আরশিযুগল প্রেম❤পর্ব-৫২

0
1158

# আরশিযুগল প্রেম
# লেখনীতে — নৌশিন আহমেদ রোদেলা
#পর্ব – ৫২

প্রায় মধ্যরাত। সামনের রাস্তা থেকে কুকুরের আর্তনাদ আর মৃদু পিনপিনে শব্দ ব্যতীত অন্যকোনো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। শেষ শরৎ এর হিম ধরা রাতেও পৃথার ঘরের ফ্যানটা ক্যাটক্যাটে শব্দ তুলে ঘুরছে। পূর্ব দিকের দেয়ালের সাথে রাখা বিশাল আয়নাটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে পৃথা। কপালে হালকা ভাঁজ ফেলে আয়নায় নিজেকেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সে। নাক, গাল, চোখ, ঠোঁট সব কিছুই আলাদা আলাদা করে দেখার চেষ্টা করছে। মুগ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছে। গত দুই ঘন্টা ধরে টানা দাঁড়িয়ে থেকেও নিজের ওপর সন্তুষ্ট হতে পারছে না পৃথা। আজ হঠাৎ করেই তার মনে হচ্ছে, সে আসলে ততটা সুন্দরী নয়। মোটামুটি রকম সুন্দরী। আর তার হাইটটাও খুব একটা ভালো নয়। আরো কয়েক ইঞ্চি উচ্চতা খুব বেশিই প্রয়োজন ছিল তার। আর তার নাকটাও বোধহয় একটু বেশিই খাঁড়া, সাদাফের মতো মিডিয়াম নয়। চোখগুলোও চায়নিজদের মতো। এই চোখে কাজল মানাবে না। পৃথা মন খারাপ করে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসলো। হঠাৎ করেই তার এসব আজগুবি চিন্তার কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই। কিশোরী মনের হুটহাট অনুভূতিগুলোর যুক্তিসংগত কারণ থাকতে নেই। এই অনুভূতিগুলোকে ধরা বা বাঁধার সুযোগও নেই। এদের কাজ হলো নিরন্তর ছুটে চলা। সময়ে অসময়ে তীব্র অনুভূতিতে কিশোরী মনটিকে পাগল করে তোলা। পৃথার অনুভূতিগুলোও যুক্তিহীন ছুটছে। সময়ে অসময়ে অদ্ভুত সব প্রশ্নে ভয়ানকভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলছে। পৃথার বুক চিড়ে তপ্ত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। ডানহাতের পিঠ দিয়ে গালের ওপর পড়ে থাকা দু’ফোঁটা টসটসে জল মুছে নিলো সে। নিজেকে পৃথিবীর সব থেকে শ্রীহীন, বিদঘুটে নারী বলে বোধ হতে লাগলো। কান্নাগুলো গুটি বেঁধে বুকের বাম পাশটাই জমা হতে লাগলো। কারণহীন উদ্বেগ আর হতাশায় সারাটা রাত অযথাই কাটা হয়ে বসে রইল পৃথা। এডমিশনের পড়াশোনাগুলো নেহাৎই বিরক্তিকর উপদ্রব বলে মনে হওয়ায় তুমুল ভৎসনার শিকার হলো।

কিছুক্ষণ আগেই গায়ে হলুদের পর্ব শেষ হয়েছে শুভ্রতার। অর্পন,পুষ্পি, প্রেমা এখনও হলুদ ছুঁড়াছুড়ি করছে। তাদের কাউকেই এখন আর সভ্য মানুষের আওতায় ফেলা যাচ্ছে না। শুভ্রতা দু’হাতে মেহেদী পরে বারবারই অসহায় চোখে ফোনের দিকে তাকাচ্ছে। সকাল থেকে এই দুপুর পর্যন্ত একটা বারও ফোন দেয় নি সাদাফ। শুভ্রতা অভিমানে মুখ কালো করে বসে আছে। আর কয়েক ঘন্টা পরে বউ নিতে চলে আসবে অথচ বউয়ের সাথে এতো রাগ? শুভ্রতা যদি সত্য সত্য মারা যেত তখন কোথায় যেত সেই রাগ? এতোক্ষণে কেঁদে কেটে চোখ ফোলাত। আচ্ছা? সাদাফ কি সত্যিই কাঁদতো তার জন্য? সত্যিই? শুভ্রতার ভাবনার মাঝেই স্টেজ কাঁপিয়ে পাশে এসে বসলো অর্পণ। শুভ্রতার গায়ের ওপর গা এলিয়ে দিয়ে বলল,

—-” আমি খুব টায়ার্ড শুভ্রা। একটু আদর করে দাও না।”

শুভ্রতা বিরক্তি এবং রাগের সংমিশ্রণে অর্পণের দিকে তাকাল। অর্পণ ভুবন বুলানো হাসি দিয়ে বলল,

—-” চোখ গরম করে লাভ নাই। কাল থেকে এগুলোই রোজ শুনতে হবে জানু। তাই একটু মুখস্থ করিয়ে দিচ্ছিলাম তোকে। হাজার হলেও প্রাণের দোস্ত তুই। ফ্রীতে শিখিয়ে পরিয়ে দিচ্ছি।”

শুভ্রতা ভ্রু কুঁচকে বলল,

—-” তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে তোর বহুত এক্সপিরিয়েন্স।”

পুষ্পি ক্লান্ত হয়ে শুভ্রতার অন্যপাশটাই আয়েশ করে বসলো। প্রেমা ফচকে গলায় বলল,

—-” আরে, ওর কি তোর মতো একটা জামাই নাকি? ওর কত শত ক্রাশিত জামাই আছে। এইতো তোর হলুদেও দুইটা পোলাকে দেখে ভীষণ রকম ক্রাশ খেয়েছে সে। পোলারা হইলো দুই ভাই। আমাদের অর্পু কারে রেখে কার ওপর ক্রাশ খাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। একটাকে বাছতে গেলে অন্যটার জন্য কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে তার।”

প্রেমার কথায় হুহা করে হেসে ফেলল পুষ্পি-শুভ্রতা। অর্পন ঠোঁট উল্টিয়ে বলল,

—-” সত্যিই!”

শুভ্রতা হাসি থামিয়ে ‘হঠাৎ কিছু মনে পড়েছে’ এমন মুখভঙ্গি নিয়ে বলল,

—-” এই? তনুকে আরেকটাবার ট্রাই করে দেখ না প্লিজ। সকালের পর তো আর ফোন দেওয়া হয় নি।”

অর্পন মাথা দুলিয়ে শুভ্রতার ফোনটা নিজের হাতে নিলো। তনয়াকে ভিডিও কল দিয়ে বেশ আয়েশ করে বসলো সে। কয়েক মুহূর্ত পরেই ওপাশ থেকে হাস্যোজ্জল তনয়ার মুখ ভেসে উঠলো। গায়ে তার হলুদ রঙা শাড়ি। কানে-মাথায় কাঁচা ফুলের গহনা।

—-” তানু বেবি! তোকে একদম রসগোল্লা লাগছে।”

তনয়া হেসে বলল,

—-” লাগতেই হবে। দেখতে হবে না কাদের বান্ধবী? শুভি? আমি নেই বলে একদম মন খারাপ করবি না। দেখ, অর্পনদের সাথে মিলিয়ে সেইম সাজে সেজেছি। হলুদ বাটাও নিয়ে বসেছি। মুখ এগিয়ে আন ছুঁয়ে দিই একটু।”

শুভ্রতা হাসলো। হঠাৎই চোখদুটো জলে টলমলে হয়ে উঠলো তার। তনয়া হেসে বলল,

—-” তুই দিন দিন বোকা হয়ে যাচ্ছিস শুভি। আগে তুই কথায় কথায় কাঁদতি না। সাদাফ ভাইয়া আমাদের শুভিটাকে ছিঁচকাদুনে বানিয়ে বড্ড অন্যায় করেছেন।”

শুভ্রতা রুদ্ধস্বরে বলল,

—-” তোকে খুব মিস করছি। চলে আয় না প্লিজ। ভাইয়া বুঝি এলাউ করবে না? আমি রাজি করানোর চেষ্টা করি?”

—-” আরে ধুর, তেমন কিছুই না। তোদের ভাইয়া এসব নিয়ে কিচ্ছু বলে না। ও নিজেই তোর বিয়ে এটেন্ড করতে বলেছিল কিন্তু আমিই মানা করেছি। আপাতদৃষ্টিতে, আমাদের সংসারে ভীষণ সুখে আছি আমি। কিন্তু দৃষ্টির অগোচরে অনেক সত্যই চাপা পড়ে। আর আমার সবচেয়ে বড় সত্যটা হলো, আমি যাকে ভালোবাসি সে অন্যকেউ। সারাটা জীবন হয়ত সেই অন্যকেউ, অন্যকেউই থেকে যাবে। আর এই চরম সত্যের মুখোমুখি হতে চাইছি না আমি। মনেপ্রাণে সত্যটাকে আড়াল করতে চাইছি।”

কথাটা বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল তনয়া। ঠোঁটের কোণে হাসি টানার চেষ্টা করে বলল,

—-” সেসব ছাড় হলুদের ডেকোরেশন তো দেখা। কিভাবে সাজিয়েছে সব?’

অর্পণ এতোক্ষণ থম ধরে বসে থাকলেও এবার আগ্রহী কন্ঠে বলল,

—-” ওয়েট। ব্যাক ক্যামেরা অন করছি। আজকের ডেকোরেশনে আমার অবদান ব্যাপক বুঝলি? কিন্তু শুভ্রতার কাজিনগুলো ভীষণ বেদ্দপ। তবে দুটো হ্যান্ডসাম পোলা আছে। দুইটাই সেই লেভেল। কোনটার সাথে ট্রাই মারবো বুঝতেছি না। তুই একটু হেল্প কর ওকে?”

তনয়া হাসলো। বলল,

—-” একটা তুই রেখে অন্যটা প্রেমাকে দিয়ে দে।”

—-” ধুর! ওর তো কালাচাঁদ আছে। আমার ধলা চাঁদদের মিষ্টি মিষ্টি মুখগুলোকে ওর কালাচাঁদের দুনিয়ায় দিয়ে অান্ধার বানিয়ে দিতে পারি না আমি। কিছুতেই না।”

প্রেমা ক্ষেপে গিয়ে কিছু বলবে তার আগেই পেছনের ক্যামরা অন করে উঠে দাঁড়াল অর্পণ। এদিক-সেদিক ক্যামেরা ঘুরিয়ে নিজের খ্যাতি বিশ্লেষণ করতে লাগল। ডেকোরেশনের কোণ কোনায় তার ক্রাশদের দেখা যেতে পারে তারও বিস্তর আলোচনা করলো। তনয়ার হাসি হাসিমুখে হঠাৎই মলিনতা দেখা দিলো। উচ্ছল দৃষ্টিজোড়ায় প্রথম দফায় শীতলতা। দ্বিতীয় দফায় অশ্রু জমতে লাগলো। অর্পণ ব্যাপারটা খেয়াল করে উদ্বিগ্ন গলায় বলল,

—-” তুই কি কাঁদছিস তনু? কি হলো হঠাৎ? ”

কথাটা বলে সামনের দিকে তাকাল অর্পণ। ফোন ক্যামেরার ঠিক পেছনেই প্যান্ডেলের চেয়ার গুছাচ্ছিল শুভ্রব। অর্পণের মুখে ‘তনু’ নামটা শুনে ততক্ষণে সেদিকেই তাকিয়েছে শুভ্রব। চোখে মুখে তার উদভ্রান্ত দৃষ্টি। গভীর মায়ামাখা চোখে সে তাকিয়ে আছে ব্যাক ক্যামেরায়। সে বুঝতে পারছে, তনয়ার স্নিগ্ধ চোখজোড়া সেখান থেকেই দেখছে তাকে। শুভ্রবকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে নড়েচড়ে দাঁড়াল অর্পণ। কিছু না ভেবেই সামনের ক্যামেরাটা অন করে ফোন ঘুরিয়ে শুভ্রবের দিকে ফেরালো সে। মোবাইলের স্ক্রিনে ছলছল চোখের তনয়াকে দেখেই নিঃশ্বাসটা বন্ধ হয়ে এলো শুভ্রবের। শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া গলায় ঢোক গিলার চেষ্টা করলো। প্রায় দেড় থেকে দুইমাস পর বহু আকাঙ্খিত মুখটা দেখতে পেয়ে বাকি পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে এলো শুভ্রবের। তনয়া তখন স্ক্রিনের ওপাশে দু’হাতে মুখ চেপে অশ্রু দমনের বৃথা চেষ্টা করছে। শুভ্রব দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে পাশে রাখা চেয়ারটাতে ধপ করে বসে পড়ল। শুভ্রতা তাড়াহুড়ো করে অর্পণের হাত থেকে ফোনটা ছিনিয়ে নিলো। শুভ্রতার চাহনী দেখে উপলব্ধি করলো, কাজটা ঠিক করে নি সে। তনয়া হয়তো মনে মনে ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিল। সময় পেরিয়ে গেলেও সামলে উঠার শক্তিটা যে তাদের কারোরই হয় নি তা যেন ভীষণ নির্লজ্জের মতো আবারও প্রকাশ পেয়ে গেলো। শুভ্রব কপাল চেপে ধরে চুপচাপ বসে রইলো। কিছুক্ষণ পর টালমাটাল পা নিয়ে ধীরে ধীরে নিচে নেমে গেলো। শুভ্রতা টলমলে চোখে ভাইয়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। মনের আনাচে কানাচে একটা কথায় বাজতে লাগল সমান তালে, ‘ ইশ! যদি তনয়াকে ফিরিয়ে আনার একটা ছোট্ট সুযোগও থাকতো । যদি সময়টাকে পিছিয়ে নেওয়ার ক্ষমতাটুকু অন্তত তার হতো!’

ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে গায়ে হলুদের গহনাগুলো খুলছিলো শুভ্রতা। অর্পণ শুভ্রতার শাড়ির পিন খুলতে সাহায্য করছিলো। প্রেমা-পুষ্পি বিয়ের ড্রেস,গহনাগুলো উল্টেপাল্টে দেখছিলো। বিয়ের জিনিস ভর্তি লাগেজটা সাদাফের বাসা থেকে এসেছে। সকালে হলুদ দিতে আসার সময় পৃথা আর ওর চাচাতো ভাই লাগেজটা পৌঁছে দিয়েছে এখানে। পুষ্পি বিয়ের লেহেঙ্গাটা উল্টেপাল্টে দেখে বলল,

—-” দোস্ত? সাদাফ ভাইয়ের পছন্দ কিন্তু মারাত্মক। পৃথা বলছিলো তোর জন্য যা যা কেনা হয়েছে সব সাদাফ ভাই নিজে পছন্দ করেছেন। লেহেঙ্গার লাল রঙটাই কেমন রেয়ার দেখেছিস?”

—-” পায়ের মলটাও ভীষণ সুন্দর। এটা তোর বিয়ের জিনিস না হলে যুদ্ধ করে হলেও এই জিনিসটা নিজের আন্ডারে নিতাম আমি।”

কথাটা বলে হাসলো প্রেমা। ঠিক তখনই দরজা ঠেলে ভেতরে এলেন রাদিবা। হাতে কয়েকটি ভাঁজ করা শাড়ি। রাদিবাকে ঢুকতে দেখেই উঠে দাঁড়ালো পুষ্পি আড প্রেমা। অর্পণকে ইশারা করে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো তিনজন। রাদিবা ছোট্ট শ্বাস টেনে শুভ্রতার বিছানার ওপর বসলেন। কাপড়গুলো পাশে নামিয়ে রেখে মৃদু গলায় বললেন,

—-” তুমি হওয়ার পর থেকেই এই শাড়িগুলো জমাচ্ছিলাম আমি। বেশ কিছু শাড়িই ওল্ড ফ্যাশনের হয়ে গিয়েছে। তোমার হয়ত পছন্দ হবে না, তবুও দিচ্ছি। আসলে, তুমি হওয়ার পর থেকেই রাস্তায় অল্প বয়স্কা মেয়ের গায়ে সুন্দর শাড়ি দেখলেই চট করে কিনে ফেলতাম আমি। তোমার বাবা সবসময় বকাবকি করে বলত, এতো এতো শাড়ি কিনো কিন্তু পরতে তো দেখি না একটাও। শাড়ি কি তুলে রাখার জন্য কিনো নাকি? আমি বলতাম, ওগুলো আমার শুভির। বিয়ের পর সব শাড়ি উপহার দেব তাকে। তোমার বাবা অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকতেন।”

কথাগুলো বলে হাসলেন রাদিবা। শুভ্রতা উঠে এসে মায়ের পায়ের কাছে ফ্লোরে বসল। রাদিবার কোলে মাথা রেখে টলমলে চোখে তাকাল। আজকে রাতেই এই মা,এই বাড়ি সব ছেড়ে চলে যেতে হবে ভেবেই দুনিয়া অন্ধকার করে কান্না পেল শুভ্রতার। ধরা কন্ঠে বলল,

—-” সরি মা।”

রাদিবার গাল বেয়ে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল। চোখে-মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটিয়ে বলল,

—-” আমার পুতুল পুতুল মেয়েটা আজ শশুরবাড়ি যাবে!”

শুভ্রতার মাথায় একটা হাত রেখে বললেন,

—-” মনে কোনো কষ্ট রাখিস না মা। পরিস্থিতির চাপে বাবা-মাকে অনেক সময়ই কঠিন হতে হয়। তারমানে এই নয় যে তারা সন্তানদের ভালো বাসে না। সন্তানদের উচিত বাবা-মার জায়গায় দাঁড়িয়ে চিন্তা করে দেখা। এমন একটা পরিস্থিতি আসলে তারা কি করতো? আমি আর তোর বাবাও প্রচন্ড ভালোবাসি তোকে। আমাদের সব সুখ যেন তোর ঝুলিতে গিয়ে পড়ে এই দোয়াই করি। কিন্তু, বেশি ভালো চাইতে গিয়েই হয়ত দুই বুড়োবুড়ি মিলে তোদের বিতৃষ্ণার কারণ হয়ে গিয়েছি। শুভ্রব আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। তার ধারণা, তার বোনকে আমি খুন করতে চাই। তুইই বল? তার বোনটাকে কি আমি পেটে ধরি নি? তার সেই বোনটা কি আমার মেয়ে নয়? সে বলে, তার একটা মাত্রই বোন। আমারও তো সেই একটা মাত্রই মেয়ে। তোরও মনে হয়, আমি তোর ক্ষতি করতে চাই?”

কথাটা বলতেই আবারও গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। শুভ্রতা উঠে মায়ের পাশে বসল। মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,

—-” একদমই না মা। তোমার আর বাবার মতো আমায় এতোটা ভালোবাসতে কেউ পারবে না মা। ভাইয়াও না আর না যার সাথে আমার বিয়ে হচ্ছে সে। তোমাদের প্রতি আমার একফোঁটা অভিযোগ নেই মা। বরং নিজের কাছেই ছোট হয়ে গিয়েছি আমি। বড় চাচার সাথে বেয়াদবি করেছি। আত্মহত্যা করতে গিয়েছি। সরি মা। এমন ভুল আর কখনোই করব না। কক্ষনোও না।”

রাদিবা মেয়েকে ডানহাতে আগলে ধরে বললেন,

—-” কখনোও করিস না মা। সেদিন তোর কিছু হলে, তোর বাবা আর আমি সেখানেই মরে যেতাম রে মা। দশটা মাস নিজের শরীরের মধ্যে রেখেছি তোকে। আমার শরীরের একটা অংশ তুই। আমাদের শরীরের একটা অঙ্গ নেই ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। সেখানে মায়ের বুক থেকে তার কলিজাটা ছিঁড়ে নেওয়াটা যে কতোটা কষ্টের তা আর কয়েক বছর পর বুঝবি। শরীর ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা বাচ্চাটা মায়েদের জন্য শুধুই একটা সন্তান নয় নিজের অন্য একটা শরীর। নিজেকে ছোট থেকে পায়ে পায়ে বড় হতে দেখা। ”

কথাটা বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রাদিবা। কিছুক্ষণ মা-মেয়ে উভয়ই চুপ থেকে তাড়া দিয়ে বললেন,

—-” জলদি গোসল সেড়ে নে যা। পার্লারের লোকেরা এলো বলে।”

শুভ্রতা মাকে ছেড়ে উঠে বসতেই চলে যেতে উদ্যত হলেন রাদিবা৷ কিছুটা গিয়েও হঠাৎ থেমে পেছনে ফিরে তাকালেন। স্নিগ্ধ গলায় বললেন,

—-” তুই ভুল করিস নি, ছেলেটা আসলেই খুব ভালো শুভি।”

রাদিবার হঠাৎ এমন কথায় চোখ তুলে তাকাল শুভ্রতা। জিগ্যেসু দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। রাদিবা মৃদু গলায় বললেন,

—-” সেদিন হাসপাতালে খেয়াল করে দেখলাম ছেলেটাকে। এতোকিছুর পরও এতটুকু উচ্চবাচ্য করে নি ছেলেটি। না কোনো হৈ-চৈ করেছে। আজকাল ছেলে-মেয়েরা যতটা না ভালোবাসে তার থেকে হাজার গুণ বেশি ভালবাসাটা দেখাতে পছন্দ করে। বড়-ছোট মান্য না করেই নিজেদের ভালোবাসার প্রমাণ দিতে চায়৷ কিন্তু সাদাফের মধ্যে এমন কিছুই ছিলো না। সে প্রমাণ দেওয়ার চেষ্টা না করেও অনেক কিছু প্রমাণ করে দিয়েছে। সকাল দশটা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত নীরব বসেছিলো ছেলেটি। কিছুক্ষণের জন্যও জায়গা ছেড়ে উঠে নি। কিছু না বললেও সেখানে থাকা প্রত্যেকটা মানুষ বুঝে গিয়েছিল এই ছেলেটা আমার মেয়েটাকে কতটা চায়। এমনকি তোর বাবাও এই একই কথা বলেছেন আমায়।”

শুভ্রতা লজ্জা পেয়ে মাথা নুয়ালো। রাদিবা মৃদু হেসে বললেন,

—-” সুখী হও৷ ”

____________________

বিকেল চারটা। শেষ বিকেলের নরম আলোয় চারপাশটা অত্যন্ত স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। শুভ্রতাদের বিল্ডিংয়ের সামনে বানানো বিরাট গেইটটিতে বাঁধা লাল ফিতার ওপারে দাঁড়িয়ে আছে রাকিব। তার চোখে-মুখে চাপা বিস্ময়। রাকিব সাদাফের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল,

—-” দোস্ত?এইটা রবীন্দ্র সরোবরের ওই ঝগড়ুটে মাইয়াটা না?”

সাদাফ আড়চোখে তাকাল। রাকিব চাপা আর্তনাদ করে বলল,

—-” হায় সর্বনাশ! আমাদের ভাবি কি তবে ওই মেয়েগুলোর মধ্যে একজন? শালা, ভাবির একটা ছবি সেন্ট করতে বলছিলাম ম্যাসেঞ্জারে। তবু করিস নি। বউ আলমারিতে তুলে রাখিস।”

সাদাফ ভ্রু বাকিয়ে বলল,

—-” দরকার পড়লে তাই রাখব, কোনো সমস্যা?”

—-” কোনো সমস্যা নাই। তোর বউ তুই যেখানে ইচ্ছে তুলে রাখ। কিন্তু, আমাদের ভাবিটা কোনখান?”

পাশ থেকে দুষ্টু গলায় বলে উঠলো মাহিন,

—-” তুমি যার হিলের চিপাই পড়ছিলা সে-ই আমাদের ভাবি, মামা।”

রাকিব গোল গোল চোখে আবারও সাদাফের দিকে তাকাল। দুঃখী দুঃখী গলায় বলল,

—-” দোস্ত? মনে মনে তবে এই ছিলো তোর? উপরে উপরে আমার সাইড নিয়া তলে তলে বিয়া পর্যন্ত পৌঁছায় গেছো? এইটা কিছু হইলো?”

সাদাফ হাসলো। রাকিব মুহূর্তেই মুখভঙ্গি পরিবর্তন করে ফিচেল হাসলো। দুষ্টু গলায় বলল,

—-” আচ্ছা যা। বিয়া করছিস তো করছিস। এখন তোর শালীটাকে সেটিং করে দে। আমারও তো একটা হক আছে নাকি?”

মাহিন পাশ থেকে বলল,

—-” বন্ধু? আজকে মাইয়াটাকে পটাইতে না পারলে কিন্তু তুই ডাহা ফেইল।”

ডানপাশ থেকে চাপা উচ্ছ্বাস নিয়ে বলে উঠল জিহাদ আর রাফাত,

—-” অল দ্যা বেস্ট বন্ধু। জিত এবার আমাদেরই হবে।”

ওদের ফিসফাস কথাবার্তার মধ্যেই তুড়ি বাজিয়ে ভ্রু বাঁকালো পুষ্পি। কোমরে হাত রেখে বলল,

—-” মাত্র বিশ হাজার টাকা ডিমান্ড করা হয়েছে তাতেই যে মন্ত্রণা সভা জুড়ে দিয়েছেন। মনে হচ্ছে, আপনাদের প্রাণ ধরে টানাটানি করছি। ভেতরে আসার ইচ্ছে টিচ্ছে নেই নাকি?”

রাকিব ফিচেল হেসে বলল,

—-” সুন্দরী বেয়াইন সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে কি আর ভেতরে যেতে ইচ্ছে করে? হতে থাকুক না আমার আপনার শুভদৃষ্টি, সমস্যা কই?”

রাকিবের পেছনে থাকা বন্ধুরা হৈহৈ করে উঠলো। অর্পণ হাসি হাসি মুখ নিয়ে বলল,

—-” শুভ দৃষ্টি করার জন্য আপনার নজরে নজর ফোঁটা লাগাতে হবে ভাইয়া। যেনতেন চোখ দিয়ে তো আর শুভদৃষ্টি চলে না। নজর ফোঁটা হিসেবে বিশ হাজার টাকা টেবিলে ফেলে দিন তারপর নাহয় শুভদৃষ্টি থেকে বৃন্দাবন পর্যন্ত চিন্তা করে দেখা যাবে। শুকনো কথায় কি চিড়া ভিজে?”

একঘন্টা ব্যাপী বাকবিতন্ডার পর গেইটের মূল্য পনেরো হাজারে এনে ঠেকালো ছেলেরা। এই পাঁচ হাজার টাকা কমাতেই বেচারাদের ঘাম ছুটে যাওয়ার মতো অবস্থা। ফিতা কেটে ভেতরে ঢুকেই পুষ্পিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল রাকিব,

—-” আসসালামু আলাইকুম বেয়াইন সাব। কেমন আছেন বেয়াইন সাব।”

পুষ্পি মুখ বাঁকিয়ে বলল,

—-” বহুত ভালো।”

রাকিব বন্ধুদের তাড়ায় সামনের দিকে এগুতেই পুষ্পির কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে হালকা ধাক্কা দিলো অর্পণ। ফিচেল হেসে বলল,

—-” বুকে নয়া প্রেমের জ্বালা হচ্ছে নাকি বেয়াইন সাব?”

পুষ্পি রাগী চোখে তাকাল। প্রেমা গুণগুণিয়ে বলল,

—-” আহা! বুকে নয়া প্রেমের জ্বালা।”

পুষ্পি ফুঁসে ওঠে বলল,

—-” একদম পঁচানোর চেষ্টা করবি না আমায়। পৃথিবীতে আর কোনো ছেলে নাই যে ওই ব্যাটার সাথে প্রেম করব আমি? একে তো সাগোরনার খাবারের সময় বুঝাবো মজা। শুভ দৃষ্টি কাহাকে বলে এবং কত প্রকার সব বুঝাব।”

অর্পণ আর পুষ্পি উচ্ছল গলায় বলল,

—-” নাও! বেয়াই সাব ইজ গন!”

বর স্টেজে বসার ঘন্টাখানেক পরই জুতো চুরির ধুম পড়লো। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত বরের জুতোজোড়া কারো চোখে পড়ল না। চেয়ার-টেবিল সবকিছুর নিচে খোঁজাখুঁজি করার পরও জুতোর ‘জ’ পর্যন্ত চোখে পড়লো না তাদের। জুতো খুঁজতে খুঁজতে পুষ্পি সাদাফের স্টেজের কাছাকাছি আসতেই আহ্লাদী গলায় ডেকে উঠলো রাকিব,

—-” আরে বেয়াইন সাব! ইশ, আমার প্রতি কতো টান আপনার। ডাকার আগেই ছুটে চলে এসেছেন। তো? চেয়ার-টেবিলের দিকে এতো না তাকিয়ে আমার দিকে তাকালেই তো পারেন।”

পুষ্পি ভ্রু কুঁচকে বলল,

—-” কেন? আপনার মুখে কি পরশ পাথর ঝুলানো? হা করে তাকিয়ে থাকতে হবে কেন?”

রাকিব বুকে হাত দিয়ে বলল,

—-” আহা! কথাগুলো বুকে গিয়ে লাগছে। প্রতিদিন সকালে ওঠে মধু খান বুঝি?”

পুষ্পি ঠোঁটজোড়া জোরপূর্বক প্রসারিত করে বলল,

—-” জি না। করলার রস খাই। বহুত টেস্ট, খাবেন?”

—-” আপাতত বেয়াইন সাবের মুখখানা দেখেই পেট ভরে গিয়েছে। নেক্সট টাইম খাবো, সমস্যা নাই।”

সাদাফের পাশে বসে থাকা ছেলেরা আবারও হৈহৈ করে উঠলো। পুষ্পি চোখ-মুখ ফুলিয়ে জায়গা ত্যাগ করলো। বরের খাবার শেষে বরের বন্ধুদের সামনে মিষ্টির থালা নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো পুষ্পি আর অর্পণ। গদগদ কন্ঠে বলল,

—-” বেয়াইন সাহেবদের মিষ্টি খাওয়াতে এলাম। হাজার হলেও আমাদের অতিথি। নিজের হাতে আপ্যায়ন না করলে চলে?”

জিহাদ সন্দেহী গলায় বলল,

—-” আপনাদের এতো আদর গায়ে সইবে বলে মনে হচ্ছে না।”

অর্পণ অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,

—-” কেন? বাসা থেকে বেয়াইনদের আদর-যত্ন গ্রহণ করার প্রিপারেশন নিয়ে আসেন নি বুঝি?”

পুষ্পি থালাটা এগিয়ে দিয়ে বলল,

—-” ছেলেদের স্বভাবই সন্দেহ করা। ছাড় তো অর্পু। তা, আপনারই নাহয় সিলেক্ট করুন। কোন মিষ্টিটা খেতে চান।”

সবাই বেশ দু’মনা করে একটি করে মিষ্টি তুলে নিলো হাতে। সাদাফ নিলো না। মিষ্টিটা ভালো করে পর্যবেক্ষন করে মুখে দিলো রাকিবসহ সবাই। আস্ত মিষ্টিতে দু’এক কামড় বসাতেই সবার মুখেই থমথমে রূপ লাভ করল। জিহাদ কোনোরকমে বলল,

—-” মিষ্টিতে গোল মরিচ!”

অর্পন-পুষ্পি অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,

—-” কি সব বলছেন? মরিচ! সেটা কিভাবে সম্ভব? আসলে, আপনারা তো বাসা থেকে বেয়াইনদের জন্য এক্সট্রা প্রিপারেশন নিয়ে আসেন নি তাই এমনটা হচ্ছে। মিষ্টির মধ্যে ঝাল ঝাল ফিল হচ্ছে। আহারে! প্রিপারেশন নিয়ে আসা উচিত ছিলো।”

ততক্ষণে ঝালে চোখমুখ লাল হয়ে এসেছে সবার।
রাফাত লাল চোখেই বিস্তর হাসলো। বললো,

—-” এক মাঘে শীত যায় না, বেয়াইন সাহেবা। আপনারা ভালো করে প্রিপারেশন নিয়ে আসবেন। আমাদের মন বহুত বড় কিনা? বেয়াইনদের যত্ন আত্মি একবিন্দুও কম করবো না।”

আরাফ ঝালে শুশাতে শুশাতে বলল,

—-” আমি তো তোমাদের দুলাভাই লাগি। আমাকে এটলিস্ট খাতিরদারিটা কম করতা শালিকাবৃন্দ।”

অর্পণ মুখ ভেঙিয়ে বলল,

—-” সাদাফ ভাইয়া ব্যতীত অন্য কাউকে দুলাভাই হিসেবো স্বীকৃতি দিচ্ছি না আপাতত। সো, আদর-যত্নের ভাগিদার আপনাকেও হতে হবে আরাফ ভাই।”

আরাফ শালিকাদের ওপর হতাশ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পানির খেতে মনোযোগী হলো।

_____________________

ছাঁদের সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছে পৃথা। ভারী লেহেঙ্গা পরে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে সে। সারাদিনের ক্লান্তি আর ভারী লেহেঙ্গায় অনেকটাই মিইয়ে গিয়েছে পৃথা। মেকাপ নষ্ট হওয়ার ভয়ে চোখে-মুখে পানি দেওয়াটাও মুশকিল হয়ে পড়েছে। তারওপর রাদিবা আহমেদকে খুঁজে বের করার মতো বিশাল দায়িত্বটা পড়েছে তার মাথায়। সাদাফের মা শুভ্রতার মায়ের সাথে ফোনে কথা বলতে চান। দুই বেয়াইনের নাকি গোপন আলাপ আছে। পৃথার দায়িত্ব হলো, রাদিবা আহমেদকে খুঁজে বের করে মায়ের সাথে কথা বলিয়ে দেওয়া। কিন্তু আধাঘন্টা ধরে খুঁজেও কোনো কূলকিনারা পাচ্ছে না পৃথা। এতোগুলো মানুষের মাঝে রাদিবা আহমেদকে কোথায় খুঁজবে সে? এমন সময় সিঁড়ির গোড়ায় শুভ্রবের দেখা মিলল। এই ছেলে সেদিন তাকে চরম অপমান করার পরও তাকেই ডাকলো পৃথা। পৃথার ডাকে দাঁড়িয়ে পড়লো শুভ্রব। ভ্রু কুঁচকে বলল,

—-” জ্বি?”

—-” আন্টি কোথায় জানেন?”

—-” কোন আন্টি?”

—-” উফ! আপনি এতো বকা কেন? অবশ্যই আপনার মায়ের কথা বলছি।”

শুভ্রব ছোট্ট করে বলল,

—-” ওহ্। ঠিক বলতে পারছি না। আপনি বরং বাসার ভেতরে চেইক করে দেখুন।”

কথাটা বলে সোজাসুজি পৃথার দিকে তাকাল শুভ্রব। শীতল গলায় বলল,

—-” আর কিছু বলবেন?”

পৃথা মাথা নাড়লো। পৃথার উত্তর পেয়ে শুভ্রব দ্রুত পায়ে ছাঁদে ওঠে গেলো। শুভ্রব চলে যেতেই রাতের দুঃখ দুঃখভাবটা তাড়া করলো পৃথাকে। অযথায় একঝাঁক মন খারাপে ছেয়ে গেলো তার কিশোরী মন। চারপাশের হৈ-হুল্লোড়, আনন্দময় পদচারণ ভীষণ বিরক্তিকর মনে হতে লাগল। বুক চিড়ে বেরিয়ে আসা দুঃখবার্তাকে পুঁজি করে পৃথা ভেতরের দিকে হাঁটা দিলো। হঠাৎ করেই উপলব্ধি করলো, মুখটা কেমন তেঁতো তেঁতো লাগছে তার। নাড়িভুড়ি উল্টে বমি পাচ্ছে। এমনটা কেন হচ্ছে কে জানে? পৃথার এই মুহূর্তে নিজের ওপরই ভীষণ বিরক্ত লাগছে। কেন যে বিয়েতে এলো? আর কেনই বা ওই লোকটির সাথে নিজ থেকে কথা বলল, তা ভেবেই রাগে চোখ-মুখ লাল হয়ে আসছে। কি দরকার ছিল নিজ থেকে কথা বলার? ওই লোক কি আদৌ চিনেছে তাকে? উফ! আর ভাবতে পারে না পৃথা। অচেনা এক খারাপ লাগায় বুকে চিনচিনে শিহরণ বয়ে যায়।

_______________________

দূরের মসজিদ থেকে এশার আযান ভেসে আসছে। শুভ্রতা বিছানার ওপর ঠাঁই বসে আছে। বিকেল থেকে টানা বসে থাকায় পা’দুটো ঝিমঝিম করছে। খানিকটা হাঁটাহাঁটি করলে হয়ত স্বস্তি পেতো সে। কিন্তু আশেপাশের কৌতূহলী দৃষ্টির বেড়াজালে হাঁটাহাঁটি তো দূর স্বস্তিতে নিঃশ্বাসও ফেলতে পারছে না শুভ্রতা। সেই বিকেল থেকে পরিচিত- অপরিচিত মানুষের কৌতূহলের মূল বিষয় হয়ে উঠেছে সে। সারা গায়ে ভারী লেহেঙ্গা আর গহনা জড়িয়ে কেমন দমবন্ধ দমবন্ধ লাগছে শুভ্রতার। তারওপর ঘরভর্তি মানুষের গরম নিঃশ্বাস। এবার বিয়ের ফর্মালিটিস শেষ করে তাকে এখান থেকে নিয়ে গেলেই বাঁচে সে। পরক্ষণেই আবার আৎকে উঠে শুভ্রতা। সাদাফের বাসায় তাকে কেমন পরিস্থিতির শিকার হতে হবে কে জানে? তারওপর সাদাফ ফোনও তুলছে না। রাগে-অভিমানে শুভ্রতার নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। আজ সাদাফকে জাস্ট খুন করে ফেলবে শুভ্রতা। এতো এতো টেনশন আর অস্বস্তির বেড়াজালেও পেটের ক্ষুধাটা টের পাচ্ছে শুভ্রতা। এতো এতো সাজ আর মানুষের কৌতূহলী চোখের সামনে দু’মুঠো ভাতও মুখে তুলে নি সে। রাদিবার জোড়াজুড়িতেও নয়। শুভ্রতার এই মুহূর্তে বিয়ে নামক ব্যাপারটাকেই সবচেয়ে ঝামেলাময় বলে বোধ হচ্ছে। তার থেকে সাদাফ-শুভ্রতার হুট করে হওয়া বিয়েটাই ঠিক ছিলো। কয়েক মিনিটের মাথায় কেমন বর-বউ বনে গেল! শুভ্রতা চোখ বন্ধ করে চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এশার নামাযের পরপর শুভ্রতা আর সাদাফের আবারও বিয়ে পড়ানো হলো। কবুল বলার সময় এক মুহূর্তও অপেক্ষা করলো না শুভ্রতা। তার শুধু মনে হচ্ছিলো, এই ঝামেলাগুলো এবার আপাতত শেষ হোক! বিয়ে পড়ানোর আধাঘন্টার মাথায় বউ নিয়ে ফেরার জন্য তোরজোর শুরু করল বরপক্ষ। বাবা-মা থেকে শেষ বিদায় নিলেও ভাইয়ের দেখা মিললো না তার। সবাই অনেক খোঁজাখুঁজির পর কোথা থেকে শুভ্রবকে ধরে আনলো কেউ। শুভ্রতাকে কাঁদতে দেখে খানিকটা থতমত খেয়ে বলল শুভ্রব। এতোগুলো মানুষের সামনে বোনকে কি বলে সান্ত্বনা দিবে মাথায় আসছে না তার। শুভ্রতা নিজে থেকেই শুভ্রবকে জড়িয়ে ধরতেই সব অস্বস্তি যেন উবে গেল শুভ্রবের। বোনকে দুই হাতে আগলে নিয়ে হাসার চেষ্টা করে বলল,

—-” এমনিতেই পেত্নী লাগছিল তোকে। কাঁদার পর কি ভয়ানক লাগছে ভাবতে পারছিস? তোর বরটা যে ঘুরেফিরে একটা পেত্নীকে কেন বিয়ে করল কে জানে? কাঁদিস না তো আর।”

শুভ্রতা ভাইয়ের পেটে হালকা ঘু্ষি দিয়ে বলল,

—-” একদম মজা নিবি না ভাইয়া।”

শুভ্রব প্রথমবারের মতো বোনের দুই গালে হাত রেখে কপালে ঠোঁট ছুঁয়ালো। আদুরে গলায় বলল,

—-” আমাদের পেত্নীটা এই পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর রাজকন্যা। একদম পরীদের মতো সুন্দর। সেন্টি খাস না, সম্পূর্ণটাই ডাহা মিথ্যা।”

শুভ্রতা মৃদু হেসে ফিসফিস করে বলল,

—-” তোর শরীর থেকে সিগারেটের গন্ধ আসছে ভাইয়া। আবার যদি সিগারেট খাস তো খবর আছে। আমি রোজ এসে তোর কাপড় শুঁকে দেখব গন্ধ আছে কিনা। ছাড় পেয়ে গিয়েছিস ভাবিস না।”

শুভ্রবের চোখদুটো ভরে এলো এবার। শুভ্রতাকে ছেড়ে দিয়ে আবারও ভীরের মাঝে হারিয়ে গেল সে।

গাড়িতে বসেও সাদাফের সাথে কথা বলার সুযোগ হলো না শুভ্রতার। শুভ্রতার সাথে মেয়েপক্ষ থেকে যাচ্ছে তার তিন বান্ধবী আর রুম্পি। গাড়িতে আরো কয়েকজন থাকায় প্রাইভেসিটা পাওয়া হচ্ছে না। শুভ্রতা ভেবেছিলো সাদাফের বাসায় এসেও দীর্ঘ সময় রোবটের মতো বসে থাকতে হবে তাকে৷ কিন্তু এমনটা কিছুই হলো না। সাদাফের বাসায় ঢুকার আধাঘন্টার মাঝেই রুমে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে। সাদাফের শোবার ঘর বা বিছানা কোনোটাই নতুন নয় শুভ্রতার। তবুও আজ অন্যরকম এক অনুভূতি হচ্ছে মনে। সারা ঘর গোলাপের সৌরভে ‘ম ম’ করছে। সাদা চাদরে ঢাকা বিছানাটা গোলাপোর লাল পাপড়িতে ভরে আছে। পুরো বিছানাটা সাজানো হয়েছে তাজা লাল গোলাপের থোকায়। ঘরের দুই কোণে বড় বড় দুটো মোমও জ্বালানো হয়েছে। শুভ্রতাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে কানের কাছে আধঘন্টার মতো ফিসফাস করলেন মেঝো ভাবি। শুভ্রতার ক্লান্ত মাথা তার একটা কথারও মর্মার্থ করতে পারলো না। কথার মাঝে মাঝে দুই একবার মাথা নাড়লো শুধু। মেঝো ভাবি বেরিয়ে যাওয়ার পর রাত বারোটার দিকে রুমে এলো সাদাফ। রুমে ঢুকে দরজায় ছিটকানি লাগিয়েই আলমারি খুললো সাদাফ। শুভ্রতার ঘোমটার আড়াল থেকেই সাদাফের গতিবিধি লক্ষ্ম করছে। সাদাফ আলমারি বন্ধ করে শুভ্রতার পাশে গিয়ে বসল। কোনো ভূমিকা না করে বলল,

—–” সারাদিন এই বস্তাবাস্তি পড়েই বসে আছো। ওয়াশরুমে গিয়ে দ্রুত চেঞ্জ করে নাও। শর্ট টাইম শাওয়ার নাও ভালো লাগবে। আমি অপেক্ষা করছি, যাও।”

শুভ্রতাকে উঠতে না দেখে, সাদাফ মজার ছলে বলল,

—-” আমার সাহায্য লাগবে?”

শুভ্রতা ঘোমটার ভেতর থেকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই উঠে দাঁড়ালো। সাদাফের হাত থেকে শাড়ি আর তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতেই হাত টেনে ধরলো সাদাফ। শুভ্রতাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলল,

—-” গায়ের জিনিস খুলতেই তো তিনদিন লাগবে তোমার। অলরেডি বারোটা বেজে গিয়েছে। আজ আর বাসর রাত-টাত কপালে নেই আমার। আসো আমি হেল্প করছি।”

শুভ্রতা থম ধরে বসে রইল। সারাদিন একটা খবর না নিয়ে এখন এতো আদিখ্যেতা একদম ভালো লাগছে না শুভ্রতার। সাদাফের চুলগুলো টেনে ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। শুভ্রতা এতোক্ষণে সাদাফের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। সাদাফ গভীর মনোযোগে শুভ্রতার হাতের চুড়ি খুলছে। সাদাফের চোখে-মুখের স্নিগ্ধতা দেখে মনে হচ্ছে সে ফ্রেশ হয়েই রুমে এসেছে। কাপড় পাল্টে সুতি একটা পাঞ্জাবি পরেছে। শুভ্রতার বুকটা অদ্ভুত এক ভালো লাগায় আপ্লুত হয়ে উঠল। এই মানুষটা এখন সারাটাক্ষণ তার সাথে, তার সামনে থাকবে ভাবতেই সারা শরীরে শীতল শিহরণ বয়ে গেল।

#চলবে….

( রি-চেইক করা হয় নি)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here