#অপ্রিয়_প্রেয়সী
#লিখা_তানজিলা
#পর্ব – ৩৩
অতীত
——————-
মা তীব্র যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। সীমান্তর চোখের সামনেই লোকটা ওর মায়ের হাতের একটা আঙুল কেটে নিলো! পারেনি ও নিজের মাকে রক্ষা করতে! কোনমতে একটা ব্যান্ডেজ পেঁচিয়ে দেয়া হয়েছে ক্ষতস্থানে! অমানুষটার মুখে লেপ্টে আছে ক্রুর হাসি। সে সীমান্তর ছটফট করতে থাকা আঁখি জোড়ায় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠলো,
-“রাগ হচ্ছে অনেক তা-ই না! আমাকে মে*রে ফেলতে ইচ্ছে করছে?
চেয়ারে হাত পা বেঁধে রাখায় নড়াচড়া করতে পারছে না সীমান্ত। মুখ স্কচটেপে বন্দী! দম বন্ধ হয়ে আসছে। সামনেই ওর মায়ের হাতের অন্য আরেক আঙ্গুল বেশ ধারালো যন্ত্রের মাঝে রাখা। ওদিকে তাকাতেই ফুপিয়ে উঠলো সীমান্ত। এ দৃশ্যে লোকটার চোখে এক অদ্ভুত তৃপ্তি ফুটে উঠলো যেন।
-“আমাদের যেতে দিন! মা’র কষ্ট হচ্ছে!”
এটাই বলতে চেয়েছিলো সীমান্ত। কিন্তু মুখ থেকে কোন আওয়াজ বের হয়নি। হবেই বা কী করে। মুখ যে বাঁধা!
-“আই লাভ কিডস! দে আর সো কিউট! সো ইনোসেন্ট! তুমি নিশ্চয়ই বোর হচ্ছো! চলো, আমরা বরং একটা গেম খেলি। খুবই ইন্টারেস্টিং গেম!”
সীমান্তর মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে সে। সীমান্ত নিজেকে ছাড়ানোর জন্য অনবরত চেষ্টা করে যাচ্ছে। হুট করেই লোকটার মুখে লেগে থাকা হাসিটা যেন পূর্বের তুলনায় আরো একধাপ বেড়ে গেলো।
-“তোমার মায়ের আঙুলটা আমি চারতলার একটা খালি এপার্টমেন্টে লুকিয়ে রেখেছি। তুমি যদি ত্রিশ মিনিটের মধ্যে সেটা খুঁজে আনো তাহলে তোমাদের ছেড়ে দেয়া হবে। আর যদি ব্যর্থ হও, তাহলে একে একে তোমার মায়ের হাত থেকে বাকি নয়টা আঙুলই কেটে টুকরো করে তোমার বাবার কাছে পার্সেল করে পাঠাবো! অনেক ইন্টারেস্টিং না গেমটা!”
মুহূর্তেই থেমে গেল সীমান্ত। লোকটার কথা যেন ওর মস্তিষ্ক ভেদ করেনি। এক নজর মায়ের দিকে তাকিয়ে থরথর করে কাঁপছে সে। সীমান্তর কম্পিত দেহের সামনে এগিয়ে যাচ্ছে সেই ব্যাক্তি। আলতো ভাবে মুখে লাগানো স্কচটেপ খুলে দেয়া হলেও সীমান্তর শুষ্ক ঠোঁট জোড়া যেন নড়তে চাইছে না।
-“মা…মা…!”
সীনান্তর ডাকে পিট পিট করে তাকালো সে। হয়তো উঠে আসার চেষ্টাও করলো। কিন্তু অতটা শরীর নিতে পারলো না। তখনই মৃদু আর্তনাদের শব্দে কেঁপে উঠলো সীমান্ত। লোকটা সেই ধারালো যন্ত্র ওর মায়ের আঙুলে আরো জোরালো ভাবে গেঁথে যাচ্ছে।
-“প্লিজ, মাকে মারবেন না!”
সীমান্তর বেধে রাখা ছোট শরীরটা সাথে সাথেই খুলে দেয়া হলো,
-“তাহলে সময় নষ্ট করো না! আর মাত্র আটাশ মিনিট বাকি!”
কথাটা বলতেই একবার মায়ের বিধ্বস্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে ছুটে গেলো সীমান্ত ওর মায়ের আঙুল আনতে। এই মুহুর্তে আর কিছুই যেন ওর মাথায় ঠেকছে না। একটু পর পর বুক ফেটে গলা অব্দি শ্বাস আঁটকে আসছে। চারদিকে বন্দুকধারী লোক দাঁড়িয়ে আছে। আর সামনে একটা লিফট। আশেপাশে সিঁড়ির কোন দেখা নেই। লিফটে চড়তে প্রচন্ড ভয় পায় সীমান্ত। কিন্তু আজ যেন সে ভয় তুচ্ছ! এক দৌড়ে লিফটের দিকে ছুটে গেলো সীমান্ত।
লিফটের ভেতরে ওর সাথে আর কেউই নেই। সম্পূর্ণ একা দাঁড়িয়ে আছে ও। একটা আওয়াজ করে লিফটটা সোজা চার তালায় গিয়ে থামলো। চারতলায় ঠিক চারটা এপার্টমেন্ট। একে একে তিনটা দরজায় জোরালো ভাবে ধাক্কা দিয়ে গেলো সে। সবগুলো ভেতর থেকে লক করা।
একমাত্র শেষের দরজাটাতেই কোন লক ছিলো না। একবার ধাক্কা দিতেই খট করে শব্দ করে খুলে গেলো সে দরজা। যেমনটা বলা হয়েছিলো। সম্পূর্ণ খালি এপার্টমেন্ট। সামনের দেয়ালে এটাচ করা বড় স্মার্ট টিভিতে ওর মাকে দেখা যাচ্ছে। যেন সীমান্তকে মনে করিয়ে দেয়া হলো ও এখানে কেন এসেছে!
চারিদিকে কাগজপত্র, জামা কাপড় আর সাথে বিভিন্ন যন্ত্রপাতির ভাঙা অংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সবকিছুই অগছালো। সীমান্ত কয়েক সেকেন্ডর জন্য জমে রইলো যেন। পরক্ষণেই হন্তদন্ত হয়ে জমিতে পড়ে থাকা জিনিসপত্র ওলট-পালট করে খুঁজতে শুরু করলো ওর মায়ের আঙুল। কাঁদতে কাঁদতে একে একে বস্তুগুলোকে দেয়াল ছুড়ে মারছে ও। ফলাফল শূন্য। ওদিকে সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। মায়ের হাতে সেট করা সেই ধারালো যন্ত্রের ধার তীব্র গতিতে বেড়েই চলছে!
সময় বাকি আর মাত্র আটান্ন সেকেন্ড। হাতে ছোট্ট একটা বাক্স নিয়ে লিফটে দাঁড়িয়ে আছে সীমান্ত। সময় যেন আলোর গতিতে ছুটে যাচ্ছে। এই মুহুর্তে এ লিফটটাকে ওর কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে ধীরগতির বস্তু মনে হচ্ছে! বাক্সটার সাথে লেপ্টে থাকা রক্তের ছাপ ওর হাত অব্দি লেগে আছে। প্রচন্ড ঠান্ডা লাগছে সীমান্তর। পুরো শরীরে বরফে আটকা পড়েছে যেন!
লিফট থামতেই রক্তমাখানো বাক্সটা নিয়ে দ্রুতগতিতে ওর মায়ের কাছে ছুটলো সীমান্ত। কিন্তু কোথাও দেখতে পাচ্ছে না তাকে। শুধুমাত্র সে লোকটার ঠোঁটে লেগে থাকা ভয়ংকর হাসির উপস্থিতি সীমান্তর দৃষ্টিতে আঘাত করছে। কাঁপা কাঁপা চোখে ঘড়িতে চোখ রাখতেই কুৎসিত এক আওয়াজ কানে গিয়ে পৌঁছালো,
-“পাঁচ সেকেন্ড লেট…!”
ঠাস করে হাত থেকে বাক্সটা নিচে পড়ে গেলো। তৎক্ষনাৎ দ্রুত গতিতে সেই লোকটার হাতে নিজের দাঁতের ছাপ বসিয়ে দিলো সীমান্ত। লোকটার কিঞ্চিত আর্তনাদেও থামলো না সে। শেষমেষ গালে হিংস্র এক থাবায় রুমের এককোণে ছিটকে পড়লো সীমান্তর শরীর। মনে হচ্ছে শরীরের সব হাড় যেন গুড়িয়ে গেছে। ওর গলা ধরে এলেও দূর্বল কন্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠলো,
-“মা কোথায়!!”
লোকটা কোন জবাব দিলো না। উল্টো সীমান্তর ক্রন্দনরত চাহনি দেখে পৈচাশিক হাসি ফুটে উঠলো তার মুখে!
বর্তমান
——————–
হাতে থাকা বাক্সে আংটির পাশে রাখা ছোট চিরকুটটা চোখের সামনে ধরলো সীমান্ত।
-“সময়ের মূল্য যে কত তাতো তুমি জানোই। আশা করি এবার অন্তত লেট করবে না। ৭২ ঘন্টার মধ্যে আমার সামনে এসে না দাঁড়াতে পারলে পরের বাক্সে তোমার স্ত্রীর কাটা মাথা উপহার হিসেবে শিকদার বাড়ির সামনে রেখে আসা হবে।”
সীমান্তর হাতের মধ্যেই পিষে যাচ্ছে সে চিরকুট। সম্পূর্ণ অনুভূতিহীন চোখে বাক্সটা দেখে যাচ্ছে সীমান্ত। জামিল মাহমুদ যখন এম্বুলেন্স আনালেন তখনই সীমান্ত বুঝতে পেরেছিলো কোন ঘাপলা আছে। সেই এম্বুলেন্সে ক্লিনিক স্টাফদের অগোচরে ট্রেকার লাগিয়েছিলো সীমান্ত। ফোনের স্ক্রীনে ভেসে থাকা লোকেশন অনুযায়ী সেই এম্বুলেন্স ক্লিনিক থেকে ঠিক বিশ মিনিটের দূরত্বে আছে। তৎক্ষনাৎ রিয়াদকে কল করে নিজের বাইক স্টার্ট করলো সীমান্ত। পেছনে জামিল মাহমুদ আর আরফানকে ছুটে আসতে দেখেও থামলো না সে!
যেমনটা ভেবেছিলো, এম্বুলেন্স একজায়গায় খালি পড়ে আছে। হয়তো এখানে এটা ফেলে অন্য গাড়িতে আইজাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আশেপাশে গাড়ির কোন দেখা নেই। বেশ দূর থেকে বজ্রপাতের শব্দ শুনতে পাচ্ছে সীমান্ত। ক্ষীণ শব্দটাও বিকট হয়ে ধরা দিলো ওর কানে। সময় কত হলো জানা নেই সীমান্তর। সত্যি বলতে ঘড়ি অথবা ফোনে সময় দেখতে একদমই ইচ্ছে করছে না ওর।
সীমান্তর ঠিক পাশেই থেমে যাওয়া ট্যাক্সি থেকে বেরিয়ে এলো রিয়াদ। অগোছালো হাতে তাড়াহুড়ো করে ভাড়া মিটিয়ে বলে উঠলো,
-“সরি স্যার, লেট হয়ে গেলো। ফোনে তো কিছুই বুঝতে পারলাম না। আপনি ঠিক আছেন তো!”
রিয়াদের চিন্তিত কন্ঠে ভ্রু কুঁচকে এলো সীমান্তর। মাথায় জমে থাকা পানি ঝাড়তে ঝাড়তে স্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠলো,
-“আমার কী হবে?”
-“আপনি এই মুহুর্তে এতো শান্ত কি করে? ওরা কিন্তু ভাবির ক্ষতি করতে পারে!”
রিয়াদের কন্ঠে অধৈর্য্যর রেশ। যেন সীমান্তর মুখে লেগে থাকা নির্লিপ্ততা বুঝে উঠতে পারছে না সে। রিয়াদের প্রশ্নের কোন জবাব দিলো না সীমান্ত। ধীর গতিতে বাইকে চড়ে বসলো ও।
-“স্যার, আপনি…!”
রিয়াদের দিকে নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে তাকালো সীমান্ত। ঠান্ডা গলায় বলে উঠলো,
-“কাল সারারাত ঘুম হয়নি। এখন আমি ক্লান্ত। আমি চাই আমার জায়গায় আপনি এখানের পরিস্থিতি খেয়াল রাখুন। আরমান যাতে এ ক্লিনিক থেকে বের না হয়!”
সীমান্তর কথায় ভ্রু কুঁচকে তাকালো রিয়াদ।
-“কিন্তু ভাবি…!”
-“এতো কথা কেন বলেন আপনি?”
সীমান্তর ক্রোধভরা কন্ঠে তৎক্ষনাৎ চুপ হয়ে গেলো রিয়াদ। পাল্টা কোন জবাব দিলো না। সীমান্ত বাইক স্টার্ট করে ছুটে চললো ক্লিনিকের ঠিক উল্টো পথে। প্রচন্ত ক্লান্তি এসে ভর করেছে শরীরে। এখন তার শান্তি চাই!
চলবে…