#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম -৫৩
[অন্তিম পর্ব]
রাতের হাতছানিতে সন্ধ্যে মিলিয়েছে অনেক আগেই। ঝিঁঝিঁপোকার শব্দে চারিদিকটা কম্পিত হচ্ছে। দলে দলে জোনাকিরা এদিক সেদিক ছুটোছুটি করছে। চাঁদের কিরণ গ্রিল ভেদ করে ভেতরে এসে উঁকি দিচ্ছে। মুখরিত হচ্ছে চারিপাশটা।৷
সময়ের স্রোতের ধারা অব্যাহত রেখে দিন এগিয়ে চলেছে সামনে। এরই মধ্যে নীল মনি, আশা আর শ্রাবণের বিয়ের দিনও ধার্য্য করা হয়ে গেছে। যেহেতু সকলে নীলের আসার অপেক্ষাতেই ছিলো, অন্যদিকে শ্রাবণরাও ভদ্রতার সহিত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেছে তাই আর দেরি করতে চান না নীলের ফ্যামিলি। সামনের শুক্রবারেই বিয়ে। হাতে আছে ধরাবাধা আর তিন দিন সময়। এ তিনদিনে বিয়ের কেনাকাটা, সমস্ত আয়োজন সব কমপ্লিট করতে হবে।
হিমা প্রেগ্ননেন্ট হওয়ায় সে খুব কমই কাজে হাত লাগাতে পারছে। অন্যদিকে মনি আর আশা বিয়ের কণে।।যদিও মনির মনের ভেতর এক অজানা লাজুকতা জেকে বসেছে। চাইলেও সকলের সামনে আগের মতো যেতে পারছেনা। তার উপর নীলের উপস্থিতি তাকে প্রচন্ড লজ্জা দেয়। ওর তাকানো প্রতিটি শিরায় শিরায় শিহরণ যোগায়।
বিয়ের আগের রাতে ঘরোয়াভাবে আশা আর নীল মনির গায়ে হলুদ সম্পন্ন করা হয়। নিলয়সহ ওদের সবারই ইচ্ছে ছিলো বেশ জাকজমকভাবে হলুদ করার। তবে, নীলের ইচ্ছেনুযায়ী এতোটা আয়োজন করা হলোনা। নীলের মনের চাওয়া, ওর বউকে অপুর্ব সাজে শুধু ওই দেখবে। আয়োজন যত বেশি হবে, মানুষের পরিমাণ তত বাড়বে। আর তত বেশি পরিমাণে লোকজন তার বউকে দেখবে। এটা সে মানতে পারে না।
ওদিকে নীলের এই আবদার শ্রাবণের কানেও যায়। তার মাথায় নাড়া দেয় সেটা। অতঃপর দুজনের ভাবগতি এক হয়ে যায়। আশার মনে যথেষ্ট আকাঙ্খা থাকলেও ভাই আর হবু বরের ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে সেটায় পানি ঢালে বেচারি।
যেহেতু স্বল্প আয়োজনে গায়ে হলুদ সম্পন্ন করা হয়েছে তাই রাত ১১ টার মধ্যেই সেটা শেষ হয়ে গেছে। অনুষ্ঠান শেষ হলে সকলে যার যার রুমে চলে যাচ্ছে শোবার জন্য। রাত পোহালেই যেহেতু দু দুটো বিয়ে তাই একটু রেস্ট দরকার।
ঝিঁঝিঁপোকাদের আর্তনাদে তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। মাঝে মাঝে দুই একটা পাখির ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। পরিবেশটা নিস্তব্ধ, সেই নিস্তব্দতার মাঝে জেগে আছে মনি। ঘরের লাইটটা অন করে খাটের কোনায় বসে হাতে লেগে থাকা মেহেদীর রঙ এর দিকে তাকিয়ে আছে অপলক ভাবে। এই মেহেদী তার নতুন জীবনে পদার্পণ করার সাক্ষী। মনি একবার পাশ ফিরে তাকালো। আশা ঘুমোচ্ছে। কিছুক্ষণ আগেও শ্রাবণ কল করেছিলো। মেয়েটা ঘুমের ঘোরে কথাও বলতে পারেনি। মনি মুচকি হাসলো। এরই মাঝে দরজায় টুকার শব্দ এলো। অবাক হলো মনি। এতো রাতে কে? মনি ধীর গলায় প্রশ্ন করে
-কে?
ওপাশ থেকে মিহি কন্ঠ ভেসে আসে।
-মনি আমি। দরজাটা একটু খুলো তো।
মনি অবাক হয়। এত রাতে নীল কেন আসলো এখানে? কিছু কি হয়েছে? মনি কিছুটা দুঃচিন্তা নিয়ে দরজাটা খুলে। দরজা খোলা মাত্রই নীল মনির হাত ধরে আচমকা টেনে বাইরে নিয়ে যায়। কিছুটা হতভম্ব হয় মনি। মাঝ রাতে এ লোকের মাথা কি পুরোটাই গেছে?
নীল অবাক চাহনী তে তাকিয়ে রয়েছে মনির দিকে। মনি সম্মোহিত হয় সে দৃষ্টিতে। কিছু জিজ্ঞাসা করার কথা হটাৎ মাথা থেকে হাওয়া হয়ে গেছে তার। নীল আবেশি গলায় বলে
-আজ সারাদিনে একটাবারের জন্য তোমাকে দেখিনি। গায়ে হলুদেও তোমাকে আমার থেকে আড়াল করা হয়েছে। যতদুর শুনেছি, কাল বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার আগ পর্যন্ত তোমাকে দেখতে পাবোনা মনি। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি তোমায় না দেখে, তোমার কথা না শুনে।
মনি হাসলো। নীলের বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বললো
-এতো অধৈর্য হলে কি চলে।
-তোমার ব্যাপারে আমার এতো ধৈর্য আসে না মনি।
-একটু ধৈর্য ধরুন৷ শুধু আজকের রাত টা।
নীল হাসলো। সে মনির কপালে চুমু খাওয়ার জন্য উদ্ধত হল, ঠিক সেই মুহূর্তে পাশ থেকে হালকা কেশে উঠলো আশা। মনি ছিটকে দূরে গিয়ে দাড়ালো। নীলও কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। আশা কপাল বাকিয়ে তাকিয়ে আছে নীল আর মনির দিকে। নীল মেকি হেসে আশাকে বললো
-তু তুই এখানে কি করছিস?
-দেখছি, কি আর করবো।
-এটা কি ঠিক না আশা। আমি তোর বড় ভাই।
-তোর কি কোনো লজ্জা নেই রে ভাই, বিয়ের আগেই বউ এর সাথে রোমান্স করতে চাইছিস।
মনি লজ্জায় মাথা নিচু করে। নীল আশার মাথায় চাপড় মেরে বলে
-বড্ড বড় হয়ে গেছিস তাই না।
-হুম। এবার মনিকে ছেড়ে নিজের রুমে যা। কাল দেখিস বউকে, আজ অনেক হয়েছে।
মনি হাসলো। সে নীল কিংবা আশার অপেক্ষা না করে রুমে চলে গেলো।
নীল নিজের রুমের দিকে যেতে যেতে বললো
-ভাবতে অবাক লাগে, তুই আমার বোন।
-ভাবিস না, তাহলেই তো হয়।
পরের দিন সকাল সকাল আশাকে আর মনিকে সাজানোর জন্য পার্লার থেকে মেয়ে আনানো হলো। তারা মনি আর আশাকে সাজাতে ব্যস্ত। মুনিয়া আজ সম্পুর্নই হিমার তত্ত্বাবধানে। যেহেতু প্রেগন্যান্সির কারণে সে কোনো কাজে থাকতে পারবে না, তাই সে মুনিয়াকে সামলাচ্ছে।। বাইরের বড় উঠোনটায় অনেক বড় করে ডেকোরেশন করা হয়েছে। নিলয় আর ওর বাবা মিলে সেটার দেখাশোনা করছে। বাবুর্চিরা ইয়া বড় বড় পাতিলে রান্না বসিয়ে দিয়েছে অনেক আগেই।
দুপুরের আগ নাগাদ শ্রাবণের বাড়ি থেকে বরযাত্রী চলে আসে। নিলয়, ওর বাবা আর অন্যান্য মুরুব্বীরা শ্রাবণদের আপ্যায়ন করতে চলে যায়৷ এদিকে নীলকে বর সাজিয়ে স্টেজে বসানো হয়েছে। শ্রাবণ আর নীল দুজনের জন্য আলাদা আলাদা স্টেজ বানানো হয়েছে।
বরযাত্রীদের খাবার দাবার শেষ হলে বিয়ের আয়োজন শুরু করা হয়। নীল যেহেতু বড়, তাই সর্বপ্রথম নীলের বিয়ের কাজ শুরু করা হয়। কাজী সাহেব প্রথমে তার সমস্ত ফর্মালিটি কমপ্লিট করলেন। এরপর নীল আর মনির বিয়ে সম্পন্ন করলেন। কাজী সাহেব যখন কবুল বলার জন্য মনিকে বলছিলেন তখন মনির মনে কোনোরকম জড়তা কাজ করেনি। বরং এক অজানা সুখের খোঁজ পাচ্ছিলো সে এই আলহামদুলিল্লাহ বলে কবুল বলার পেছনে। সে কোনো দ্বিধা ছাড়া মনের আনন্দেই কবুল বলেছিলো।ছোট্র মুনিয়া তখন মায়ের কোলে বসে ফ্যালফ্যাল করে মায়ের মুখপানে তাকিয়ে ছিলো।
মনি আর নীলের বিয়ে কমপ্লিট হলে কাজী সাহেব আশা আর শ্রাবণের বিয়ে পড়াতে উদ্ধত হন। আগের মতো সমস্ত ফর্মালিটি কমপ্লিট করে ওদের বিয়েও সম্পন্ন করেন। যেহেতু শ্রাবণ দের বাড়ি আশাদের বাড়ি থেকে অনেকটাই দূরে তাই তাদের যাওয়ার তাড়াটাও ছিলো ভীষণ রকম। নতুন বউ নিয়ে তারা সন্ধ্যের আগে রওনা করতে চায়। আশাদের বাড়ি থেকে কেউ কোনো আপত্তি করে নি। বিদায় নেওয়ার আগে আশার বাধ মানছিলো না আর। একমাত্র মনি ব্যতিত বাকি সকলের গলায় জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করেও ক্ষান্ত হচ্ছিলো না সে। মুনিয়াকে কোলে নিয়ে অনেক আদর করে দিয়েই সে বাপের বাড়ি ত্যাগ করলো। মুহুর্তটা ছিলো একদিকে সুখের, অন্যদিকে তীব্র বেদনার। যেখানে বেড়ে উঠা, সেখানটা ছেড়ে, পরিবারের সবাইকে পর করে নিজের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে পা রাখার নামই বিয়ে।
আশার বিদায়পর্ব শেষ হলে বিয়েতে নিমন্ত্রিত প্রায় সকলেই একে একে নীলদের বাড়ি ত্যাগ করতে থাকে। শুধুমাত্র কাছের আত্মীয়েরা থেকে যায়। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলো আরিশা। আশার খালাতো বোন। আরিশার মা আরশিয়াও এসেছেন। উনিও থেকে গেছেন আজ। উনার বিশেষ জোরাজুরিতে আরিশাও থাকতে বাধ্য হয়েছে। যদিও আরিশা আজ আসার জন্য মোটেও ইচ্ছুক ছিলো না। তবে, আরশিয়ার জোরাজোরিতে আসতে হয়েছে।
আরিশা অনেক্ষণ ধরেই ঘুর ঘুর করছে নীলের সাথে একটু আলাদা ভাবে কথা বলার জন্য। কিন্তু সেভাবে পাচ্ছেনা।। অনেক চেষ্টার পর একসময় ঠিকই সুযোগ হলো। নীল শেরওয়ানি পরিহিত থেকেই বাসার ছাদে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোলে আছে মুনিয়া। আঁধো আঁধো গলায় মুনিয়া বলছে
-তুমি আজ এতো সেজেছো কেন?
-আমি আজ পাকাপোক্ত ভাবে তোমার বাবা হয়েছি তাই।
মুনিয়া নীলের কথার মানে বুঝলোনা। নীল মুনিয়ার কপালে চুমু খেলো। আরিশা এতোক্ষন সবটাই দূর থেকে দেখছিলো।
শরীরে তার পিত্তি জ্বলছে। রাগে ফেটে যাচ্ছে সে। একসময় কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে সে এগিয়ে গেলো নীলের দিকে। পিছন থেকে বললো
-তোমার রুচির নিন্দে না করে পারছিনা নীল।
নীল চমকে পেছনে তাকালো। আরিশা তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নীলের দিকে। এ দৃষ্টি দিয়ে যেনো এখনই সে নীলকে ভষ্ম করে দেবে। নীল হেসে বললো
-তুমি এখানে।
-উইস করতে এলাম।
-করো তাহলে। আমি ধন্য হই।
আরিশা মুখ বাকিয়ে বলল
-বিয়ে করার জন্য আর কাউকে পেলে না। যার চরিত্রে কলঙ্ক লেগে আছে তাকেই কিনা শেষে। আরিশার কথায় স্পষ্ট ঘৃণার ছাপ ভেসে আসছে। নীল হাসলো। বললো
-চাঁদেরও কলঙ্ক আছে। তাই বলে চাঁদকে কে না ভালোবাসে বলো।
– মনি আর চাঁদ কি এক এলো।
-আমার কাছে তো চাঁদের চেয়েও বেশি সুন্দরী আমার মনি।
আরিশা ঘৃণায় নাক কুচকালো। নীল হেসে বললো
-কি হলো?
-তুমি কি আমাকে দেখতে পাও না?
-হুম পেয়েছি। তোমার কাছে আমার একটা জিনিস চাওয়ার আছে। দেবে?
আরিশা উৎফুল্ল মেজাজে বললো
-কি চাও বলো। আমি তোমাকে সব দিতে প্রস্তুত।
-প্রমিস করো।
-প্রমিস।
নীল মুচকি হেসে বললো
-নিচে চলো।
-এখানে বলো। নিচে কেন যেতে হবে?
নীল হাসলো। নীলকে অনুসরণ করে আরিশা নিচে নেমে এলো।।একটা ঘরে এক জটলা মানুষ। রাবেয়া, আরশিয়া, হিমা নিলয় সবাই বসে আছে একসাথে। রাবেয়াকে মুলত বাকিরা শান্তনা দিচ্ছে। একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দেওয়ায় তিনি আজ বড্ড একাকী অনুভব করছেন। আরিশা আর নীলকে একসাথে ঘরে ঢুকতে দেখে কিছুটা ভ্রু বাকালো হিমা। বললো
-তোমরা? কিছু বলবে নীল?
-আসলে ভাবী, আমি আজ আরিশা কাছে একটা জিনিস আবদার করেছি। আর ও প্রমিস করেছে আমাকে দিবে। কি তাইতো আরিশা? দেবে তো নাকি?
আরিশা আত্মবিশ্বাসের সাথে বললো
-অবশ্যই দিবো। আমার ব্যাপারে তুমি জানোই না।
-আমি চাই, আমার বাসর ঘরটা আজ তুমি সাজাও।
আরিশা চমকালো। সে বজ্রপাতের ন্যায় তাকালো নীলের দিকে। কিছুটা সময় পিনপতন নীরবতা ছেয়ে গেলো।। নীল আবারও বললো
-কি হল আরিশা বলছো না যে কিছু। তুমি কিন্তু প্রমিস করেছো।
সকলের সামনে কথা দেওয়ায় আর মানা করতে পারলো না আরিশা। দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে বললো
-আচ্ছা।
_____
পুরোটা রুম আজ সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। চারিদিকে রজনীগন্ধা আর গোলাপের সুগন্ধ মো মো করছে। খাটের মাঝে লাল গোলাপের পাপড়ি দিয়ে লাভ শেইপ দেওয়া আছে। তারই মাঝে লম্বা ঘোমটা দিয়ে বসে আছে আশা। এক অজানা অনুভূতি আজ জেঁকে বসেছে তাকে। কিছুটা সময় পার হলে পায়ের আওয়াজ কানে আসে আশার। বুকে ধক করে উঠে হটাৎ। শ্রাবণ রুমে ঢুকেই ভেতর থেকে দরজাটা লাগিয়ে দেয়। আশা চুপটি মেরে তাকিয়ে থাকে তখনও। শ্রাবণ এগিয়ে আসে তার দিকে। আশার মনে হয়, এবার তার কিছু করা উচিৎ। সে মাথা তুলে তাকায়। শ্রাবণ গভীর চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। আশা বিছানা ছেড়ে নেমে শ্রাবণের সামনে এসে দাঁড়ায়। কিছুটা সময় দুজন দৃষ্টি বিনিময় করে। এক পর্যায়ে আশা নিচু হয়ে বসে শ্রাবণকে সালাম করতে যায়। তার আগেই তাকে খপ করে ধরে ফেলে শ্রাবণ। আশা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকে তার দিকে।।শ্রাবণ আশাকে আলতোভাবে ধরে বিছানায় বসিয়ে দেয়। সাথে নিজেও বসে। শান্ত গলায় বলে
-অতঃপর, পার্মানেন্ট ভাবে নিজেকে আমার কাছে সপে দিলে তো?
আশা মাথা নাড়ায়। শ্রাবণ মুচকি হেসে বলে
-নতুন জীবনে পদার্পণ করতে প্রস্তুত?
আশা মুচকি হাসে এবার। তবে মুখে নেই কোনো কথা। শ্রাবণ মুচকি হেসে নিজের কাছে টেনে নেয় আশাকে। বাহুডোরে আবদ্ধ করে বলে
-ভালোবাসি প্রিয়া, নিজের চেয়েও বেশি।
এদিকে ঘর সাজিয়ে রাগে ফুসতে ফুসতে বেরিয়ে এলো আরিশা। ওকে এমনভাবে বেরোতে দেখে খুব হাসি পায় নীলের। আরিশার সামনে দাঁড়িয়ে বলে
-বখশিশ নেবে না?
-ছাই পড়ুক তোমার ওই বখশিশে।
হনহন করে চলে গেলো আরিশা। নীল হাসলো ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে।
_____
“আমি তোমারই প্রেমে মোহিত হয়েছি,
আমি তোমারই নেশায় মত্ত রহিয়াছি..
ভালোবেসেছি, ভালোবাসবো..
ভালোবাসায় মত্ত হয়ে, তোমাতে ডুবিবো…””
নীলের বলা ছন্দগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে মনি। নীল নেশাভরা চোখে দেখছে মনিকে। আজ লাল শাড়িতে বড্ড বেশিই ভালো লাগছে তাকে। চোখ ফেরানো দায় হয়ে গেছে তার। মনির কোলে মুনিয়া বসা। নীল মুনিয়াকে টেনে নিজের কোলে নেয়। আদর দিয়ে বলে
-আমায় আব্বু বলবে না মুনিয়া..
মুনিয়া ফ্যালফ্যাল করে তাকায় নীলের দিকে। নীল আবারও বললো
-আব্বু বলো সোনা..
মুনিয়া আধো গলায় বলে
-আব্বু।
নীল হাসে। সে জরিয়ে ধরে মুনিয়াকে। নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। মনি তৃপ্তির নিশ্বাস ছাড়ে বাবা মেয়ের মুহূর্ত দেখে।
এরই মাঝে দরজায় টুকা পরে। নীল সামান্য বিরক্তি নিয়ে বলে
-এই সময় আবার কে এলো।
নীল উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই হিমা এসে ঢুকে ঘরের ভেতরে। নীল আহত গলায় বলে
-তুমি আবার কেন এলে ভাবী..
-আমার মেয়েকে নিতে এসেছি আমি।
হিমা মনির কোল থেকে মুনিয়াকে টেনে নেয়। মনি বলে
-মুনিয়া থাকুক আমার কাছে ভাবী।
-তোমার কাছে তো সারাজীবন থাকবেই মনি। আজ নাহয় আমার মেয়েটা আমার কাছেই থাকুক।
মনি আর কিছু বলতে পারলোনা। হিমা চলে গেলে নীল দরজা লাগিয়ে এগিয়ে আসে মনির দিকে। ওর পাশে বসে হাতে হাত রেখে বলে, “শুধু মেয়ে দিয়ে হবে, ছেলে লাগবে না? আমি শুধু মুনিয়ার না, ছেলেরও বাবা হতে চাই৷ এক মেয়ে, এক ছেলে। তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে মনি?
মনি অবাক হয়ে তাকায় নীলের দিকে। নীলের মুখে দুষ্টু হাসি। মনি এবার লজ্জা পায়। সে লজ্জামাখা মুখে বলে
-আপনি যে কি না…
-আমি তো তোমার বর। একমাত্র বর।
মনি হাসে। নীল সে হাসিতে আত্মহারা হয়ে মনির কানে ফিসফিসিয়ে বলে
“এ হাসিতে আমি বারংবার মারা পরছি মনি। বেঁচে থাকার অক্সিজেন টুকু এবার আমার চাইই চাই।
মনি হেসে বললো,
-আমি আপনার অক্সিজেন হয়েই সারাজীবন বেঁচে থাকতে চাই প্রিয়”
নীল মনিকে জরিয়ে ধরে বললো,
-তাহলে হয়ে যাক, অক্সিজেন দেওয়া নেওয়া.
মনির এবার লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে। নীল আর কোনো কথা না বলে মনিকে টেনে নিলো নিজের কাছে। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো
-এই মুহূর্ত থেকেই ছেলের নাম ঠিক করে রাখতে পারো। আমার কোনো আপত্তি নেই।
-আপনি বড্ড দুষ্ট।
-আমি জানি, এতেই তুমি তুষ্ট।
____
সকাল সকাল ভেজা চুলের স্পর্শ পেয়ে ঘুম ভাংগে নীলের। মনি তাওয়ালে চুল পেচিয়ে নীলের পাশে বসে আছে। ঘুমন্ত মুখখানা দেখছিলো সে। এরই মাঝে তাওয়াল খুলে গিয়ে চুলগুলো নীলের বুকে ঝাপটা দেয়। তাতেই ঘুম ভেংগে যায় তার। চোখ মেলে মনির মুখটা দেখা মাত্রই হাসে নীল। একহাতে টেনে নেয় তাকে। মনি বাধ সেধে বলে
-দুষ্টুমি ছেড়ে এবার উঠুন। ঘড়িতে কয়টা বাজে একবার দেখুন। রান্নাবান্না শেষ, সবাই আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। একসাথে খাবে বলে। নীল ভ্রু বাকায়। এতো সকালে কে রান্না করলো। আজানের সময় উঠে রেঁধেছে নাকি। সে ফোনটা হাতে নিয়ে টাইম দেখেই চোখ কপালে উঠে। ঘড়িতে ১০:১০ বাজে। সে ধরফরিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে। দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকতে ঢুকতে বলে, “এতো বেলা হয়ে গেলো আগে কেন ডাকোনি?
মনি হাসলো নীলের এহেন কান্ডে।
সকালের খাওয়া শেষে আবারও এক জটলা বাধলো ড্রয়িং রুমে। একেক জন একেক কথা বলায় ব্যস্ত। এমন সময় নীল ওর বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল
-আমি আজ মনিকে নিয়ে একবার ওদের বাড়িতে যেতে চাই বাবা।
নীলের বাবা একবার রাবেয়ার দিকে তাকালো। এরপর কিঞ্চিৎ হেসে বললো
-আমরা সেটাই ভেবেছিলাম। মেয়েটা অনেক কিছু হারিয়ে এবার একটা সংসার পেয়েছে নিজের করে। এ সুখের মুহূর্তে তার বাবা মায়ের সান্নিধ্য পাওয়া উচিত। নীল কৃতজ্ঞতা জানালো ওর বাবা মাকে। অন্যদিকে মনির চোখের কোনে এক বিন্দু পানি দেখা গেলো।৷ এ পানি সুখের পানি। নীলকে জীবনসঙ্গী হিসেবে মেনে নিয়ে সে কোনো ভুল করেনি।
_____
বাবার বাড়িতে এসেছে অনেক্ষণ হয়েছে। এতোদিন পর মেয়ে, নাতনি আর মেয়ের জামাইকে পেয়ে প্রচন্ড খুশি রহিম আর মনির মা। সাধ্যমতো উনারা জামাই এর আপ্যায়ন করাতে ব্যস্ত। মনিও আজ খুশি, নীল মনির খুশিতে নিজের খুশি খুঁজে পায়।
বিকেল বেলা নীলের ইচ্ছে হয় একটু বাইরে হাঁটাহাটি করার। বাবা মায়ের কাছ থেকে হুকুম নিয়ে মুনিয়াকে নিয়ে বাইরে বেরোয় নীল মনি। মুনিয়ার হাত ধরে দুজন হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে পাড়ার সেই চায়ের দোকানটার কাছাকাছি চলে যায় ওরা। দোকানটা এখনো সেই আগের মতোই রয়ে গেছে।
উষ্কখুষ্ক চুল, নোংরা পোশাক পরে একটি ছেলে বসে সিগারেট টানছে। কিছুক্ষণের জন্য নীল আর মনি কথায় ব্যস্ত হয়ে যায়, ঠিক সেই সময়ে অবুঝ মুনিয়া দৌড়ে চলে যায় সে ছেলেটির কাছে। মুনিয়া এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। ছেলেটির নজর আসে হটাৎ মুনিয়ার দিকে। মুগ্ধ চোখে তাকায় সে মুনিয়ার দিকে। হটাৎ মুনিয়া বলে উঠে
-কি খাও?
নিয়ান হাতের সিগারেট টার দিকে তাকায়। এরপর হেসে বলে,
-সিগারেট খাই।
-পচাঁ গন্ধ। ফেলে দাও।
নিয়ানের ইচ্ছে করে মেয়েটিকে ছুতে। বেশ মায়া লাগে মেয়েটির প্রতি। সে হাতের সিগারেটটা ফেলে দিয়ে হাটুগেড়ে মুনিয়ার সামনে বসে। আলতো হাতের স্পর্শে মুনিয়ার গাল স্পর্শ করে বলে
-তুমি কে মামনী?
-আমি, আমি মুনিয়া।
নিয়ান কিছুটা চমকায়। এ নামটা সে আগেও শুনেছে।
নিয়ান মুনিয়াকে কোলে নিয়ে বলে
-কোথায় এসেছো তুমি? কার সাথে এসেছো মামনি?
মুনিয়া হাতের ইশারায় মনি আর নীলকে দেখায়।৷ নিয়ান ওদের দেখে আঁতকে উঠে। বসা থেকে দাঁড়িয়ে পরে হটাৎ। ততোক্ষণে নীল মনির দৃষ্টিও এদিকে আসে। ওরা কিছুক্ষণ স্তব্দ হয়ে তাকিয়ে থাকে নিয়ানের দিকে। নিয়ান মুচকি হাসে। ধীরপায়ে মুনিয়াকে কোলে নিয়ে এগিয়ে আসে ওদের দিকে। মনি চোখ ফিরিয়ে নেয়। নিয়ান হাত এগিয়ে দেয় নীলের দিকে। নীল হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে দেয়। একে অন্যের সাথে কুশল বিনিময় করে। নিয়ান এবার মনির দিকে দৃষ্টি দেয়। নীরব গলায় বলে
-কেমন আছো মনি?
মনি উত্তর দেয় না। নীলের মনে হয়, ওর একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ানো উচিত। একটু কথা বলার সুযোগ দেওয়া উচিৎ। সে মুনিয়াকে কোলে নিয়ে সামান্য দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। নিয়ান মনিকে প্রশ্ন করে
-মুনিয়া আমার মেয়ে তাইনা?
মনি চমকে তাকালো নিয়ানের দিকে। নিয়ান হেসে বলল
-মেয়ের দাবী করবোনা মনি। শুধু একবার বল, এ আমার মেয়ে তো তাইনা? আমার রক্তের মেয়ে?
মনি শক্ত গলায় বললো
-আপনার রক্তের ঠিকই, কিন্তু আপনি তার বাবা না।
নিয়ান হেসে বললো
-অধিকার নেই জানি তো।
মনির হটাৎ মনে হলো, এ নিয়ান আগের নিয়ান নয়। এ সম্পুর্ণ নতুন এক নিয়ান। মনি আগ্রহ নিয়ে বললো
-আপনার কি খবর? ইতি ভালো আছে তো?
-ইতি নেই মনি। সে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।
মনি অবাক হয়ে বললো
-মানে?
নিয়ান তীব্রভাবে হেসে বললো
-ও সন্তান ধারণে অক্ষম। টেস্টের রিপোর্ট এও তাই এসেছে। কিন্তু সে এটা মানতে নারাজ।। সারা এলাকা রটিয়েছে, আমি টাকার বিনিময়ে রিপোর্ট তৈরি করেছি।
-ওহ। আর বিয়েশাদি করেন নি পরে?
-চেষ্টা করেছিলাম। তবে আমার এই সংবাদ টা চারদিকে এমনভাবে রটেছে, আশাপাশের সব গ্রাম এখন এটাই জানে, আমি সন্তান ধারণে অক্ষম। এক অক্ষম ছেলেকে কি কোনো মেয়ে বিয়ে করতে চায়?
নিয়ানের চোখেমুখে হতাশা। মনি বললো
-চাইলে সবার ভুল ভাঙ্গাতে পারতেন। দূরে কোথাও বিয়ে করতে পারতেন। রিপোর্টের সত্যতা সবাইকে জানাতে পারতেন।
-নিজের ভুলটা যখন বুঝতে পেরেছি, তখন সব চেষ্টা বাদ দিয়েছি মনি। এটা তোমার সাথে করা অন্যায়ের ফল। আল্লাহ ছাড় দেন, কিন্তু ছেড়ে দেন না। আমিই তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।
মনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো
-পিছনে যা ঘটেছে, তা সবটা দুর্ঘটনা ভেবে নতুন করে জীবন শুরু করেন। যেমনটা আমি করেছি।
নিয়ান নীল আর মুনিয়ার দিকে তাকালো। কিঞ্চিৎ হেসে মনিকে বললো
-আমাকে মাফ করেছো তো মনি?
-মাফ করার আমি কে!
নিয়ান হাসলো। মনি নীলের দিকে তাকিয়ে নিয়ানকে বললো
-জীবনটা হেলায় শেষ করে দিবেন না। বাকি জীবনে কাউকে সঠিকভাবে বেছে নিয়ে জীবনের মাহাত্ম্য বুঝুন। আমি বরং যায়। উনি অপেক্ষা করছেন আমার জন্য।
নিয়ান হাসিমুখে বিদায় দিলো মনিকে। মনি এগিয়ে চলেছে নীলের কাছে।
নীলের কাছাকাছি যেতেই নীল বলল
-কথা হলো?
-হুম।
-মাফ করেছো?
-যদি শাস্তি দেওয়ার মালিক আল্লাহ হয়ে থাকেন, তাহলে মাফ করার মালিকও তিনি। আমি তো নস্যি মাত্র। তবে, উনার সাথে যা ঘটেছে, আমি তা চাইনি। সত্যিই চাইনি।
-জীবনটাই এমন মনি। কখন কি হবে, না হবে তা আল্লাহ ছাড়া আর কেউই জানেন না।
-হুম।
-এবার বরং চলো।
-হুম, চলুন…
[সমাপ্ত]
[কেমন হয়েছে জানাতে ভুলবেন না কিন্তু। নিয়ানের শাস্তি পছন্দ হয়েছে কি হয়নি, সেটাও জানবেন🙂]