#বাঁধিব_হৃদয়ে_তোমায়
#পর্ব_১৭
#সুমাইয়া মনি
রতন বোস সকলের সঙ্গে বিভার পরিচয় করিয়ে, পরিশেষে আবিরের সঙ্গে পরিচয় করাতে এগিয়ে আসে।
‘ওনি হচ্ছেন আমাদের কোম্পানির মালিকের ছোট ছেলে আবির আহমেদ। বর্তমানে তিনিই এখন আমাদের কোম্পানির মালিক।’
বিভা ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল,
‘হ্যালো! মি.আবির আহমেদ।’ বলে হাত বাড়িয়ে দেয়।
আবির কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বাঁকা হেসে হাত এগিয়ে বলল,
‘হাই!’
‘তো? কেমন আছেন?’
‘যেমন রেখে গিয়েছিলে?’
‘হোয়াট?’ ভ্রু কিঞ্চিৎ ভাজ ফেলে বলল।
‘নাথিং।’ মৃদু হেসে বলল আবির।
বিভা কিছুটা বিরক্ত বোধ করে অন্য পাশে এগিয়ে যায়। একজন গার্ড চেয়ার এগিয়ে দেয় বসতে। বিভা বসে। ওর পাশে জিনি নামের মেয়েটিও বসেছে। আবির এক দৃষ্টিতে বিভাকে দেখছে। চোখের পলক ফেলার কোনো চান্স নেই।
এত বছর পর প্রিয়তমা’কে দেখে চোখ জুরিয়ে নিচ্ছে। তবে বিভার অদ্ভুত আচরণে তার মনে সন্দেহর বীজ তৈরী হয়েছে। জামিলা আশ্চর্যজনক কণ্ঠে বলে উঠে,
‘এ আমি কাকে দেখছি। এটা কি সেই বিভা…!’
‘যার ছিল না কোনো সাজসজ্জা, ড্রেসআপ..।’ মারুফ জামিলার সঙ্গে তাল মিলায়।
আবির পকেটে হাত পুরে বলল,
‘সময় যদি বদলাতে পারে। মানুষ কেন বদলাবে না?’
‘নিজেকে জারা বলে কেন পরিচয় দিচ্ছে। ওর নাম তো বিভা।’ জামিলা কুর্নিশ করে বলল।
‘নিজের সঙ্গে, পরিচয়ও পাল্টে নিয়েছে হয়তো।’ আবির স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে।
জামিলা রাগ নিয়ে আবির’কে বলল,
‘তুই এত স্বাভাবিক আছিস কিভাবে? তোর রাগ হচ্ছে না বিভার ওপর? এই মেয়েটার জন্য তুই এত বছর কত যন্ত্রণায় ছিলি।’
ফিক করে হেসে দেয় আবির। নেতিবাচক মাথা দুলিয়ে বলল,
‘কিছু অভিমান উড়িয়ে দিতে হয়। মনে রাখতে নেই। আমি জানি এটাই আমার বিভা।’
‘এক দেখাতেই চিনে নিলি?’ সামিম এতক্ষণ পর মুখ খুলল।
আবির সামিম’কে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে পিঠে চাপড় মেরে বলল,
‘তোকে ধন্যবাদ সামিম। তোর জন্যই বিভা’কে আমি পুনোরায় পেয়েছি।’
সামিম সহ সকলে বিস্মিত চোখে তাকায়। আবির পুনোরায় বলল,
‘রতন বোসের স্যালারি বাড়িয়ে দিবি।’
আবিরের এমন উদ্ভট কথা শুনে কেউ অবাক না হয়ে পারছে না। আইরিন বেগম, আফিন দূর থেকে আবিরের পাগলামি দেখছে। তারা এখনো কনফিউজড! এটা সত্যি কি বিভা নাকি জারা জেরিন? আইরিন বেগম বিভার নিকট এগিয়ে যায়। বিভা আইরিন বেগম’কে দেখে সালাম দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
‘কেমন আছেন আন্টি?’
‘ভালো। আমাকে চিনতে পেরেছো বিভা?’
‘নিশ্চয়, আবির আহমেদের মাম্মি আপনি।’
‘হুম।’
‘এতদিন কোথায় ছিল তুমি?’
‘নিজের বাড়িতে ছিলাম।’ হেসে হেসে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে বিভা।
‘আমার ছেলে….’
পুরো কথা বলার আগেই বিভার ফোন বেজে উঠে। বিভা শাহাদাত আঙুল তুলে ‘জাস্ট এ মিনিট’ বলে সেখান থেকে জনশূন্য স্থানে চলে আসে। সেখানে আসার পর পরই বিভার কন্ঠ চেঞ্জ হয়ে যায়। হাতের পার্সটি পাশের টেবিলের উপর রেখে গম্ভীর কণ্ঠে কাউকে বলল,
‘বলো, কোনো খবর পেলে?’
‘হ্যাঁ! একবার আসতে হবে।’
‘আসবো।’ বলে বিভা ফোন রেখে ঘুরে তাকায়। তখনই আবিরের সম্মুখীন হয় সে। হাত পকেটে পুরে ক্ষোভিত চোখে বিভা’কে দেখছে। বিভা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠে। এত দিন যেই মানুষটার কাছ থেকে আড়াল ছিল। আজ তার সামনে নিজেকে অপরাধী বলে মনে করছে বিভা। আবির ভাবছে, প্রচুর ভাবছে! এই মেয়েটির জন্য কত বছর অপেক্ষার প্রহর সে গুনেছে। কতোই না পাগলামি করেছে। এখনো হাতের মধ্যখানে সেই কাঁটা দাগটি রয়েছে। কিছু দাগ সহজে মুছে না। রয়ে যায় অনন্তকাল!
আবিরের চোখের মাঝে ঝেকে দেখার সাধ্য তার নেই। না মুখোমুখি দাঁড়ানোর কোনো অধিকার আছে! পাশ কাঁটিয়ে চলে যেতে নিলে আবির বিভার বাহু ধরে টেনে একই স্থানে এনে দাঁড় করায়। হাত সরিয়ে একটু কাছে এসে বলল,
‘এতদিন কোথায় ছিলে? প্রশ্ন করব না। শুধু বলব, তোমার বিরহে প্রতিটা ক্লেদাক্ত দিন গুলো ফিরিয়ে দেও। ফিরিয়ে দেও আমার চোখের অশ্রু! পারবে না তুমি। কেননা তুমি একজন হৃদয়হীন, পাষানী মেয়ে। যার মধ্যে ভালোবাসার ছিটেফোঁটাও নেই।’
অনাড়ম্বর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বিভা। বলার মতো কোনো বাক্য নেই। আবির এবার ক্রোধ নিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেসে ধরে বলল,
‘আমার কাছ থেকে তুমি এত সহজে মুক্তি পাবে না বিভা। নিজের পরিচয় অন্যের কাছে গোপন করলেও, আমি জানি তুমি আমার বিভা। তোমাকে আমার হৃদয়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখার প্রতিজ্ঞা নিয়েছি। এবার আর হারাতে দেবো না।’
‘পাগলামি করবেন না মি.আবির। আমি এখন আপনার বিভা নই।’ আবির’কে সরিয়ে বলল।
‘কে তুমি জারা?’ তাচ্ছিল্য হেসে বলল আবির।
বিভা উত্তর না দিয়ে ভ্রু কুঁচকে ফেলে। আবির আবার বলে,
‘তুমি আমার বিভা ছিলে, আছো, থাকবে সারাজীবন। আর রইলো পাগলামি! এখন থেকে তুমি আমার পাগলামি দেখবে। ভয়াবহ পাগলামি!’ পুরো কথা শেষ করে বিভা’কে শক্ত করে বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয় আবির। বিভা দম নিতে পারছে না। আবির বুঝতে পেরে ছেড়ে দেয়। তেজী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রস্থান করে। বিভা চোখমুখ ঘুচে তাকায়। এটা কোন ধরনের পাগলামি দেখিয়ে গেল বুঝতে পারছে না বিভা। ফোনে আবার একটি মেসেজ আসে। ওপেন করে বুঝতে পারে তাকে এখনই যেতে হবে। ফিরে যায় হল রুমে। দশ মিনিট সময় ব্যয় করে বিভা চলে যাওয়ার জন্য বিদায় নেয় সবার কাছে। প্রথমে তো সকলে ভেবেছিল বিভা’কে আবির যেতে দিবে না। কিন্তু সবার ধারণা পাল্টে যায়৷ আবির কোনো প্রকার পাগলামি করে না। বরং হাসিমুখে বিভাকে বিদায় দেয়। এতে বিভাও কিছুটা বিস্মিত! আপাতত সে এসব নিয়ে কিছু ভাবে না। তাকে যেতে হবে।
‘আবির, তুই ঠিক আছিস?’
আবির ভাবলেশহীন হয়ে বলল,
‘আমার কি হবে?’
সামিম তৎক্ষনাৎ বিভার কথা উল্লেখ করে না ৷ সে কিছুটা কনফিউজড হয়ে পড়ে। আবির হেসে অন্য পাশে এগিয়ে যায়। আফিন এগিয়ে আসে আবিরের নিকট।
.
‘থ্যাংক’স জারা! একদিনের জন্য আমাকে তোমার পদবি দিয়েছো।’ বিভা হাসিমুখে জিনি মানের মেয়েটিকে বলল। মেয়েটির আসল নাম জারা জেরিন। একজন নতুন মডেল। যার কারণে সে সবার কাছে এতটা পরিচিত নয়। তার পদবিটা বিভা একদিনের জন্য নিয়েছিল। সবাইকে চমকে দেওয়ার জন্য। এখানেও বড়ো রহস্য লুকিয়ে আছে।
‘না মেডাম! আপনার উপকার করতে পেরে আমি খুশি।’
‘আমি কিন্তু তোমাকে মাঝেমধ্যে জ্বালাব।’
‘সমস্যা নেই মেডাম। আমি আপনার সাহায্য করতে প্রস্তুত আছি।’
বিভা মৃদু হাসে। ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বলে,
‘সামনের গলিতে নামিয়ে দেও আমাকে।’
ড্রাইভার বিভার কথা অনুযায়ী সামনের নিরব গলিটির মুখে বিভাকে মানিয়ে দেয়। বিভা গাড়ি থেকে নেমে জারার কাছে বিদায় নিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করে। হাতের সিল্কের ওড়নাটি গায়ে পেঁচিয়ে নেয়। বিভা এমন একটি গলি ধরে হাঁটছে সেখানে মানুষজনের আনাগোনা একদমই নেই। পাশে বাড়িঘর আছে। কিন্তু কেউ বসবাস করে না। দু পাশে বড়ো বড়ো গাছপালা রয়েছে। এড়িয়াটা ভূতুড়ে পরিবেশের মতো। কিছু ল্যাম্পপোস্টের বাতি নিভু নিভু করে জ্বরছে।
বিভা নির্ভয়ে হেঁটে চলেছে। হঠাৎ ফিল করে তার পিছনে কেউ আছে। ঘুরে তাকায়। তীক্ষ্ণ নজর বুলিয়ে আগে ন্যায় হাঁটতে নিলে কারো সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে দু কদম পিছনে সরে যায়। কঁপাল কুঁচকে ফেলে। আবির’কে দেখে বিভা ভড়কে যায়। আবিরের নজর গম্ভীর! পরনে এখন আর কোট নেই কালো শার্ট রয়েছে। দু’হাতা কনুই পর্যন্ত ফোল্ড করা। গলায় কালো রঙের টাইটি ঢিলা করে রাখা। যেটা মৃদু বাতাসে উড়ছে। আরাম করে পকেটে হাত গুঁজে বিভাকে ক্ষীণ নজরে দেখছে।
বিভা আবির’কে এখানে দেখে বিস্মিত! তবে স্বাভাবিক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
‘আপনি এখানে?’
প্রশ্নটি শুনে আবির কিঞ্চিৎ বিরক্ত বোধ করল। বলল,
‘এরূপ প্রশ্ন আমার করা উচিত।’
‘মোটেও না। আপনি আমার পিছু নিচ্ছেন? এখানে কিভাবে পৌঁছালেন?’
আবির বিভার হাতের পার্সটি নিয়ে নেয়ে। দু’টি সাদা পাথরের বোতাম চাপ দিতেই খুলে যায়। তার ভেতর থেকে নিজের ফোনটি বের করে নেয়। বিভার দিকে ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘এবার নিশ্চয় বুঝেছো।’
বিভা চোয়াল জোড়া রাগে শক্ত করে ফেলে। এবার সে বুঝতে পেরেছে বিদায় নেওয়ার পরও আবির তাকে কেন আটকায় নি। আর তখন শক্ত করে জড়িয়ে কেন ধরেছিল। এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে অন্য হাত দিয়ে তার পার্সের মধ্যে ওর ফোনটি রেখে দিয়েছিল। ফোন সর্বক্ষণ হাতে থাকার ধরুন পার্সটি খোলা হয়নি। এবং সে বুঝতেও পারে তা তার পার্সটিয়ে আবিরের ফোন রয়েছে। যেটা তার অগোচরে রাখা হয়েছিল। আবির ফোনের লোকেশন অন করে রেখেছিল। তাই খুব সহজেই জানতে পারে বিভা এখন কোথায় রয়েছে। এবং চুপিচুপি বাইক নিয়ে এখানে পৌঁছাতে সক্ষম হয়।
‘অবশেষে বুঝতে পেরেছো তাহলে।’ এক ভ্রু উঁচু করে বলল আবির।
বিভা কিছুটা রাগী কণ্ঠে শুধালো,
‘পিছু কেন করছেন?’
‘তুমি এদিকে কোথায় যাচ্ছো?’
‘বাড়িতে।’
‘আজকাল ভূতুড়ে এড়িয়ায় থাকছো নাকি?’
‘থাকছি, তাতে আপনার কি।’ বলেই বিভা হাঁটতে আরম্ভ করে। আবির ফোন পকেটে রেখে ওর পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটছে। বিভা সেটি দেখে রেগে বলে,
‘আমার পিছু কেন আসছেন। চলে যান।’
‘উঁহু! তোমাকে বাড়িতে যাব।’
‘আমি অচেনা কাউকে বাড়িতে নিবো না।’
‘কে নিতে বলল তোমাকে।’
‘তাহলে আমার পিছু হাঁটছেন কেন?’ ক্রোধ নিয়ে বলল।
‘বাড়িতে যাওয়ার জন্য।’
‘মেজাজ খারাপ করবেন না। চলে যান বলছি।’
‘নাহ!’
বিভা রাগ নিয়ন্ত্রণ করে থেমে যায়। আবির বিভার থেমে যাওয়া দেখে সামনে এসে দাঁড়ায়। বিভা ওর পার্স থেকে একটি রুমাল বের করে। আবির বলল,
‘আমাকে দিবে নাকি?’
‘নিন।’ বলে আবিরের নাকমুখের উপর চেপে ধরে রুমালটি। আবির এক ঝটকায় বিভার হাত সরিয়ে ফেলে। ওর হাত থেকে রুমালটি মাটিয়ে পড়ে যায়। হঠাৎ আবির বিভার দিকে তাকিয়ে থাকাকালীন অনুভব করে তার মাথা ঘুরছে। চোখ জোড়া ক্রমশে বন্ধ হয়ে আসছে। এক বার মাথা ঝাকিয়ে হাতের তর্জনী উঁচু করে মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই বিভার গায়ে এলিয়ে পড়ে। বিভা আবির’কে ধরে মাটিতে চিৎ করে শুইয়ে দেয়। আবির জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। মুখের উপর একবার হাত দিয়ে চেক করে। পুরোপুরি কনফার্ম হবার পর মুচকি হাসে। তার কাজ হয়েছে। ক্লোরোফর্ম মাখা রুমালটি পরিশেষে কাজে দিয়েছে। ল্যাম্পপোস্টের ঘোলাটে বাতিতে আবিবের স্নিগ্ধ মাখা আদল দেখে বিভার মায়া হয়। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে চট করে উঠে দাঁড়িয়ে কাউকে কল দেয়। এক মিনিট কথা বলে আবির’কে সেভাবে রেখেই বিভা তার গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলে।
.
.
.
#চলবে?
কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।