#অপ্রিয়_প্রেয়সী
#লিখা_তানজিলা
#পর্ব – ৩৫
সীমান্ত ছেড়ে দিতেই বুক চাপড়ে ধরে কাশতে কাশতে বসে পড়লো সাহিল। মুখ দেখে মনে হচ্ছে শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। সীমান্ত এক গ্লাস পানি সাহিলের সামনে তুলে ধরতেই রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালো সে। তবে পানির গ্লাসটা হাতে নিয়েই।
-“টাকা ছাড়া আমার মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হবে না!”
সাহিলের দৃঢ় কন্ঠে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সীমান্ত। ব্যাগ থেকে একটা টাকার বান্ডিল রাখলো ওর সামনে।
-“জানতাম আমি! এখন বলুন, এই ফ্ল্যাটটার খোঁজ আপনাকে কে দিয়েছে?”
সামনে টাকার বান্ডিল দেখে সাহিলের চোখ জোড়ায় চকচকে এক আভা ফুটে উঠলো। প্রিয় বস্তুটাকে বেশ মনোযোগ সহকারে দেখে যাচ্ছে সে। কিছুক্ষণ পর চোখে সন্তুষ্টির ছাপ নিয়ে টাকাগুলো ধরতে গেলেই সীমান্ত ছো মেরে তার সামনে থেকে সেগুলো উঠিয়ে বলে উঠলো,
-“এতো সহজে না। আগে মুখ খুলুন।”
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সাহিল। সোফায় গা এলিয়ে দিলো সে। মুখে একঘেয়েমীর ভাব এনে বললো,
-“আসিফ ভাই এই ফ্ল্যাটের সন্ধান দিয়েছিলো আমাকে। আমি অর্ধেক ভাড়া দেই আর বাকি অর্ধেক ভাড়া আরেক ভাড়াটিয়া দেয়। খুশি!!! এখন টাকা দিয়ে বিদায় হন!”
সাথে সাথেই এক ভ্রু উঁচু হয়ে এলো সীমান্তর। মুখে ফুটে উঠলো অদ্ভুত উজ্জ্বল আভা।
-“আই সি….!”
বিড়বিড় করে বলে উঠলো ও। আসিফ এই মুহুর্তে পলাতক। রাইভাল কোম্পানির কাছে ইনফরমেশন লিক করেছে সেটা জানলেও ফাহাদ খানের সাথেও যে তার কানেকশন ছিলো জানতো না সীমান্ত। নইলে সে রাতই লোকটাকে আটক করতো ও!
এরই মধ্যে সাহিল দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলে বলে উঠলো,
-“চলে যান!”
সাহিলের উত্তেজিত কন্ঠে মৃদু বাঁকা হাসির রেখা নিয়ে সোফায় বসে পড়লো সীমান্ত। এক সাইডে রাখা বড় সাইজের এক ব্যাগের দিকে চোখ রেখে বলে উঠলো,
-“সাহিল সাহেব দেখি প্যাকিং করে রেখেছেন। কোথাও যাচ্ছেন না-কি!”
ভ্রু কুঁচকে তাকালো সাহিল। এরই মধ্যে রুম জুড়ে কারো ফোনের রিংটোনের আওয়াজ ভেসে এলো। সীমান্তর ঠোঁট জুড়ে বিচরণ করতে থাকা বাকা হাসির ঝলক যেন আরো তীব্র হয়ে উঠলো।
-“কল রিসিভ করুন!”
সীমান্তর কথায় অনেকটা ধীর গতিতে ফোনের দিকে আগাচ্ছিল সাহিল। এতো সময় কার আছে! সীমান্ত নিজেই ফোন তুলে সাহিলের সামনে তুলে ধরলো। কিছুটা সন্দেহজনক দৃষ্টি নিয়েই সে ফোন কেড়ে নিলো সাহিল। প্রায় পনেরো সেকেন্ড পর ফোনটা কান থেকে সরালো সে। চাহনি জুড়ে বিস্ময়ের ছাপ।
-“আপনি আমার ঋণ শোধ করেছেন!”
-“অর্ধেক করেছি। নইলে এতোক্ষণে আপনি হয়তো খু*ন হয়ে যেতেন। পালিয়ে যাওয়ার সময়ও হতো না!”
সোফার সাইডে পড়ে থাকা ব্যাগে চোখ রেখে নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে উঠলো সীমান্ত।
-“কী চান আপনি?”
-“এ ফ্ল্যাটের আরেক ভাড়াটিয়া কে?”
সাহিলের প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন জুড়ে দিলো সীমান্ত।
-“এখানে আমি একা থাকি। আরেক যে ভাড়াটিয়া সে এখানে থাকে না। শুধু নিজের জিনিসপত্র এখানে রেখে যায়! এরচেয়ে বেশি কিছু আমি জানি না।”
সীমান্ত সোফায় গা এলিয়ে আরামে বসে পড়লো। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা হাজারো প্রশ্নে জর্জরিত ব্যাক্তিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করেই নিজের ফোন বের করলো। ষোল বছর আগে হওয়া এক্সিডেন্টের নিউজে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। পাহাড়ের খাদে এক মাইক্রো ভ্যানের এক্সিডেন্ট। সে ভ্যানের ড্রাইভিং সীটে থাকা ফাহাদ খান নামক ব্যাক্তির কোন হদিস না পাওয়ায় তাকে মৃত হিসেবে ধরে নেয়া হয়। জীবিত মানুষকে খুঁজে বের করা যতটা সহজ, মৃতদের তালিকাভুক্ত জীবিত মানুষকে গুহা থেকে বের করা ঠিক ততটাই কঠিন।
এই মুহুর্তে আইজার অবস্থান খুব ভালো করেই জানে সীমান্ত। সে এ বিল্ডিং-এই আছে। এখন শুধু দৃষ্টির অগোচরে নজর দেয়া বাকী!
***
-“এক ঘন্টাও তো হয়নি। তোমার পাপার কুকর্ম তোমাকে দেখানো হলো। তোমার মা’কে কি করে গাড়ির নিচে পি*ষে ফেলা হয়েছিলো তা-ও দেখলে। এখনই এতো উন্নতি!”
লোকটার কথায় আইজার চাহনিতে কোন অনুভূতি ফুটে উঠলো না। বরং নিজের হাত টেবিলের ওপর রেখে আঙুল দিয়ে খটখট শব্দ করতে লাগলো ও। নিষ্প্রভ কন্ঠে বলে উঠলো,
-“আপনি কী ভেবেছিলেন, আমি মাটিতে গড়াগড়ি করে কাঁদবো!”
-“এই মেয়ে, ভয় করছে না তোমার?”
-“আমি ভয় পেলেই কী আমাকে এখান থেকে জীবিত ছেড়ে দেয়া হবে!”
-“তোমার বুলশি*ট কথাবার্তায় অনেক সময় নষ্ট করেছি। আর নষ্ট করতে চাই না। তোমার উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, আমি এ ফাঁদে পা দিচ্ছি না আইজা আজাদ!”
নিজের কৌতুহলী মুখভঙ্গি লুকোলো না আইজা। লোকটার বিরক্ত মুখের ওপরই প্রশ্ন করে বসলো,
-“আসলেই বুলশি*ট! এতোক্ষণ কথা হলো অথচ আপনার নাম-ই জানা হলো না!”
এতোক্ষণ বিরক্ত হয়ে থাকা ব্যক্তির মুখে এবার পুনরায় বাকা হাসি ফুটে উঠলো,
-“আমি তোমার পাপার বন্ধু। আর তুমি আমার নামটাই জানো না! তুমি তো এর আগেও এখানে এসেছো।”
-“হয়তো আপনি এতোটাও গুরুত্বপূর্ণ কেউ নন যাকে আমার চেনা প্রয়োজন!”
লোকটার শক্ত করে মুঠ করে রাখা হাত চোখে পড়লো আইজার। মনে হচ্ছে অনেক কষ্টেই নিজের ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে সে,
-“ফাহাদ। ফাহাদ খান।”
-“তো ফাহাদ আঙ্কেল, আমার অফারটা নিয়ে কী ভাবলেন?”
আইজার প্রশ্নে ভ্রুযুগল উঁচু করে ফেললো ফাহাদ। ধীর কন্ঠে বলে উঠলো,
-“তোমার এই এটিটিউড আমাকে যতটা রাগায় ততটাই ইমপ্রেস করে! কিন্তু শুধুমাত্র এই কারণে তো আমি তোমার সাথে কোন ডিল করবো না!”
ফাহাদের ব্যঙ্গার্ত্বক চাহনি দৃষ্টিগোচর হয়নি আইজার। টেবিলে টোকা দিতে থাকা আঙুলদ্বয় তৎক্ষনাৎ থেমে গেলো।
-“কারণ?”
আইজার কন্ঠে কৌতুহল আর অস্থিরতার কিঞ্চিত ছাপ বিদ্যমান। ফাহাদের চোখে স্পষ্ট তাচ্ছিল্যের ছাপ। যেন আইজা তার সামনে কোন ছোট কীট। যাকে পিষে গুড়িয়ে দেয়ার মতো ক্ষমতা ফাহাদের আছে। এই মুহুর্তে লোকটার মুখে লেগে থাকা বাঁকা হাসি আইজার ধৈর্যের বাঁধ ক্রমাগত ভেঙে চুরমার করছে।
-“কখনো নিজেকে আয়নার দেখেছো..!”
-“প্রতিদিনই দেখা হয়!”
ঝটপট বলে উঠলো আইজা। এভাবে বলাটা হয়তো পছন্দ হয়নি ফাহাদের। মুহূর্তেই রক্তচক্ষু নিয়ে নিজের হাতের মুষ্টি দ্বারা টেবিলে সজোরে আঘাত করলো সে। ঘটনার আকস্মিকতায় খানিকটা পিছিয়ে গেলো আইজা।
ফাহাদের ক্রোধ ভরা মুখে সাথে সাথেই ফুটে উঠলো সন্তুষ্টি। আইজার মাথা থেকে পা অব্দি ঠান্ডা নজরে চোখ বুলিয়ে নিলো সে। ধীর কন্ঠে বলে উঠলো,
-“এখন যদি আমি তোমার ওপর ঝাপিয়ে পড়ি নিজেকে রক্ষা করতে পারবে তো! এখানে উপস্থিত কারো সাথেই পেরে উঠবে না তুমি! তোমার দেহে সে জোর নেই! এতো দূর্বল প্রাণির সাথে আমি কেন ডিল করতে যাবো!”
থমথমে মুখে তাকালো আইজা। একবার শুকনো ঢোকও গিলে নিলো। তবে ওর এ মুখভঙ্গি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ফাহাদের চোখের সামনেই উচ্চস্বরে হেসে উঠলো আইজা। সে হাসি যেন থামতেই চাচ্ছে না।
আগের বার যতটা পিছিয়ে বসেছিলো ততটাই সামনে এগিয়ে গেলো আইজা। ঠোঁটে মৃদু হাসির ঝলক বজায় রেখেই বলে উঠলো,
-“যদি শরীরের জোরেই সবকিছু চলতো তাহলে এতো বছর নিজের এ ক্রাইম ক্লাব টিকিয়ে রাখা কখনোই হতো না আপনার। কারণ এ দুনিয়ায় আপনাদের থেকেও বেশি শারিরীকভাবে শক্তিশালী ক্রিমিনাল অথবা রাইভালের অভাব নেই! এরকম ক্রাইম অর্গানাইজেশন চালাতে যে শারিরীক বল ছাড়াও আরো অনেক কিছুর প্রয়োজন হয় সেটা অন্তত আপনার জানার কথা!”
কপাল কুঁচকে তাকালো ফাহাদ। চোখে কৌতুহলের রেশ! কিছুটা গমগমে গলায় বলে উঠলো,
-“কিছু করছি না দেখে যা ইচ্ছে বলে যাচ্ছো! এখন হয়তো তুমি আমার সামনে সুরক্ষিত বসে আছো। এই আমিই একসময় তোমাকে নিজের হাতে টুকরো টুকরো করে শিকদার বাড়িতে পার্সেল করবো!”
-“দ্যাট’স ইওর লস! আমাকে মারলে সীমান্তকে সহজে হারানোর একটা বড় সুযোগ মিস করবেন আপনি।”
আইজার কথায় সশব্দে হেঁসে উঠলো ফাহাদ। ওর আঁখি জোড়ায় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বললো,
-“নারী! কী সুন্দর এক প্রাণি! ওদিকে সীমান্ত তোমাকে খুঁজতে মানুষের বাড়ি বাড়ি ছুটছে। আর তুমি! এখন তো আমার সীমান্তর জন্যই বেশি কষ্ট হচ্ছে!”
-“আপনি এখনো নিজের ভুল ধারণা নিয়ে পড়ে আছেন! সীমান্ত আমাকে না আপনাকে খুঁজতে ব্যস্ত।”
গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকালো ফাহাদ। শক্ত কন্ঠে বললো,
-“কোন স্বার্থ ছাড়া নিশ্চয়ই তুমি এসব করছো না।
ফাহাদের কঠোর দৃষ্টির ভাজে লুকিয়ে থাকা সন্দেহের উপস্থিতি বুঝতে বেশি সময় লাগলো না আইজার।
-“অফ কোর্স নট! আমার প্রথম কারণ আমি আপনার হাতে টুকরো টুকরো হতে চাই না। আর দ্বিতীয় কারণ..!” কিছু মুহূর্তের জন্য শান্ত ভঙ্গিতে তাকালো আইজা। ঠান্ডা গলায় আরো বললো,
-“নাজিম আর জাফর শিকদারকে বরবাদ করতে চাই। আমার মা তো কোন দোষ করেনি। সে তো কারো ক্ষতিও করেনি। তবুও তাকে খু*ন হতে হলো! আমি তিল তিল করে শেষ করতে চাই ঐ দু’জনকে! এন্ড আই নিড ইওর হেল্প ফর দ্যাট!”
চলবে…