মন মুনিয়া পর্ব-২১

0
1709

#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম -২১
(বোনাস পর্ব)

রাতের খাবার খেয়ে আশার রুমে এসে বসে রইলো মনি। এতো আদর আপ্যায়নের মাঝেও মনটা তার ভালো নেই। বার বার মায়ের কথা মনে পরছে। আশার মা যেভাবে ওকে কথায় কথায় মা বলে সম্বোধন করছে তাতে মাকে সে অধিকতর ভাবে মিস করছে।

আশার রুমের সাথে লাগোয়া একটা বারান্দা আছে। মনি ধীরপায়ে সেই বারান্দায়টায় গেলো। বারান্দার কর্নারে একটা ইজি চেয়ার পাতা। মনি সেটা খেয়াল করেও বসলোনা। কেন জানি মনে হলো, এটাতে বসে সে শান্তি পাবেনা, হয়তো উল্টে পরে যাবে।

বারান্দার গ্রিল ধরে সে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরের আবছা আলোতে দুরের গাছগাছালি আর কয়েকটা টিনের বাড়িঘর চোখে পরছে তার। একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে মনি।

বহুদিন পর মা আর ভাবীকে পেয়ে তাদের সাথে আড্ডায় মত্ত হয়েছে আশা। মনের কোনে জমিয়ে রাখা না বলা কথাগুলো আজ মন খুলে শেয়ার করছে তাদের কাছে। বেশ ফুরফুরে রাখছে তার। গল্প আড্ডার এক পর্যায়ে হিমা বললো
-কিরে আশা, তোর সাথে মনি নামের যে মেয়েটা এসেছে সে কোথায়? সেই যে খেয়ে গেলো, আর তো এলোনা।
-হয়তো আমার রুমে।
-মেয়েটা অনেক চুপচাপ, খুবই শান্তশিষ্ট।
-হয়তো।

আশার মুখটা মলিন দেখালো। হিমা আর রাবেয়া সেটা খেয়াল করে বললো
-তোকে এমন দেখাচ্ছে যে? কিছু কি হয়েছে?

আশা লম্বা একটা শ্বাস টেনে বললো
-তোমাদের একটা কথা বলবো, বাজে রিয়েক্ট করবে না তো?
-কি এমন কথা বলবি যে বাজে রিয়েক্টের কথা আসছে?
আশা কিছুক্ষণ সময় নিলো নিজেকে ধাতস্থ করতে। এরপর বলতে শুরু করলো
-আসলে মনিকে আমিই নিয়ে এসেছি, কিন্তু বেড়ানোর জন্য নয়।
-তাহলে কিসের জন্য? অবাক হয়ে বললো রাবেয়া।
-ও এখানে থাকবে মা।

আশার কথা শুনে ওর মুখের দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে রইলো হিমা। রাবেয়া বললো
-মেয়েটার কি কেউ নেই?
-সবই আছে মা। ওর মা আছে, বাবা আছে, ছোট্ট একটা বাড়িও আছে। হয়তো গরিব তবে ভালোই সুখে ছিলো সে। তবে ওর সাথে একটা বাজে দুর্ঘটনা ঘটে গেছে।
-কি দুর্ঘটনা? আতঁকে উঠলেন রাবেয়া। হিমাও হন্তদন্ত হয়ে বললো
-কি হয়েছে তারাতাড়ি বল।

আশা দরজার দিকটায় একবার তাকালো। মনি এদিকে আসছে কিনা সেটা দেখার জন্য। রাবেয়া আর হিমা প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো আশার দিকে। আশা বলতে শুরু করলো পুরো ঘটনাটা।

_____
আশার মুখে পুরো ঘটনাটা শুনে কিছুক্ষণের জন্য নির্বাক হয়ে গিয়েছিলো রাবেয়া আর হিমা। এইটুকু একটা মেয়ের সাথে এটা কি ঘটে গেলো। যে বয়সটা তার লেখাপড়ার বয়স, যে বয়সে অনেকে প্রেম ভালোবাসার মানেই বুঝেনা সেই বয়সে এইটুকু একটা মেয়ে বাচ্চা পেটে নিয়ে ঘুরছে। তাও সেটা তার নিজের ভুলে নয়, পরের ভুলের বোঝা এই ছোট্ট একটা মেয়ে বয়ে বেরাচ্ছে।

হিমা খানিক ক্ষীপ্ত কন্ঠে বললো
-ওই ছেলেটার নামে সে নালিশ বসাতো, ওর বাবা মাকে জানিয়ে ওই ছেলের বিচারের ব্যবস্থা করা উচিৎ ছিলো।
-সেটা যদি পারতো তাহলে তো হয়েই যেতো। প্রথমত ওর বাবা খুবই বদমেজাজি আর লোভী। এর আগে সে মনিকে টাকার বিনিময়ে একটা মাতাল লোকের সাথে বিয়ে করাতে চেয়েছিলো।
-বলিস কি? বিস্ফোরিত গলায় বললো রাবেয়া।
-হুম মা। ওর বাবাকে যদি এই কথা বলতে যায়, তাহলে ওর বাবা ওকে মেরে ফেলতে দুইবার ভাববেনা।
-এমন বাবাও আছে দুনিয়াতে? করুণ কন্ঠে বললো হিমা।

-হুম আছে। প্রথমত এটা একটা কারণ। দ্বিতীয়ত যে ছেলে এটা করেছে তার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড খুবই ভালো। নামি-দামি মানুষ ওরা। তাই ওদের সাত খুন মাফ। ওরা কোনো ভুল করলেও কেউ কোনো পদক্ষেপ নিবেনা। ইনফ্যাক্ট, অন্যরা কিছু করার আগে ওরাই এটা টাকা দিয়ে ধামাচাপা দিয়ে দিবে।

সেদিন রাতে আর কেউ মনিকে বিরক্ত করলোনা। শুধু আশা এসে তাকে অন্য একটা রুমে শিফট করার জন্য নিয়ে গেলো। সেই সময়টায় প্রশ্নবিদ্ধ কন্ঠে মনি বলেলো
-এইটা কার রুম আশাপু?
-এইটা আমার ছোট ভাইয়ার রুম মনি।
-ওহ, তয় আমি এইখানে থাকলে তোমার ভাই কই থাকবো?

আশা হাসলো। ঠোঁটের কোনে হাসিটা অটুট রেখে বললো
-আমার ছোট ভাইয়া বাড়িতে থাকেনা মনি। সে লন্ডন থেকে লেখাপড়া পড়া।
মনি অবাক হয়ে বললো
-তোমার ভাই কি ছোটবেলা থেকেই বিদেশ থাকে?
-নাহ। বাংলাদেশের লেখাপড়া শেষ করে হাইয়ার এডুকেশনের জন্য সে স্টুডেন্ট ভিসায় লন্ডন গিয়েছে।

মনি এতোকিছু বুঝলো না। তাই ছোট্ট করে বললো
-ওহ।

রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলেও মনি ঘুমালোনা। তীব্র একটা যন্ত্রণা ওকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। মনি বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো। আশেপাশে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে।

মনি ধীরে ধীরে বিছানা ছেড়ে উঠে হাতড়ে হাতড়ে সুইচবোর্ডটা খুঁজে বের করে ঘরের লাইটটা জ্বালালো। এরপর বিছানায় গিয়ে আবারও বসে পরলো সে। দুপা ভাজ করে বসে হাটুর উপর মাথা রেখে কিছুক্ষণ বসে রইলো মনি। এভাবে এতোক্ষণ সময় পার হলো তার জানা নেই।

একটা সময় দরজায় টোকা পরলো। এতো রাতে কে আসতে পারে ভাবতে লাগলো মনি। আশাপু এসেছে?

মনি ধীর পায়ে উঠে গেলো দরজার সামনে। আস্তে করে দরজাটা খুলতেই দেখতে পেলো রাবেয়া দাঁড়িয়ে আছে। মনি কিছুটা অবাক হলো, তবে সেটা প্রকাশ না করে মুচকি হেসে বললো
-আন্টি আপনে?
রাবেয়া ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো
-ঘুমাও নি এখনো?
-ঘুম আইতেছে না।
-আমি পানি খেতে উঠেছিলাম। দেখলাম তোমার ঘরের লাইট জ্বালানো, ভাবলাম কোনো সমস্যা হলো কিনা। তাই আসলাম।

মনি মুখে হাসির রেখা টেনে বললো
-আমার মতো আপনেও ঘুমান নাই?
-আমি ঘুমিয়ে পরেছিলাম। তোমার আঙ্কেল আসলো মাত্রই, উনিই ডেকে তুলেছেন আমাকে।
-ওহ, তাই জন্যই আঙ্কেলরে দেখি নাই তখন।
-হুম।
-ঘুম আসছেনা কেন? অসুস্থ লাগছে?
-নাহ আমি ঠিক আছি আন্টি। হয়তো নতুন জায়গা, তাই ঘুম আইতেছেনা।
-হবে হয়তো। তোমার কে কে আছে?

মনির মুখটা মলিন হয়ে গেলো রাবেয়ার করা প্রশ্নে। তিনি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বললেন
-থাক বলতে হবেনা। আশা বলেছিলো আমাকে, কিন্তু মনে ছিলোনা।
মনি হাসলো, তবে সে হাসি ছিলো দেখানো হাসি। সে হাসির আড়ালে যে ভেতরটা তার পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে।

রাবেয়া মনির মাথায় হাত রেখে বললো
-এবার লাইট অফ করে ঘুমিয়ে পরো মা। বেশি রাত জাগা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকারক। আর তোমার জন্য তো আরো বেশি ক্ষতি।
মনি মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। রাবেয়া চলে গেলে মনি দরজা লাগিয়ে লাইট অফ করে দিলো। ঘুম না আসলেও ঘুমানোর চেষ্টা তো করতে হবে।

পরের দিন সকালে পাখির কলকাকলি আর মোরগের ডাকে ঘুম ভাংলো মনির। জানলার স্বচ্ছ কাঁচের ভেতর দিয়ে রোদ এসেও উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে।

মনি বিছানা ছেড়ে নেমে বাথরুমে গিয়ে ঢুকলো। কিছুক্ষণ নাগাদ ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসে ঘর থেকে বাইরে বেরোলো সে।

রান্নার ঘরে আজ পিঠে পুলির আয়োজন চলছে। একমাত্র মেয়ে এতোদিন পর বাড়ি এসেছে তাই নিয়ে আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে যেনো। মনি ধীরপায়ে রান্নাঘরের পাশে গিয়ে দাড়ালো। আশা চুলার পাশে বসে আছে, হিমা চুলায় লাকড়ি দিয়ে আগুন ধরাচ্ছে। পাশেই রাবেয়া বসে হাতে হাতে পিঠে বানিয়ে দিচ্ছে।

মনিকে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আশা বললো
-কি মনি, ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন, ভেতরে আসো।
আশার কথার তালে তাল মিলিয়ে হিমাও বললো
-ভিতরে এসে বসো মনি, পিঠে খাও।
মনি ভিতরে গেলে ওকে বসার জন্য একটা মোড়া দেওয়া হলো। মনি সেখানে বসতে বসতে বললো
-আঙ্কেল আর ভাইয়া কই, উনারা খাইবোনা?
হিমা হেসে বললো
-ওরা সবাই খাবে। তুমি খাও তো আগে।

রাবেয়া মনির সামনে পিঠের থালাটা দিতে দিতে বলল
-একদম লজ্জা পেয়ো না। পেট ভরে খাও।
মনি হাসলো। একটা পিঠা হাতে নিয়ে খাওয়া শুরু করলো সে।

কিছুটা বেলা হয়ে এলে মনিকে নিয়ে বেরোলো আশা। প্রথমেই বাচ্চাদের কোচিং এর জায়গাটায় গেলো। মনি অবাক হল, গতকাল যেটা দেখে সে আশ্চর্য হয়েছিলো সেটাই কোচিং সেন্টার। মনি উৎসাহু কন্ঠে বললো
-আশাপু।
-বলো।
-এই কোচিংটার নামটা অদ্ভুত না?
-হুম।
-এইরকম নাম দেওয়ার কারণ কি? আমি কোনোখানে এমন নামের কোচিং দেখি নাই।

আশা হেসে বললো
-এটা আমাদের পুরোনো ঘর ছিলো। অনেক আগের ঘর এটা। এ ঘরেই নাকি আমার দুই ভাই আর আমি জন্মেছি। তাই বাবা এই ঘরটার নাম দিয়েছি নীলাশা।
-নীলাশা কেন?
-আমার বড় ভাইয়া নাম নিলয়, আর ছোট ভাইয়ার নাম নীল। আমার নাম আশা। ওদের দুই ভাইয়ের নাম থেকে নীল আর আমার আশা নাম একত্রে করে নাম দিয়েছে নীলাশা। আর এই ঘরে যেহেতু বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখানো হয়, তো আমাদের ইচ্ছে বাচ্চারা লেখাপড়া শিখে আলোর পথ দেখবে।

তাই বাবা অনেক চিন্তাভাবনা করে এই নামটা রেখেছে, “নীলাশায় আলোর দেখা”

মনি হেসে বললো
-আঙ্কেলের চিন্তাধারা অনেক সুন্দর আশাপু।
-হুম, তোমার পছন্দ হয়েছে আমাদের বাড়ি? থাকতে পারবে তো?
মনি মলিন কন্ঠে বললো
-থাকতে তো হইবোই। সবই পারমু।
-আমার একটা কথা রাখবে?
-কও আশাপু।
-তুমি আজ থেকে এভাবে কথা বলবেনা। সুন্দর করে কথা বলবে। সবসময় মাথায় রাখবে, তোমার কাছ থেকে বাচ্চারা শিখবে।
-চেষ্টা করমু।
-হুম।
-আমিতো কাল চলে যাবো, চলো তোমাকে আমাদের গ্রামটা একটু ঘুরে দেখিয়ে আনি।

মনির মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। সে নির্জীব কন্ঠে বললো
-কাইল চইলা যাইবা?
-উহু, হয়নি। সুন্দর করে বলো।
মনি হাসলো। আবার কথাটা রিপিট করে বললো
-কাল চলে যাবে আপু?
-হুম, যেতে তো হবেই। আর কয়দিন গেলে তুমি কোচিং এ জয়েন করবে। আমি ভাইয়া আর বাবার সাথে আলাপ করেছি। কোনো সমস্যা হবেনা তোমার। তুমি শুধু হাসিখুশি থাকবে আর বাচ্চাদের পড়াবে,, বুঝেছো?

আশার কথার বিপরীতে মাথা নাড়ালো মনি, তবে মুখে কিছু বললোনা।

চলবে….

[আগামীকাল থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় গল্প আপলোড করবো]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here