#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম -৪৫
পুরো ঘর জুড়ে ছেয়ে আছে নিরবতা, যেমনটা ঘূর্ণিঝড়ের আগ মুহুর্তে হয়ে থাকে। আশার চোখমুখ বিকৃত। শ্রাবণের বাড়ির লোকজন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে শ্রাবণের দিকে। মনে কি কাজ করছে তা অজানা।
হটাৎ শ্রাবণের বড় বোন চটে গেলো। তিনি বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে কড়া গলায় বললেন
-মান সম্মান টা শেষ করে দিলি রে শ্রাবণ। তুই না প্রফেসর, তাহলে মুখে কোনো লাগাম নেই কেন?
-আমি আবার কি করলাম?
-না জেনে কারো ব্যপারে এমন মন্তব্য করা ঠিক হয়নি তোর।
-আমি ঠিকই তো বলেছি। না জেনে বলবো কেন। সেদিনই তো উনি আমার কলেজে গিয়েছিলো, আমার সাথে কথাও হয়েছিলো।
শ্রাবনের বড় বোন লজ্জার সাথে ঘরে উপস্থিত থাকা অন্যান্যদের দিকে তাকালেন। এরপর জোরপূর্বক হাসি টেনে সকলের দিকে তাকিয়ে বললেন
-হয়তো আশার মতো দেখতে কারো কথা সে বলছে। আপনারা মনে কিছু নিবেন না প্লিজ।
আশার ততক্ষণে রাগ মাথায় চড়ে গিয়েছে। বাকিরা সবাই সামনে আছে তাই কিছু বলতেও পারছেনা, আর সইতেও পারছেনা। এ পর্যায়ে নিলয় বললো
-মেনে নিলাম আশার মতো কারো সাথে তার পরিচয় হয়েছে। তাই বলে কেউ এভাবে কারো বিরুদ্ধে আঙ্গুল উঠায় কি করে?
-আমাদের ভুল হয়ে গেছে। প্লিজ, রেগে যাবেন না। আর আশাকে আমাকে ভিষণ পছন্দ হয়েছে। আমরা চাই, ওই আমার ভাইয়ের বউ হোক।
এমন সময় শ্রাবণ বলে উঠলো
-কি বলছিস আপা। আমি একজন প্রফেসর, আর আমি কিনা আমার কলেজেরই এক স্টুডেন্ট এর মাকে বিয়ে করবো? হাউ পসিবল?
এতোক্ষণ সবকিছু মুখ বুঝে সহ্য করলেও আর সহ্য করলোনা আশা। সে ঠাস করে বলে উঠলো
-এই যে মিস্টার খাম্বা, কাকে কি বলছেন? আপনার ধারণা আছে কি বলছেন আপনি? আমি বাচ্চার মা কিভাবে হলাম? আমি এখনো ভার্সিটিতে পড়ছি। আর আপনি আমাকে দামড়া দামড়া বাচ্চার মা বানিয়ে দিচ্ছেন? হাহ, এই নাকি প্রফেসর। সারাজীবন মনে হয় টুকলি করে পাস করে এসেছেন। তা নাহলে এই গোবর ভরা মাথা নিয়ে কেউ প্রফেসর হয় কি করে?
-আমি টুকলি করেছি? আমার মাথায় গোবর ভরা? সামান্য রেগে গিয়ে বললো শ্রাবণ।
-হ্যাঁ, আপনার মাথায় গোবরেই ভরা। তা নাহলে এই ধরনের ষ্টুপিড কথাবার্তা বলেন কিভাবে?
-আপনি যান নি ওইদিন কলেজে?
-গিয়েছি তো। তো কি হইছে? কলেজে আর কেউ যায় না? আমিই কি প্রথম গিয়েছি?
শ্রাবণ এবার নরম গলায় বললো
-তা না। তবে, সেদিন আমি যখন বললাম আপনি বাচ্চার সাথে দেখা করতে এসেছেন কিনা, তখন তো বলেন নি আপনার বাচ্চাকাচ্চা নেই, বিয়েও হয়নি।
-আপনার কাছে আমার ঢোল পিটাতে হবে? আমি কি জানতাম আপনি ধেই ধেই করে নাচতে হাচতে আমাকে বিয়ে করার জন্য চলে আসবেন?
-আমি নাচতে নাচতে চলে এসেছি?
-হুম।
-এই আপা, উঠ তো। আমি এনাকে জীবনেও বিয়ে করবো না। কি ডেঞ্জারাস মেয়ে, আমার জীবনটা তো ত্যানাত্যানা করে ছাড়বে এই মেয়ে।। ভাগ্যিস, বিয়েটা কনফার্ম হওয়ার আগেই জেনে গেছিলাম, উনি সত্যিকারের এক শাকচুন্নি।
আশা মুখ বাকিয়ে বললো
-আমি শাকচুন্নি হলে আপনি এক নম্বরের শাকচুন্না। তাল গাছের পেত্না। আপনি, গোপাল ভাড়ের মন্ত্রী নামক ষড়যন্ত্রী। সবচেয়ে বড় কথা, আপনি একটা বিশাল খাম্বা। আর কোনো খাম্বাকে বিয়ে করার প্রশ্নই আসেনা।
তাছাড়া, আপনার মতো গোবরভর্তী মাথা যার আছে, তাকে আমি কেনো, দুনিয়ার কোনো মেয়েই বিয়ে করবে না। এখানে এসে আমার মতো কোনো মেয়েকে বিয়ের জন্য দেখতে পেরেছেন, এটাই আপনার সাত জন্মের কপাল। আর বিয়ে করতে হবেনা। এবার বিদেয় হোন।
রাবেয়া সেখানে উপস্থিত ছিলো তখন। আশার কথায় তিনি কিছুটা রেগে গিয়ে বললেন
-এইসব কি বলছো আশা? কার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয়, সেই শিক্ষাটা নিশ্চয়ই আমি তোমাকে দিয়েছি?
আশা হতাশ গলায় বললো
-উনি আমাকে সেই কখন থেকে যা তা কথা বলছে, আর তুমি কিনা আমাকেই বকছো?
-হ্যাঁ বকছি, কারণ উনি না জেনে ভুল করেছেন। আর তুমি জেনেশুনে উনাকে বাজে কথা শোনাচ্ছো।
-থাকো তুমি তোমার ভালোমানুষ নিয়ে। আমি গেলাম। মনির একহাতে টান দিয়ে আশা বললো
-এই মনি, চলতো এখান থেকে।
_
এদের দুইজনের মধ্যে এমন গুরুগম্ভীর ভাব দেখে সকলে বুঝে গেলো, এদের দ্বারা সংসার হবেনা। যদি ভুল করে হয়েও যায়, তাহলে উঠতে বসতে এরা একে অন্যের ঘাড় মটকানোর ধান্দায় থাকবে। তাই, দুই পরিবার একে অন্যের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে উঠে পরলো। যাবার আগে শ্রাবণের বড় বোন আর ভাবী রাবেয়ার আর হিমার হাত ধরে বলেগিয়েছিলো, এই বিয়েটা হোক উনারা চান। শ্রাবনকে উনারা যেভাবেই হোক রাজি করাবেন। আশাকেও যেনো উনারা একটু বোঝায়। রাবেয়া কোনো কথার উত্তর না দিলেও হিমা বলেছিলো,
-দেখা যাক কি হয়। এইসব তো কপালের লিখন। কপালে লিখা থাকলে অবশ্যই বিয়ে হবে।
বিকেলের ফুরফুরে হাওয়ায় ছাঁদের এক কোনায় আশা আর মনি বসে আছে। মুনিয়াকে নিয়ে রাবেয়া বসে গল্প করছে নিজের ঘরে। আশা ফোন স্ক্রল করতে করতে মনিকে বললো
-কপাল করে জন্মেছিলাম মনি, কোথাকার কোন দামড়া বুড়ো আমাকে কলেজে পড়ুয়া বাচ্চার মা বানিয়ে দিলো। ভাবা যায় বল।।
মনি হেসে বললো
-ভাইয়াটা কিন্তু অনেক সুন্দর ছিলো আশাপু। তোমার সাথে বেশ মানাতো।
আশা কপাল কুচকে বললো
-তুই তো আমার ভাইয়ের নামে বুকড। তা নাহলে তোরেই ওই ব্যাটার গলায় ঝুলাইয়া দিতাম। তখন থেকেই শুধু সুন্দর সুন্দর করে যাচ্ছিস।
আশার কথায় মনি হাসলো।
এমন সময় নীলের গলায় আওয়াজ পেলো ওরা। ছাঁদে উঠার সময় আশার বলা কথাগুলো তার কানে গিয়েছিল।। আশাকে সে সামন্য ধমক দিয়ে বললো
-মনি তোর গুরুজন আশা। আর গুরুজনের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে?
-কে আমার গুরুজন?
আশার সামনে এসে দাঁড়িয়ে সবগুলো দাঁত বের করে হাসলো নীল। এরপর বললো
-মনি।
-কবে থেকে।
-যবে থেকে আমার বিয়ে করা বউ হয়েছে।
-সেই হিসেবে আমিও তোর গুরুজন। আমারেও তুই সম্মান দিবি ভাইয়া।
নীল ভ্রু বাকিয়ে বললো
-তুই কিভাবে আমার গুরজন হইলি? মাথা গেছে নাকি প্রফেসরের পাল্লায় পড়ে?
-শোন, কানের কাছে সারাক্ষণ প্রফেসর প্রফেসর করিস না তো।। সাধারণত, একটা ছেলের জন্য মেয়ে কারা দেখে?
-কারা?
-গার্জিয়ানরা দেখে। মুরুব্বিরা দেখে বুঝলি।
-তো?
-তোর বউটারে পাইছিস কেমনে?
-কেমনে পাইছি?
-আমার কল্যানে পাইছিস। যেই কাজটা বাড়ির মুরুব্বিরা করার কথা ছিল, সেইটা আমার দ্বারা খুব সহজেই হয়ে গেছে। এইবার আমি তোর গুরুজন হইছি কিনা বল।।
নীল মুখ বাকিয়ে বললো
-ফালতু যুক্তি নিয়া আসিস না তো আমার সামনে। এইবার এইখান থেকে যা একটু।
আশা রহস্যময়ী হাসি হেসে বললো
-কেন যাবো?
-যা নারে বোন। তোর ভাবীর সাথে একটু কথা বলতে দে।
-তো বল না, না করছে কে।
-তোর সামনে বলমু?
-হুম।
নীল দুষ্টুমি হাসি হেসে আশার দিকে তাকিয়ে বললো
-ওকে, পরে দেখিস লজ্জা পেয়ে দৌড় দিস না।।
-আচ্ছা।
ভাইবোনের এইসব কথাবার্তায় লজ্জার নেতিয়ে পরছে মনি। ইচ্ছে করছে, এক ছুটে নিচে চলে যাক। কিন্তু কিভাবে যাবে, পা দুটো যে অবশ হয়ে যাচ্ছে। নীল মনির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো
“আজি মন খুলে চেয়েছি ভালোবাসতে, আজি চোখে মেলে এসেছি তোমায় দেখিতে।
তুমি কি শুনিতে পাও না এ হৃদয়ের স্পন্দন,
কেন বাধো না এ ভালোবাসার বাধন?
কেন তুমি থাকো দূরে, কেন যাও অবিসারে…
আমি আজ হারিয়েছি, মেতেছি তোমারি খেয়ালে
ভালোবাসার আবদারে, ঘুরছি তোমারি দ্বারে দ্বারে””
এতোক্ষণ কানে হাত চেপে ধরে রেখেছিলো আশা। তবুও হাত ভেদ কানের ভেতর নীলের বলা কথাগুলো ঠিকই চেলে গেছে।।
নীল হাসতে হাসতে মনির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আর বলছে
-লজ্জাবতী, লজ্জা পেয়ো না আজ, আমায় তুমি আগলে নাও, ভালোবেসে করে নাও তোমার মাথার তাজ””
-এনাফ, এনাফ এনাফ। পাশ থেকে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠলো আশা। নীল হেসে বললো
-তোর আবার কি হলো?
-তোর কি লজ্জাশরম নেই রে ভাইয়া?
-আছে।
-তাহলে আমার সামনে তুই এতো রোমান্স করছিস কি করে?
-তুই লজ্জা পাচ্ছিস?
আশা মুখ বাকিয়ে বললো
-মোটেও না।
-তাহলে এতো রিয়েক্ট করছিস কেন?
-জানিনা।
আশা আর কথা না বাড়িয়ে দৌড়ে চলে গেলো নিচে।
নীল হাসলো। মনি লজ্জায় বলল
-আপনি আসলেই অনেক নির্লজ্জ। তা নাহলে কেউ ছোট বোনের সামনে এমন করে?
-আমি তো তোমায় ছুইনি, অশ্লীল বাক্যালাপও করিনি। তাহলে নির্লজ্জ হলাম কি করে?
-এতো ছন্দ আসে কোথা থেকে?
-যেখানে তুমি আছো!
মনি হাসলো। নীল মনির কাছাকাছি গিয়ে দাড়ালো। বাতাশে মনির খোলা চুলগুলো উড়ছে। বার বার এলো চুলগুলো মনির চোখের সামনে এসে বিরক্ত করছে। এক হাত দিয়ে অনবরত সেই চুলগুলো সরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বেয়াহা বাতাস কি সেগুলো মানে?
এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে মনি চুলগুলো খোপা করার জন্য বাধ্য হলো। সে এক হাতে চুলগুলো মুঠি করে অন্য হাতে খোপা করার জন্য উদ্ধত হতেই নীল মনির হাত খপ করে ধরে ফেলল। মনি বিস্ময়ে বললো
-কি?
-খোলা চুলেই থাকো। ভালো লাগছে।।
-চোখের সামনে এসে যাচ্ছে বার বার।
-তবুও ভালো লাগছে।
মনি হাসলো। সে চুলগুলো হাতের মুঠো থেকে ছেড়ে দিয়ে অন্যদিকে তাকালো। এমন সময় আবারও একটুখানি বাতাস ভেসে এসে মনির চুলিগুলোকে আবারও ওর চোখে মুখে ছেয়ে দিলো
তবে এবার আর কিছু করলোনা মনি। এভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো।
নীল মনির মুখ বরাবর একটু উপুর হলো। কিছুক্ষণ এলোকেশী কন্যাটার দিকে এক নজরে তাকিয়ে রইলো সে। মনি লাজুক হাসি দিয়ে নিচের দিকে তাকালো। নীলও হাসলো। এক পর্যায়ে একটা ফুঁ দিয়ে মনির মুখের উপর থাকা চুলগুলো সে সরিয়ে দিলো। হটাৎ অজানা শিহরনে শিহরিত হলো মনি।
সে চমকিত হয়ে তাকালো নীলের দিকে। নীল আকাশের প্রান্তে তাকিয়ে বললো
-আমি ভালোবাসি আমার অস্তিত্বকে। আর আমার সেই অস্বস্তি হচ্ছো তুমি। তুমি ছাড়া আমি নিজেকে ভাবতে পারছিনা কিছুই। থাকতে পারছি না একদন্ড। দুইদিন পর আমাকে পরদেশে পাড়ি জমাতে হবে। তখন কি করে আমার দিন পার হবে মনি?
মনি এক পলকে তাকিয়ে রইলো নীলের দিকে। চোখেমুখে তার হতাশা। এ প্রশ্নের উত্তর তার কাছেও যে অজানা।
চলবে…
[ভালো পরিমাণে রিয়েক্ট আসলে রাতে আরেকটা পার্ট দিবো ইনশাআল্লাহ ]