মন মুনিয়া পর্ব-৮

0
1967

#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম-০৮

এই মুহূর্তে মনির ঠিক মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে নিয়ান। ওর চোখেমুখে খুশির ঝলক। তবে সমপরিমাণ বিরক্তি নিয়ে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছে মনি। নিয়ান সেটাকে অগ্রাহ্য করে অস্পষ্ট ভাবে মনিকে বললো
-আজ আমাদের বাড়ি আসোনি কেন?
-ইচ্ছা করছে তাই। আপনে কেন আইলেন?
-তোমাকে দুদিন ধরে দেখিনা। তাই দেখতে আসলাম।
-আপনে চইলা যান। আব্বায় দেখলে আমারে অনেক কথা শুনাইবো।
-খুব ভয় পাও বাবাকে?

মনি নিচের দিকে তাকালো। নিশ্বব্দে মাথা নাড়িয়ে বললো
-হু।
-তোমার কাল বিয়ে ছিলো?
মনি খানিক চমকালো নিয়ানের কথায়। এই কথা টা তো নিয়ানের জানার কথা না। মনি লজ্জায় আবারও মাথা নিচু করলো। নিয়ান সেটা লক্ষ্য করে নিশ্বন্দে হেসে বললো
-লজ্জা পাবার মতো কিছু হয়নি মনি। আমি তো তোমার বন্ধু তাইনা?
মনি একদৃষ্টিতে তাকালো নিয়ানের দিকে। নিয়ান চোখের ইশারায় আবারও জিজ্ঞেস করলো
-কি, আমি তোমার বন্ধু তো?
-না।
-কেন?
-আপনে আমার চাইতে অনেক বড়, আর বড়লোকও।

নিয়ান আড়চোখে তাকালো মনির দিকে। মনি এখনো ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। নিয়ানের তাকানো দেখে মনি লজ্জা পেলো, সে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো তৎক্ষনাৎ। নিয়ান স্বাভাবিক গলায় বললো
-তোমার কি এমন মনে হয়, বন্ধুত্বে সমবয়সী হওয়া আর পারিবারিক সামর্থ্য থাকাটাই মুখ্য ব্যাপার?
-হুম।
-এমন মনে হবার কারণ?
-জানিনা।
-তুমি কি আমার বন্ধু হতে চাওনা?

নিয়ানের কথায় মনি অদ্ভুতভাবে তাকালো তার দিকে। তারও ইচ্ছে করে কেউ তার বন্ধু হোক। এমন বন্ধু, যাকে মনের সব কথা বলা যাবে, সব সময় পাশে পাওয়া যাবে। তবে নিয়ান আর তার মাঝে যেই আকাশ পাতাল ব্যবধান, তাতে ব্যাপারটা এমন হবে যেন সে বামন হয়েও চাঁদের দিকে হাত বাড়াবার দুঃসাহসিক কাজটা করতে চেয়েছে।

নিয়ান এবার বলল
-আমি এক থেকে তিন পর্যন্ত গুনবো, এর মধ্যে যদি তুমি আমার সাথে বন্ধুত্ব করতে রাজি হও তো ভালো, আর তা না হলে…
-তা না হলে কি? ভয়ার্ত গলায় বললো মনি।
-তা নাহলে আমিও জয়নাল হবো। উঠিয়ে নিয়ে যাবো তোমাকে।

মনি ভ্রু বাকালো, মনে মনে হাসিও পেলো বেশ। কারণ সে এটা ভালো করেই জানে, নিয়ান দুষ্টুমি করে এই কথাটা বলেছে।
-এই গুনা স্টার্ট করলাম। এক…….. দুই…

তিন বলার আগেই মনি হাত উচু করে নিয়ানকে থামিয়ে দিলো। নিয়ান হেসে মনির সামনে ওর এক হাত বাড়িয়ে বললো
-ফ্রেন্ডস?
মনি সেই হাতের দিকে একবার তাকিয়ে বললো
-হুম।
নিয়ান হাত গুটিয়ে নিয়ে বললো
-গুড গার্ল। কিন্তু হ্যান্ডশেক করলেনা কেন?
-আমার সরম করে। লজ্জার হাসি হেসে বললো মনি।।
নিয়ান বিড়বিড় করে বললো
-আহারে, আমার লজ্জাবতী বান্ধবীটা।
মনি আবারও লজ্জায় নেতিয়ে গেলো। এবার প্রসঙ্গ পালটে নিয়ান বললো
-আমি কিন্তু তোমার উপর খুব রেগে আছি মনি।
-কেন?

-আনফরচুনেটলি তোমার বিয়ে হতে যাচ্ছিলো। এতোক্ষণে তুমি অন্যের ঘরের বউ হয়ে যেতে, আমাকে কেন জানাও নি?
-আপনেরে কইলে কি হইতো?
-তোমার বিয়ে খেতে আসতাম।
মনি চোখ বড় বড় করে তাকালো নিয়ানের দিকে। ওর এমন তাকানো দেখে হাসলো নিয়ান। এরপর বলল

-ওই মায়াময় চোখদুটো কিন্তু বেশ সুন্দর। যেভাবে আছে সেভাবেই রেখো, বিকৃত করো না। বাজে লাগে।
-আপনে এখন যান এইখান থেইকা। আম্মা দেখলে খবর আছে আমার।
-ওকে। কাল এসো কিন্তু আমাদের বাড়ি। ভুলে যেও না, আমার এখানে কোনো বন্ধু নেই, আমি নিঃসঙ্গ।
মনি ঘরের দিকে ছুটতে ছুটতে বললো
-ওইখানে গেলেও আমি পড়তে যামু, আলাপ করতে না।
-দেখা যাবে।

রাতে খাওয়া যাওয়া শেষে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো মনি। দুইদিন মনের মধ্যে খুব অশান্তি থাকলেও অকারণে আজ বেশ ভালো লাগছে তার। বার বার ইচ্ছে করছে মন খুলে সে হাসুক আজ, কিছুক্ষণ সারা ঘর জুরে লাফালাফি করুক, মনের আনন্দে নেচে বেড়াক পুরো উঠান জুরে। মনি বার বার হাসছে, তবে নিশ্বব্দে।

ব্যাপারটা চোখে আসলো মনির মায়ের। তিনি গম্ভীরমুখে কিছুক্ষণ পরখ করলেন মেয়ের ব্যবহার, এরপর শক্ত গলায় বললেন
-আইজ মনের মইধ্যে অতো ফুর্তি কেন?
মায়ের কথায় হাসি থামিয়ে দিলো মনি। কাচুমাচু মুখ করে বললো
-কই কিছু নাতো।
-পুলাডা কেডা?
চমকিত হলো মনে। বিস্ময়ে তাকালো মায়ের দিকে। না জানার ভান করে বললো
-কার কথা কও মা?
-সন্ধ্যার আগে যেই পুলাডার লগে কথা কইছোস তার কথা কইতাছি। কেডা পুলাডা?

মনি মায়ের কথায় ভয় পেয়ে গেলো বেশ, এমনিতেও ভয় পাবার মতো করেই বেশ শক্ত গলায় কথা বলছেন তিনি। মনি কিছু বুঝে উঠতে না পেরে আমতা আমতা করে বললো
-আমি চিনি না।
-দেখ মনি, আমার লগে মিছা কথা কইবিনা। পুলাডা কেডা কইয়া দে। নইলে কিন্তু কথাডা তোর বাপের কানে যাইবো।

মনি চোখের পানি ছেড়ে দিলো এবার। কাদতে কাদতে বললো
-আমি চিনিনা কইলাম তো।
মনির মা কিছুক্ষণ মেয়ের দিকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে রইলো। এরপর আবারও ঝাঝলো গলায় বললো
-তয় একলা একলা অতো হাসতাছোস কেন?
মনি কোনো উত্তর দিলোনা মায়ের কথায়।।

মনির মা কিছুক্ষণ নিজে নিজে কি যেনো ভাবলো। সন্ধ্যার আগে একটা সুদর্শন ছেলেকে সে দেখেছে, তবে মনির সাথে দেখা করতে বা কথা বলতে দেখেন নি উনি। উনি ব্যাপারটাকে স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছিলেন। হয়তো, এ রাস্তা দিয়েই কোথাও গিয়েছলো বা যাচ্ছে।

তবে সন্ধ্যার পর থেকেই মনির এমন অদ্ভুত আচরণে তিনি দুইয়ে দুইয়ে চার ভেবে নেন। মনের এই অজানা সন্দেহ থেকেই মনিকে এই উদ্ভট প্রশ্ন করেন তিনি। আন্দাজে ঢিল ছুড়ে দেন মনির দিকে। তবে এবার তিনি নিশ্চিত, যে এই ছেলেকে মনি সত্যিই চিনে না।

পরেরদিন নিয়মমাফিক আবার স্কুল ছুটির পর স্যারের বাড়ি যায় মনি। যাওয়ার পথে স্যারের বাড়ির সামনেই নিয়ানের মুখোমুখি হয় সে। তবে ইতিসহ বাকিরা থাকায় তাকে এড়িয়ে সামনে যেতে লাগে মনি। নিয়ান অবাক হয় ব্যাপারটায়। সে বাকিদের অগ্রাহ্য করে মনির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তবে দৃষ্টি মনির দিকে নয়, অন্যদের দিকে। ইতি খুশি হয় এই ভেবে, নিয়ান হয়তো তার সাথে কথা বলতে এসেছে।

সে অতি উৎসাহ নিয়ে হাসিমুখে তাকিয়ে থাকে নিয়ানের দিকে। তবে ওর সমস্ত উৎসাহে পানি ঢেলে নিয়ান মনির হাতে ধরে টান দেয়। ওদের মাঝখান থেকে সামান্য দূরে এনে ফিসফিসিয়ে বলে
-মাত্র একদিনেই আমাকে এভয়েড করছো?
মনি হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে অপরাধীর মতো বাকিদের দিকে তাকায়। বাকিরা অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে মনির দিকে। তবে ইতির মুখের ভাবভঙ্গি দেখে বুঝা গেলোনা, সে আদৌ রেগে আছে নাকি অবাক হয়েছে।

নিয়ান সকলের ভাবমূর্তি দেখে বুঝতে পারলো সে ঠিক কতোটা অযৌক্তিক একটা আচরণ করেছে। যদিও ওদের ভার্সিটিতে এইসব ডালভাত। নিয়ান বাকিদের দিকে তাকিয়ে বললো
-কি ব্যাপার? সবাই এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? আমি কোনো মানুষ খুন করিনি, আমার বান্ধবীর হাত ধরেছি মাত্র, সিম্পল একটা বিষয়।
-মনি আপনার বান্ধবী? ভ্রু বাকিয়ে বললো ইতি।
-হুম। তোমার কোনো প্রব্লেম?
-অবশ্যই।
-এক সেকেন্ড, কি সমস্যা তোমার?
-সমস্যা আমার না, সমস্যাটা আপনার। ভালো ভার্সিটিতে পড়লেও রুচি বেশ খারাপ। আমি ভেবেছিলাম, আপনার রুচি বেশ উচুমানের। কিন্তু, আমার ভাবনাটা ভুল।

ইতি হনহন করে উল্টোপথে হাটা ধরলো। আজ সে আর পড়বেনা। মন মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেছে তার। নিয়ান বাঁকাচোখে তাকিয়ে দেখছে ইতির চলে যাওয়া। ইতি সম্পুর্ন চোখের আড়ালে চলে গেলে বাকিরাও রুমে চলে গেলো। মনি ইতস্ততভাবে বলল
-আপনে কেন আমার হাত ধরলেন। সবাই কি মনে করবো এখন?
-কে কি ভাবলো সেটা একান্তই ওদের ব্যাপার। আমি আমার বন্ধুর হাত ধরতেই পারি। হাত ধরাতে কেউ নিশ্চয়ই কলঙ্কিত হয়ে যায়না?

মনি লজ্জা পেলো নিয়ানের কথায়। সে কোনোমতে সেখান থেকে চলে আসতে চাইলো। তবে আবারও বাধ সাধলো নিয়ান। সে উৎসাহ নিয়ে বললো
-এই মেয়েটা এভাবে রিয়েক্ট করলো কেন?
-আমি জানিনা।
-তুমি জানো। বলো আমাকে, ওই মেয়ের এভাবে রিয়েক্ট করার কারণ কি?
মনি আড়চোখে তাকালো নিয়ানের চোখে। কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে বললো
-ইতি বোধহয় আপনারে পছন্দ করে।

নিয়ান হাসলো মনির কথায়। এরপর দুষ্টুমি করে মনির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো
-আমার প্রেমিকার সাথে কিছুদিন ধরে খুব মনোমালিন্য চলছে। ব্যাপার না, সে চলে গেলে ওকে মানিয়ে নিবো। কি বলো?
মনি অদ্ভুতভাবে তাকালো নিয়ানের দিকে। অস্ফুটে বলল
-কি কন আপনে এইগুলা?
-কেন, এমন করলে কি খুব খারাপ হবে? আমার প্রেমিকার চাইতে এই মেয়েটা অনেক বেশি সুন্দর।

মনি ভ্রু নাচিয়ে বললো
-আপনে যা খুশি তা করেন, আমার লগে আপনের কোনো কথা নাই।
মনি চলে যেতে নিলে ফিক করে হেসে ফেললো নিয়ান। মনি আবারো রাগী চোখে তাকালো নিয়ানের দিকে।
মুখের হাসিটা অক্ষত রেখে মনির দিকে কিছুটা ঝুকে দাঁড়িয়ে নিয়ান বললো
-রাগ করো না প্রিয় বান্ধবী, আমি জাস্ট মজা করছিলাম।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here