মন মুনিয়া পর্ব-২৮

0
1650

#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম -২৮

পৌষের শীতের ভয়ার্ত থাবা থেকে বাঁচার জন্য যখন সকলে কাথা কম্বলের দিকে পাড়ি দেয় সেই সময়টায় একা একা ছাঁদের এক কার্নিশ ঘেষে দাঁড়িয়ে থাকে মনি।
শীত পেরিয়ে বসন্ত আসে, প্রকৃতিকে ফুলে ফুলে সাজিয়ে অতঃপর গরমকে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে এসে সে বিদায় নেয়। দিন যায়, মাস যায়। কাছের মানুষগুলোও দূরে চলে যায়। তবে একাকীত্ব যেনো মনির থেকে কাছ ছাড়া হয়না। একাকীত্ব পণ করেছ, সে মনিকে সঙ্গ দিবে সবসময়।

সেদিনের পর আরো অনেকগুলো দিন পেরিয়ে গেছে। মাস চলে গেছে কয়েকটা। আশাপু চলে গেছে অনেক আগেই। পেটের ভিতর থাকা মানিকটাও বড় হচ্ছে ধীরে ধীরে। আর হয়তো বেশিদিন বাকি নেই তার আসার। সে কারণে কোচিং এ যাওয়া এখন তার বারণ। পাছে যদি কোনো বিপদ আপদ হয়।

মনি ভেবে পায়না, মানুষগুলো কেন তাকে এতো প্রায়োরিটি দেয়। মনের সমস্ত জল্পনা কল্পনা সে মনের মধ্যেই পুষে রাখে। কখনো কারো কাছে প্রকাশ করেনা।

মনি ফুরফুরে বাতাসের স্বাদ নিতে ছাদে গিয়ে বসে থাকে প্রায়ই। বাড়িটা একতলা হলেও ছাদটা অসাধারণ ভাবে বানানো হয়েছে। বসার জন্য প্লেস আছে, রোদের তাপ থেকে বাচার জন্য বসার প্লেসের উপরে সিমেন্টের তৈরি ছাতা বানানো আছে অনেক বড় করে। মনি সেখানেই দিনের বেশ কিছুটা সময় কাটায়। ছাদ বাগানে ফুটে থাকা অসংখ্য ফুল তাকে আনন্দ দেয়। সেই আনন্দ প্রাণভরে গ্রহন করে সে তৃপ্তি পায়।।

একদিন হটাৎ করে বিকেলের দিকে ব্যাথা উঠে মনির। প্রচন্ড ব্যাথায় ককিয়ে উঠে সে। সে সময়টায় সে ছাদেয় ছিলো।। অসহ্য ব্যাথা সইতে না পেরে সে জোরে চিৎকার করে হিমাকে ডাকে। হিমা পরিস্থিতি বুঝতে পেরে দৌড়ে আসে ছাদে। পিছন পিছন রাবেয়াও দৌড়ে আসে মনির কাছে। মনিকে এই অবস্থায় দেখে তারা দিশেহারা হয়ে যায়। এই অবস্থায় ওকে বাড়িতে না রেখে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত। বর্তমানে বাড়িতে বাচ্চা প্রসব করানোটা অনেক রিস্কি হয়ে যায়।।

হিমা ফোন করে নীলকে। নীল ছাড়া আর কোনো পুরুষই বাড়ির আশেপাশে নেই। সকলে কাজে ব্যস্ত। হিমার ফোন পেয়ে নীল ছুটে আসে তারাতাড়ি। পাড়ার কোনো এক গলীতেই সে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলো।

নীল ছাদে এসে মনিকে এই অবস্থায় দেখে হিমাকে বলে
-কি হয়েছে ভাবী।
-ওর প্রসব ব্যাথা উঠেছে। ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। একটা এম্বুলেন্স এর ব্যবস্থা করো তারতারি।
-আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি ভাবী।

নীল চলে যাবার পর রাবেয়া হিমাকে বলে
-মনিকে শক্ত করে ধর হিমা, দুজনে মিলে দেখি ছাদ থেকে নামাতে পারি কিনা।
-দেখছি।
রাবেয়া আর হিমা মিলে অনেক চেষ্টা করেও মনিকে সেখান থেকে উঠাতে পারেনা। হিমা হতাশ গলায় বলে
-পারছিনা মা। আমরা হয়তো পারবোনা। নীল আসুক।

মনির ব্যথা বাড়তে থাকে। ব্যাথার চোটে ছাদটা খামছে ধরতে চায় সে। সে ব্যর্থ চেষ্টাতে নখের কোনা ভেঙ্গে যায় তার। হিমা মনির মাথাটা ওর কোলে রেখে সেখানেই বসে পরে। বার বার মনিকে সান্ত্বনা দেয় মনকে শক্ত করার জন্য। রাবেয়া পাশে বসেই দোয়া দরুদ পরতে থাকে বার বার।

প্রায় অনেক্ষণ কেটে যায়। হসপিটালের উদ্দেশ্যে একটা এম্বুলেন্সও খুজে পায়না নীল। অনেক চেষ্টার পর একটা এম্বুলেন্স নিয়ে বাড়ি ফিরে সে। তবে বাড়িতে এসেই সে বড়সড় একটা ধাক্কা খায়। রাবেয়ার কোলে একটা ফুটফুটে বাবু। তিনি বসে থেকে খুব যত্নসহকারে বাবুটাকে পরিষ্কার করছেন। উনার মুখে আজ অফুরন্ত হাসি। নীল বিস্ময়ে রাবেয়াকে প্রশ্ন করে
-এটা কে মা?
-আমার নাতনী।
রাবেয়ার কথায় ভড়কে যায় নীল। অবাক হয়ে বলে
-মানে?

রাবেয়া হাসে। নীলের দিকে তাকিয়ে খুশমেজাজে বলে
-মনির মেয়ে হয়েছে নীল। মনিতো এ বাড়িরই মেয়ে, তাহলে ওতো আমার নাতনীই হবে।
নীল অবাক হয়, সেই সাথেও খুশিও হয় অনেক। মায়ের কাছে গিয়ে বসে বাবুটাকে দেখতে দেখতে বলে
-খুব সুন্দর হয়েছে মা। কিন্তু আমাকে বলোনি কেন? আমি কতো কষ্ট করে এম্বুল্যান্স টা নিয়ে এলাম।

-তোমাকে কতোগুলো কল করেছি একটু ফোনটা চেক করো তো নীল।
হিমার কথায় নীল সেদিকে তাকায়। ওয়াশরুম থেকে মনিকে নিয়ে বের হচ্ছেন উনি। মনিকে প্রচন্ড নির্জীব দেখাচ্ছে। খুব কষ্ট হয়েছে মেয়েটার। নীলের কেন জানি খুব মায়া হলো। সে মায়াভরা চোখে তাকিয়ে রইলো মনির দিকে।

হিমার কথায় ঘোর ভাংলো নীলের। হিমা বললো
-কি হলো, চেক করো ফোনটা।
নীল পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখলো ১৩ টা মিসড কল। সে হিমার দিকে তাকিয়ে বললো
-অনেক টেনশনের ছিলাম গাড়ি পাচ্ছিলাম না বলে, সেই টেনশনেই হয়তো কলের শব্দ পায়নি আমি।

বিছানায় মনিকে বসিয়ে দিয়ে ওর কোলে বাবুটাকে দেওয়া হলো। বাবুটার দিকে একভাবে তাকিয়ে রইলো মনি। এভাবে কিছুক্ষণ বাবুটাকে দেখে তৃপ্তির হাসি হাসলো সে। রাবেয়া তাড়া দিয়ে বললো
-ওকে খাওয়া মনি। ওর খিদে পেয়েছে।
মনি ইতস্তত বোধ করে। সামনেই নীল দাঁড়িয়ে আছে।

নীল বুঝতে পারে সেটা। তাই সে মায়ের কথা শোনামাত্র ঘরের বাইরে চলে গেলো। বাইরে গিয়ে দেখলো এলাহী কান্ড। বাজার থেকে কয়েক কেজি মিষ্টি নিয়ে ঘরে ফিরেছে নিলয়। ওর বাবাও সাথে ঢুকছে। দুজনের মুখেই খুশির ঝলকানি। নীল ওদেরকে দেখে বললো
-তোমরা মিষ্টি নিয়ে ফিরলে হটাৎ?
-বাড়িতে নতুন অতিথি এসছে, সবাইকে মিষ্টিমুখ করাতে হবে না?
-তোমরা কোথায় শুনলে?
-হিমা ফোন করে জানিয়েছে।
-ওহ।

নীলের বাবা ভেতর ঘরের দিকে ঢুকতে ঢুকতে হাক ছাড়লেন
-কই গো আশার মা, আমার নাতনী কোথায়?
রাবেয়া হাসিমুখে ঘর থেকে বেরোলো। বললো
-আমার নাতনীকে দেখতে হলে আগে টাকা বের করতে হবে। তা নাহলে নাতনীর মুখ দেখতে পাবেনা।
-সে চিন্তা আমার। তুমি শুধু নাতনীকে আমার কাছে নিয়ে এসো।

রাবেয়া হাসিমুখে ঘরে ঢুকলো। এরমধ্যে বাচ্চাকে খাওয়ানো হয়ে গেছে।। তাই তিনি মনির কোল থেকে বাবুকে নিয়ে বললেন
-তোর আংকেলকে দেখিয়ে আনি মনি। উনি বাবুর মুখ দেখার জন্য ছটফট করছেন।
মনি হাসলো। রাবেয়া বাবুকে নিয়ে বের হতে হতে হিমাকে বললো
-আশাকে বলেছিস হিমা?
-জ্বি মা। ও আজই চলে আসবে।
-ঠিক আছে, চুলার উপর পাতিলে দুধ গরম করা আছে। এক গ্লাস দুধ এনে মনিকে দে খেতে।
-আচ্ছা।

রাবেয়া বেরিয়ে গেলে হিমা মনির জন্য দুধ আনতে উদ্ধত হয়। পিছন থেকে তখন মনি বলে
-ভাবী,
-কি?
-আমি তো আপনাদের কেউ হই না। তাও আমাকে আপনারা কেন এতো ভালোবাসেন? এই বাবুটা যদি আমার নিজের বাড়িতেও হতো তবুও হয়তো এতোটা ভালোবাসা, এতোটা যত্ন পেতাম না। হয়তো বাবুটা অনেক আগেই আমি হারিয়ে ফেলতাম।

হিমা এসে মনির পাশে বসলো। নিরব কন্ঠে বললো
-আমাদের কোনো আচরণে কি কখনো তোমার মনে হয়েছে আমরা তোমাকে পর ভাবি?
মনি মাথা নাড়ালো। হিমা আবারও হেসে বললো
-আর বাবুটা হওয়াতে সবাই অনেক বেশি খুশি হয়েছে কারণ এ বাড়িতে কোনো বাবু নেই। আমাদের বিয়ে হয়েছে প্রায় আট বছর হতে চললো। এর মধ্যে আমি মা হতে পারিনি। অনেক কিছু করেছি, ডাক্তারী, কবিরাজি কোনোটাই বাদ দেইনি। যে যেখানে বলেছি সেখানে আমাকে নিয়ে গেছে আমার স্বামী। কোনো ফল পাইনি।

শেষে তোমার ভাইয়া আমাকে ইন্ডিয়াতে নিয়ে গেছে। ওখানে গিয়ে জানতে পেরেছি, সমস্যাটা আমারই। আমার নাকি মা হওয়ার ক্ষমতা নেই।
মনি খেয়াল করলো হিমার চোখের কোনে বিন্দু বিন্দু পানি জমে আছে, কথা বলার সময়ও গলাটা বেশ ধরে এসেছিলো তার।

হিমা আবারও বললো
-জানো মনি, পৃথিবীর বেস্ট স্বামীটা বোধহয় আমিই পেয়েছি। অন্য কেউ হলে কোনদিন হয়তো আমাকে ছেড়ে দিতো নয়তো আরেকটা বিয়ে করে ঘরে দ্বিতীয় বউ তুলতো।

মনি জানলা দিয়ে বাইরে তাকালো। ভেজা গলায় বললো
-তবুও ভাবী তুমি কতো সুখী। তোমার মাথার উপর একটা ছাদ আছে, আগলে রাখার মানুষ আছে। আমার কি আছে? আমার তো কিছুই নেই। মা বাবা থেকেও আজ আমি এতিমের মতো থাকি।
মনি কাঁদছে। হিমা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বললো
-হয়েছে হয়েছে। এবার কান্নাকাটি বন্ধ। আমি দুধ নিয়ে আসছি, খেয়ে নিবে।

হিমা চলে গেলো রান্নাঘরে। তবে মনির দৃষ্টি এখনো জানলার বাইরেই রাখা।

____
বাবুকে দেখে আশার বাবার চোখেমুখে উৎফুল্লতা কাজ করছে। সে খুশির সহিত রাবেয়ার কোল থেকে বাবুকে নিতে গেলেন। রাবেয়া বললেন
-সাবধানে..
নিলয় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো বাবুর মুখের দিকে। চোখমুখে খুশি আর সেই সাথে কিছুটা হাহাকার।

সেটা চোখে পরলো নীলের। সে ভাইয়ের কাধে হাত রেখে বললো
-একটু কোলে নে ভাই।
নিলয় অদ্ভুত ভাবে তাকালো নীলের দিকে। সে কিছুক্ষণ নিরব ভাবে নীলকে দেখে বললো
-হ্যাঁ, নিবো তো।
বাবার কোল থেকে বাবুকে আলতোভাবে ধরে কোলে নিলো নিলয়। কিছুক্ষণ সেই নিষ্পাপ মুখপানের দিকে তাকিয়ে থেকে গালে একটা চুমু খেলো সে। আরো কয়েক সেকেন্ড বাবুটাকে দেখে এক পর্যায়ে বুকের সাথে জরিয়ে নিলো নিলয়। রাবেয়া তৃপ্তি সহকারে দেখলো সেই মুহূর্তটা।

সন্ধ্যের আগ নাগাদ বাড়ি এসে পৌছুলো আশা। এসেই হৈ-হুল্লোড় করে মনির কাছে গেলো সে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে প্রচন্ড খুশি সে। আশাকে দেখে মনি হাসিমুখে বললো
-কেমন আছো আশাপু?
-আজ তো আমি অনেক খুশি রে মনি। তুই কেমন আছিস সেটা বল।
মনি হাসলো। কিন্তু উত্তরে কিছু বললোনা। আশা মনির কোলে বাবুকে দেখতে না পেয়ে বললো
-তুই একা বসে আছিস, বাবুনি কোথায়?
-হয়ত আন্টির কাছে।
-ওকে, তুই বস। আমি বাবুকে দেখে তারপর আসছি তোর কাছে।
-আচ্ছা।

আশা চলে গেছে। হিমা রান্নাঘরে রান্নার কাজ করছে। নিলয় আর ওর বাবা দুজনেই হৈ-হুল্লোড় করে বাইরে বেরিয়েছে।।

মনি এইমুহূর্তে একলা ঘরে বসে আছে। একদিক থেকে মনটা ভালো হলেও অন্যদিক থেকে ভীষণ খারাপ। আজ মায়ের কথা খুব মনে পরছে তার। এই সময়টায় প্রায় প্রতিটা মেয়েই তার মায়ের কাছে থাকে। কিন্তু ওর কপালে আল্লাহ সেই সুখটা লিখেনি। কিন্তু আল্লাহর প্রতি কোনো অভিযোগ নেই তার।

মনির এইসব ভাবনাচিন্তার এক ফাঁকে নীল এসে ঢুকলো ঘরে। নীলকে দেখে একটু নড়েচড়ে বসলো মনি। একটা টুল টেনে সেটাতে বসতে বসতে নীল বললো
-এখন কেমন লাগছে?
-ভালো।
-মেয়ের মা হয়েছো, অনুভূতিটা কেমন?
মনি একটা নিশ্বাস ছেড়ে নীলের দিকে তাকালো। বললো
-ভালো।
নীল মুচকি হাসলো। হাস্যোজ্জ্বল মুখটা নিয়ে সে মনির দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলো । সে তাকানোর এক অদ্ভুত ধরণ। মনি কিছুটা লজ্জায় মাথা নত করলো। গালদুটো হালকা লাল রঙ ধারণ করেছে তার।

নীল অবাক হলো, লজ্জা পেলে মেয়েদের এতোটাও সুন্দর লাগে তার জানা ছিলোনা।। সে ঘোরের মধ্যে থেকে বললো
-মা হওয়ার পর তোমার সৌন্দর্য আরো বেড়ে গেছে মনি।
মনি অবাক হয়ে বললো
-কিহ!!
নীলের ঘোর ভাংলো। মনিকে স্বাভাবিক করার জন্য বললো
-মেয়ের নাম কি রাখলে?
-রাখিনি এখনো।
-ভেবেছো কিছু?
-হুম।
-কি?
মনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এরপর একরাশ হাহাকার নিয়ে নীলের দিকে তাকিয়ে বলল
-মুনিয়া।

চলবে…..

[#বিঃদ্রঃ যারা যারা এখনো আমার পেইজে লাইক দেন নি, তাদের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, আপনারা প্লিজ আমার পেইজে একটা লাইক দিয়ে পাশে থাকুন❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here