মন মুনিয়া পর্ব-১৩

0
1805

#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম -১৩

শীতের তীব্রতা যাকে জমাতে পারেনি, এই একটা মুহূর্ত তাকে পুরোপুরি জমিয়ে দিলো। মনি পাথর হয়ে গেছে, কথা বলতে ভুলে গেছে সে।

স্কুল থেকে আসার পর অনেক বার কথা বলতে চেয়ে বলতে পারেনি মা। মেয়েটার ইদানিং কি হলো ভেবে অস্থির হোন তিনি। মনি গায়ে মাখেনা সেটা।

পরের দিন সকাল সকাল হামিদ স্যারের বাড়ির দিকে রওনা দেয় মনি। ওর বাবা মা হটাৎ স্যারের বাড়ি যাবার কারণ জানতে চাইলে মনি কিছুটা কাচুমাচু করে উত্তর দিয়ে বলে
-স্যার কিছু নোট দিবে, সেইটা আনতে যাইতেছি।
রহিম মিয়া আবারও বললো
-কিন্তু তোর তো পরীক্ষা শেষ।

মনি হাসলো। মুখের হাসিটা অটুট রেখে বাবার দিকে ফিরে বললো
-আমার পরীক্ষা শেষ হইলে তো আমারে বিয়া দিয়াই দিতা। আমার এখনো প্র‍্যাক্টিক্যাল পরীক্ষা বাকি আছে আব্বা। সেই প্র‍্যাক্টিক্যালের বিষয়েই স্যার কিছু বলবো।

রহিম মিয়া মাথা নাড়িয়ে বললো
-ওহহো তাইতো। আমি ভুইলাই গেছিলাম। আইচ্ছা মা যা, তয় সাবধাইনে যাইস।

মনি আর কোনো উত্তর দিলোনা। সে হাটতে লাগলো সোজা বরাবর।

২০ মিনিটের রাস্তা প্রায় বারো তেরো মিনিটে চলে এসেছে মনি। স্যার আজ বাড়ি নেই সেটা সে জানে। এই মুহূর্তে তিনি স্কুলেই থাকেন বরাবর। আর সেই সুযোগেই সে নিয়ানের সাথে দেখা করবে৷

মনি স্যারের বাড়ি ঢুকে প্রথমে অবাক হলো। পড়ার রুম থেকে কারো ফিসফিসিয়ে কথা বলার আওয়াজ আসছে। এই সময়ে এখানে কে থাকতে পারে?
আর নিয়ান কোথায়? খুজতে থাকে মনি।

এক সময় কোথাও নিয়ানকে না পেয়ে পড়ার রুমে ঢুকে গেলো সে। নিয়ান আর ইতি বসে আলাপচারিতা করছে। ওরা মনিকে লক্ষ্য করলোনা। ইতির মুখে অফুরন্ত হাসি, গোলাপের ন্যায় স্নিগ্ধ সেই হাসিমাখা মুখটার দিকে এক নজরে তাকিয়ে আছে নিয়ান।

মনির বুকে মোচড় দিলো, সে সহ্য করতে না পেরে জলদি সরে গেলো সেখান থেকে। তবে সরে আসার সময় রুমের দরজার সাথে তার শরীরের ধাক্কা লাগে, তাতে কিছুটা শব্দ হয়।

নিয়ান আর ইতি অপ্রস্তুত হয়ে পরে তখন। ওরা জলদি সেখান থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলতে থাকে
-কে, কে ওখানে?
মনি আর আড়ালে না থেকে ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ইতির কপালে সুক্ষ্ম ভাজ পরে তাতে। নিয়ান অবাক হয় এই বেলা এখানে মনিকে দেখে।

ইতি সামান্য বিরক্ত হয়ে বলে
-তুই এইখানে কি করিস?
-তুমি এইখানে স্যারের ছেলের লগে খালি ঘরে কি করো? পালটা প্রশ্ন করে মনি।
মনির কথায় ভড়কে যায় ইতি। আমতাআমতা করে বলে
-আমি স্যারের সাথে দেখা করতে আসছিলাম। আচ্ছা আমি গেলাম।

ইতি পালানোর মতো করে চলে যায়। নিয়ান অবাক হয়ে তাকায় মনির দিকে। মনি এবার সামান্য রাগি চোখে তাকালো নিয়ানের দিকে। নিয়ান সে দৃষ্টির মানে বুঝতে না পেরে বললো
-হটাৎ এখানে কেন এসেছো মনি, কোনো বিশেষ দরকার কি?
মনি চাপা গলায় বললো
-হুম দরকার।
-কি?
-তার আগে কন ইতির লগে আপনে কি করতাছিলেন?

নিয়ান স্বাভাবিকভাবেই হাসলো। বললো
-কিছু করছিলাম না তো। বাবার সাথে দেখা করতে আসছিলো মেয়েটা, বাবা নেই তাই একটু গল্প করছিলাম।
-আমি যতদূর জানি গল্প করার মতো সম্পর্ক ওর সাথে আপনের ছিলোনা। তাইলে কি এইবার আমার পরিবর্তে ওরে বান্ধবী বানাইছেন?
-হিংসে করছো?
-আমার মতো মাইয়ার হিংসা সাজেনা।

-কেন এসেছো সেটা বলো?
-বিরক্ত হইতাছেন মনে হয়?
-বিরক্ত হচ্ছিনা। আমার কিছু কাজ আছে। সেগুলো কমপ্লিট করতে হবে।
-এতোক্ষণ বুঝি কোনো কাজই ছিলোনা?
-আহ মনি, এতো প্যাচ ধরোনা তো। কোনো দরকার থাকলে বলো।
মনি অসহায়ের মতো তাকালো নিয়ানের দিকে। শান্ত গলায় বললো
-আমারে বিয়া করবেন?

মনির কথাটা নিয়ানের কানে একটা ফানি জোক্সের মতো লাগলো। সে হাসতে হাসতে বললো
-তুমি কি অসুস্থ মনি? হটাৎ উল্টাপাল্টা কি বকছো কোনো ধারণা আছে তোমার?
-আমার পেটে আপনের বাচ্চা। আমি মা হইতে যাইতাছি।

নিয়ানের মাথায় বাজ পরলো। সে বিস্ফোরিত গলায় বললো
-মানে?
-মানেটা সোজা। যেইটা শুনলেই সেইটাই। আমারে আপনে বিয়া করবেন। নইলে আমার মরন ছাড়া উপায় নাই। করবেন আমারে বিয়া?
মনির চোখের পানিগুলো অনবরত পরছে।।

নিয়ান চিন্তিত গলায় বললো
-উতলা হয়োনা মনি। আমাকে বুঝতে দাও ব্যাপারটা। তুমি যেটা বলছো সেটা কি সত্য?
-আপনের কি মনে হয় আমি মিথ্যা কইতাছি?
-না, আমি জানি তুমি মিথ্যা বলবে না। তবে আমার মানতে কষ্ট হচ্ছে ব্যাপারটা।
-আপনে আমার ক্ষতি করছেন সেটা মানেন তো?

নিয়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো মনি। নিয়ান সে কথাকে উপেক্ষা করতে না পেরে বললো
-আমি অস্বীকার করবোনা সেটা। তবে তাই বলে বিয়ে?
-তাইলে আমারে কি করতে কন?
-আমাকে একটু সময় দাও মনি। একটু ভাবতে হবে।।
-ভাবাভাবির কিছুই নাই। হয় আমারে বিয়া করবেন নয় আমি গলায় দড়ি দিমু।।
-পাগলামো করোনা মনি, শান্ত হও। আমি বুঝতে পারছি তোমার মনের উপর দিয়ে কি বয়ে যাচ্ছে।

নিয়ান কিছুক্ষণ চিন্তামগ্ন হলো। মনি সেদিকে তাকিয়ে রইলো অদ্ভুত ভাবে। এক পর্যায়ে নিয়ান বললো
-তোমার সমস্যাটা যেহেতু আমার দ্বারা হয়েছে, তাহলে সেটার দায়ভার সম্পুর্ণই আমার। আমি সে দায় বহন করতে প্রস্তুত। তুমি আজ বাড়ি যাও। আগামীকাল সকাল সকাল প্রস্তুত হয়ে চলে এসো। আশা করছি, ব্যাপারটা জানাজানি হবেনা, আর এটার বাহানায় কেউ তোমার দিকে আঙুল তুলেও ধরতে পারবেনা।

মনি স্বস্তি পেলো এবার। সে অসংখ্যবার নিয়ানকে ধন্যবাদ জানালো, ওর মতো একটা গরিব ঘরের মেয়ের দায়ভার সে বহন করবে। নিয়ান মনিকে হেসে শান্তনা দিলো, সে যেনো সাবধানে বাড়ি যায় তার জন্য বার বার হুশিয়ার করে দিলো।

বাড়ি ফিরে নিজেকে গতকালের তুলনায় আজ একটু হালকা লাগছে। সে এক সেট জামাকাপর নিয়ে কলপাড়ে চলে গেলো। মনের সাথে সাথে সে শরীরটাকে হাল্কা করতে চায়। তার জন্য আগে সুন্দর একটা গোসল প্রয়োজন।

দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ করে সে দাওয়ায় বসে আছে, এমন সময় কোত্থেকে যেনো মা ছুটে আসলো হনহন করে। আজ কি কাজে যায় নাই? মনে মনে ভাবে মনি।।

মনির মা এসেই মেয়ের দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকায়। মনি অবাক হয় সে তাকানো দেখে। তিনি দৃষ্টি সরিয়ে তারাহুরো করে ঘরে ঢুকে পরে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আবারও হাতে একটা কি যেনো নিয়ে বেরিয়ে আসেন তিনি। এসেই মনির সামনে বসে পরেন।

মনি অবাক হয়ে বলে
-কিছু কইবা?
-এইডা কি? গতকালের সেই প্রেগন্যান্সির স্টিকটা মনির সামনে ধরে বলেন উনি।।

মনি হকচকিয়ে যায় মুহুর্তের মধ্যে। অসম্ভব রকমের ভয় কাজ করে মনের মধ্যে। এই বুঝি মা সবটা জেনে গেলো। তবে ভয়টা মায়ের সামনে প্রকাশ করেনা সে। কিছু জানে না এমন একটা ভাব নিয়ে বলে
-এইডা কি মা?
মনির মা রেগে গিয়ে বলে
-আমারে জিগাস কেন, আমি তোরে জিগাইতাছি। এইডা এই বাড়ি আইলো কেমনে?

মনি আবারও অভিনয় করল, সে বললো
-আমি কেমনে জানি, এইডা দিয়া কি করে? ও মা কও না এইডা দিয়া কি করে? কইত্তে পাইলা এইডা?.
-তুই সত্যিই জানোস না এইডার ব্যপারে? সন্দিহান গলায় বললো মনির মা।
-না তো।

-তয় এইটা আমাগো বাড়ি আইলো কেমনে?
-কই ছিলো এইডা?
-কলপাড়ে পইরা আছিলো।
-তয় বোধহয় পোলাপাইনে আইনা ফেলাইছে।
-কিন্তু আমাগো বাড়ি তো কোনো পোলাপাইন নাই।
-হয়তো কেউ আইছিলো। পাড়ায় কি পোলাপাইনের অভাব আছে।
-হইবো হয়তো।

মনির মা বিস্ময়ে সেটা দেখতে দেখতে উঠে চলে গেলেন। এটা পাবার পর থেকে উনার মনে কু ডাকছিলো। বাড়িতে মনি ছাড়া আর কেউ নেই, কয়দিন যাবত মনিটারেও অন্যরকম লাগে। মনিই এইরকম আকাম কিছু ঘটাইছে কিনা চিন্তা করেই উনার মাথা গরম হয়ে গেছিলো।

মা উঠে চলে যাবার পর গাটা ঝেড়ে একটা লম্বা নিশ্বাস টানলো মনি। একটা সত্য ঢাকতে গিয়ে কতোগুলো মিথ্যা বলেছে সে মায়ের সাথে।

মনির খুব অবাক লাগছে এবার। সে কখনো কারো সাথে মিথ্যা বলতোনা, বিশেষ করে মায়ের সাথে তো বলতোই না, আর এখন সে কতো সুন্দর করে গুছিয়ে মিথ্যা বলা শিখে গেছে।

সন্ধ্যায় রান্নার বন্দোবস্ত করে চুলার কাছে গেলো মনি। মায়ের শরীরটা আজ ভালো লাগছেনা, তাই আজ মনিই রাধবে।

রহিম মিয়া আজ জলদিই বাড়ি ফিরেছেন। এসে গরুটাকে পানি খাইয়ে সেটাকে রান্নাঘরের এক কোনে নিয়ে বেধে দিলেন। এরপর দাওয়ায় বসে বিড়ি টানতে ব্যস্ত হলেন।

মনির মা শুয়ে থেকে মনিকে বলে দিচ্ছে কিভাবে কি করবে না করবে। মনি মায়ের নির্দেশ মতো কাজ করে যাচ্ছে।

সন্ধ্যে মিলিয়ে অন্ধকার হয়ে এলো এবার। ওর রান্না এখনো শেষ হয়নি। রহিম মিয়া দাওয়া থেকে উঠে ঘরে যাবার জন্য পা বাড়ায়। এমন সময় বাড়ির দেউড়ির মুখ দিয়ে বাড়িতে কারো ঢুকার আওয়াজ পায় উনি। ঘরে যেতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পরেন। সশব্দে জিজ্ঞেস করেন
-কেডা, কেডায় ওইখানে?

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here