#অপ্রিয়_প্রেয়সী
#লিখা_তানজিলা
#পর্ব -৩
অদ্ভুত একাকীত্বের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। মন খারাপের দেশে সবকিছু অযথা মনে হচ্ছে। টেবিল ভর্তি খাবার সামনে নিয়ে একা বসে আছে আইজা। গলা দিয়ে এক লোকমাও যেন আর নামতে চাইছে না। বিষন্ন মনেই মুখ থেকে বেরিয়ে এলো এক দীর্ঘশ্বাস। ইচ্ছে করছে দৌড়ে কোথাও পালিয়ে যেতে।
কিন্তু কোথায় যাবে ও! এখানে যতটা সুরক্ষিত আছে তা হয়তো বাইরে থাকতে পারবে না। আইজার শ্বশুর ওর পরিবারের সাথে যোগাযোগ কম রাখতে বললেও অন্তত তাদের খেয়াল তো রাখছে। নইলে আইজার বাবা পলাতক হওয়ার পর থেকে তো কম সমস্যায় পড়তে হয়নি ওদের। খাবার টেবিল থেকে উঠে দাঁড়ালো সে। দুপুর থেকে পেটে কিছু পড়েনি।তারপরও পেটে ক্ষিদের দেখা নেই। ড্রইংরুমে সোফায় বই হাতে নিয়ে বসে পড়লো আইজা। আজ বাড়ি থেকে বইগুলো আনার কথা ভুলেনি।
-“রিয়াদ, আমার স্টাডি রুমে এক কাপ কফি রেখে যান!”
সীমান্তর কন্ঠ কানে প্রবেশ করতেই তৎক্ষনাৎ ওদিকে চোখ চলে গেলো আইজার। রিয়াদ এ বাড়িতে মালির কাজ করলেও বাকি সময় সীমান্তর সাথে ঘুরঘুর করতে থাকে। কিছু একটা মনে পড়তেই আইজা হুট করে বলে উঠলো,
-“রাত হয়ে গেছে। রিয়াদকেও তো বাড়ি যেতে হবে। আমি আপনার জন্য কফি নিয়ে আসছি।
-“আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।”
আইজার দিকে তাকিয়ে শুষ্ক কন্ঠে বললো সীমান্ত। কষ্ট! ভ্রু কুঁচকে এলো আইজার।
-“সীমান্ত আমি..”
-“রিয়াদ! আপনাকে একটা কাজ দিয়েছি আমি!”
সীমান্তর কন্ঠস্বর হুট করে বেড়ে যাওয়ায় আর কিছু বলতে পারলো না আইজা। আজ প্রথম তাকে এতো উঁচু কন্ঠে কথা বলতে শুনলো ও। রিয়াদ তো বাহানা মাত্র। এতো গুলো মানুষের সামনে এরকম করাটা কী খুব জরুরি ছিলো!
পাখি ভীত চোখে একবার সীমান্ত আর একবার আইজাকে দেখে সেখান থেকে চলে গেলো। রাজিয়া এক ভ্রু উঁচু করে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটের এককোণে মৃদু হাসি লক্ষ্য করলো আইজা। এই মেয়ের হাসি দেখেই গা জ্বলে উঠলো ওর। রিয়াদ থমথমে মুখ নিয়ে রান্নাঘরে কফি মেশিনের দিকে পা বাড়ালো। সীমান্তর ফোন বেজে ওঠায় আইজার দিকে তাকিয়েই ফোনটা কানের কাছে ধরলো সে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে কোন কিছু নিয়ে অত্যাধিক রাগান্বিত হয়ে আছে।
সীমান্তর চোখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে বক্র হাসি ঝুলিয়ে রাখলো আইজা। এখনই এই অবস্থা! স্টাডি রুমে গেলে কি হবে সেটা ভাবতেই মজা লাগছে ওর। আইজা তো সীমান্তর কথা ভেবেই রিয়াদকে বারণ করছিলো। এখন শুধু রিয়াদ কেন বাড়িসুদ্ধ সবাইকে নিয়ে স্টাডি রুমে গেলেও আইজা টু শব্দটি করবে না। আইজার মুখভঙ্গি সীমান্ত চোখ মুখ কুঁচকে তাকালো ওর দিকে। কিন্তু কিছু বললো না। মুখটা শক্ত করেই কোথায় যেন চলে গেলো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো ড্রইংরুম ফাঁকা। কিন্তু আইজা মন দিতে পারছে না কোনকিছুতেই। একটু পর পর মনোযোগটা হুট করে কোথায় যেন গুম হয়ে যাচ্ছে। চোখগুলো বইতে অটল থাকলেও মস্তিষ্ক যেন অন্য কোথাও হারিয়ে গেছে। বেশ শব্দ করেই বইটা বন্ধ করে পাশে রাখলো আইজা।
সোফায় মাথা এলিয়ে দিয়ে ক্ষনিকের জন্য চোখটা বন্ধ করতেই কাপ ভাঙার আওয়াজে টনক নড়লো ওর। অল্প স্বল্প যে ঘুম আঁখি জোড়ায় ভর করেছিলো সেটার অস্তিত্ব আর নেই। আওয়াজটা কোথা থেকে আসছে ধারণা করতে পেরে মুখে সুক্ষ্ম হাসি টেনে পায়ের ওপর পা তুলে বসলো আইজা। এখন তো শুধু অপেক্ষার পালা!
রাজিয়া ছুটে আইজার সামনে এসে বললো,
-“ভাইয়া আপনারে ডাকতাছে।”
আইজার এক ভ্রু উঁচু হয়ে এলো। নিজের চুল ঠিক করতে করতে বললো,
-“আমার পা ব্যথা করছে। আমি এতো কষ্ট করে ওদিকে যাবো না। বেশি প্রয়োজন হলে সীমান্তকে এখানে আসতে বলো।”
রাজিয়া কিছুটা সতর্ক ভঙ্গিতে আইজার আরও সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো,
-“ভাবী, সীমান্ত ভাই কিন্তু সহজে রাগে না। কিন্তু একবার রাগলে পুরা বাড়ি উল্টায় ফেলে। আপনের যাওয়া উচিত। ভাইয়ের হাবভাব ভালো ঠেকতেছে না!”
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার সতর্ক বার্তা কানে যেতেই সশব্দে হেঁসে উঠলো আইজা। রাজিয়ার গালটা বাচ্চাদের মতো টেনে ধরে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো,
-“এখন তুমি আমাকে বলবে আমি কী করবো আর কী করবো না!”
আইজার চাহনি দেখে রাজিয়া আর কথা বাড়ালো না। মুখে কিঞ্চিৎ রক্তিম ভাব নিয়েই চলে গেল।
আইজা নিজের মতো করে বইটা আবার হাতে নিলো। এ পর্যন্ত এক লাইনও ঠিকমতো পড়েছে কি-না সন্দেহ। ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। গুনগুন করতে করতে নিজের ঘরে এসে দরজা ভালো করে আটকে দিলো ও। তবে একটু আগের মতো ঘুমটা আর চোখে নেই। সীমান্তর মতো ঘরজুড়ে পায়চারি করে যাচ্ছে আইজা। পার্থক্য এই যে সীমান্ত ফোনে কথা বলার সময় ঠিক এভাবেই অস্থির হয়ে ঘরজুড়ে হাঁটতে থাকে।
-“একটা দুটো ভুল হতেই পারে। তাই বলে ফাইল ভর্তি ভুল করবেন! আপনার কাজে গাফিলতির কারণে কোম্পানিতে লস পর্যন্ত হতে পারে!”
আয়নার দিকে তাকিয়ে সীমান্তকে নকল করে শান্ত কন্ঠে বলে উঠলো আইজা। তার ঠান্ডা গলায় ঝাড়ি মারার অভ্যেস আছে। আবার নিজে নিজেই হেসে উঠলো ও।
কয়েক সেকেন্ড পর দরজায় খটখট শব্দ করে উঠলো কেউ। আইজা দরজা খুললো না। কানে হেডফোন লাগিয়ে বিছানায় বসে রইলো। বইটা পড়তে পড়তে সময়ের তাল হারিয়ে ফেলেছে ও। হঠাৎ করেই বেশ শব্দ করে ফোনটা বেজে উঠলো। একটু সোজা হয়ে বসলো আইজা।আননোন নাম্বার থেকে আসা কল ও সচরাচর না তুললেও আজ পরিস্থিতি ভিন্ন। কিছুক্ষণ ভেবেই ফোন রিসিভ করে কানের কাছে ধরলো ও।
ওপর পাশ থেকে পরিচিত কন্ঠ শুনেই দাঁড়িয়ে পড়লো আইজা। গলা অনবরত কাঁপছে। মুখ অব্দি কথা আসতে চাইছে না। চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি বের হতে না হতেই সাথে সাথে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে নিলো ও। দ্রুত বারান্দায় গিয়ে দরজা আটকে দিলো।
-“পাপা কোথায় তুমি?”
-“আমার কাছে বেশি সময় নেই! আমি তোকে একটা এড্রেস মেসেজ করছি৷ তুই এই মুহুর্তে চলে আয়।”
-“কী হয়েছে? তুমি ঠিক আছো তো? কেউ…”
-“আইজা প্লিজ, আজ তোর সাথে দেখা করা খুব জরুরি। আমি যদি নির্দোষ প্রমান হই তাহলে সবকিছু আগের মতো হয়ে যাবে। তুই তো জানিসই, তোর চাচা আমার আপন মায়ের পেটের ভাই ধোঁকা দিয়েছে আমাকে। আমার সত্যি তোর সাহায্য দরকার!”
-“সীমান্তর বাবা তো বলেছিলো তোমাকে সাহায্য করবে। তুমি এভাবে পালিয়ে যাওয়ায় প্রবলেম আরো বেড়েছে! আর আমি এখন বাড়ি থেকে কি করে বের হবো! তাও এতো রাতে!”
অপর পাশ থেকে আর কোন আওয়াজ এলো না। আইজা পুনরায় কল করলেও কল ব্যস্ত দেখাচ্ছে। ফোনে টুং করে একটা শব্দ হলে আইজা বুঝতে পারলো মেসেজ এসেছে। আইজা আবার কল করলো। কিন্তু এইবার তো নাম্বারটাই বন্ধ! কিচ্ছু বুঝতে পারছে না ও। এতো দিন ওর বাবাকে কত খুঁজলো! লাভ হয়নি। এখন এতো রাতে কী করে বের হবে ও! পুলিশ খুঁজছে ওর বাবাকে!
কপালে চিন্তার ভাজ নিয়ে বারান্দার দরজা খুলতেই আৎকে উঠলো আইজা। বুকে হাত দিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালো সামনে। সীমান্ত বিছানায় বসে কী যেন গভীর চিন্তায় মেতে আছে। কিন্তু ও তো দরজা লক করে ছিলো!
তখনই ঘরের একপাশে বন্ধ এক দরজায় চোখ পড়লো আইজার। ও তো ভুলেই গিয়েছিলো এই রুমের সাথে এটাচ আরেকটা রুম আছে। যেটা সবসময় বন্ধ থাকে। সে রুমের চাবিও ওর কাছে নেই।
-“আপনি স্টাডি রুমে কেন গিয়েছিলেন? রাজিয়া আপনাকে বারণ করেনি?”
-“রাজিয়া আমাকে বারণ করার কে!”
কঠোর গলায় বলে উঠলো আইজা। এই রাজিয়ার কথা মানতে বসে না-কি ও! সীমান্ত হুট করে উঠে আইজার দিকে এগিয়ে যেতেই এক কদম পিছিয়ে গেলো ও। সীমান্তর চোখে কোন ক্রোধ নেই যেমনটা ও আশা করেছিলো। বরং আইজার পিছিয়ে যাওয়া দেখে মৃদুস্বরে হেঁসে উঠলো সে। আবার সেই হাসি! এই হাসি দেখলে গা শিউরে ওঠে ওর। সীমান্ত আইজার আরো সামনে গিয়ে ওর চুলে মুখ লুকিয়ে ধীর কন্ঠে বলে উঠলো,
-“আমার সম্পর্কে একটা বিষয় হয়তো আপনি জানেন না।”
সীমান্তর এই রূপের সাথে পরিচিত না আইজা। এই মুহুর্তে কেন যেন অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। যদিও আইজা তা মুখে প্রকাশ করলো না। নিজের হাতটা সীমান্তর কাঁধে রেখে মিহি কন্ঠে বললো,
-“শুধু একটা বিষয় বললে ভুল হবে। আমার তো আরো অনেক কিছু জানা বাকি। তবে এখন সেই একটা বিষয় জানলেও চলবে।”
তার উচ্চস্বরে হাসি অনুভব করতে পারছে আইজা। মুহুর্তেই সীমান্তর কাঁধে রাখা আইজার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো সীমান্ত। স্থির কন্ঠে বলে উঠলো,
-“আমার অভিনয় স্কিল কিন্তু আপনার থেকেও বেশ চমৎকার!”
চলবে…