অপ্রিয় প্রেয়সী পর্ব-২৫

0
2163

#অপ্রিয়_প্রেয়সী
#লিখা_তানজিলা
#পর্ব – ২৫

দূর থেকে ট্রেনের হুইসেলের শব্দ ভেসে আসছে। মৃদু আলোয় নাজিম শিকদারের অনুভূতিহীন দৃষ্টি স্পষ্ট ফুটে উঠলো সাহিলের চোখ জোড়ায়। চেয়ারে কিছুটা হেলান দিয়ে আরাম ভঙ্গিতে বসে আছে সে। রাতের গভীরতা নিয়ে এই মুহুর্তে কোন ধারণা নেই সাহিলের। ফার্মেসি থেকে বেড়িয়ে মেইন রোডের পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ওড়ানোর তালে খেয়ালই হলো না কখন ফুল স্পিডে ধেয়ে আসা মাইক্রো ভ্যান থেকে গুটিকয়েক মুখোশধারী ব্যক্তি সামনে এসে পড়লো!

অতঃপর এখন সে নাজিম শিকদারের সামনে রাখা ভাঙা চেয়ারটায় বেশ অস্বস্তিকর ভঙ্গিতে বসে আছে। হাত দুটো পেছনে মোড়ানো অবস্থায় বাঁধা। কাঠের চেয়ারের ভাঙা অংশে মেরুদণ্ডের হাল তো বেহাল হয়েই গেলো। সামনে পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকা ভদ্রলোকের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সে বোধহয় কারো জন্য অপেক্ষা করছে। নাজিম শিকদারের অপেক্ষারত স্থির চাহনি ক্রমাগত কৌতুহলী করে তুলছে সাহিলকে।

কিন্তু নাজিম শিকদারের এ অপেক্ষার অবসানের সাথে সাহিলের এ হাল হবে কল্পনাও করেনি ও। দরজার ওপাশে সুট টাই পড়া মাঝ বয়সী একজন ব্যাক্তি ধীর পায়ে সাহিলের দিকে এগিয়ে আসছিলো। লোকটাকে চেনা চেনা মনে হলেও প্রথমে সেটা বোধগম্য হয়নি ওর। পরক্ষণেই ফিহার মুখটা ভেসে উঠেছিলো সাহিলের মস্তিষ্কে। ফিহার ফোনেই এই ভদ্রলোকের ছবি দেখেছে ও।

লোকটা বেশ শান্ত ভঙ্গিতে সাহিলের দিকে এগিয়ে এলেও হুট করে সাহিলের বুক বরাবর লা*থি মেরে বসলো সে। আকস্মিক আক্রমনে চেয়ার সহ উল্টে পড়লো সাহিল। মাথায় তীব্র যন্ত্রণা অনুভব হচ্ছে। মনে হচ্ছে বুকের পাঁজর আর আস্ত নেই!

কিন্তু লোকটা এখনো ক্ষান্ত হয়নি। লা*থির ওপর লা*থির বর্ষণ হয়ে যাচ্ছে সাহিলের ওপর। কিছুক্ষণ পর ঠান্ডা চোখে সাহিলের গাল চেপে ধরলো সে। সাইকো ব্যাক্তির মুখটা সামনাসামনি পড়তেই সাহিলের নিভু নিভু দৃষ্টি সর্বপ্রথম গিয়ে ঠেকলো তার গালের দিকে। চোখের নিচ থেকে চিবুক অব্দি কুৎসিত বিকৃত কাটা দাগটা জ্বলজ্বল করছে সাহিলের চোখে।

-“এস এফ হসপিটাল, ফোর্থ ফ্লোর, রুম নং -401.”

জাফর শিকদারের ব্যঙ্গার্ত্বক কন্ঠ কানে যেতেই সাহিলের দূর্বল চাহনি মুহূর্তেই ক্রোধান্বিত হয়ে উঠলো। হৃদয় জুড়ে একরাশ ভয় এসে জড়ো হলো। নিজের হাত দুটোকে শক্ত দঁড়ির বাঁধন থেকে ছাড়ানোর তীব্র প্রচেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে উঠলো ও। যদিও শরীরে তা কুলোচ্ছে না। সাহিল ওর দূর্বল চোখে ক্ষুব্ধতার আভাস নিয়ে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠলো,

-“আমার মায়ের আশপাশেও যেন তোকে না দেখি!”

সাহিলের এ প্রতিক্রিয়া যেন তার বিনোদনের খোরাক হয়ে দাঁড়িয়েছে। দাঁত কপাটি বের করে ভয়ানক ভঙ্গিতে হেসে উঠলো সে। পরক্ষণেই ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
-“আমাদের বাড়ির ছেলে কী করছে কেন করছে সেটা জানতে তোকে এখানে আনা হয়নি।” এ কথা বলেই কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো লোকটি। তারপর সাহিলকে ছেড়ে দিয়ে সুক্ষ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
-“মাস দুয়েক আগে রোববার রাতে কোথায় ছিলি তুই? আর সেই ভিডিও কোথায় লুকিয়েছিস?”

কাশির সাথে সাহিলের মুখ থেকে কিঞ্চিত রক্ত বেরিয়ে এলো। এরূপ করুন অবস্থায়ও লোকটার প্রশ্ন শুনে হাসি পেলো ওর। সাহিল অতি কষ্টে মুখ বেঁকিয়ে বাঁকা হেসে বলে উঠলো,
-“কোথায় আবার! তোর মেয়ের সাথেই তো ছিলাম! ফিহা তোকে কিছু বলেনি! সময়টা এতো মোহনীয় ছিলো যে ভিডিও করার সময় পাইনি! চিন্তা করিস না, পরেরবার খেয়াল থাকবে!”

ব্যাঙ্গার্ত্বক কন্ঠে বলা সাহিলের প্রতিটা কথাই রক্ত চোখে দাঁতে দাঁত চেপে শুনে গেলো জাফর শিকদার। পরক্ষণেই বিকট শব্দে কুৎসিত ভঙ্গিতে হেসে উঠলো সে। জোড়ালো ভাবে সাহিলের গলা চেপে ধরে বলে উঠলো,
– মজা করছিস আমার সাথে! তাও আবার আমার মেয়েকে নিয়ে…!”
কথাটা বলতে বলতে সাহিলের শরীরে ক্রমাগত লা*থি মেরে যাচ্ছে সে!

অবস্থা বেগতিক দেখে নাজিম শিকদার দ্রুতবেগে ওর বড় ভাই জাফর শিকদারকে সাহিলের কাছ থেকে টেনে সরিয়ে নিলো। ঠান্ডা গলায় বললো,
-“নিজেকে সামলান। এ মরলে কিন্তু আমরা ফেঁসে যাবো!”
জাফর শিকদার ক্ষুব্ধ নিশ্বাস ছেড়ে সাহিলের প্রায় নিথর দেহের দিকে একবার তাকিয়ে হুংকার দিয়ে বলে উঠলো,
-“আমার চোখের সামনে থেকে নিয়ে যা একে!”

কালো ফর্মাল পোশাকধারী লম্বা চওড়া লোকটা সাহিলকে নিয়ে যেতেই জাফর শিকদার অস্থির ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে পড়লো। কন্ঠে অধৈর্য্যের রেশ নিয়ে বললো,
-“নাটক করছে শা*লা! আমাকে ব্ল্যাকমেইল করে পাড় পেয়ে যাবে ভেবেছে! এখন আবার আমার মেয়েকে নিয়ে বাজে বকছে! একে তো আমি…!”

-“এখন কী সাহিলকেও আরমানের স্ত্রীর মতো খুন করতে চাইছেন? এতেই কী আমাদের সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে!!”
নাজিমের কন্ঠে রুক্ষতার আভাস। সাথে সাথেই নাজিমের কলার চেপে ধরলো জাফর শিকদার। কর্কশ গলায় বলে উঠলো,

-“আরমানের স্ত্রী…আরমানের স্ত্রী, কথাটা শুনলে আমার মাথায় রক্ত চড়ে যায়! ভবিষ্যতে আমার সামনে ভেবে কথা বলবি। আর ঐ রাতে আমি ড্রাঙ্ক ছিলাম। রাগের মাথায় হয়ে গেছে যা হওয়ার! ঐ মহিলার সাহস কী করে হয়েছিলো জাফর শিকদারের গালে চড় মারার!!”
শেষের বাক্যটা বিড়বিড় করে বললো জাফর। নাজিম কিছুক্ষণ শান্ত হয়ে দেখে গেলো তার বড় ভাইকে। নিজের কলার থেকে জাফরের হাত সরিয়ে সতর্ক কন্ঠে বলে উঠলো,
-“মাথা ঠান্ডা রাখুন। রাগের মাথায়ই যত ঝামেলা হয়। একটু চিন্তা করুন, সাহিল যদি সেই ব্ল্যাকমেইলার না হয় তাহলে আপনি আরও বাজে ভাবে ফেঁসে যাবেন। ঐ ব্ল্যাকমেইলারের কাছে কিন্তু এখনো আপনার রাগের মাথায় করা অপরাধের ভিডিও ফুটেজ আছে!”

***
একটু পর পর মুখটা তড়তড় করে ঘেমে একাকার হয়ে উঠছে। টিস্যু দ্বারা কপাল থেকে গলা অব্দি বেয়ে পড়া ঘাম মুছে যাচ্ছে আইজা। তাও যেন স্বস্তি নেই। আজ সারাদিন কফি আর পাস্তা ছাড়া পেটে কিছু পড়েনি। ভাত গলা দিয়ে নামে না। আর তরকারির সাথে যেন একপ্রকার শত্রুতাই হয়ে গেছে ওর রুচির। এসব ছেড়ে সারাদিন কফির সাথে বন্ধুত্ব করার ফলই হয়তো ভোগ করছে আইজা।

-“তোর কি শরীর খারাপ লাগছে?”
-“একটু।”
আরফানের প্রশ্নে অস্ফুটে বলে উঠলো আইজা। গাড়িতে অসুস্থ হওয়ার প্রবনতা আইজার নেই বললেই চলে। তবুও কেন আজ এমন হচ্ছে বুঝে উঠতে পারছে না ও।

কিছুক্ষণ পর গাড়ির জানালা ভেদ করে শীতল বাতাসের স্পর্শেই যেন কলিজা ঠান্ডা হয়ে গেলো। একটু স্বস্তি পায় আইজা। হঠাৎ করেই নিজের পাশে সযত্নে রাখা হ্যান্ডব্যাগে নজর গেলো আইজার। অনিচ্ছাকৃতভাবেই মস্তিষ্কের একাংশে নাড়া দিয়ে উঠলো সেই দিনের স্মৃতি! ঐদিই প্রথম সীমান্ত নিজ থেকে আইজাকে নিয়ে ঘুরতে বেড়িয়েছিলো,

অতীত
——————
ভর দুপুরে আইজাকে বাইকের পাশে একা রেখেই কোথায় যেন চলে গেছে লোকটা। ভাপসা গরমে ছটফট করতে করতে নিজ থেকেই কোল্ড কফি কিনে খেতে শুরু করলো ও। সচরাচর কফির মাঝে কোন আকর্ষণবোধ কাজ করে না আইজার। চা হাতে পেলেই দিল খুশ! কিন্তু আজ একটু বেশি কফি ক্রেভিং হচ্ছে ওর!

সীমান্ত নিজের ঘর্মাক্ত মুখটা নিয়ে বেশ কয়েকটা শপিং ব্যাগ হাতে আইজার সামনে এসে দাঁড়াতেই ভ্রু কুঁচকে এলো ওর। সীমান্ত আইজার হাতে থাকা কোল্ড কফিতে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করে বসলো,

-“আপনার ক্ষিদে পেয়েছে? সামনেই একটা রেস্টুরেন্ট…!”

সীমান্তর কথা শেষ হতে না হতেই আইজা সীমান্তর হাত থেকে একটা শপিং ব্যাগ নিজের হাতে নিয়ে বলে উঠলো,
-“আপনি আরও শপিং করেছেন? আমাকে ছাড়া!”

আইজার অসন্তুষ্ট কন্ঠে করা প্রশ্নে সীমান্তর দৃষ্টিতে কোন হেলদোল নেই। সে নির্লিপ্ত ভাবে বললো,
-“কয়েকদিন পর আমার এক ক্লোজ ফ্রেন্ডের বিয়ে। তার জনই গিফট। আপনার সাথে শপিং করার সময় বিষয়টা মাথায় ছিলো না।”

সীমান্তর কথায় আইজা সন্দেহজনক চাহনি নিক্ষেপ করলো। কিন্তু মুখে কিছু বললো না। তবে সেই শপিং ব্যগগুলোর মধ্যে একটা শপিং ব্যাগে রাখা হ্যান্ডব্যাগে চোখ আঁটকে যায় আইজার। এই হ্যান্ডব্যাগটা অনেক দিন ধরেই কিনতে চাইছিলো ও। কিন্তু স্টক না পাওয়ায় কেনা হয়নি। তাছাড়া মার্কেটে এ ব্যাগ তো তখন আইজার চোখে পড়েনি!

-“আপনি এটা রাখুন।”
সেই হ্যান্ডব্যাগের দিকে ইশারা করলো সীমান্ত। তার গম্ভীর কন্ঠে বলা কথাটা শুনতেই এক ভ্রু উঁচু করে তাকালো আইজা।
-“না! আমার এই ব্যাগ লাগবে না!”
এই বলে শপিং ব্যাগটা সীমান্তর হাতেই ফেরত দিলো ও। কিন্তু সীমান্ত বরাবরের মতো নিজের সিদ্ধান্তে অটল। অনেকটা জোর করে সেই হ্যান্ডব্যাগটা আইজার হাতে ধরিয়েই শান্ত হলো সে!

বর্তমান
——————-
হঠাৎ গাড়ির হর্নের আওয়াজে হুশ এলো আইজার। বর্তমান পরিস্থিতিতে মন দিলো ও। সামনেই বাস স্ট্যান্ড। আইজা ড্রাইভিং সীটে বসা ব্যাক্তির উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
-“গাড়ি থামান!”

রিয়ার ভিউ মিররে লোকটির বিরক্তিতে জর্জরিত মুখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে আইজা। যদিও লোকটা ওর কথা অমান্য করলো না। এক সাইডে গাড়ি থামিয়ে আইজার দিকে অধৈর্য্যের দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সে।
-“এবার কী হয়েছে?”

প্রিয় মামা সাহেব দেখি এখনই বিরক্ত হয়ে গেছে। তাকে তো কেউ প্রতিরাতে ঐ বাড়ির সামনে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেনি! আর এখন এতো দ্রুত বিরক্ত হয়ে পড়লো সে! এ কথাগুলো ভাবতেই হাসি পেলো ওর। তবে হাসলো না। কোন কিছু না বলে সোজা গাড়ি থেকে নেমে গেলো। এক ছুটে একটা বাসে চড়ে উঠলো আইজা। বেশ কয়েকটা সীট খালি পড়ে আছে। হাতে থাকা হ্যান্ডব্যাগ থেকে ফোন বের করে খালি ব্যাগটা ঐ বাসের একটা সীটে রেখে দিলো ও।

-“এসব কী পাগলামো আঁখ..আইজা!!!”
আইজার মামা জামিল মাহমুদ ওর পেছন পেছন বাস পর্যন্ত এসে পড়েছে! আইজা এবারও কোন জবাব দিলো না। উল্টো জামিলের হাত ধরে টেনে তাকে সেই বাস থেকে নামিয়ে দিলো। নিজেও নেমে পড়লো।
-“ব্যাগটা আমার পছন্দ না। তাই ফেলে দিলাম!”
কথাটা বলেই হনহন করে গাড়িতে এসে বসে পড়লো ও। ঐ বাসটা ছেড়ে দিতেই আইজার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সেদিকে পড়লো। ওদের থেকে একদম উল্টো দিকে যাচ্ছে বাসটা।

দ্রুত গতিতে বাসটা চলে যেতেই অদ্ভুত বক্র হাসি জায়গা করে নিলো আইজার ঠোঁট যুগলে। সীমান্ত এমনি এমনি ওকে সে ব্যাগ গিফট করেনি। আইজা জানে ওর অপ্রিয় হাসবেন্ড নিজের স্ত্রীকে দেয়া উপহারের মাঝে বোনাস হিসেবে একটা ট্র্যাকারও সংযুক্ত করেছিলো!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here