#বাঁধিব_হৃদয়ে_তোমায়
#পর্ব_০২
#সুমাইয়া মনি।
‘ভিক্ষুকের অভিনয় করে দেখাতে হবে। সামিম ক্যান্টিন থেকে একটি বাটি নিয়ে আয়।’ কাঠ কাঠ কন্ঠে কথাটি বলে উঠে আবির।
সামিম আবিরের নির্দেশ অনুযায়ী ক্যান্টিনের দিকে দৌঁড়ে যায়। আবিরের দিকে তাকিয়ে শুঁকনো গলায় পুনোরায় ঢোক গিলে বিভা। অপমানে মুখ থমথমে হয়ে আছে তার। দূর থেকে কিছু ছাত্রছাত্রীরা দাঁড়িয়ে তাদের দেখছে। সামিম ফিরে আসে একটি বাটি নিয়ে। আবির হাতে নিয়ে বিভার দিকে এগিয়ে দেয়। বলে,
‘শুরু করো অভিনয়।’
বিভা দৃষ্টি নত রেখে বলল,
‘আমি পারব না।’
‘না বলার পরিনতি কিন্তু ভয়ানক হবে মিস… নাম কি তোমার?’ পাল্টা প্রশ্ন করে আবির।
‘বিভা।’
‘বিভা হও বা টিভা, অভিনয় শুরু করো।’
অসহায় হয়ে আবির সহ ওর বন্ধুদের দিকে একবার তাকায়। সে চাইলেই প্রতিবাদ করতে পারে। কিন্তু আপুর কথা ভেবে চুপ আছে।
‘কি হলো…আহ!’ আবিরের পুরো কথা শেষ করার আগেই একজন মহিলা এসে আবিরের কান মলে দেয়। তাকে দেখে ভয়তে সকলে জড়োসড়ো। আইরিন ম্যাম এই কলেজের টিচার এবং আবিরের নিজের মা। তার ছেলের কর্মকাণ্ডে তিনি ভীষণ ক্ষেপে আছে। প্রতিদিনই স্টুডেন্ট রা তার কাছে আবিরের নামে যার্গের বিচার নিয়ে হাজির হবে। আজও এক স্টুডেন্ট তাকে ডেকে নিয়ে এসেছে। তিনি রাগী কণ্ঠে বলে,
‘তোমাকে বহুবার বলা হয়েছে স্টুডেন্টদের যার্গ-টার্গ না দিতে।
কথা শুনছো না। তুমি কলেজের স্টুডেন্ট নও। ভার্সিটির থার্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট। তাহলে তুমি কীভাবে কলেজের স্টুডেন্টদের যার্গ দেও? এখন মেয়েদের সঙ্গে মিসবিহেভ করছো। না জানি কখন সম্মান নিয়ে টানাটানি করবে।’
আবির ভীরু গলায় বলল,
‘আম্মু আমি এমনটা কখনোই করব না…’
‘থামো! এটা কলেজ। আমাকে ম্যাম বলে সম্বোধন করবে আম্মু নয়। তোমার বন্ধুদের নিয়ে যাও এখান থেকে। কোনো ক্লাসরুমে যেন না দেখি তোমাদের। ক্লাসরুম তোমাদের আড্ডা দেওয়ার স্থান নয়। ফারদার যার্গের কাহিনী যেন না শুনি।’
আবির তার বন্ধুদের নিয়ে চলে যায়। বিভা অবাক হয়ে আইরিন ম্যামকে দেখছে। ফর্সা চেহারার সুন্দর গঠনের দেহ তার। চুল গুলো পরিপাটি করে বাঁধা। গায়ে খয়েরী রঙের শাড়ি। দেখতে ভীষণ সুন্দর তিনি। আইরিন ম্যাম বিভার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন,
‘কলেজে নতুন?’
‘জি ম্যাম।’
‘কোন গ্রুপের?’
‘সায়েন্স।’
‘ওহ! কিছু মনে কোরো না।’
নেতিবাচক মাথা দুলায় বিভা।
‘যাও ক্লাসে।’ বলে তিনি চলে যায়।
বিভা নিজের ক্লাস রুমে আসে। সবাই একবার বিভাকে দেখে। পরক্ষণে নজর সরিয়ে নেয়। বাকি সবার মতো বিভা এতটা স্মার্ট, স্টাইলিশ ছিল না। পরনে ছিল ঢিলাঢালা কালো রঙের থ্রিপিস। মাথার চুল গুলো বেনী করা। শ্যামলা গায়ের রং। অতি সুন্দর না হলেও, নজরে পড়ার মতো।
পিছনের বেঞ্চে এসে বসার পর একটি মেয়ে তার পাশে এসে বসতে বলে। বিভা বসে। মেয়েটি মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করে,
‘তুমি বোধহয় নতুন?’
‘হুম।’
‘আমিও নতুন। দু তিনদিন হয়েছে মাত্র। এখনো কারো সঙ্গে পরিচিত হতে পারিনি। তোমার নাম?’
‘বিভা। তোমার?’
‘মোহনা।’
দু’জনের বাক্যবিনিময়ের মাধ্যমে স্যার আসে। ক্লাস আরম্ভ হয় ওদের। অর্ধেক ক্লাস শেষ হবার পর তারা ক্যান্টিনে আসে। চিকেন রোল নিয়ে আসে মোহনা। নিজেই বিভাকে ট্রিট দিবে। খেতে খেতে গল্প করে। তখন সেখানে আবির তার বন্ধুদের নিয়ে উপস্থিত হয়। অনেকেই ওদের দেখে সিট ছেড়ে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে যায়। মোহনা আবিরের উপস্থিতি টের পেয়ে বিভাকে নিয়ে চলে যেতে চাইছিল। তবে বিভা খাবার শেষ করে যাওয়ার আর্জি জানায়। খাবার রেখে যাওয়া মানে নষ্ট করা। বিভা সেটা পছন্দ করে না। চুপচাপ বসে খাচ্ছে তারা।
আবির এক চেয়ারে বসে অন্য চেয়ারে পা উঠিয়ে বসেছে। ওর মধ্যে কেমন গুন্ডা গুন্ডা ভাব দেখা যাচ্ছে। জামিলা সেলফি তুলছে। সামিম, মারুফ কোল্ড কফির মজা নিচ্ছে। আবির আলস্য ভঙ্গি ভেঙে সামিমকে বলল,
‘দুইটা কফি নিয়ে আয় সামিম।’
‘কোল্ড, হট দু’টোই?’
‘হ্যাঁ!’
‘এক সঙ্গে দুইটা খাবি নাকি?’ জামিলা কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করে।
‘মোটেও না! চেটেচেটে তোদের মুখে ছুঁড়ে মারব।’ বিরক্ত স্বরে বলল আবির।
‘ওয়াক ছিঃ!’ নাক ছিটকায় জামিলা।
‘ঝামেলা কোথাকার।’ বিড়বিড় করে বলে আবির। জামিলা ঠিক শুনেছে কথাটি। বলল,
‘একদম আমাকে ঝামেলা বলবি না আবির।’ আঙুল তুলে বলে জামিলা।
‘ভুল কোথায় বললাম। তুই তো আসলেই একটা ঝামেলা।’
জামিলা রাগে ফুঁসছে। ছোঁ মেরে সামিমের হাত থেকে কফি নিয়ে ছুঁড়ে মারে আবিরের উদ্দেশ্যে। আবির দ্রুত মাথা নিচু করে ফেলে। যার দরুন মোহনার মুখে কফিটি লাগার আগেই বিভা প্লেট দিতে ঢেকে ফেলে মোহনার মুখমণ্ডল। আকস্মিক ঘটনায় তারা বাদে উপস্থিত সকলে বিস্মিত! এমনটা হবে কেউ বুঝে নি। পাশাপাশি সিট ছিল ওদের। দূরত্ব ছিল দু তিন হাত। বিভা ওদের কথপোকথন শুনলেও, মোহনা বকবক করার দরুন কিছু শুনে নি। মোহনা অবাক নজরে বিভাকে দেখছে। যদি কফিটা গায়ে লাগতো লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়তে হতো। সেটির হাত থেকে বিভা ওঁকে রক্ষা করেছে। বিভা প্লেট রেখে উঠে দাঁড়িয়ে আবিরদের টেবিলের কাছে এসে দাঁড়ায়। বলে,
‘এমন কোনো রাগ বা দুষ্টুমি করবেন না। যার ফলে অন্যদের ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা থাকে।’
‘স্যরি।’ জামিলা নিচু স্বরে বলে।
কিন্তু আবির ক্ষেপে উঠে দাঁড়ায়। বিভার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
‘তোমার কাছ থেকে জ্ঞান নিতে প্রস্তুত নই।’
‘কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছোটদের কাছ থেকে জ্ঞান নেওয়া উত্তম বলে মনে করি।’
‘নট ইন্টারেস্টেড!’
‘ইচ্ছে! জোর করে চাপিয়ে দওয়া হচ্ছে না।’ বলেই মোহনাকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। আবির বিভার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রাগী নিশ্বাস ত্যাগ করে।
_____
ববি একটি গার্মেন্টসে চাকরি করে। এখন সে কর্মস্থানে আছে। একটি শার্ট সেলাই করছিল তখন সেখানে মেনেজার আকবর আলির আগমন ঘটে। বয়স অনুমান ৫৫-৫৬ হবে। চুলে ক্লব দেওয়া। পান খেয়ে ঠোঁট লাল টকটকে করে রেখেছে। ববির একটু কাছে ঘেঁষে হাত ধরে বললেন,
‘এই ভাবে করো বেবি।’
‘ববি আমার নাম আঙ্কেল।’ হাত ছাড়িয়ে বিরক্ত নিয়ে বলল ববি।
‘থুক্কু! মনেই থাকে না। খালি ভুইল্লা যাই।’ লাল টকটকে দাঁত গুলো দিয়ে হেসে বললেন তিনি।
ববি বিরক্ত প্রকাশ করে৷ মুখে কিছু বলে না। ববি এখানে জয়েন্ট হবার পরপরই আকবর আলি কু নজর পড়েছে ওর ওপর। ববির গায়ের রং কালো হলেও দেখতে মন্দ না। কাজ দেখানোর বাহানায় গায়ে হাত দেওয়ার বাহানা খুঁজে আকবর আলি। শুধু ববি নয়। সুযোগ পেলেই এখানে অনেক মেয়েদের গায়ে হাত দিয়ে কথা বলেন তিনি। বলা যায় এটা তার অভ্যেস। চাকরি যাওয়ার ভয়ে কেউ নালিশ দিতে পারে না। আকবর আলি পুনোরায় হাত ধরতে গেলে ববি হাত সরিয়ে নেয়। এতে সে কিছুটা অপমান বোধ করে। ক্ষোভ নিয়ে তার ডেকে চলে আসে।
ববি কিছুটা হলেও হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে। মুঠোফোনটি বের করে মায়ের কাছে কল দেয়। জিজ্ঞেস করে বিভা কলেজ থেকে বাড়িতে ফিরেছে কি-না। বিভার কাছে ফোন নেই। বাসায় আসেনি শুনে কল কেটে দেয়। ববি ভাবে বিভাকে একটি ফোন কিনে দিবে। তাহলে হয়তো একটু হলেও চিন্তামুক্ত থাকতে পারবে।
_______
রাতে….
‘তোর তো প্রাইভেট পড়তে হবে তাই না বিভা?’
‘হ্যাঁ! আপু।’
‘কলেজে এমন কেউ আছে, মানে ভালো শিক্ষক?’
‘আছে আফিন স্যার। তিনি সায়েন্সের স্টুডেন্টদের পড়ায়। মোহনও তার কাছে প্রাইভেট পড়বে বলেছে।’
‘কত কি টাকা নিবে আলাপ করে কাল আমাকে জানাস।’
‘জি আপু।’
‘বলছিলাম কি, প্রাইভেট না পড়লে হয়না। এত টাকা ..’
‘টাকা নিয়ে ভেবো না মা। আমি ওভারটাইম করে নিবো। বিভার প্রাইভেট খুব জরুরী। সায়েন্সের স্টুডেন্ট বলে কথা।’
‘তোর কথা একবার ভাব ববি।’
‘সেই ছোট থেকে সব ভেবে নিয়েছি মা। এখন আর নতুন করে ভাবার নেই কিছু।’
‘আপু তোমার ওভার টাইম করতে হবে না। আমি পড়ব না।’
‘চুপ! কাল গিয়ে স্যারের সঙ্গে কথা বলে আসবি। প্রাইভেট পড়বি ব্যস!’
ববির কথার উপর আর কিছু বলল না তারা। দীর্ঘশ্বাস টেনে নিলেন বিলকিস বানু।
.
কলেজ শেষ করে প্রাইভেটের জন্য কথা বলতে শিক্ষক কক্ষে যায় বিভা, মোহনা। তারা ধীরে ধীরে একে অপরের সঙ্গে অনেকটা ক্লোজ হয়েছে। তুই করে সম্মোধন করে।
ভেতরে প্রবেশ করার পূর্বে মোহনার ফোন বেজে উঠে। বিভাকে ভেতরে যেতে বলে মোহনা বাহিরে থেকে যায়।
মনে কিঞ্চিৎ ভয় নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে সে।
উল্টোদিকে মুখ করে চেয়ারে হেলান নিয়ে ফোন টিপতে মগ্ন আবির। তাকে ছাড়া আর কাউকে দেখতে পায় না সে। বিভা ওর মুখ দেখনি। তাকেই আফিন স্যার ভেবে নেয়।
দ্বিধাবোধ ফেলে বলে,
‘স্যার আপনার সঙ্গে কথা ছিল?’
আবির মেয়েলী কণ্ঠের স্বর শুনে, না ফিরেই ফোন লক করে উঁচু করে ধরে স্ক্রিকে বিভাকে দেখে বাঁকা হাসে। সে বুঝতে পেরেছে বিভা ওঁকে স্যার মনে করেছে। গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
‘বলো?’
‘আমি ও মোহনা আপনার কাছে প্রাইভেট পড়তে চাই। বেতন কত নিবেন? বাসায় পড়াবেন নাকি কলেজে বললে ভালো হতো।’
‘প্রথমত, আমি প্রেমের পাঠ পড়াতে জানি। দ্বিতীয়, আমার সঙ্গে প্রেম করলে ফ্রি-তে পড়াবো। তৃতীয়, কলেজ, বাসায়, পার্কে, রেস্টুরেন্টে এক স্থানে প্রেমপাঠ পড়লেই হবে।’
উত্তর শুনে বিভার চোখমুখ ঘুচে আসে। তীব্র রাগের আভা দেখা যাচ্ছে আদলে। তেড়ে এসে আবিরের সামনে দাঁড়ায়। ওঁকে দেখে রাগ যেন দ্বিগুণ বেড়ে যায়। আবির মুচকি হাসে বিভাকে দেখে। মুখ খুলে কিছু বলতে নিলে আবির পূর্বে বলে উঠে,
‘আরে ভাবী’যে তুমি না-কি।’
‘সাট-আপ! আমার নাম বিভা। আর আপনি এখানে কেন। শিক্ষক কক্ষকেও নিজের আড্ডা স্থান বানিয়ে ফেলেছেন।’
আবির চট করে উঠে দাঁড়ায়। বিভার ধমকে নাকে তীব্র রাগ দেখা যায় তার। কাঠিন্য কন্ঠে বলে,
‘সাহস হয় কি করে আমাকে ধমক দেওয়ার।’
‘আপনার সাহস হয় কি করে আমাকে প্রেমের পাঠ শিখানোর কথা বলার।’
‘তুমি আমাকে…’
‘এখানে কি হচ্ছে শুনি?’ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বলল আফিন।
‘কিছু না।’ কথাটি বলে জায়গা প্রস্থান করে আবির।
বিভা কিছুটা অবাক হয়। আফিন বিভাকে জিজ্ঞেস করে,
‘কিছু বলতে চাও তুমি?’
‘জি।’
‘বলো?’
.
.
.
#চলবে?
কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।