#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম -৩৫
দাওয়ায় একটা জীর্ণ শীর্ণ শীতল পাটি বিছানো। তার উপর নির্জীবতা নিয়ে বসে আছে রহিম মিয়া। হাড্ডিসার দেহখানায় আগে অনেক শক্তি থাকলেও এখন পুরোটাই নিথর। কোনো হেলদোল নেই শরীরে। একধ্যানে দেউরির দিকে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তিনি।
কয়েক মুহূর্ত ব্যবধানে দেউরি দিয়ে মনির মা বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই শান্তশিষ্ট গলায় রহিম মিয়া বললেন
-কই গেছিলি মনির মা?
মনির মা হাসলেন। খুশমেজাজে বললেন
-দেহেন কারে নিয়া আইছি।
রহিম মিয়ার উৎসুক দৃষ্টি বাইরের দিকে দেখার চেষ্টা করলো।।কাউকে দেখতে না পেয়ে বললো
-কারে দেখমু? কেডা আইছে?
মনির মা ইশারায় দেউরির ওপাশে থেকে মনিকে আর নীলকে ডাকলেন।।
মনি ধীরপায়ে মাথা নিচু করে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো। সে এক এক করে এগিয়ে এলো রহিম মিয়ার সামনে। রহিম মিয়া এখনো নির্বাক। নিস্তেজ হয়ে তাকিয়ে আছেন তিনি মেয়ের দিকে। এক সময় উনার সামনে এসে মনি বসলো। কিছুক্ষণ বাবার দিকে তাকিয়ে থেকে মৃদু গলায় বললো
-আব্বা…
রহিম মিয়া এবার কেঁপে উঠলেন। গা ঝাড়া দিয়ে উঠলো তার। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো
-মনি মা, তুই আইছোস?
মনি কান্না বিজড়িত গলায় বললো
-আব্বা, তুমি কেমন আছো?
রহিম মিয়া হটাৎ আকাশের দিকে তাকালো। হতাশ গলায় বললো
-পাপ করছিলাম রে মা, মেলা পাপ করছিলাম।।তার প্রায়শ্চিত্ত করতাছি।
বাবার কথায় মনির কান্নার বেগ বেড়ে গেলো হটাৎ। সে কাঁদতে কাঁদতে রহিম মিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলল
-এমন কথা বলো না আব্বা, তুমি কোনো পাপ করো নি।।
-আমার প্রতি তোর এতোই রাগ ছিলো মা, যে তুই এইভাবে আমাগোরে ছাইড়া চইলা গেলি। গেছিলিই যহন আর ফিইরা আইলি না কেন। এই বুড়া বাপটারে শাস্তি দিলি এইভাবে?
মনি কাঁদছে।
-আমায় মাফ করে দাও আব্বা। আমার আসার মতো কোনো রাস্তা ছিলোনা।
রহিম মিয়া আর কিছু বললোনা মনিকে।। সে আবারও নির্বাক ভাবে বসে রইলো কিছুক্ষণ।
এক পর্যায়ে রহিম মিয়ার চোখ গেলো নীলের দিকে। তিনি বিস্ময় নিয়ে মনির মায়ের দিকে তাকালেন। ধীর গলায় বললেন
-পুলাডা কেডা মনির মা?
-ওগো বাড়িতেই থাকে আমার মনি।। ওই মনিরে নিয়া আইছে।
-ওহ, মনি তাইলে ওর লগেই গেছিলো?
মনি চমকে উঠলো। সে বিস্মিত গলায় বললো
-না আব্বা।
রহিম মিয়া হাসলেন। তিনি মেয়ের দিকে তাকিয়ে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললেন
-মা মনি, তুই অহনো আমারে ডরাস? আমারে আর ডরাইস না, আমি আর আগের মতো নাই। মিছা কথা কইস না আমারে ডরাইয়া, পাপ হইবো।
এরপর কিছুক্ষণ তিনি নীলের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে মনির দিকে তাকালেন।। হাসিমুখে বললেন
-জামাই আমার পছন্দ হইছে।
মনি এবার লজ্জায় নীলের দিকে তাকালো। এই নীল এখন কি ভাববে? বাবার এমন কথায় নিশ্চয় তিনি খুব রেগে যাবেন।
নীলের দিকে তাকানো মাত্রই মনির রাগ সপ্তম আকাশে উঠে গেলো। কারণ, মনির বাবার কথা শুনে নীল মনির দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছে, ভাবখানা এমন যেনো উনার খুব ভালো লেগেছে কথাটা। মনি বেশ রাগি রাগি চোখ করে নীলের দিকে তাকালো। নীল এইবার মনির মা আর রহিম মিয়ার দৃষ্টির বাইরে গিয়ে মনিকে চোখ টিপ দিলো। বাবা মা সামনে থাকায় প্রচন্ড রাগ হওয়া স্বত্বেও সে সবটা মুখ বুজে মেনে নিলো।
রহিমের দিকে তাকিয়ে মনি চড়া গলায় বললো
-তোমার মাথা খারাপ হয়ছে আব্বা? উনার সাথে বিয়ে….
মনির কথা সম্পুর্ণ শেষ হবার আগে ওর কথায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে নীল বললো
-মনি আমার কথাতেই বাড়ি ছেড়েছিলো আংকেল। আমরা সেদিনই বিয়ে করেছি। এখন আমাদের একটা মেয়েও হয়েছে, নাম মুনিয়া।
মনি এবার পুরো হতবাক। এ কি বলে ব্যাটা? মনির মা নীলের কথাকে সমর্থন করে রহিম কে বলে
-নীল বাবাজি ঠিকই কইছে।
মাকে সামান্য ধমক দিয়ে মনি বললো
-তোমরা কি শুরু করলে মা?
-তোরা যা করছিস, তাই বলা হইছে। অহন রাগ হোস কেন।
মনির মা ঘরের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো
-নীল বাবাজিরে নিয়া ঘরে আয় মনি।
মনি মায়ের কথায় কোনো উত্তর দিলোনা। তার রাগের পরিমাণ অহরহ বেড়েই চলেছে।
রহিম মিয়া এবার ধীরে ধীরে উঠে দাড়ালো। সে নীলের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো
-বাবাজী, তুমি গিয়া বহো। আমি দেহি বাজার থেইকা কিছু কিইনা আনি, প্রথমবার জামাই আমার বাড়ি আইছে।
নীল সৌজন্যতার হাসি হেসে এগিয়ে এলো রহিমের দিকে। আলতো হাতে উনাকে ধরে বললো
-আপনি এই শরীর নিয়ে কোথাও যাবেন না আংকেল। ঘরে গিয়ে বসুন। আমি বাজারে যাবো, যা যা আনতে হবে আমি গিয়ে আনবো।
রহিম মিয়া লজ্জিত গলায় বললো
-এইডা কেমনে হয় বাজান, তুমি আমার বাড়ির নতুন জামাই, তোমারে কেমনে বাজারে পাঠাই।
-আমি তো আপনার ছেলেও।
রহিম মিয়া তৃপ্তির হাসি হাসতে হাসতে বললো
-কহন কোন ভালা কাম করছিলাম বাপ জানিনা, যদি কোনো দিন কোনো ভালা কাম কইরা থাকি, সেই কামের পুরষ্কার হিসাবেই মনে হয় আল্লাহই তোমারে আমার মাইয়ার জামাই বানাইছে।
রহিম মিয়া কাঁপতে কাঁপতে ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। নীল মুচকি মুচকি হাসছে আর মনির দিকে তাকাচ্ছে। মনি এবার তেড়ে এলো নীলের দিকে। ঝাঝালো গলায় বললো
-আপনি এইসব মিথ্যা কথা কেন বললেন আব্বারে।
-বেচারা অসুস্থ মানুষ। খুশি হয়েছে আমার কথা শুনে। তোমার তো আমাকে ধন্যবাদ জানানো দরকার। বড্ড অকৃতজ্ঞ তুমি।
-মিথ্যা কাহিনীর জন্য ধন্যবাদ জানাবো?
-অভিউসলি।
-আন্ডা জানাবো।
-তাই? কিসের আন্ডা?
-আপনার।৷ সামান্য চিৎকার করে বললো মনি।
ঘরের ভেতর থেকে মনির মা বললেন
-চিৎকার করিস কেন মনি, কি হইছে?
মনি কন্ঠ স্বাভাবিক করে বললো
-কিচ্ছু না মা।
সে আবার রাগীচোখে তাকালো নীলের দিকে। এরপর চিন্তার স্বরে বললো
-মা কেন আপনের পক্ষ নিয়ে মিথ্যা কথা বললো, আমার মা তো কখনো মিথ্যা বলতো না।
নীল রহস্যময় হাসি হেসে বললো
-আন্টিকে আমি যা বলেছি উনি তো তাই বলেছেন। মিথ্যা বলেন নি তো উনি।
-মানে? চোখ বড় বড় করে নীলের দিকে তাকিয়ে হতবাক হয়ে বললো মনি।
নীল হাসলো। বললো
-শাশুড়ি মাকে আমি এইসবই বলেছি।
-শাশুড়ি মা কে? ভ্রু বাকিয়ে বললো মনি।
নীল প্রাণখোলা হাসি হেসে বললো
-তোমার মা।
মনির রাগ আবারও বেড়ে গেলো। সে কিছু বলতে যাবে তার আগেই নীল আবারো বললো
-আমি বাজারে গেলাম মনি, শশুড় পছন্দ করেছে বলে কথা।
নীল দুপা বাড়াতেই মনি ছুটে গেলো তার দিকে। হন্তদন্ত হয়ে বললো
-তাহলে আপনি যে তখন বলেছিলেন সব বলেছেন মাকে।
-হুম, সব বলেছি, কিন্তু আমাকে নিয়ে বলেছি।
-তাহলে নিয়ানকে নিয়ে কিছু বলেন নি? চাপা গলায় বললো মনি।
নীল মুচকি হেসে মনির মুখের কাছে মুখটা নিয়ে বললো
-পাগল নাকি, ওই নিয়ান ফিয়ানকে নিয়ে আমি উনাকে বলি, আর উনিও ওই নিয়ানের কাছে গিয়ে তোমাকে বউ হিসেবে মেনে নেওয়ার জন্য চাপ দিক, আমি বাবা সেই রিস্ক নিতে চাইনা।
-আমার মা কখনোই এমন করতো না।
-রাগের চোটে জিজ্ঞাটাও তো করতে পারতো। এমন করলে সবাই জেনে যাবে, লোক জানাজানি হয়ে গেলে তোমারও মান সম্মান যাবে। সবচেয়ে বড় কথা, সবার কানে কথাটা গেলে যে তোমার একটা বাচ্চা আছে, আর সেই বাচ্চার বাবা নিয়ান, তখন এটা নিয়ে পাড়ায় দরবার হবে, মাতব্বর নিয়ে মাতামাতি হবে। শেষে চাপে পরে মুনিয়ার কারণে নিয়ান যদি তোমাকে মেনে নিতে বাধ্য হয়, তখন আমার কি হবে শুনি?
-স্বার্থপর একটা।
-ভালোবাসা পেতে নাহয় একটু স্বার্থপর হলাম।
মনি মুখ বাকালো। নীল মনির দিকে ফ্লায়িং কিস ছুড়ে দিয়ে বললো
-অপেক্ষায় থেকো, আমি শ্রীঘ্রই চলে আসবো বাজার থেকে।
-আমার ঠ্যাকা পরেছে আপনার জন্য অপেক্ষা করতে।
-বাই দ্যা ওয়ে, বাজারটা কোন দিকে।
-আমার মাথার উপরে। সামান্য চেচিয়ে বললো মনি।
নীল আবারও হাসলো। মিষ্টি করে বললো
-হাউ সুইট।
মনি আর দাড়ালো না নীলের সামনে। মনে হচ্ছে, ওর সামনে বেশিক্ষণ থাকলে পাগল হয়ে যাবে সে। তাই হনহন করে ঘরের দিকে ছুটে এলো মনি। নীল মনির প্রস্থানের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। এরপর হেসে বললো
-নীলের মনি কোঠায় একদিন না একদিন তুমি ধরা পরবেই মনি।
_______
সন্ধ্যার আগ মুহুর্তে রহিম মিয়া আর মনির মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসলো নীল আর মনি। যদিও মনির ইচ্ছে ছিলোনা আসার, তবে মুনিয়ার জন্য আসতে হলো। আর তাছাড়া ও যে কলেজে ভর্তি হয়েছে। আসার আগে রহিম মিয়া আর মনির মাকে মনির পড়ালেখার ব্যপারে জানানোতে উনারাও সাদরে সেটা মেনে নিয়েছে। এখন উনারাও চায়, মনি লেখাপড়া করে ভালো কিছু করুক। আর যেহেতু উনারা জানে নীলের সাথে মনির বিয়ে হয়েছে, তাই মনিকে নীলের সাথে যেতে দ্বিমত করেন নি তারা। আর মনিও বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করেনি। সমাজে কলঙ্কের হাত থেকে বাঁচতে হলে এটা তাকে মুখ বুজে মেনে নিতে হবে।
মনিদের বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরে গিয়ে গাড়িতে উঠতে হয়। সে জন্যই নীল আর মনি হেঁটে হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। মনি নিচের দিকে তাকিয়ে একভাবে হেঁটে চলেছে। নীল কয়েকবার মনিকে ডেকেও সাড়া পায়নি কোনো।
এক পর্যায়ে নীল বললো
-ওয়াও মনি, দেখো কি সুন্দর কাপল।
নীলের কথায় মনি সামনের দিকে তাকালো। খুব দেখতে ইচ্ছে হয়েছে কাপলটাকে।
সে সামনে তাকানো মাত্রই তার চোখ আঁটকে গেলো। নীল হেসে বললো
-আমরা কবে এমন কাপল হবো মনি?
মনি কথা বললোনা, তার গলা দিয়ে কথা বেরোচ্ছেনা। এমন সময় সামনে থাকা কাপলটা ওদেরকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলো। ছেলেটা মনিকে কয়েকবার আড়চোখে দেখে নীলের দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে ভ্রু বাকিয়ে বললো
-হু আর ইউ?
নীল হাসলো। ফুরফুরে কন্ঠে বললো
-আমি এ গ্রামের জামাই।
চলবে…..