#অপ্রিয়_প্রেয়সী
#লিখা_তানজিলা
#পর্ব -১২
আইজা কয়েক সেকেন্ড শান্ত চোখে তাকিয়ে ছিলো সাহিলের দিকে। এই উদাসীন ঠান্ডা দৃষ্টি হয়তো সহ্য হয়নি সাহিলের। পূর্বের থেকে দ্বিগুণ পরিমান বল প্রয়োগ করে আইজার হাত চেপে ধরলো সে। মনে হচ্ছে হাড় ভেঙে যাচ্ছে। দৃষ্টি ঠান্ডা রেখেই শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি ব্যবহার করে সাহিলকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে নিলো আইজা। মুহুর্তেই সজোরে চড় বসিয়ে দিলো সাহিলের গাল বরাবর।
-“তোমাকে এ অফিস থেকে গেট আউট করতে আমার এক মিনিটও লাগবে না। সীমান্ত যদি জানতে পারে তার ওয়াইফের সাথে তুমি এরকম আচরণ করছো সে নিশ্চয়ই তোমাকে এখানে চাকরিতে রাখবে না! আর সিসিটিভি তো আছেই। আমি কিন্তু তোমাকে ওয়ার্নিং দিচ্ছি না সাহিল! ট্রাস্ট মি! আজ ছাড় দেয়ার মুডে নেই আমি! সো তুমি আমার থেকে দূরে থাকো!”
আইজা সাহিলকে কখনো চড় মারবে সেটা হয়তো আশা করেনি সাহিল। তাই তো বিস্ময় চোখে তাকিয়ে ছিলো সে। তবে তা স্থায়ী হয়নি। আঁখি জুড়ে লেগে থাকা বিস্ময়ের স্থানে এবার ভর করলো ক্ষুব্ধতার রেশ। ক্রোধ দৃষ্টিতে আইজার দিকে এগোতে গেলেই আইজার কান ফাটা চিৎকারে থমকে গেল সে। আইজাকে থামাতে ওর মুখ চেপে ধরতেই কেউ এক ধাক্কায় সাহিলকে আইজার থেকে দূরে সরিয়ে ফেললো।
সীমান্তকে দেখেই আইজা নিজের চোখে অশ্রু এনে বলতে শুরু করলো,
-“আপনি ছিলেন না, কোন কাজও ছিলো না তাই জায়গাটা ঘুরে দেখছিলাম। এই লোক কোথা থেকে এসে আমার ওপর হামলা করে বসলো! আমি…!”
আর বললো না আইজা। কান্নায় ভেঙে পরলো ওদিকেই। সীমান্তর মাথায় কী চলছে বুঝতে পারছে না আইজা। তার চোখে কোন অনুভূতি যেন স্পষ্ট না। আইজার ক্রন্দনরত মুখ টা এক নজর দেখেই সাহিলের কলার ধরে টেনে কোথায় যেন নিতে শুরু করলো সীমান্ত। সাহিল বারবার নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করে যাচ্ছে।
-“স্যার বিশ্বাস করুন, আইজা নিজে এখানে এসেছে আমার সাথে কথা বলতে। ও আমাকে ডিস্টার্ব করছিলো। আমি ওকে পাত্তা দেয়নি বলে ও এসব করছে!”
আইজার ভ্রু কুঁচকে এলো। মুখে এতোটা নিরপরাধ ভাব এনে রেখেছে যেন ও আজ প্রথম আইজাকে দেখেছে! আইজা ওকে ডিস্টার্ব করছিলো! আইজা রাগে কিছু একটা বলতে গিয়েও আৎকে উঠলো। সাহিলের কথা শেষ হতে না হতে সীমান্তর কী যেন হলো সাহিলকে মাটিতে ফেলে একের পর এক ঘুসি মারতে শুরু করলো সে।
এর আগে এতটা রাগান্বিত রূপে সীমান্তকে কখনো দেখেনি আইজা। আইজার লক্ষ্য ছিলো সাহিলকে চাকরি থেকে বের করা না-কি হাসপাতালে পাঠানো। সীমান্তর মুখ দেখে ওর ধারে কাছে যেতেও ভয় লাগছে আইজার। দু’জন এমপ্লয়ি এসে কোনরকমে সীমান্তর কাছ থেকে সাহিলকে ছাড়িয়ে নিলো। তবে সাহিলকে নিয়ে যাওয়ার আগে একবার ওর কানে কী যেন বললো সীমান্ত। যা শুনে সাহিলের মুখ টা ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো। নাকে মুখে রক্ত লেগে থাকা চেহারাটা রক্তশূণ্য মনে হচ্ছে। নাম না জানা লোকগুলো রক্তাক্ত সাহিলকে নিয়ে লিফটে চড়ে বসলো। লিফট ক্লোজ হওয়ার আগ পর্যন্ত সাহিলের তীক্ষ্ণ নজর আইজার ওপরই নিবদ্ধ।
সীমান্ত আইজার দিকে না তাকিয়েই হনহন করে নিজের কেবিনে ছুটে গেলো। সবাই চলে যেতেই আইজার ক্রন্দনরত মুখটা মুহূর্তেই বদলে গেলো। ঠোঁটের এক কোণে জায়গা করে নিলো সুক্ষ্ম বাকা হাসি! হাতের উল্টো পিঠ দ্বারা চোখে জমে থাকা মিথ্যে অশ্রু মুছে নিলো আইজা। সীমান্ত এমনি ওর কথায় বিশ্বাস করবে চিন্তা করেনি ও! হৃদয় জুড়ে বেয়ে চলা তিক্ত অনুভূতি টাকে উপেক্ষা করেই হেঁটে চললো আইজা।
***
সীমান্ত সেই কখন থেকে শান্ত হয়ে বসে আছে। ফিহা চুপচাপ বসে কী যেন ভাবছে। তখন ফিহাকে না দেখে একটু অবাক হয়েছিলো আইজা। হয়তো মেয়েটা ওয়াশরুমে গিয়েছিলো। সীমান্ত কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে কী যেন মনে করে পুনরায় চোখ খুলে আইজার দিকে তাকালো। অফিস টাইম প্রায় শেষের পথে। সাহিলের সাথে কী হয়েছে জানেনা ও!
হঠাৎ সীমান্ত ফিহাকে চলে যেতে বলে সোজা কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো। আইজাকে কিছু বললো না পর্যন্ত। ও নিজে থেকেই উঠে দাঁড়িয়ে সীমান্তর পিছু পিছু চলতে শুরু করলো। ফিহা লিফটে উঠে দাঁড়ালো। আইজা একবার ওদিকে পা বাড়াতেই দেখলো সীমান্ত সিঁড়িতেই নেমে যাচ্ছে। ও লিফটের দিকে আর এগোলো না। এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে সীমান্তর পিছু পিছু চললো।
-“আপনি এখানে কী করছেন? লিফট তো আছেই!”
আইজার দিকে না তাকিয়েই প্রশ্ন করলো সীমান্ত।
-“এমনি। সারাদিন বসে থাকতে থাকতে পা ধরে গেছে। তাই এক্সারসাইজের জন্য সিঁড়ি ব্যবহার করছি!”
ঠান্ডা গলায় বলে উঠলো আইজা। সীমান্ত আর কথা বাড়ালো না। নিজের মতো করেই নেমে যাচ্ছে।
-“সীমান্ত!”
আইজার ডাকে থেমে গেলো সে। কিন্তু পেছনে ঘুরলো না। আইজা নিজেই সীমান্তর পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো,
-“থ্যাঙ্কস। আমার সাইড নেয়ার জন্য।”
সীমান্ত আইজার প্রতিউত্তরে বললো,
-“পরেরবার ভেবে কথা বলবেন। ওখানে থাকা সিসি ক্যামেরা নষ্ট।”
সীমান্তর কথা শুনতেই কুঁচকে এলো আইজার ভ্রু জোড়া। সীমান্ত এমনি ওর কথা বিশ্বাস করেনি। সব টা দেখেছে সে! আইজা তো এমনি আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ছিলো।
-“তাহলে সাহিল…!”
-“কেন? কষ্ট হচ্ছে আপনার এক্স বয়ফ্রেন্ডের গায়ে হাত তুলেছি বলে!”
সীমান্তর তীক্ষ্ণ কন্ঠ কানে যেতেই কথা থামিয়ে দিলো আইজা। এক ভ্রু উঁচু করে বললো,
-“আমাকে কথা শেষ তো করতে দিন!’
আইজার কথা গুলো সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেই নেমে গেলো সীমান্ত। আইজাও এই মুহুর্তে আর কিছু বলার চেষ্টা করলো না।
বাইকে চড়ে বসতেই সীমান্ত নিঃশব্দে বাইক স্টার্ট করে দিলো। আইজার সীমান্তর আগে অফিস থেকে বের হওয়া আজ আর হলো না। হঠাৎ কিছু মনে পড়তেই মাঝ রাস্তায় বাইক থামাতে বললো আইজা। সীমান্ত কিঞ্চিৎ বিরক্তি নিয়ে প্রশ্ন করলো,
-“কি হয়েছে?”
-“আমার কিছু কেনার ছিলো!”
সামনে থাকা ফোনের শোরুম দেখিয়ে বলে উঠলো আইজা। তবে সীমান্ত কিছু বলবে তার আগেই বাইক থেকে নেমে ছুট দিলো ও!
***
রাত হয়ে আসছে। এই অন্ধকারেও আকাশে ভেসে যাওয়া কালো মেঘ দৃশ্যমান। বাড়ি পৌঁছাতেই সীমান্ত স্টাডি রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলো। ভ্রু কুঁচকে এলো আইজার। স্টাডি রুমটা যেন তার কাছে বেডরুমের থেকেও প্রিয়!
দুই তিন ঘন্টা পর সীমান্ত নিজের মতো করে এসে বিছানার একপাশে বসে পড়লো। পাশেই বসে থাকা অস্থির অশান্ত চোখ গুলোর দিকে দৃষ্টি গিয়ে ঠেকলো না তার। আইজা আড়চোখে সীমান্তর দিকে একবার তাকিয়ে উঠে পড়লো। মন টাকে হাজার চেষ্টা করেও শান্ত করতে পারছে না। ওর মায়ের সাথে দুপুরেই যে একবার কথা হয়েছিলো। কিন্তু সন্ধ্যা থেকে মা ফোন ধরছে না। হয়তো পুরাতন ফোন টা আবার খারাপ হয়ে গেছে। আজই মায়ের জন্য নতুন ফোন কিনে এনেছে আইজা। ভেবে রেখেছিলো কাল ভোরে একবার বাড়ি যাবে। আজ তো বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেছে।
ক্ষীণ বজ্রপাতের শব্দে টনক নড়লো ওর। নিজেই নিজের মাথায় বুনতে শুরু করলো বেশ কিছু ধারণা। এই জন্যই হয়তো ওর মায়ের ফোনে নেটওয়ার্ক যাচ্ছে না। বারান্দার দরজাটা খোলা পড়ে আছে। আইজার চোখ নিজের হাতের ওপর গিয়ে পড়লো। হাতে লেগে থাকা রক্তিম দাগ কালচে রঙ ধারণ করেছে। যন্ত্রণা হচ্ছে খুব। দাগ টা প্রচন্ড কুৎসিত দেখাচ্ছে। গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো যেন। সহ্য না হওয়ায় এক গাছি চুড়ি নিজের হাতে পড়ে নিলো ও। যেন দাগ টা সেগুলোর মধ্যে ঢেকে যায়।
তখনই সীমান্ত হুট করে নিজের ফোন হাতে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে বারান্দার দরজা আটকে দিলো। আইজা একবার নিজের বাবার ফোনে ট্রাই করলো। লাভ হলো না। প্রতিবারই বন্ধ জানাচ্ছে।
আইজার মনে হচ্ছে ও কোন মাঝ সমুদ্রে জনমানবহীন এক দ্বীপে আঁটকে গেছে। সম্পূর্ণ একা। না এখানে থাকতে পারছে আর না সাতার কেটে এ সমুদ্র পাড় করতে পারছে! হাত থেকে চুড়ি গুলো খুলে রাখলো আইজা। আজ এই রিনিঝিনি শব্দটা প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে ওর। মাথা ধরে আসছে। না চাইতেও আইজার মস্তিষ্ক অতীতের অপ্রিয় অংশ বারবার ওর চোখের সামনে তুলে ধরছে,
অতীতের কোন এক প্রান্তে
—————————————–
অসাড়তার কুৎসিত থাবা যেন গ্রাস করে রেখেছে আইজাকে। কম্পিত হাতে ফোন টা রেখেই খাটে ধপ করে বসে পড়লো ও। কালই ওর বিয়ের কথা চলছে আর আজ শূন্যতা ছাড়া কিছুই নেই ওর হৃদয়ে। হালকা জং ধরা ছোটখাটো আলমারি টা খুলতেই ড্রয়ারে রাখা নিজের মায়ের গয়নার বাক্স গুলো খুলে দেখলো ও। এই গয়না গুলো খুব একটা পড়তে দেখেনি ওর মাকে।
আরফান দ্রুত পায়ে ঘরে এসে দরজা আটকে দিলো। আইজাকে দেখে তাড়াহুড়ো করে বলে উঠলো,
-“আপু এসব কী হচ্ছে! সাহিল ভাই বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। তুই কী পালিয়ে যাবি?”
আলমারিটা বন্ধ করে কাঁপা কাঁপা দৃষ্টিতে তাকালো আইজা। চোখের কার্নিশে জমে থাকা অশ্রু কণাও যেন বের হতে চাইছে না। আরফান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলো,
-” আব্বু তো তোদের মেনে নিয়েছিলো। পড়ালেখা শেষ করে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলি তোরা। এখন এসব কী হচ্ছে?”
আইজা শক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
-“ছোট আছিস এতো কিছু জানার চেষ্টা করিস না। বাইরে যা!”
আরফানকে এক প্রকার ধাক্কা দিয়ে রুম থেকে বের করে দরজা আটকে দিলো আইজা। বারান্দায় গিয়ে সাহিলের নাম্বারে ডায়াল করতেই সাথে সাথে রিসিভ হয়ে গেলো। সাহিল বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল। আইজাকে বারান্দায় দেখা মাত্রই হাতের ইশারায় দ্রুত নিচে নেমে আসতে বললো।
-“আমি পারবো না সাহিল!”
সাহিলের চোখে কঠোরতা এসে ভর করলো। রুক্ষ কন্ঠে বলে উঠলো,
-“তুমি আসবে না! আইজা এখন তোমার এসব নাটকের জন্য আমার কাছে সময় নেই। ন্যাকামি পরে করো! চুপচাপ নিচে নেমে এসো। সারাবছর আমাকে ঘুরিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করবে তুমি! কী মনে করেছো আমাকে!”
-“সাহিল আমি পাপার সাথে কথা বলবো তো! প্লিজ একটু ভরসা রাখো! তুমি যা বলছো আমি সেটা করতে পারবো না!”
-“তোমার পাপার চোখে এই মুহুর্তে টাকা ছাড়া কিছুই পড়ছে না। আর আন্টির গয়না নিয়ে কোন চিন্তা করো না। আমরা শুধু সেগুলো বন্ধক রাখবো। পরে হাতে টাকা আসলেই সেই গয়না ছাড়িয়ে নিয়ে আন্টিকে ফেরত দিয়ে যাবো। আমরা তো আর একেবারেই সবকিছু নিয়ে যাচ্ছি না। একটু প্রেক্টিকালি চিন্তা করো আইজা। আজ যদি তুমি না চলো তাহলে আমাদের সম্পর্ক শেষ!”
-” না আমি সীমান্তকে বিয়ে করবো আর না মায়ের গয়না নিয়ে পালাবো!”
কাঠ কাঠ গলায় বলে উঠলো আইজা।
-“ভেবে বলছো তো!”
-“পাপা কখনোই আমাকে জোর করবে না দেখো! আমি…!
-” কথায় এই সাহিল গলবে না। তোমাকে পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি। এর মধ্যে যদি তুমি আমার কথামতো নিচে নেমে না আসো আমাদের সম্পর্ক শেষ!”
সম্পর্ক শেষ কথাটা শুনতেই আইজা নিজের বুকে এক তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করলো। নিজের পরিবারকে ও ঠকাতে পারবে না। সাহিল তো আইজাকে চেনে! ও কেন এভাবে উভয়সংকটে ফেলছে আইজাকে! সাহিলকে ছাড়ার কথা ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে আসছে ওর। আজ পর্যন্ত হাজারো সমস্যা অতিক্রম করেও সাহিলের হাত ছাড়েনি। আইজাকে অনেকে সাহিলের বিরুদ্ধে কত কিছু বলেছে। কিচ্ছু মাথায় নেই নি ও। সাহিলের প্রতি ভরসা এক বিন্দুও কমেনি। আর এখন সাহিল ওকে ভরসা করছে না!
সাহিলের তীক্ষ্ণ চাহনি আর সহ্য হলো না আইজার। রুমে ঢুকতেই নিজের মাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থমকে গেলো ও। দরজা পুরোপুরি আটকে দিতে ভুলে গেছিলো হয়তো! আইজার মা ওকে দেখে কিছু না বলেই হাত ধরে টেনে নিয়ে বিছানায় বসালো। আইজা শূন্য চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
আলমারি খুলে নিজের গয়নার বাক্স গুলো একে একে বিছানায় রাখলো ওর মা। তার চোখগুলো দেখে তেমন কিছু বুঝতে পারছে না আইজা। এতটুকু তো নিশ্চিত যে সাহিলের সাথে ওর কথপোকথন সে শুনেছে। কিন্তু কিছু বলছে না কেন! তার রাগ হচ্ছে না! ইচ্ছে করছে না গালে কষিয়ে এক চড় বসিয়ে দিতে! এতো শান্ত হয়ে কেন আছে মা!
স্বর্ণের হার টা আইজার গলায় পড়িয়ে দিলো ওর মা। কানের দুল গুলো এক এক করে পড়িয়ে যাচ্ছে। যেন আজই আইজার বিয়ে! আর নিতে পারলো না আইজা এই অদ্ভুত আচরণ। শক্ত করে চেপে ধরলো মায়ের হাত। আইজার চোখ গুলো দেখে মৃদু হাসলো ওর মা। ক্লান্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
-“তুই যথেষ্ট বড় হয়েছিস। তাই কোন কিছুতে আমি তোকে জোর করবো না। সীমান্তকে বিয়ে করতে না চাইলে তোকে কেউ বাধ্য করবে না। আর না সাহিলকে বিয়ে করতে চাইলে কেউ তোকে আটকাবে। আমি তোর কাছে ওয়াদা করছি। সাহিল যদি আজ এই মুহুর্তে এই বাড়িতে এসে তোকে বিয়ে করতে পারে তোর পাপাকে আমি মানাবো। কিন্তু সাহিল তোকে বিয়ে করবে তো! যে তোকে মায়ের গয়না নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে বলে সে তোকে আগলে রাখবে! আবেগ দিয়ে জীবন চলে না আইজা। দুনিয়া এতোটাও সহজ না।”
আইজা নিশ্চুপ হয়ে ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু বলতে চাইলেও মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে না কোন ধ্বনি। আজ পর্যন্ত কতবার সবার সামনে সাহিলের পক্ষ নিয়ে কথা বলেছে কিন্তু আজ গলা ধরে আসছে! আইজার মা আরও বলে উঠলো,
-“খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না। মনে হচ্ছে দম বন্ধ হয়ে যাবে। বিশ্বাস কর, একসময় এই পরিস্থিতির কথা মনে পড়লে হাসি পাবে তোর! কতটা বোকা ছিলি তুই! কিন্তু ততক্ষণে যদি এমন কোন ভুল করিস যাতে তোকে সারাজীবন পস্তাতে হয় তাহলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবি তো!”
আইজার মা আর বসলো না। গয়না গুলো সামনে রেখেই রুম থেকে চলে গেলো। আইজা ওভাবেই পড়ে রইলো কিছুক্ষণ। পাঁচ মিনিট হয়ে গেছে সেই কখন। ফোনটা অনবরত বেজে যাচ্ছে। আইজা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেদিকে। জীবনের অনেক বড় সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে আজ ও!
বর্তমান
—————
হঠাৎ হাতে হেঁচকা টান পড়ায় টনক নড়লো আইজার। সীমান্তর তাতে কোন হেলদোল নেই। শুধু তাড়াহুড়ো করে বললো,
-“আমাদের যেতে হবে!”
সীমান্তর মুখভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা নিয়ে ইতস্তত বোধ করছে সে। আইজা বললো,
-“এতো প্যানিক করছেন কেন? কী হয়েছে?”
তখনই হুট করে আইজার ফোন বেজে উঠলো। যদিও সীমান্ত আইজাকে সেই ফোন হাতে নিতে দিলো না। নিজেই আইজার ফোন হাতে নিয়ে ওর হাত ধরে বাইরে নিয়ে যেতে শুরু করলো,
-“আপনি কী করছেন এসব? আমার হাত ছাড়ুন! কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?”
-“হসপিটালে!”
হসপিটালের নাম শুনতেই থমকে গেলো আইজা। অজানা এক ভয় গ্রাস করলো হৃদয় জুড়ে। এমনিও সেই কখন থেকে কেউ ফোন তুলছে না!
-“কী হয়েছে সীমান্ত?”
সীমান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আইজার দুই বাহু আলতো করে চেপে ধরে বললো,
-” আন্টি মানে মা এখন স্টেবল আছে। আমি..!”
-“কী হয়েছে মায়ের?”
শান্ত গলায় প্রশ্ন করলো আইজা। আইজার কথায় চুপ হয়ে রইলো সীমান্ত। আর কথা না বাড়িয়ে পুনরায় আইজার হাত ধরে টেনে গাড়িতে বসিয়ে দিলো আর ফোনটা আইজার কোলের ওপর রাখলো। ফোন পেয়ে সাথে সাথে ওর কল লিস্টের শেষ আননোন নাম্বারে কল করলো আইজা। হয়তো আরফান অন্য কোন নাম্বার থেকে কল করেছে! কিন্তু এইবার কেউ ফোন উঠালো না। আইজা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সীমান্তর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো,
-“একে তো নিজে আমাকে কিছু বলছেন না! তার ওপর ফোন টাও রিসিভ করতে দিলেন না কেন? আমার মা-র কী হয়েছে! আমি আজকে মায়ের কাছে যেতে গিয়েও গেলাম না! আমি…!”
ধরে রাখতে পারলো না নিজেকে আর। মনের মধ্যে জমে থাকা সমস্ত কুচিন্তায় বাঁধা পড়েছে ওর মস্তিষ্ক। আরও কয়েক বার কল করলো আইজা সেই নাম্বারে। ফোন বেজে যাচ্ছে কিন্তু কেউ রিসিভ করছে না। রাস্তা টা আজ বেশ লম্বা মনে হচ্ছে। এক হাতে মাথা চেপে ধরে পাগলের মতো চিৎকার করে কান্না করে যাচ্ছে আইজা। পাশ থেকে সীমান্তর বলা কোন কথাই যেন ওর কান অব্দি পৌঁছাচ্ছে না!
চলবে…