অপ্রিয় প্রেয়সী পর্ব-৪৮

0
2226

#অপ্রিয়_প্রেয়সী
#লিখা_তানজিলা
#পর্ব – ৪৮

দরজার ওপাশে কেউই ছিলো না। বিষয়টা নতুন না আইজার কাছে। প্রায়ই কিছু বাচ্চার দল কলিং বেল বাজিয়ে চলে যায়। তবে নাজিম শিকদারের চেহারা দেখার মতো ছিলো। সীমান্তকে মেসেজ দেয়ার বিষয়টাও মিথ্যে ছিলো!

ভাঙা মগের টুকরো গুলো ইতোমধ্যে সরিয়ে ফেলেছে আইজা। সত্যি বলতে নাজিম শিকদারের সাথে কোন ঝামেলায় যাওয়ার ইচ্ছেই নেই ওর। আর আরফান যদি আজকের ব্যপারে জানতে পারে নিশ্চিত কোন ঝামেলা পাকিয়ে ফেলবে! আরফানকে এসব থেকে দূরেই রাখতে চায় আইজা। যদিও শেষমেশ নিজ মুখটাও সামলানো হয় না ওর! চাইলেও সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে পারছে না আইজা!

আরফানের ফিরতে ফিরতে রাত এগারোটা বেজে গেলো। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে এসেছে হয়তো। অতঃপর আইজাকে দেখতেই প্রশ্ন করে বসলো,

-“আপু তোর গাল কি করে কেটেছে?”

এর জবাব আগেই রেডি করে রেখেছে আইজা।
-“ঐ দরজার বাইরে হোঁচট খেয়েছিলাম।”
সামনের ঘরটার দিকে ইশারা করলো ও। দরজার একপাশে ধারালো পিন গাঁথা!

-“একটু দেখে চলতে পারিস না!”

আরফানের কথার বিপরীতে আর কিছু বললো না আইজা। গলায় মাফলার পেঁচিয়ে রেখেছে। কারণ সে দাগের কোন জবাব ঠিক করে রাখেনি ও! সিমি চোখ ডলতে ডলতে বেরিয়ে এলো। মেয়েটা বড্ড ঘুম কাতুরে। এক বার ঘুমোলে এর পাশে ফুল ভলিউমে কোন সাউন্ড বক্স বাজালেও ঘুম ভাঙে না!

***

রাত পেড়িয়ে সকাল হয়ে এলো। টেবিল পরিষ্কার করছিলো আইজা। এমন সময় কলিং বেল বাজতেই আইজা বলে উঠলো,
-“আরফান! দেখ্ তো কে!”

হঠাৎ গোলাপ ফুলের তীব্র সুবাস নিঃশ্বাসে প্রবেশ করতেই হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে নিলো আইজা! হাঁচির ওপর হাঁচি দিতে শুরু করলো ও। সামনে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সীমান্ত। চাহনি দেখে মনে হচ্ছে এখানে কী হচ্ছে বুঝতেই পারছে না সে। গোলাপ ফুলে মৃদু এলার্জি আছে আইজার। ফলস্বরূপ ওর নাক ইতোমধ্যে লাল বর্ণ ধারণ করেছে!

-“আপনি আপুর নাকে গোলাপ ধরতে গেলেন কেন! আপুর এতে এলার্জি!!!”
জোড় গলায় বলে উঠলো আরফান।

আইজার নাকের ন্যায় সীমান্তর চোখ গুলোও লাল হয়ে আছে। সে আরফানের দিকে রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে বলে উঠলো,
-“কাল মিথ্যে কেন বললেন আপনি! আপনি বলেছেন গোলাপ আইজার খুব প্রিয়!”

-“আমি কী জানতাম আপনি একদম মুখের সামনে ফুল ধরবেন! নিজের স্ত্রীর সম্পর্কে দেখি কিছুই জানেন না আপনি! আবার বড় বড় কথা!”

আরফানের কথায় যেন সীমান্ত আরো চটে গেলো।
-“আপনাকে তো পরে দেখছি। আইজা চলুন! আপনাকে হসপিটালে নিতে হবে।”

-“এর জন্য হসপিটালে যাওয়ার প্রয়োজন নেই!”

আইজা সীমান্তকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সামনের ঘরটায় গিয়ে দরজা আটকে দিলো। হাঁচি ইতোমধ্যে থেমে গেছে তার। সীমান্ত মনোক্ষুণ্ণ চাহনিতে তাকিয়ে আছে। করতে কী চেয়েছিলো আর হয়ে কী গেলো!

দাঁতে দাঁত চেপে আরফানের দিকে তাকালো ও! আরফান কাচুমাচু হয়ে চেয়ারে বসে আছে। পরক্ষনেই সীমান্তর ক্রোধ চাহনি টের পেয়ে বলে উঠলো,
-“এতো দরদ থাকলে আপুর জন্য এক কাপ চা করে দিন! আপু খুশি হয়ে যাবে।”

আরফানের কন্ঠ কানে প্রবেশ করতেই সীমান্তর মনে হচ্ছে ওর মাথায় যেন রক্ত চড়ে গেছে। হাত দুটো শক্ত করে মুঠ করে রেখেছে ও!
-“আপনি যদি আইজার ভাই না হতেন তাহলে….!”

-“এক মিনিট! আপনি কী আপুকে ভয় পান!!”

সীমান্তর ক্রোধমিশ্রিত আঁখি জোড়া মুহূর্তেই চুপসে গেলো। আরফানের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলো ও। ভয়! তাও আবার আইজাকে! ব্যপারটা বেশ হাস্যকর! সীমান্ত শুনেছিলো স্বামী স্ত্রীর মাঝে তৃতীয় পক্ষকে নাক গলাতে দেয়া মানে সংসারে অশান্তি। এখানে তো সেই ভূমিকা সীমান্তর একমাত্র শা*লা বেশ চমৎকারভাবে পালন করছে!!”

মিনিট কয়েক পর আইজা দরজা খুলে বেরোতেই দেখে সীমান্ত টেবিলে দুই কাপ চা রাখছে। গরম ধোঁয়া দেখেই বুঝা যাচ্ছে মাত্র বানিয়ে আনা হয়েছে। আইজাকে চোখে পড়তেই ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে নিলো সে।

আইজার ফোলা ফোলা চোখ জোড়া মুহূর্তেই শক্ত হয়ে এলো। প্রচন্ড অদ্ভুত লাগছে ওর। কারণ সীমান্তর হাসি। সচরাচর তার মুখে তিন ধরনের হাসি দেখেছে আইজা। প্রথম হলো বাঁকা হাসি! দ্বিতীয়টা ব্যাঙ্গাত্মক হাসি এবং তৃতীয় অর্থাৎ সর্বশেষ হচ্ছে নিজ স্বার্থ হাসিল করার পর তৃপ্তির হাসি! কিন্তু এই মুহুর্তে সীমান্তর মুখে উক্ত তিন ধরনের হাসির বদলে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির হাসি জ্বলজ্বল করছে!

এমন উষ্ণ ভঙ্গিতে এর আগে সীমান্তকে কখনো হাসতে দেখেছে কি-না জানা নেই আইজার। সাথে সাথেই শুকনো ঢোক গিললো ও। আইজার মনে হচ্ছে ওর বুকে কেউ ক্রমাগত ধারালো তীর ছুড়ে যাচ্ছে! এর আগে এ হাসি কেন দেখেনি ও! হুট করেই এ প্রশ্ন এসে ভর করলো মস্তিষ্কে।

-“চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে! আমাকে পরে দেখলেও চলবে।”

সীমান্তর শীতল কন্ঠে টনক নড়লো আইজার। ভয়ংকর কোন এক ঘোর থেকে যেন বেড়িয়ে এলো ও। তার বলা শেষ বাক্যটা বোধগম্য হতেই এবার নাকের সাথে সাথে গালটাও রক্তিম আভায় ছেয়ে গেছে! যদিও আইজার মুখে মাস্ক থাকার কারণে সেটা সীমান্তর চক্ষুগোচরে রয়ে গেলো।

-“মেডিসিন নিয়েছেন আপনি?”
আইজার মুখে থাকা মাস্কটাকে লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করলো সীমান্ত। ও জানে, আইজার ঠান্ডা জনিত কোন সমস্যা হলেই সারাদিন মাস্ক পড়ে থাকে।

আইজা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো। আজ কোন এক অদ্ভুদ কারণে লোকটার সামনাসামনি দাঁড়িয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। আরফান আর সিমি হয়তো ইতোমধ্যে বেড়িয়ে গেছে।

সীমান্তর দিক থেকে চোখ সরিয়ে দ্রুত টেবিলে রাখা চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে নিলো আইজা। হঠাৎ সীমান্তর ফোনে কল আসায় উল্টো ঘুরে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ালো সে। সাথে সাথেই লম্বা একটা শ্বাস ছাড়লো আইজা। এতক্ষণ যেন নিশ্বাস আঁটকে আসছিলো! ইচ্ছে ছিলো কয়েকটা কথা শুনিয়ে দেবে তাকে। কিন্তু সীমান্তর হাস্যোজ্জ্বল চাহনি দেখে সেটা আর হলো না ওর দ্বারা!

বাহ্! লোকটা তো বেশ ভালো চা করে! সীমান্তর এ গুনটা আগে জানা ছিলো না আইজার। আনমনা আঁখি জোড়া সীমান্তর দিকে পড়তেই কিঞ্চিত আঁতকে উঠলো ও! ফোনটা শক্ত হাতে ধরে রেখেছে সে! মনে হচ্ছে একটু পরেই পিষে যাবে সেই ইলেকট্রনিক ডিভাইস! লোকটার চোখ থেকে যেন রক্ত ঝড়ছে! একটু আগেই তো হাসছিলো!

ঝড়ের বেগে আইজার দিকে তেড়ে আসলো সে! রাগান্বিত চাহনি তার মুখে। তবে সে চাহনি আইজার গাল আর গলার দিকে। নিশ্বাস ভারি হয়ে আসছিলো বলে মনের অজান্তেই গলার মাফলার কিছুটা নামিয়ে ফেলেছিলো আইজা। সেটাই এখন সীমান্তর চোখে পড়লো!

আইজার গালের একসাইডে জ্বলজ্বল করতে থাকা দাগে হাত রাখলো সীমান্ত। ঘরে ঢোকার পর থেকে তো মেয়েটার মুখ অতটা ভালো ভাবে দেখার সুযোগই পায়নি ও!

-“কে করেছে এসব!”

ধীর কন্ঠে প্রশ্ন করলো সীমান্ত। আইজা নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে। তার এ নিস্তব্ধতা সহ্য হলো না ওর।

-“কে করেছে এসব!!!”
এবার অনেকটা চিৎকার করে উঠলো সীমান্ত। আইজার দুই বাহু চেপে ধরলো সে।

-“জেনে কী করবেন আপনি!”

-“ভণিতা করবেন না। আমার প্রশ্নের জবাব দিন!”
দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো সীমান্ত। আইজার গলায় বসে যাওয়া ক্ষতটা বেশিই গুরুতর মনে হচ্ছে ওর কাছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আইজার বাহু ছেড়ে দিলো ও। টেবিল থেকে কিছুটা ওপরে দেয়ালে এটাচ করা কেবিনেটে চোখ গেলো সীমান্তর। সেখানে রাখা ফাস্ট এইড বক্স বের করে আইজার পাশেই চেয়ার টেনে বসে পড়লো ও।

সীমান্তর নিজের ওপরই রাগ হচ্ছে। ওর আগেই বোঝা উচিত ছিলো। আইজা অন্যদিনের তুলনায় আজ একটু বেশিই শান্ত হয়ে আছে। নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে! আইজার গলার ক্ষতটা পরিষ্কার করে তাতে মলম লাগিয়ে দিলো সীমান্ত। শান্ত গলায় বলে উঠলো,

-“এভাবে চুপ করে থাকবেন না! কার এতো সাহস হলো আপনার গায়ে হাত…!”

-“আপনার বাবা!”
অকপটে বলে ফেললো আইজা। সীমান্ত ঠান্ডা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটা ওর কথা বিশ্বাস করলো কী করলো না সেটা তার চেহারায় তেমন বুঝা যাচ্ছে না।

***

নাজিম শিকদার নিজের রুমে বসে চা খাচ্ছিলো। দরজার সামনে সীমান্তকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাসি মুখে বলে উঠলো,
-“বাইরে কী করছিস!”
হাতের ইশারায় সীমান্তকে বসতে বললো নাজিম।

-“কাল আপনার আইজার সাথে দেখা হয়েছিলো?”

সীমান্তর প্রশ্নে নাজিমের চাহনি মুহূর্তেই শক্ত হয়ে উঠলো। কটমট করে বললো,
-“ঐ মেয়ে অলরেডি তোর কাছে নালিশও করে দিয়েছে! আমি তো ওকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তোর বৌ একটা আস্ত বেয়াদব!”

-“আপনি আমাকে বলতেন!”

সশব্দে হেসে উঠলো নাজিম। যেন সীমান্ত কোন কৌতুক বললো তার সামনে।
-“তোকে বলে কোন লাভ নেই! এখনও তো বউ-এর কথায় নিজের বাবার কাছে কৈফিয়ত চাচ্ছিস!”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সীমান্ত। দৃঢ় গলায় বলে উঠলো,
-“বাবা, আপনি আমার জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ। ভিষণ সম্মান করি আমি আপনাকে। কিন্তু তাই বলে আপনি আইজার গায়ে হাত তুলতে পারেন না!”

নাজিম কিছু বলার আগেই সীমান্ত হনহন করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। রক্তচক্ষু নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে নাজিম। ছেলেটা দিন দিন বদলে যাচ্ছে ওর চোখের সামনে!

***

আজ অফিস থেকে বের হতে হতে রাত আটটা বেজে গেছে। ইদানিং কাজের চাপও বেশি! আজ সীমান্তকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। হয়তো আসবে না সে। ধ্যাত! এতো দিকে চোখ কেন যাচ্ছে! বিরক্ত হয়ে হাঁটতে শুরু করলো ও। বাড়ি থেকে জায়গাটা তেমন দূরে না। সর্বোচ্চ পাঁচ কী দশ মিনিটের পথ হবে!

রাত হলে ঠান্ডার প্রকোপটাও বেড়ে চলে। চাদরটা নিজের গায়ে ভালো করে জড়িয়ে নিলো আইজা। এই রাস্তাটা বেশ জনবহুল। চারিদিকে মানুষের ভীর। রাস্তার ওপারে শপিংমল থাকার কারণে এ ভীরটা যেন আরো বেশি!

না চাইতেও বারবার সীমান্তর হাসিমুখ চোখের সামনে ভেসে উঠছে। মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে পাগলই হয়ে যাবে ও! সীমান্তর মতিগতি বরাবরই অনিশ্চিত প্রকৃতির। আজও সীমান্ত আইজার কথার বিপরীতে কিছু না বলে থমথমে মুখ নিয়ে বেরিয়ে গেছে! কী চলছে তার মস্তিষ্কে জানা নেই ওর!

হঠাৎ নিজের পাশে একটা মাইক্রো ভ্যানের অস্তিত্ব টের পেলো আইজা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হেঁচকা টানে সেই মাইক্রো ভ্যানে উঠিয়ে নেয়া হলো ওকে! সাথে সাথে চোখ মুখ আর হাত-পা বেঁধে দেয়া হলো। এক বিন্দুও নড়তে পারছে না আইজা। নিজের ছাড়ানোর প্রচেষ্টায় বেশি একটা দেখা সম্ভব হয়নি। তবে এটুকু বুঝতে পেরেছে যে ভ্যানটাতে অন্তত ছয় সাত জনের মতো হবে! এরা ফাহাদের লোক নয়তো! আজই কী মে*রে ফেলা ওকে! কিছু মাথায় আসছে না আইজার!

হঠাৎ থেমে গেলো সেই ভ্যান। আইজার হাত-পায়ের বাঁধন খুলে নামিয়ে দেয়া হলো ওকে। হাত-পা ঝিনঝিন করছে। পা নাড়াতেও মৃদু কষ্ট হচ্ছে আইজার। দ্রুত নিজের খোলা হাত দ্বারা চোখ আর মুখের বাঁধন খুলে ফেললো ও!

আইজাকে এখানে রেখেই চলে গেছে তারা। বলতে গেলে রাস্তায় এখন ও একা দাঁড়িয়ে আছে। সামনে থাকা বাড়িটা চোখে পড়তেই শক্ত ভাবে তাকালো ও। কিড*ন্যাপার গুলো আইজাকে শিকদার বাড়ির সামনে রেখে গেছে!!!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here