#অপ্রিয়_প্রেয়সী
#লিখা_তানজিলা
#পর্ব – ২১ ( শ্রুতিমধুর)
এই দুটো মাস সীমান্তর কড়া নজরদারির কোন নড়চড় হয়নি। আরফান আর সীমান্তর মাঝে প্রায় সারাদিনই কোন না বিষয় নিয়ে ঝগড়া লেগে থাকবে। সমস্যা হলো আরফান ঝগড়া করায় মাহির হলেও সীমান্তর কাছে কথা কাটাকাটির চেয়ে বেকার কিছু হতেই পারে না। সে শুধু জোর খাটাবে। আরফান মুক্ত পাখির মতো উড়তে ভালোবাসে। কেউ আটকে রাখতে চাইবে এটা সহ্য হচ্ছে না তার। আর এসবের কারণ হিসেবে সীমান্ত বলছে আরফানের বাবার শত্রু ওদের একা পেলে ক্ষতি করতে পারে। যদি বেশি কিছু না জানতো তাহলে হয়তো সীমান্তর এ সরল কথায় তৎক্ষনাৎ ভরসা করেই ফেলতো আইজা।
আজ সকাল সকাল রায়হানের রুমে গিয়ে কড়া নাড়লো আইজা। দরজা খুলে আইজাকে দেখেই মুখে ক্রোধ নিয়ে তাকালো সে। আইজা দরজা ঠেলে নিজের মতো করে বিছানায় বসে পড়লো। হাতে থাকা ছোট একটা চিরকুট রায়হানের দিকে বাড়িয়ে বলে উঠলো,
-“আজ বাসায় সময় এটা নিয়ে আসবেন !”
-“আমি কী আপনার চাকর নাকি! নিজের হাসবেন্ড কে গিয়ে বলুন না!”
রায়হানের কর্কশ কন্ঠে মৃদুস্বরে হেসে উঠলো আইজা। নিজের ফোনের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“শুধু সীমান্ত না আপনার বাবাকেও বলবো!”
মুহূর্তেই চেহারার রঙ পালতে গেলো রায়হানের। সে চিরকুট টা খুলেই ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো,
-“আপনি এসব দিয়ে কী করবেন! কোন সাহসে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছেন! এখন এই চিরকুট যদি আমি সীমান্ত ভাই আর বাবাকে দেখাই! আপনি পার পাবেন না। আমি তো তার নিজের ছেলে, শুধুমাত্র কয়েকদিন ড্রাগস নিয়েছি বলে নিশ্চয়ই রাস্তায় ছুড়ে মারবেন না! কিন্তু আপনি! আপনার ক্ষেত্রে কী বিষয় টা এক!”
রায়হানের কথায় আইজার মুখের ভঙ্গিতে তেমন পরিবর্তন এলো না। উল্টো এবার উচ্চস্বরে হেসে উঠলো ও। চোখে মুখে উৎসাহের রেশ এনে বলে উঠলো,
-“চমৎকার আইডিয়া! চলুন, বাবা তো এখনো রুম থেকে বের হয়নি। এখন গিয়ে সবটা নিজের বাবাকে খুলে বলুন। তিনি নিশ্চয়ই নিজের আদরের ছোট ছেলেকে বাড়ি থেকে বের করবেন না! হয়তো!”
আইজা উঠে দরজার দিকে পা বাড়াতেই রায়হানের তড়িঘড়ি আওয়াজ কানে প্রবেশ করলো। বাঁকা হেঁসে নিজের পদচালনা থামিয়ে দিলো ও।
-“আমি নিয়ে আসবো।”
আইজা লক্ষ্য করলো বাইরে কেউ উঁকিঝুকি দিচ্ছে। বিষয়টা বুঝতে পেরে আইজা বলে উঠলো,
-“আচ্ছা, কাল অফিস থেকে আসার সময় দেখলাম আপনাকে। মেয়েটা কিন্তু খুব সুন্দরী ছিলো।”
রায়হান কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে তাকালো। তৎক্ষনাৎ নিজের হাবভাবে কঠোরতা এনে বললো,
-“এখন এসব নিয়েও আমাকে ব্ল্যাকমেইল করবেন না-কি! করলে করুন। নেহাকে বাবা আমার জন্য পছন্দ করেছে! এই সেমিস্টার ফাইনালের পরই হয়তো আমাদের বিয়ের কথা হবে!
-“না, সেরকম কিছু করবো না! কিন্তু আমি তো শুনেছি আপনি রাজিয়াকে পছন্দ করেন। ওকেই বিয়ে করবেন!”
রাজিয়ার কথা শুনতেই চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো রায়হান। কটমট করে বললো,
-“কী আবোলতাবোল বলছেন। মেয়েটার জন্য করুণা হয় তাই একটু ভালো ভাবে কথা বলি। এখানে পছন্দের কী দেখলেন! রাজিয়ার এমনিও মানসিক সমস্যা আছে। বানিয়ে বানিয়ে যা মন চায় তাই বলে! যার মধ্যে সত্যের ছিটেফোঁটাও থাকে না। আপনি ওর উল্টোপাল্টা কথায় কান দিতে যাবেন না!”
-“ওয়াটএভার!”
আইজার কন্ঠে নির্লিপ্ততার রেশ। সে রাত রাজিয়ার সাথে রায়হানের কথোপকথন শুনেছে ও। কী সুন্দর ভাবে সবটা শুধুমাত্র রাজিয়ার ওপরই চাপিয়ে দিলো রায়হান! সত্যি বলতে অবাক হয়নি আইজা।
বাইরে বেরিয়ে ড্রইংরুমে যেতেই চোখ মুখ লাল হয়ে থাকা মানবীকে দেখতে পেলো ও। শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে সোফা ঝেড়ে ঝেড়ে পরিষ্কার করছিলো সে। আইজাকে দেখেই থেমে গেলো রাজিয়া। সে রাতের পর থেকে আইজার থেকে দূরে দূরেই থাকে মেয়েটা। রাজিয়া সরে পড়তেই সোফায় পায়ের ওপর পা তুলে বসে পড়লো আইজা। মাথাটা চেপে ধরে বললো,
-“মাথাটা খুব ধরেছে। কড়া করে এক কাপ কফি দিয়ে যাও তো!”
আইজার বলতে দেড়ি রাজিয়ার ছুটে যেতে দেরি হলো না। টিভিটা সোফা বরাবর সেট করিয়েই ছেড়েছে আইজা। বন্ধ টিভির কালো স্ক্রীণে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পেলো ও। আজ হয়তো আবারও নিজেকে পাথর দিল হিসেবে প্রমানিত করলো সে!
রাতে সিমির সাথে ড্রইং রুমে বসে ছিলো আইজা। রায়হান হুট করে এসে আইজার সামনে একটা কফি জার তুলে ধরলো। আইজা প্রথমে কনফিউজড হলেও পরক্ষণেই বুঝতে পারলো এতে কফির সাথে কী আছে। ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে বললো,
-“আমার এতো খেয়াল রাখার জন্য অনেক ধন্যবাদ।”
রায়হান তীক্ষ্ণ নজরে আইজাকে দেখেই চলে গেলো। আঁড়চোখে রাজিয়াকে দেখতে পেলো আইজা। ও জানে রায়হানের সাথে আইজার কথোপকথন পুরোটাই শুনে নিয়েছে রাজিয়া। তবুও চিন্তিত না ও। রাজিয়া এই মুহূর্তে নিজের জীবন নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়বে। আইজাকে নিয়ে ভাবার খালি সময় ও পাবেই না!
সিমি কিছুটা ঢুলে পড়ছে। হয়তো ঘুম পাচ্ছে। কোনমতে টেনে সিমিকে বিছানায় এনে ফেললো আইজা। সিমির হুশ নেই। ও ইতোমধ্যে ঘুমের দেশে পৌঁছে গেছে। আইজা সিমির পাশে নিজের শরীর এলিয়েমাম দিলো। খুবই মনোযোগ সহকারে হাতে থাকা কফির জার টা দেখছে ও। আর মাত্র কয়েকটা দিনের অপেক্ষা!
***
মাঝরাতে ঘুমটা হঠাৎ করেই ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো। কী যেন স্বপ্নে দেখেছে! এখন তো মনেও করতে পারছে না। তারপরও বুকের ধুকধুকানি শুনতে পাচ্ছে আইজা। ব্যথায় টনটন করতে থাকা আঁখি জোড়া ধীরে সুস্থে মেলতেই সীমান্তর ঘুমন্ত মুখখানা স্পষ্ট হয়ে উঠলো। যদিও জাগ্রত অবস্থায় যে শক্ত আর গম্ভীরতার রেশ নিয়ে ঘুরে বেড়ায় তার ছিটেফোঁটাও এইমুহুর্তে তার মুখে নেই। অস্থির হয়ে আছে বন্ধ আঁখি জোড়া। কোন দুঃস্বপ্ন দেখছে হয়তো! নিজের হাতের দিকে লক্ষ্য করতেই ভ্রু কুঁচকে তাকালো আইজা। নিদ্রিত অবস্থায়ও হাতটা কী শক্ত করে ধরে রেখেছে লোকটা! কয়েক সেকেন্ড পর সীমান্তর সেই অশান্ত মুখ হুট করে শান্ত হয়ে গেলো। ঘন নিশ্বাস ছেড়ে আইজার হাতটা বুকের কাছে চেপে ধরলো সে।
আইজা নিজের হাত সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলো একবার। সাথে সাথেই নড়েচড়ে উঠলো সীমান্ত। নিভু নিভু চোখে আইজার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“এতো নড়ছেন কেন? ঘুমোতে দিন!”
-“আপনাকে শান্তিতে ঘুমোতে দেখে সহ্য হচ্ছিলো না।”
নির্লিপ্ত কন্ঠ বলে উঠলো আইজা।
সীমান্ত উত্তরে কিছু বললো না। আইজার দিকে এগিয়ে গিয়ে ওর মাথার একপাশ চেপে ধরে চুলে মুখ ডুবিয়ে দিলো। সাথে সাথেই সীমান্তকে সরিয়ে উঠে বসলো আইজা। সীমান্ত শান্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
-“ঘুম নষ্ট করে এখন উঠে গেলে পার পাবেন না!”
নির্বিকার চোখে সীমান্তর দিকে তাকালো আইজা। পরক্ষণেই সীমান্তর এক টানে তার বুকের ওপর গিয়ে পড়লো ও।
-“আপনার শারিরীক তাড়না অন্য সময় মেটাবেন। আজ আমার শরীর ভালো লাগছে না!”
-“গত দুই মাস যাবৎ একই কথা আপনার। কালকেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো আপনাকে!”
কথাটা বলেই তৎক্ষনাৎ আইজাকে এক ধাক্কায় নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দিয়ে উল্টো পাশ ফিরলো সীমান্ত। আইজাও বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো। সোজা রুমের বাইরে গিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে থামলো। উদ্দেশ্য কফি খাবে। বেশ বাজে অভ্যেস হয়ে গেছে ওর। মাথা ধরলে কফি না খাওয়া পর্যন্ত ভালো লাগে না।
হঠাৎ কারও ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজে পিছনে ফিরে তাকালো আইজা। রান্নাঘর থেকে কয়েক কদম পরের রুমেই থাকে রাজিয়া। পাখি কাজ শেষে নিজের বাড়ি চলে গেলেও রাজিয়া ইদের আগ পর্যন্ত কখনও নিজের বাড়ি যায় না। এটাই শুনেছে আইজা।
ক্রদনরত মানবীকে উপেক্ষা করেই কফিটা কাপে নিয়ে নিলো ও। রান্নাঘরে দাঁড়িয়েই চুমুক দিলো সে কাপে। তরল পানীয়টা যেন ঝলসে গলা দিয়ে শরীরের ভেতর প্রবেশ করছে। অসম্ভব জ্বালা করছে বুকটা। আনমনেই চোখটা বন্ধ হয়ে এলো আইজার। অন্যের ব্যপারে মুখ খুলে বলা যতটা সোজা নিজের ব্যাপারে কোনকিছু শোনা ততটাই কঠিন!
চলবে…