললেন।
“বাচ্চারা কত জ্বালায় সেটা জানি। রাতেও ঘুমাতে দেয়না দিনেও ঘুমাতে দেয়না। আমি তো এইদিন পার করে এসেছি। তখন আমারও মনে হতো সকালে একটু ঘুমাই কিন্তু তোমার মতোই উঠে পড়তাম। কেমন যেনো লাগতো। যদিও শ্বাশুড়ি মা কিছুই বলতেন না। তবুও…”
কথাটা বলেই চা নিয়ে চলে গেলেন মিসেস শাহনাজ। আঁখি মুচকি হাসলো। ওর সত্যি ঘুম আসে কিন্তু মনের মাঝে একটা কেমন কেমনের জন্য শ্বশুড় বাড়ি অনেক মেয়েই ইচ্ছা করলেও ঘুমিয়ে থাকে না। ওর শ্বাশুড়ি ঠিক বলেছে। এভাবেই প্রতিটা শ্বাশুড়ি যদি নিজের বৌ কালের কথা চিন্তা করে তবে বৌমাদের বুঝতে পারে। বৌদেরও শ্বাশুড়িকে বোঝা লাগে। সবার স্যাক্রিফাইসেই তো একটা সংসারে সুখ আসে। এখনও আঁখি বাবার বাড়ি গেলে কিছু মনে না করে নিঃচিন্তায় ঘুমায়। আর এখানে?
সকাল আট টা। আঁখি নাস্তা বানিয়ে রুমে গেলো। এখনও দুজনে ঘুমাচ্ছে। সাজ্জাদ অফিসে ১০টায় যাবে। নয়টার আগে উঠবে না ও। আঁখি ভাবলো একসাথে গোসলটা সেরে নিক! ওদের দুজনে একজন উঠলেও ও সময় পায়না। ও ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে গেলো গোসল করতে।
সাজ্জাদ গভীর ঘুমে ছিলো হঠাৎ করেই নুর উঠে কান্না শুরু করে দিলো। সেকি কান্না? রুম কাপিয়ে কান্না করছে। সাজ্জাদের চোখে অনেক ঘুম। ও ঘুমের চোখেই চোখ বন্ধ করে ওর মেয়ের পিঠে হালকা চাপড় দিয়ে ঘুম পাড়াতে লাগলো। কিন্তু লাভ হলো না। নুর আরও জোরে কান্না করতে লাগলো। সাজ্জাদ হতাশ হয়ে ঘুম ছেড়ে উঠে পড়লো। কোলে নিয়ে দোলাতে দোলাতে বললো।
“কি হয়েছে আমার মামনির? কান্না করে কেনো? কাঁদেনা মামনি৷ কাঁদেনা!”
কে শোনে কার কথা। নুর কেঁদেই চলছে। সাজ্জাদ একটু বিরক্ত হলো। প্রতিদিন ওকে এভাবে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয় আর তুমুল কান্না করে। ও এনব করার পড়েও থামছে না। সাজ্জাদ কোলে নিয়ে এদিক ওদিক হাটতে লাগলো। তবুও মেয়েটা কাঁদছে। ওর কান্না শুনে আঁখি তাড়াতাড়ি ওয়াশরুম থেকে বের হলো। গোসল শেষ করেছে কোনো মতে। চুলগুলো তাওয়ালে দিয়ে পেঁচাতে পেঁচাতে বললো।
“কি তুমি? একটা ছয় মাসের বাচ্চাকে সামলাতে পারো না? আবার নিজেকে বাবা দাবি করো?”
কথাটা বলতে বলতে আঁখি ওর মেয়েকে কোলে নিলো। সাজ্জাদ অবাক হয়ে বললো।
“বাবা দাবি করার কি আছে? আমি তো এমনিতেও লিখিত সনদপ্রাপ্ত ওর বাবা। কেনো তোমার সন্দেহ আছে? তাহলে দোষটা কিন্তু তোমার।”
শেষের কথাটা সাজ্জাদ দুষ্ট হাসি দিয়ে বললো। আঁখি বড়বড় চোখ করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে ফাসাতে গিয়ে ও নিজেই ফেঁসে গেলো? আঁখি হালকা কেশে আমতা আমতা করে বললো।
“নাহ! কখনই না। আমি কখনও বললাম সন্দেহ আছে? একটুও সন্দেহ নাই।”
কথাটা বলে আঁখি হেঁটে হেটে ওর মেয়ের কান্না থামাতে লাগলো। নুর এখনও কাঁদছে। সাজ্জাদ ওর দিকে এগিয়ে এসে বললো।
“এবার তুমি কান্না থামাতে পারছো না কেনো?”
“তোমার মেয়ে তোমার মতোই ফাজিল। আমায় জ্বালিয়ে মারবে তাই এমন করছে। তুমি এক কথা না বলে ঘোড়া হও। নুর ঘোড়ায় চড়বে বলে কাঁদছে।”
সাজ্জাদ অবাক হয়ে তাকালো। ও আশ্চর্যের শেষ সীমানায়। ও চোখ ছোট ছোট করে বললো।
“নুর কখন বললো ও ঘোড়ায় উঠবে? ও কি কথা বলতে পারে? নাকি একা বসতে পারে?”
“বলছে বলছে। তুমি আগে ঘোড়া হও তো!”
সাজ্জাদ জোরে শ্বাস ছেড়ে ঘোড়া হয়ে গেলো। এই মা মেয়ের জন্য যে ওর আর কি কি করতে হবে কে জানে? আঁখি নিজে নুরকে কোলে নিয়ে বসলো। সাজ্জাদ আগেই বুঝেছে আখিও উঠবে। ও পিঠ বাকা করে বললো।
“খেয়ে খেয়ে কি মোটাই না হচ্ছ পাখি! আমি পারছি না।”
“কথা কম চুপচাপ চলো!”
সাজ্জাদ ঘোড়া হয়ে পুরো রুম ঘুরছে। নুরের কান্না অটোমেটিক বন্ধ হয়ে গেলো। আঁখি খিলখিল করে হাসছে সাথে নুরও ফোকলা দাঁতে হাসছে। ওদের হাসি দেখে সাজ্জাদের মুখেও হাসি ফুটলো। নিজেকে কেমন পরিতৃপ্ত মনে হচ্ছে। ওদের দরজা একটু খোলাই ছিলো। ড্রইংরুম থেকে ওদের দেখে মিসেস শাহনাজ আর আশরাফ খানও হেসে উঠলেন। তাদের পিবারটা এখন পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে। যে ছেলে বিয়ে করতে চাইতো না সে আজ বৌ বাচ্চার সাথে কি না করছে? সত্যি সময় অনেক কিছু পাল্টে দেয়। পরিবারের সুখ কে না চায়? একটা পরিবারে সুখের জন্য সব সময় সবাইকে সমান হতে হয়। ভুল ত্রুটি মাফ করতে শিখতে হয়। সবসময় দোষ ধরে বসে থাকলে হয়না। আগে ভাবতে হয় আমি ওর স্হানে হলে কি করতাম? সবাইকে সমান ভাবে দেখতে হয়। সুখে দুঃখে পাশে থাকতে হয়। তবেই তো সুখ আসে পরিবারে!
ইনশাআল্লাহ চলবে…..
(গল্পটা আজেই শেষ করতে চেয়েছিলাম কিন্তু হলো না। কাল ইনশাআল্লাহ শেষ হবে। কার কাছে কেমন লাগছে গল্পটা?)