#অপ্রিয়_প্রেয়সী
#লিখা_তানজিলা
#পর্ব – ২৬
ঝড়ো শীতল হাওয়ার বেগ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। তার সাথে তাল মিলিয়ে ছুটে চলছে সীমান্তর বাইক। রাস্তায় এই মুহুর্তে গাড়ি তেমন নেই। পকেটে ফোনের ভাইব্রেট হওয়া বুঝতে পেরে এক পাশে বাইক থামিয়ে দিলো সীমান্ত। ফোন রিসিভ করে জোড়ালো কন্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠলো,
-“কোথায় তারা?”
ওপর পাশ থেকে রিয়াদের উত্তরে ভ্রু কিঞ্চিত সংকুচিত হয়ে এলো ওর। সাথে বাড়লো বিরক্তির মাত্রা।
-“দেখুন মশকরা করবেন না আমার সাথে! ভালো করে চেক করুন! এতো রাতে তাদের এমন জায়গায় যাওয়ার তো কোন কারণ নেই! একটা বাচ্চা আছে তাদের সাথে!”
সীমান্তর কন্ঠে ধমকের ছাপ। রিয়াদ কয়েক সেকেন্ডর জন্য চুপ থেকে আবারও সেই একই উত্তর দিলো। এবার সীমান্ত থম মেরে রইলো। পুরোটা বিষয় যেন ওর মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে! আশেপাশে একবার চোখ বুলালো ও। রাত তো কম হয়নি! সীমান্ত শক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
-“আপনার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে ওখানে চলে আসুন।”
রিয়াদকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে খট করে কল কেটে দিলো ও। মনের মধ্যে এক অজানা ভয়ের রেখা ফুটতেই দ্রুতবেগে বাইক স্টার্ট করলো সীমান্ত।
এতোদিনের গা জ্বালানো গরমের পর আজকের আবহাওয়া হয়তো অনেকের কাছে বেশ স্বস্তিদায়ক। কিন্তু সীমান্তর কাছে সেই স্বস্তির ছিটেফোঁটাও পৌঁছাচ্ছে না। সাধারণ ঝড়ো শীতল হাওয়াটা এই মুহুর্তে কেন যেন কনকনে ঠান্ডা মনে হচ্ছে ওর কাছে। আর ঠান্ডা বিষয়টাই ওর কাছে বিষ স্বরূপ!
সীমান্ত মনে করেছিলো আইজা হয়তো ওর মামার সাথে গেছে। এই ঢাকাতেই তিনটে ফ্ল্যাট আছে জামিল মাহমুদের। ও কয়েকজনকে সেদিকে পাঠিয়েছে নজর রাখার জন্য। কিন্তু আইজার হ্যান্ডব্যাগে লাগানো ট্র্যাকারের তথ্য অনুযায়ী ওদের অবস্থান মোটেও সুবিধার না! পূর্বের তুলনায় বাইকের স্পিড একটু বেশি বাড়িয়ে দিলো সে।
জায়গাটা ছোটখাটো একটা এলাকার মতো। সাধারণ কোন ভদ্র পুরুষ বা মহিলা এখানে কদম পর্যন্ত রাখতে চাইবে না। সীমান্তর বাইকের পিছু পিছু একটা গাড়ি এসে থামলো। রিয়াদ বেশ ক্লান্ত ভঙ্গিতে বেড়িয়ে এলো সে গাড়ি থেকে। সীমান্ত রিয়াদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ওর হাত থেকে ট্যাবটা ছিনিয়ে নিয়ে হনহন করে ছুটে গেলো নিষিদ্ধ পল্লিতে।
পান চিবুতে থাকা মাঝ বয়সী মহিলার দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে আছে সীমান্ত। ট্র্যাকারের লোকেশন অনুযায়ী হ্যান্ডব্যগের অবস্থান এখানেই। কিন্তু সামনে বসে থাকা অভদ্র মহিলা ওকে কিছুতেই ওপরে যেতে দিচ্ছে না। মহিলার পেছনে বেশ কয়েকজন শক্তপোক্ত বিশালদেহী ব্যাক্তি দাঁড়িয়ে। মনে হচ্ছে সীমান্তর সাথে আসা লোকজন তাদের ধারে কাছে গেলেই এক ফু মেরেই উড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা আছে তাদের।
-“কত চাই আপনার?”
ঝামেলাহীনতা প্রিয় সীমান্তর মুখনিঃসৃত বাক্যে সাথে সাথেই অভদ্রমহিলার মুখটা চকচকে হয়ে উঠলো। সাইডে রাখা এক পাত্রে পানের পিক ফেলে বললো,
-“দেইখা তো ভালা ঘরের মনে হয়!” কথাটা বলেই সে সীমান্তর একটু কাছে নিজের মুখ এগিয়ে ফিসফিস কন্ঠে আরও বলে উঠলো,
-“যত মাল ঢালবেন, ততই টাটকা মাল পাইবেন!”
নাক মুখ কুঁচকে এলো সীমান্তর। তবুও পরিস্থিতি বিবেচনায় নিজেকে সামলে নিলো ও। মৃদুস্বরে বললো,
-“দেখুন আমরা এখানে…!”
-“রূপা আম্মা আপনার চা…!”
মহিলার সামনে চা ধরে রাখা মেয়েটাকে দেখে সীমান্ত ওর কথার মাঝপথেই আটকে রইলো। ঠাস করে কাপ ভাঙার আওয়াজ গুঞ্জে উঠলো চারদিক। মেয়েটাও সীমান্তকে দেখে চোখ বড়সড় করে তাকিয়ে আছে। কানের কাছে রিয়াদের কন্ঠ ভাসতেই টনক নড়লো ওর।
-“স্যার, নিজের বাড়িতে এসব কাদের নিয়ে এসেছেন! একজন পাগল আর একজন প*তিতা পল্লীতে….!”
অভদ্রমহিলা কিছুটা সন্দেহজনক চোখে তাকিয়ে শক্ত গলায় বললো,
-“এরে চিনেন আপনে! কি রে রাজিয়া! এহানে না না কইরা বাইরে ঘোল খাওয়াস! উন্নতি হইছে তো অনেক!”
***
সীমান্তর দিকে না তাকিয়েই আইজার হ্যান্ডব্যাগটা ওর সামনে তুলে ধরলো রাজিয়া। সীমান্ত কটমট চোখে তাকিয়ে আছে। রাজিয়ার কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে এর কানের নিচে কষে চড় মারার ইচ্ছে দমিয়েই সীমান্ত ঝাঁঝালো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
-“আইজার ব্যাগ আপনার কাছে কী করছে!”
-“আমারে কাম থেইকা বাইর কইরেন না! আমি চুরি করি নাই!”
-“যেটা জানতে চেয়েছি তার উত্তর দিন!!”
চিৎকার করে উঠলো সীমান্ত। সাথে সাথেই হেঁচকি তুলে কাঁদতে শুরু করলো রাজিয়া। ফেচফেচ করে বলতে লাগলো,
-“আমি বাসে আছিলাম। আইজা ভাবি কই থেইকা জানি বাসে উইঠা ব্যাগটা একটা সীটে রাইখ্যা আরেক ব্যাটার লগে ভাগছে! আমার মুখ ওড়না দিয়া ঢাকা আছিলো। তাই মনে হয় চিনতে পারেনাই! আমি ডরে সামনে যাই নাই। যদি নিজের দোষ ঢাকতে আমারে মাইরা দেয়!!”
সীমান্ত ভ্রু কুঁচকে রাজিয়ার বলা কথাগুলো বুঝার চেষ্টা করছে। হঠাৎ সবটা মস্তিষ্কে পরিষ্কার হতেই চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো ওর। নিজের অজান্তেই সীমান্ত ওই হ্যান্ডব্যাগটা জমিনে সজোরে ছুড়ে মারলো। রাজিয়ার দিকে না তাকিয়েই বলে উঠলো,
-“আপনাকে যেন আর আমার বাড়ির আশেপাশে না দেখি!”
মুহূর্তেই সীমান্তর হাত চেপে ধরলো রাজিয়া। করুন কন্ঠে বলে উঠলো,
-“ভাই এমন কইরেন না! আমি ম*ইরা যামু! আমার বাপের কামের শাস্তি আমি কেন পামু! আমার বাপ ম*রার আগে এই মহিলার থেইকা বড় অংকের টাকা নিছিলো। ঐটা পুরা দিতে না পারলে আমারে এখানেই কাম করাইবো ওরা!”
-“এতো সমস্যা আপনার লাইফে!”
সীমান্তর কন্ঠে ধীরতার আভাস। রাজিয়ার হাতটা নিজের বাহু থেকে ছিটকে সরিয়ে দিলো ও। রাজিয়াকে উত্তর দেয়ার সুযোগ না দিয়ে ওর দিকে কিছুটা এগোতেই রাজিয়া এক ধাপ পিছিয়ে দাঁড়ালো। সীমান্তর চোখ জোড়া বেশ অদ্ভুত ভঙ্গিতে জ্বলজ্বল করছে।
-“আপনার যদি এতোই কাজে টিকে থাকার ইচ্ছে থাকতো তাহলে আমার স্ত্রীকে নিয়ে বাজে কথা বলার সাহস কী করে হয়েছিলো! আর এতোকিছুর পরও আপনার এখানে থাকা আবার ঐ মহিলাকে সম্মানের সাথে রূপা আম্মা বলাটা কী আমি স্বাভাবিক ভাবেই নেবো! আপনার চোখে বিন্দুমাত্র ভয় বা ঘৃণা ছিলো না রাজিয়া! এই মুহুর্তে আমি আপনাকে একদমই ভরসা করতে পারছি না!”
রাজিয়ার মুখটা কিঞ্চিত শুকিয়ে গেলো। কিছু একটা বলতে গিয়েও চুপ হয়ে রইলো ও। সীমান্ত সেই নিরবতার মাঝেই নিজের বাইকে চড়ে বসলো। গাড়ি সহ বাইকটা মুহুর্তেই রাজিয়ার চোখের আড়াল হয়ে গেলো! চোখের পানি মুছে ওখানেই ঢপ করে বসে পড়লো ও!আইজাকে কেন সহ্য হয়না ওর! এই প্রশ্নের কোন সঠিক জবাব নেই রাজিয়ার কাছে। আইজাকে দেখলেই কেন যেন ওর মাঝে আরমানকে দেখতে পায় রাজিয়া। যেই লোকটার জন্য ওর পুরো জীবন নষ্ট হয়ে গেছে!
***
জামিল মাহমুদের ধানমন্ডির ফ্লাটের সামনে থামলো সীমান্তর বাইক। খবর অনুযায়ী জামিল মাহমুদের গাড়ি এখানেই এসেছে। রিয়াদও পিছু পিছু আসছে। সীমান্ত সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বিল্ডিং এ চোখ রেখে রিয়াদকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
-“পাখির ব্যপারে খোঁজ লাগান! আর রাজিয়াকে কালকের মধ্যে টিনের ভিলাতে দেখতে চাই আমি!”
রিয়াদ ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“এখন কী লাভ এসব করে!”
রিয়াদের কথায় তার দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালো সীমান্ত। পরক্ষণেই মুখটা শক্ত করে বলে উঠলো,
-“আমি পাখি কিংবা রাজিয়া কাউকেই কাজে রাখিনি! জাফর সাহেব এদের বাড়িতে কাজে রেখেছিলো! এমনিও ওদের নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথা ছিলো না! তাই তেমন খোঁজ নেইনি!”
জাফর শিকদারের কথা মনে করতেই চোখ মুখ কুঁচকে এলো সীমান্তর। এই মানুষটাকে একদমই সহ্য করতে পারে না ও। আজকে রাজিয়া আর পাখির যে রূপ দেখলো তাতে নিজের বাবার বড় ভাইয়ের প্রতি সন্দেহ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে যাচ্ছে।
-“স্যার আমি বোধহয় একটু একটু আইডিয়া করতে পারছি!”
সিঁড়ির সামনে যেতেই রিয়াদের কন্ঠ শুনে থেমে গেলো সীমান্ত। প্রশ্নবোধক চাহনি নিক্ষেপ করলো তার দিকে। রিয়াদ সেই চাহনির জবাবে ধীর কন্ঠে বললো,
-“আপনি যেমন আমাকে নিজের পিএর মতো খাটান। সে ও হয়তো রাজিয়া আর পাখিকে নিজের কাজ আর খবরদারির জন্য শিকদার বাড়িতে এনেছে!!”
চলবে…